ইংরেজীতে নজরুলের গান: আগামী প্রজন্মের খেদ মিটলো

সুর তাল ছন্দ এক, শুধুমাত্র ভাষাটি আলাদা। কাজী নজরুল ইসলামের সব রকমের ২৫০টির বেশি গান ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে। চাইলে আপনিও গাইতে পারেন। গাইছেও অনেক শিল্পী। যেমন ভাবে গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস (জর্জ) রবি ঠাকুরে গান, দিস ওয়ারিনেস ফর গিভ মায় লর্ড। বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ পালনে স্যোশাল মিডিয়া বিশ্ব জুড়ে এনে দিল নজরুলের গান কবিতার এই বাস্তবতা।

গাওয়া যাচ্ছে নজরুলের গান ইংরেজীতে। বিশ্ব জুড়েই গাইছেন ইন্দ্রানী ব্যানারজী, মুনমুন বিশ্বাস, মালয়েশিয়ার লুবনা আলম সহ একটি টিম।

১০০বছর লাগল। কিন্তু ইচ্ছে পূরণ হলো। বাঙালি নতুন প্রজন্মের। এ সম্ভব করলো এক জনপ্রিয় এক গীতিকার কবি, সময় তো লেগেছে, কিভাবে ঘটলো? একটু পিছিয়ে যাই। ১৯৬৮/১৯৯৬৯ সাল কলেজে পড়ি। এক আসরে মুখোমুখি জর্জ বিশ্বাস। প্রথম শুনছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’র ইংরেজী রূপান্তর- This weariness forgive me oh my Lordদিস ওয়ারিনেস ফর গিভ মাই লর্ড। ভাবনা এলো নজরুলের গানেরও ইংরেজী রূপান্তর শুনতে পাবো কোনদিন। পাইনি। কেউ করেনি, কোন পারেই না। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। নজরুল প্রয়াত হলেন। কবির জন্ম শতবর্ষ উদযাপিত হলো। আশা বাড়তে লাগলো।

দেবব্রত বিশ্বাসের ডিভোসন নিয়ে কেউ কণ্ঠে ধারণ করলো না নজরুলের গানের ভাষান্তর। এ কাজ করতে পারেন দুই বাংলার তেমন মানুষের তো অভাব ছিল না।

২০০৬সালে এসে জুটি চুরুলিয়ায়। নজরুল স্মৃতি বিজড়িত স্কুলের হেডমাস্টার। পাশেই নজরুলের আবক্ষ মূর্তি।

কবিতা গান লেখার চর্চা তো ছিলই। গড়ে তুলেছি ‘সঙ মেকারস এসোসিয়েশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ কলকাতায়।

বেরিয়েছে আমার লেখা সিনেমার গান ভুপেন হাজারিকা ও হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে। জনপ্রিয় হলো লোপামূদ্রা মিত্রের আধুনিক মৌলিক গান ‘বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ’।

লেখালেখি সূত্রে অনেকেই পত্র পত্রিকা পাঠান স্কুলে। যেগুলো আসার পথে পড়ি গাড়িতে। এরকম একটি কাগজে নজরুলের একটি ইংরেজী গানের ভার্সন হাতে আসে।
সুরে পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই; এক যন্ত্রণা দানা বাঁধে। তা দিয়ে শুরু নজরুলের গানের রূপান্তর ইংরেজীতে। তারপরের ঘটনা সত্যিই ইতিহাস।

শুরু হলো সুর, ছন্দ, ফরম্যাট বজায় রেখে অনুবাদ শুরু করা, তা গাওয়ানো ও রেকর্ড করা। যা ২০১৮সালের নভেম্বরে এতিসালাত একাডেমী, গ্লোবাল মিউজিক এ্যাওয়ার্ড প্রদান করে স্বীকৃতি দিল।
এরমধ্যেও চোখে পড়ে ছোটদের কবিতা। কিন্তু আটকে গেলাম। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা। আসছে না, আসছে না!

হঠাৎ লিচুচোর কবিতার Palmy pond of the Babus এর সাথে the Bulldog of the Habus লাইন দুটির অন্তমিল বাঁধ ভেঙে দিল। পরপর প্রভাতী, মটকু মাইতি, ঠ্যাং ফুলি ও ঝিঙেফুল অনুদিত হলো। এলো নজরুলের বড় কবিতা এবং বড়দের জন্য জনপ্রিয় কবিতাগুলি। নানান ফরমের, নানা ছন্দের।

সময় লেগেছে। কবিতার ভেতরে ঢোকা, ইংরেজী উপযুক্ত শব্দ চয়ন ও মূল কবিতার স্টাইল বজায় রাখা। সবকিছুকে একটা ক্রিয়েটিভির মধ্যে সাজানো।

এরপরে নজরুলের সবক’টি উপন্যাস, কিছু ছোট গল্প, প্রবন্ধ, নাটিকা ও অভিভাষণ আদৃতও হয়। সে কথা আরেকদিন বলবো।

এভাবে প্রায় সম্পূর্ণ নজরুল সাহিত্য এখন ইংরেজীতে। প্রথম বৈকি! কেউ তো করেনি, এতটা!

প্রথমে আজকাল পরে আনন্দবাজার, দেশপত্রিকা। সম্প্রতি জাগো বাংলা কাগজ এ কাজে উৎসাহ দিয়েছে।

আকাশ আট, তারা বাংলা, ইটিভি উর্দু, কলকাতা দূরদর্শন আলোচনা বা অনুবাদ সম্প্রচার করেছে, সম্প্রতি করলো দ্য গ্লোবাল টিভি, লন্ডন।
ইতোমধ্যে এলো বিদ্রোহী কবিতা রচনা শতবর্ষ। বিশ্ব জুড়ে নজরুল নিয়ে এত চর্চা আগে হতে দেখিনি। তার কবিতার ইংরেজী ভাষান্তরের কথা এতটা চর্চার মধ্যেও আসেনি।

ভার্চুয়াল পদ্ধতির এই সহজ সঞ্চরণের সময়ে ওঠে ইংরেজী ভার্সনের কথা। কিছু শিল্পী তো গাইতেন শখে। বাংলাদেশের এক চ্যানেলে দুজন শিল্পীর ইংরেজী গান শুনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আহ্বান আসতে থাকে। আসানসোলের মৌসুমি ঘোষালের রেকর্ড করা ছয়টি গানের পর বাড়তে লাগলো গানের সংখ্যা। বিভিন্ন সাধের জনপ্রিয় গানগুলি।

আজও মধুর বাঁশরী বাজে, বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, পরী জাফরানি ঘাগুরি, রুমঝুম রুমঝুম, কালো মায়ের পায়ের তলায়, কবর জিয়ারতে তুমি কে যাও মদীনায়, চল চল চল, নম নম নম বাংলাদেশ মম। অনেক অনেক গান।

গুনগুন করে পড়ার জন্য দুটি গানের মুখরা দেইঃ

এক
Sweet melody of flute lingers on
During dusk in my heart alone
Still melody of flute lingers on… আজো মধুর বাঁশরী

দুই
Bulbuli in serene Nargis bower
Listens to the elegy of fallen wild roses… বুলবুলি নীরব

স্ক্যানিং এ মিলছে, গাওয়া যাচ্ছে, গাওয়া হচ্ছে, অন্য ভাষায় মানুষ তো নিচ্ছেনই। মুগ্ধ বাংলা ভাষীরাও। বিদেশে অন্য ভাষার পরিবেশে বেড়ে ওঠা বাঙালির নতুন প্রজন্মের স্বাদ পাচ্ছে তাদের নিজস্ব হেরিটেজের। অন্য ভাষার বন্ধুদের শোনাতে পারছে। নজরুলের গানের ইংরেজী ভার্সনের সার্থকতা এখানেই।
করোনা কালের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান সহজ করে দিল নজরুলগীতির এ বিশ্বায়ন।

এখন যুক্ত হয়েছেন আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত শিল্পীরা, বাংলাদেশ লন্ডন ও মালয়েশিয়ার গায়ক-গায়িকারা। সাথে চলছে সঠিক মিটার ও ছন্দে অনূদিত নজরুলের জনপ্রিয় কবিতাগুলিও, যার মধ্যে আবৃতিকাররা এক ম্যাজিক্যাল এফেক্ট খুজে পাচ্ছে। আবৃতি সংস্থা ‘উৎস’, ‘নব নীহারিকা’, ‘ছন্দবন্ধন’, ও নজরুল চর্চা কেন্দ্র ছায়ানটের এক ঝাঁক ছেলেমেয়েরা নিয়মিত তা আবৃত্তি করে চলেছেন।

এভাবে বিদ্রোহী সহ অগ্নিবীণার কবিতাগুলির ইংরেজী ভার্সন ‘The harp of fire’ নজরুলের গানের ইংরেজী ভার্সনের সাথে জনসমক্ষে এলো। যদিও একশ বছর লেগে গেলো।

যেভাবে পঞ্চাশ বছর আগে সদ্য কলেজে পা দেওয়া আমি শুনেছিলাম দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে ইংরেজী রবীন্দ্র সঙ্গীত, শুনতে পাইনি নজরুল আমার মতো সদ্য কলেজে পা রেখে বা এই আগামী প্রজন্মের কারণ অন্তত: সেই অফসোস থাকবে না যে নজরুলের গান ইংরেজীতে নেই কেন? নজরুল ইংরেজী নেই কেন? কি করেছেন পুরবসুরীরা!?

নজরুলের গান ও তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে এই বাস্তবতাটি আজকের দিনের। পথ অনেকটা হলেও আমার এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের তৃপ্তিও তাই অনেকটাই।⊕

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!