বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সেরনিয়াবাতকে আমরা কেউ বা স্মরণে রেখেছি, কেউ বা ভুলে গেছি। তার ডাকনাম ছিলো ঝিলু। তিনি পেশায় ছিলেন আইনজীবী, শিক্ষক ও সাংবাদিক।
১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী মিয়া বাড়িতে (নানাবাড়িতে) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত, মায়ের নাম সেতারা বেগম। তার পৈত্রিক গ্রামের বাড়ি আগৈলঝাড়ার সেরাল। সেরাল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর বড় ভাই; আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত বরিশাল কালেক্টরেটে চাকুরি করতেন। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে কালিবাড়ী রোডে জমি ক্রয় করেন এবং ভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে মালিক হন। এরপর শহীদ সেরনিয়াবাত বরিশালের নব আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬২ সালে ব্রজমোহন স্কুল থেকে এস.এস.সি, ১৯৬৪ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচ.এস.সি ও ১৯৬৭ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। ১৯৭৪ সালে বরিশালের আইন মহাবিদ্যালয় থেকে আইন পাস করেন।
তিনি ছিলেন কালীবাড়ি রোডের সকল যুবক তথা তরুণদের মধ্যমণি। তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল বরিশালের ভাসানী ন্যাপ গ্রুপের সঙ্গে। ১৯৬৭-৬৯ এই দুই বছর তিনি চর আইচা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করতেন। প্রথমে ‘দৈনিক পাকিস্তান’, পরে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার বরিশাল প্রতিনিধি ছিলেন ও স্টাফ রিপোর্টার হন। তিনি বরিশাল থেকে ‘সৈকতবার্তা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বরিশাল প্রেসক্লাব গঠনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি বরিশাল বারের একজন নবীন এডভোকেট হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট কালো রাতে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে ঢাকাস্থ ধানমন্ডির বাসায় যখন হত্যা করা হয় ঠিক সে সময় মিন্টো রোডে পানিসম্পদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ এবং ভুমিমন্ত্রী মন্ত্রী মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনে ঘাতকদের আরেকটি দল হামলা করে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন শহীদ সেরনিয়াবাতের চাচা। এর কয়েকদিন পূর্বে শহীদ সেরনিয়াবাত বরিশাল থেকে এক ঝাঁক উদীয়মান তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদের তার চাচার বাসায় এক অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন। কে জানতো ঐ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হবে? ঐ রাতে আব্দুর রব সেরনিয়াবত, শহীদ সেরনিয়াবাত সহ তার পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য গুলিতে নিহত হন। এছাড়া সঙ্গীত শিল্পী রিন্টুও নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। শহীদ সেরনিয়াবাত মাত্র ৩৫ বছর বয়সে নিহত হন। এক তরতাজা যুবকের ‘শহীদ’ নাম তার আত্মত্যাগের সঙ্গে এভাবে সত্য হয়ে গিয়েছিল।
তার এই স্বল্পকালীন জীবনে তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ সংগঠক। বরিশাল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘প্রান্তিক সঙ্গীত বিদ্যালয়’ এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। বরিশালের কালিবাড়ি রোডে নানারকম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন সক্রিয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের নির্ভীক যোদ্ধা শহীদ সেরনিয়াবাত ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একজন রাজনৈতিক সচেতন মানুষ। ছিলেন সমাজসেবী ও জনপ্রিয় সাংস্কৃ্তিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় উদ্যমী ও সক্রিয় কয়েকজন যুবকদের নিয়ে কালীবাড়ি সড়কে গড়ে তুলেছিলেন উদয়নী ক্লাব ও পাঠাগার।
কালিবাড়ি রোডে নিজ বাড়ির সামনের স্টলে বন্ধু বদিউর রহমান, ফরাদ, সঞ্জীব দাস (বর্মন রোড নিবাসী) এ তিনজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভাষালিপি’ নামে একটি বইয়ের দোকান। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষা সংস্কৃতি বিকাশে সুস্থ ধারার বইয়ের সমারোহ, যা ঐ সময়ে বরিশালের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের বেশ আকৃষ্ট করেছিলো। এ বইয়ের দোকানে একাধিকবার ভারতীয় লেখকদের ভাল ভাল বই পাঠকদের জন্য আনা হয়েছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সেই বইয়ের স্টলটি এক প্রকার মালিকানাবিহীন পরিত্যক্ত থাকায় কে বা কারা সেইসব বই নিজেদের করায়ত্ব করে নেয়–তার হদিস পাওয়া যায় না। ৭৫’ এর মর্মান্তিক ঘটনার পর অন্যান্য উদ্যোক্ততারাও আর সাহস করে এগোতে পারেনি।
বরিশালে তার অন্যতম আরও একটি অবদান হচ্ছে জগদীশ সারস্বত গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের বিপরীতে বিশেষ করে তৎকালীন উদীচী অফিস সংলগ্ন পুকুরপাড়ে ভাষা আন্দোলনের স্মরণে শহীদ মিনার স্থাপন। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক রানী ভট্টাচার্য একটি শহীদ মিনার স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তিনি যথারীতি তরুণ সমাজকর্মী শহীদ সেরনিয়াবাত সহ উদীচীর বদিউর রহমান ও অন্যান্যদের এ বিষয়ে অবহিত করেন। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেন স্কুলের ভেতর নয়, বরং স্কুলের ঠিক বিপরীতে রাস্তার পাশে পুকুর পাড়ে নির্মাণের স্থান ঠিক করেন। এ সময়ে শহীদ সেরনিয়াবাতের পরামর্শে তার বাসা সংলগ্ন ‘চিত্রালি আর্ট’ এর সত্ত্বাধিকারী বরিশালের অন্যতম চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর চিত্ত হালদারের নকশা ও পরিকল্পনায় এবং সকলের নানামুখী অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বরিশালে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ শহরে অতীতে ভালোবাসা দিয়ে নগরটিকে আদর্শ নগরে পরিণত করতে অনেকেই চেয়েছিলেন। শহীদ সেরনিয়াবাতও ছিলেন তাদের মাঝে অগ্রগণ্য ও অদম্য। আমৃত্যু সংগ্রামী যোদ্ধা শহীদ সেরনিয়াবাত আজ বিস্মৃতপ্রায়। দুঃখজনক হলেও সত্য এই নবপ্রজন্ম তাকে চেনে না, জানে না।
তথ্য ঋণ ও কৃতজ্ঞতা:
অধ্যাপক বদিউর রহমান
সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
ছবি: সংগৃহিত