আট কর্মঘন্টার লড়াইয়ের গল্পো

প্রতি বছরের মতো আরও একটা মে দিবস এসে উপস্থিত। কারও কারও মতে আরও একটা আপাতদৃষ্টিতে নির্ভেজাল ছুটির দিন। বাস্তবে যা ছিল শ্রমিকদের শ্রমের অধিকার ছিনিয়ে আনার দিন। আট ঘন্টার কাজের অধিকার কার্যকর করার দিন। সম্ভবত আজ সে কথা আমরা বিশেষত নবপ্রন্ম প্রায় জানেই না। কারও কারও মতে তাদের জানতে দেওয়া হয় না। হয়তো তার পেছনে লুকনো কারণ থাকতে পারে। সেই গল্পোই করব। আট ঘন্টার লড়াইয়ে গল্পো।

সময়টা ১৮৮৬ সাল। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে মিছিলে গুলিচালনার ঘটনা ঘটে। এরপরে আমেরিকায় মার্কসবাদী আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস ১৮৮৯ সালে একটি রেজোলিউশন গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নেয়, কর্মীদের দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এইদিন মে দিবস।

আট ঘন্টার লড়াই। শ্রমিকদের শ্রমের মানবিক লড়াই ছিল মে দিবসের মূলমন্ত্র। মে দিবসের আগের বা শ্রমিক দিবস ঘোষিত হবার আগের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে মে দিবসের পূর্বে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হত। অমানবিক শ্রমনির্যাতন করা হত। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা শ্রম করা প্রায় অলিখিত আইনে পরিণত হয়েছিল। সে শ্রম চলছে সপ্তাহে ৬ দিন। এই শ্রমের বিনিময়ে মজুরী মিলত নগণ্য। শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত। যা ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবী মেনে নিল না। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরন ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশবাহিনী তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্যএকজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন, এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি।

১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে “মে দিবস” বা ”আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস”। পহেলা মে সেই আন্দোলনের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিষ্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেনী কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশিয়াসহ পরবর্তীকালে আরো কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। জাতিসংঘে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসাবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (অরগানাইজেশন বা আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার সমূহ স্বীকৃতি লাভ করে এবং সকল দেশে শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায়। এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনীর প্রাধান্যের কারনে অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশে বেশ গুরুত্বও সংকল্প সহকারে মে দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে মে দিবসে সরকারি ছুটি পালিত হয়। এখানে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে মে দিবস পালিত হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হবে যে, ১৯২৩ সালের ১লা মে ভারতের তৎকালীন মাদ্রাজে, হিন্দুস্তান লেবার কিষান পার্টি প্রথম মে দিবসের আয়োজন করেছিল। ভারত-সহ ৮০টির বেশি দেশে পালিত হয় মে দিবস। মে দিবস “মহারাষ্ট্র দিবস” ও “গুজরাত দিবস” হিসেবেও পালিত হয়। ১লা মে তারিখটি মে দিবস তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে সারা দেশে ছুটি হিসাবে পালিত হয়। অনেক সংগঠন এইদিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমেও পালন করে।

মে দিবস উপলক্ষে যে তথ্যগুলো জানা দরকার তা হল-

১) ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিকাগোয় শ্রমিকদের প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

২) ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। সূচনা হয় মে দিবস পালনের।

৩) ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রস্তাব গ্রহণ হয়। প্রস্তাব ছিল, দৈনিক আটঘণ্টা কাজ এবং ১লা মে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিকদের কাজ বন্ধ। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে ১লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংগঠনগুলিকে আহ্বান জানানো হয়।

প্রতি বছর ঘটা করে শ্রমিক দিবস পালিত হয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী একটা ছুটির দিন হিসাবে। হয়তো আমার আমাদের স্মৃতির মনিকোঠায় রক্ত ঝরানো সেই সব দিনের কথা রাখতে চাই না। নিছকই একটা ছুটির দিন হিসাবে কাটাতে অভ্যস্ত হয়েগেছি।
কবির ভাষায় বলতেই হবে-
রাজা তোর কাপড় কোথা…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!