আমার দেখায় আমার বাংলাদেশ: পদ্মা সেতু

আপন মাতৃভূমি ঘুরে ঘুরে দেখার অদম্য প্রবল ইচ্ছা আমার সেই শৈশব থেকে- যা এখন নেশার পরিণত হয়েছে। কাজের ফাঁকে খানিক অবসর মিললেই সেই নেশার মোহে জাগ্রত হয়ে ঘুরে বেড়াই দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। শহর বন্দরের অলিগলি পেরিয়ে গ্রামগঞ্জের সবুজ মেঠোপথ, ধানক্ষেত, নদীর ঢেউ, সীমানা ছোঁয়া আকাশের দিগন্ত ছুঁতে ছুটে গেছি বারবার। চোখ জুড়ায় বটে কিন্তু দেখার সাধ মেটে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে আনাচে কানাচে অখ্যাত কানাগলি থেকে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরিত্যক্ত জমিদারদের বিলাসবহুল বাড়ি- সর্বত্রই আমার অবাধ যাতায়াত। আমি লেখক নই; আমি সুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করি মাত্র। আমার সেই ঘুরে দেখার ভাললাগা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয় থেকে কিছু স্থান ও তার ইতিহাস সম্পর্কে শেয়ার করা করার প্রয়াস মাত্র।

মাত্র কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম পদ্মাসেতু। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। সেতুটি নির্মাণ করতে বারবার বাধাগ্রস্থ হলেও শেষমেষ বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। ২৫জুন ২০২২ সালের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্ত দিয়ে নিজেই টোল প্রদান করেন; প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুতে আরোহণ করেন এবং এর মাধ্যমে সেতুটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই উদ্বোধনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়িত হলো। ৪১টি স্প্যান নিয়ে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। এই সেতুর উপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। এই সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ যাত্রাকে সংক্ষিপ্ত করেছে। দেশের অন্যান্য জেলাশহরের সাথের যাতায়াতের ব্যবস্থা অত্যন্ত সুগম করেছে।

কয়েকজন মিলে পরিকল্পনা করলাম পদ্মা সেতু দেখতে যাবো। সংখ্যায় বেশী থাকার কারণে একটি বাস ভাড়া (রিজার্ভ) নিলাম। পরেদিন খুব ভোরবেলায় বরিশাল থেকে বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছুটতে শুরু করলো। সকাল ন’টায় সময় এক পেট্রল পার্ম্পে এসে বাস থামল। ওখানে আমরাও নামলাম। সাথে থাকা সকালের জলখাবারের প্যাকেট সবার মাঝে বিতরণ করা হল। আমরা সবাই জলখাবার গ্রহণ শেষে চা-পান করলাম। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হঠাৎ সাথে আসা দুই-তিনজনের খোঁজাখুঁজিতে খেয়াল হল।এই পেট্রল পাম্পের ব্যবহার করার মত কোন শৌচাগার নেই। ফলে বাধ্য হয়েই পরিবেশন দূষণ করতেই হলো। প্রকৃতির ডাকের সাড়া দিতে রাস্তা ও খালের পাড়ের আড়ালে, আবডালে বসে পড়লাম, এরপর আবার বাসে চেপে বসলাম। সত্যিই আজব ব্যাপার! এমন একটা স্থান যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষের যাতায়াত, সেখানে কোন শৌচাগার নাই!

বাসে বসে গ্লাসের জানালা দিয়ে সবুজ ধানক্ষেপ ও মায়াবী নীল আকাশ মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। বাস চলে এল কাঠাল বাড়ি নদীর পাড়ে। বাসস্টেশন ছাড়িয়ে নদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে কিছুদুর যেতেই দেখা গেল নদীর পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা (টলার)। বাস থেকে নামতেই জানা গেল, এই টলারে চেপে নদীর মধ্য গিয়ে দেখতে হবে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু দেখিয়ে ঘুরিয়ে আবার পাড়ে আনানেওয়া বাবদ ওসব ট্রলার বা নৌকার মাঝিরা মাথপিছু ২০০ দুইশত টাকা নেন। যেহুতু আমরা সংখ্যায় বেশী তাই অত সহজ হিসেবে না গিয়ে একটু বক্র পথে টলার রিজার্ভ করে সবাই উঠে পড়লাম। তাতে টাকা কম লেগেছিল এবং অনেক সময় নিয়ে সেতু কাছে ঘুরে-ফিরে দেখতে পেরেছিলাম আমরা। ট্রলারে ওঠার পর সরু খাল পেরিয়ে পদ্মা নদীতে পড়ার পর পরই পদ্মার আসল প্রমত্ত পদ্মার রূপ অনুভব করতে পারছিলাম- যা এতদিন ধরে বইতে পড়েছি লোকমুখে শুনেছি। দেখতে পারছিলাম পদ্মার আসল চেহারা। যতদুর চোখ যায়, চারিদিকে শুধু থৈ থৈ পানি ও তার উপচে পড়া ঢেউ।  ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ছিলাম, যেম ঘোর লেগেছে, টেরই পাইনি মোহগ্রস্থ হয়ে কতক্ষণ যে তাকিয়ে ছিলাম সেতুর দিকে…

ট্রলারে দুজন মাঝি যাদেরকে আমরা পাইলট আর কো-পাইলট বলে ডাকি। তাদের ডাকেই সম্বিৎ ফিরে পাই, সবাই ঘুরে তাকালাম মাঝির দিকে, তাকাতেই আবছা আলো অন্ধকারের ভেতর দেখতে পেলাম পদ্মা সেতুর অয়বয়।ইঞ্জিন চালিত ট্রলার আমাদের দ্রুতই নিয়ে যাচ্ছিল সেতুর কাছাকাছি, তখন আমি আমার ভেতরে কেমন জানি এক অদ্ভুত রকমের শিহরণ অনুভব করছিলাম। মনে হয়েছে যেন পদ্মার ঢেউয়ের টানে এক নেশার জগতে প্রবেশ করেছি, তন্দ্রায় আচ্ছন্ন আমি পদ্মার ঢেউয়ে ট্রলারের সাথে দুলছি। দাঁড়িয়ে আর থাকতে পারছিলাম না। বসে পড়লাম। পদ্মার প্রকাণ্ড আকারের ঢেউ টলারের উপর দিয়ে ছাপিয়ে আমাদেরকেও ভিজিয়ে দিয়ে আবার নদীতেই  আছড়ে পড়ল। তবে সেই দিকে আমাদের বিশেষ ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কেননা ইতোমধ্যে আমরা আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর খুব কাছাআছি চলে এসেছি। এবার একদম সেতুর একেবারে নীচে এসে থামল আমাদের বহন করা ট্রলার। সে এক এলাহী ব্যাপার। সমস্ত নদী জুড়ে চলছে অত্যাধুনিক সব মেশিনের কর্মযজ্ঞ। চোখের কাছে দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে দুচোখ জুড়িয়ে গেল। স্বার্থক হল আমার আজকের ভ্রমণ। ভাবতেই ভেতরে পুলক অনুভুত হচ্ছে।

আমাদের স্বপ্নের সেতু নির্মাণ কাজ বাধাগ্রস্থ করতে একটি বিশেষ মহল অসৎ উদ্দেশ্যে সামাজিক ম্যধ্যমে জন্ম দিয়েছে বিতর্কের, ছড়িয়েছে জঘন্যতম ভয়ঙ্কর গুজব। ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে মানুষের মাথা লাগবে’- যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কিন্তু ভয়ঙ্কর গুজবের ফলে মানুষ হয়ে পড়েছিল আতঙ্কিত। অবশেষে সকল প্রকার বিতর্ক ও গুজবের অবসান করে পদ্মা সেতু নির্মাণ হল।  যা স্বচক্ষে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই সেতুর উপর দিয়ে চলবে সাধারন যানবাহন এবং নীচ দিয়ে চলবে রেলগাড়ী। বরিশালে রেললাইন নেই, তাই রেলগাড়িও নেই। হয়তো অদুর ভবিষ্যতে বরিশালে রেললাইন স্থাপিত হবে। এ জেলার মানুষ রেলগাড়িতে চড়া ও ভ্রমণের সুযোগ পারে। এই সেতু স্থাপনের ফলে দেশের মানুষ উপকৃত হয়েছে, এটাই শান্তি…

মনে ভরে দেখে পদ্মা সেতু দেখার শেষে আবার ফিরে চললাম নদীর পাড়ে। ট্রলার থেকে নেমে পাড়ে উঠে দেখলাম সকাল মাত্র সাড়ে এগারটা বাজে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার তো কোন মানে হয় না। কোথায় যাওয়া যায়? ভাবছি, ফরিদপুর গেলে কেমন হয়! সঙ্গে থাকা সঙ্গীদের সমর্থন পাবো তো? যাইহোক, শেষ পর্যন্ত নদীর পাড়ে চায়ের দোকানে বসে চা-নাস্তা-ধুমপান করতে করতে সবার কাছে প্রস্তাব দিলাম ফেরার পথে ফরিদপুর হয়ে বাড়ি ফিরলে কেমন হয়! একবাক্যে সবাই রাজী হয়ে গেল। আর আমিও মনে মনে যারপরনাই আটখানা…

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!