এ পৃথিবীতে কেউ জীবনের আঘাত থেকে পরিত্রান পায় না। আমরা সবাই কম বেশী আঘাতের সাথে জড়িত। সেটা শারীরিক, মানসিক অথবা আধ্যাতিক যে কোনো বিষয়ে হতে পারে। অনেক সময়ে শারীরিক বেদনার চেয়ে মানসিক বেদনা ভীষণ কষ্টদায়ক হয়ে উঠে। পরিবারের প্রিয়জন যেমন সন্তান, মা-বাবা, স্বামী অথবা স্ত্রীকে হারানো। আবার কখনো বিবাহিত জীবন ভেঙে একাকী পথ চলা অথবা চাকরী হতে বরখাস্ত হওয়া, এমনকি কোনো আকাঙ্খিত সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ফলে আমরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি, যাতনায় ভুগি। তাছাড়া নানা রকম অসুখ-বিসুখ তো রয়েছেই। দুঃখ আছে, বেদনা আছে এ নিয়েই আমাদের জীবন চলছে। এটাই মানব জীবনের নিয়তি…
সেলিম দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি তার আচার ব্যবহার সবার কাছে চোখে পড়ার মতো। ছোট বেলায় সে বাবা মা’কে হারিয়েছে। বাবার কথা তো মনেই পড়েনা। মা’কে হারানোর পর তার ছোট্ট জীবনটা গৃহহারা হয়ে গেলো। তখন সেলিমের বয়স ৮ /৯ বছর হবে। কোথাও যাওয়ার বা থাকার জায়গা রইলো না। রাস্তায় রাস্তায় রাত দিন ঘুরে বেড়ায়। হাতে কোনো পয়সা নাই। খাবারের নিশ্চয়তা নেই অথচ মন চায় একটা কিছু করতে। বিশেষ করে লেখাপড়ার প্রতি তার ভীষণ আকর্ষণ। কিন্তু তার এই অনিকেত জীবনে লেখা পড়ার কথা চিন্তা করা তার পক্ষে এক দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার মতো সমতুল্য। এতটুকু বয়সে সে জীবন যুদ্ধে নামতে বাধ্য হলো। তার অদম্য সাহস, অধ্যবসায় এবং মনোবলের ফলে সে একে একে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে লাগলো। এ যেন এক অকল্পনীয় কাহিনীর মত।
সেলিম ঢাকা শহরের এক ছোট খাটো মোটর গ্যারেজের মেকানিক সাহেবের হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করলো এবং কাজের বোনাস হিসাবে উপর তলায় অন্যান্য স্টাফদের সাথে ফ্রি থাকার সুযোগ পেলো। দিনের বেলায় সে গ্যারেজে কাজ করে আর সন্ধ্যাবেলায় নিকটবর্তী এক ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস করে। সারাদিন গ্যারাজের কাজ করে সন্ধ্যায় পড়াশোনা করা, স্কুলে যাওয়া তার পক্ষে অনেক কষ্টদায়ক ছিল, তবুও সে হাল ছাড়েনি। বেতন যা পাওয়া যেত, তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যেত। কখনও মাস শেষ হওয়ার আগে টাকা পয়সা ফুরিয়ে গেলে শুধু জলপানই ছিল তার ক্ষুধা নিবারণের একমাত্র উপায়। ক্ষুধার্ত উদরে সে স্কুলে পাঠ নিতে যেত। দেখতে বেশ সুদর্শন, ফলে সুন্দর কাপড় চোপড় পড়লে তাকে ধনী ছেলের মতো মনে হতো। তাইতো মাঝে সাঝে কোনো দিন শহরের কোনো বিয়ে বাড়ীর অনুষ্ঠান দেখলে ঢুকে পড়তো, কেউ জানতে বা বুঝতে পারতোনা সে কোন দলের। একবেলা একটু পেট ভরে ভালো খাবার খাওয়া হয়ে যেত। সেই সময়ে যদিও তার পক্ষে অন্য সব মানুষের মত সাধারণ জীবন যাত্রা চালানো কঠিন ছিল, তবুও সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল, “আমাকে যেমন করে হোক লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে।”
এভাবে কষ্ট করে সে এইচএসসি পাস করলো। গ্যারেজে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা নামিদামী রেস্টুরেন্টে ম্যানেজার হিসেবে চাকরী পেলো। আর তার সাথে যথারীতি সন্ধ্যাকালীন ব্যাচেলর ডিগ্রীর ক্লাসের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলো। সময় মতো পরিস্কার দিয়ে পাশ করে সে গ্র্যাজুয়েট হলো। রেস্টুরেন্টের মালিক আহমেদ সাহেব সেলিমের কাজকর্মে ভীষণ খুশি এবং তাকে ডিপ্লোমা-ইন-হোটেল এন্ড কেটারিং কোর্স করার জন্য উৎসাহ দিলেন। সেলিম ভাবলো এরকম একটা প্রফেশনাল কোর্স অর্জন করতে পারলে সে তার এই জীবনটাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারবে।
আহমেদ সাহেবের রেস্টুরেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কাছেই। একদিন দুপুরে লাঞ্চের সময় এক সুন্দরী যুবতী রেস্টুরেন্টের ভিতরে এসে সেলিমকে রিসিপশনে বসে থাকতে দেখে বললো, “আমি এই বিশ্ববিদালয়ের ছাত্রী এবং এই মুহূর্তে আমার কাছে একটি পয়সাও নেই। আমার হ্যান্ডব্যাগটি এক ছিনতাইকারী নিয়ে ভৌ দৌড়”- এই বলে যুবতীটি কাঁদতে শুরু করলো। মেয়েটি সত্যি বলছে কি মিথ্যা বলছে সেটা যাচাই না করে সেলিম তাকে অতি যত্ন সহকারে একটা খালি সিটে বসিয়ে এক কাপ চা দিল। তারপর তাকে আশ্বস্ত করে বললো, “আপনি মোটেই ঘাবড়াবেন না। এরকম ঘটনা আজকাল হরহামেশাই হয়ে থাকে, সুতরাং এ ঘটনা মন থেকে মুছে ফেলুন।” এই বলে সেলিম তার এক ওয়েটারকে ডেকে বললো, “মেম সাহেবকে ডিমের দুটো স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে দাও।”
খাবার শেষ করার পর মেয়েটি সেলিমের দয়ার সুযোগ নিয়ে তার সাথে অসংলগ্ন আচরণ শুরু করে দিল এবং স্বার্থপরের মত বিরক্ত করার চেষ্টা করলো। সেলিম মেয়েটির এরূপ ব্যবহারে হতবাক। সে ভাবলো তাকে এভাবে হয়রানির করার পিছনে নিশ্চয় একটা ইচ্ছাশক্তি কাজ করছে। কিন্তু এই ইচ্ছাশক্তির বাঁধ ভেঙ্গে যদি অতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার শুরু হয়ে যায় তাহলে তো ভয়ের কারণ হওয়া স্বাভাবিক। গরীব ঘরের ছেলে, জীবনের দুঃখ কষ্ট অনেক কাছে থেকে দেখেছে, তাই তো এ সমস্ত মেয়ে ঘটিত কোনো ঝামেলায় সে জড়াতে চায় না। তাহলে এই “ট্রমা” থেকে সে কিভাবে বেরুবে? ভাবছে পুলিশ ডাকবে কিনা !
পুলিশ ডাকার আগেই মেয়েটি নিজেই বিষণ্ণ মনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেলো। সেলিম ভাবলো, যাক বাবা, বাঁচা গেলো। মেয়েটির এরূপ ব্যবহারে সে একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম ব্যবহার সচারচর ছেলেরা মেয়েদের পিছনে লাগার চেষ্টা করে। মেয়েরা যে ছেলেদের পিছনে এ রকম নির্লজ্জ ভাবে বিরক্ত করবে সেটা সেলিমের ধারণার বাইরে ছিল। এরপর ঘটনাটি সেলিম বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু এর সপ্তাহখানিক পর মেয়েটি সেলিমের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবরাখবর নিয়ে সমানে তাকে তার মনের ভাব ব্যক্ত করে ই-মেইল, টুইট, ভয়েসমেইল এবং চিঠিপত্র লিখে বিরক্ত করা শুরু করলো। আবার কখনও কখনও মেয়েটি রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষা করে সেলিমের সাথে একান্ত আলাপ করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সেলিম বুঝতে পারলো, সে এক মহা বিপদে পড়েছে। তাই একদিন মেয়েটিকে রেস্টুরেন্টের ভিতরে ডেকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি আমার পিছনে যে ভাবে লেগেছেন তাতে আমার চাকরী নিয়ে টানাটানি হতে পারে। তাছাড়া আপনার মতো একজন সুন্দরী, বিদুষী মহিলাকে এ রকম আচরণ করা সাজে না।”
মেয়েটি মৃদু হেসে বললো, “আপনাকে আমার ভালো লাগে, আপনার কাছের মানুষ হতে চাই- এতে আপনার গ্রহণ করতে দ্বিধা কোথায়?”
– ব্যাপারটা বিদঘুটে হয়ে যাচ্ছে না!
– মোটেই না।
-আমি এক দরীদ্র ঘরের সন্তান, এ জীবনে আমি একা। চাল নেই, চুলো নেই। যাযাবরের মতো আমার জীবন। আপনার সাথে এরকম খেলার সাথী আমি হতে পারি না। অনুগ্রহ করে আপনার এই খামখেয়ালি চিন্তাধারায় আমাকে জড়িত করবেন না।
– সত্যি বলছি, আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
– আমার মনে হয় আপনি psychopathic characters’ এ ভুগছেন। আপনাকে ডাক্তারের দেখানো প্রয়োজন।
– অসম্ভব, আপনার ধারণা অমূলক।
– কিন্তু আমি বদ্ধপরিকর আপনি একজন vulnerable মহিলা। আপনার এই অবাস্তব চিন্তাধারা এক প্রকার মানসিক রোগ।
– আপনি কেন আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ করছেন না! আমার ভালোবাসা আপনার প্রতি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ।
– আপনাকে আগেই বলেছি তো আমার অপারগতার কথা। আসলে আপনার মাঝে একটা উদ্ভট বা আজগবী চিত্র যা কল্পনা করার মত শক্তি রয়েছে যেটাতে আপনি আসক্ত এবং সেটা বিশ্বাস করেই আপনি আপনার জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। বিষয়টাকে আপনি যত বাস্তব মনে করছেন পারতপক্ষে সেটা সত্যি নয়। আমার মনে হয় আপনার বাবা মায়ের সাথে এ বিষয়ে আমার আলোচনা করা দরকার। কারণটা হলো শুধু আপনাকে এই মোহ থেকে বাঁচিয়ে তোলা নয়, আপনার চারপাশে যে সমস্ত আপনার হিতাকাঙ্খী রয়েছে তাদেরকেও এই অবরোধ থেকে বাঁচিয়ে তোলা।
– নিশ্চয় আমার বাবা-মায়ের সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। তার আগে, একটিবার বলুন আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আমাকে ভালোবাসেন।
– নিশ্চয়ই আমি মনে প্রাণে আপনার মঙ্গল কামনা করি। আমি আপনাকে ভালোবাসি বা না বাসি সেটা আমি কেমন করে বলবো? এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তবে বলতে পারি, যে কোনো পুরুষই আপনাকে সাথে পেতে ইচ্ছা করবে।
– শুনে ভালো লাগলো। এখন বলুন আপনি কবে আমার বাবা-মার সাথে দেখা করতে আগ্রহী?
– যখন বলবেন, তখনই আমি প্রস্তুত। ভালো কথা আপনার নাম তো জানা হলোনা!
– বলার সময় দিলেন কখন। আমার নাম মোস্তারী জাহান, প্রিয়জনেরা সুদীক্ষা বলে ডাকে। আপনিও আমাকে সুদীক্ষা বলে ডাকবেন, আমি ভীষণ খুশি হব।
সেদিনকার মত সুদীক্ষাকে বিদায় দিয়ে সেলিম ভাবছে সে কিভাবে এই অস্বাভাবিক বৃত্তের জাল থেকে পরিত্রান পাবে! মনে পড়ে গেলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট টুরুম্যানের এক অমরবাণী ”If you cannot bear the heat of the kitchen , then get out of the kitchen।” আজকের ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে সেলিম আহমেদ সাহেবের সাথে আলাপ করে উনার পরামর্শ চাইলো। কথাটি শুনে আহমেদ সাহেব রসিকতা করে বললেন, “বিয়ে করে ফেলো, তাহলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।” এই বলে তিনি একটু হাসলেন।
সেলিম বললো, “কি যে বলেন স্যার, আমার মতন একজন ছাপোষা ছেলে এ রকম মেয়েকে বিয়ে করলে পাগলা গারদে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা।”
-আমি তোমাকে ভালো করেই জানি, তোমার সাথে একটু মজা করলাম। এখন seriously বলছি, তোমাকে ঢাকা ছাড়তে হবে এবং এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। ঢাকার বাইরে আমার এক বন্ধুর হলিডে রিসোর্ট আছে, সেখানে কয়েক মাসের জন্য তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি এবং এখানে বাকি যা কিছুর সামলানোর প্রয়জন হবে সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
– স্যার, এটা অতি উত্তম প্রস্তাব। আমিও তাই ভাবছিলাম এখান থেকে কোথায়ও কিছু কালের জন্য সরে যেতে পারলে সমীচীন হবে।
-তুমি আমার একজন বিশ্বস্ত কর্মী, তোমাকে সাহায্য করার আমার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। তুমি কোনো চিন্তা করোনা, খুব শীঘ্রই আমি তোমার বদলির বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
কথাটি শুনে সেলিমের চোখের জল এসে গেলো, অস্ফুটো স্বরে বললো, “স্যার, আপনাকে কিছু বলার ভাষা আমার নাই, জানি না আপনি মানুষ না দেবতা!”#