উন্নয়ন: কেন্দ্র-প্রান্ত, ধনী-গরীব বৈষম্য, উপর-ভেতর উভয় কাঠামোর ফারাক!

গত বছর একটা পেশাগত কাজে নেত্রকোণাতে গিয়েছিলাম। নেত্রোকোণার কেন্দুয়া উপজেলার একটা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে একটু অবাক হলাম। পাকা স্কুল ভবনটি বেশ সু-সজ্জিত কিন্তু স্কুলে কোনো স্থায়ী বাথরুম নাই। স্কুলের ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ৪ জনই নারী শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক নিজে নারী এবং তিনি আসেন জেলা শহর থেকে। সকাল ১০ টায় স্কুলে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়েও যদি তিনি বাসা থেকে বের হন, তাহলে তাকে কমপক্ষে সাড়ে আটটায় রওনা হতে হয়। স্কুল শেষে বাসায় ফিরতে উনার নিশ্চয় ৫টা বেজে যায়। এই সময়ের মধ্যে তার স্বাচ্ছন্দ্যে ওয়াশরুম ব্যবহারের কোনো সুযোগ নাই। ভাবা যায়? আর নেত্রকোণা থেকে কেন্দুয়া আসার যে রাস্তা সেই রাস্তার কথা নাইবা বললাম।
গত কয়েকদিন আগে আবারও নেত্রকোণাতে গিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা অরুণাপল্লী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যিনি আমাদের টিমের সদস্য তাকে নিয়ে যখন নবীনগর পার হয়ে উত্তরবঙ্গের রাস্তা ধরেছি, তিনি খুব আপ্লুত হয়ে বললেন এখন আমার বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি টাংগাইল যেতে দু’ঘন্টাও সময় লাগে না। আমি বললাম সেই, সরকার এটাই চাইছে। যেগুলি নজরে পড়ে, মিডিয়া কভার করে সেই জায়গাগুলিতেই উন্নয়নের, মানে দৃশ্যমান উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দাও। আর নেত্রকোণার সেই নারী প্রধান শিক্ষক এবং তার মত আরো অনেক শিক্ষক সারাদিন ওয়াশরুম ব্যবহার না করে ভারী তলপেট নিয়ে স্থানীয় পরিবহনে ঝাঁকুনি খেতে খেতে দিনশেষে বাসায় ফেরেন। এবার কাজের প্রয়োজনে খালিয়াজুরিতে যেতে হয়েছিল। খালিয়াজুরি হচ্ছে নেত্রোকোণার অত্যন্ত প্রত্যন্ত একটা উপজেলা। আমাদের তিনজনের টিম। দু’জন সেদিন কলমাকান্দা উপজেলাতে কাজ করছিলেন, আমি একাই গিয়েছিলাম খালিয়াজুরিতে। সকাল সাড়ে ছয়টায় রওনা করে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে চেপে প্রায় দুই ঘণ্টা পর পৌঁছালাম বোয়ালিয়া, যেখান থেকে খালিয়াজুরির ট্রলার ছেড়ে যায়। পৌঁছে দেখি যাত্রীবাহী ট্রলারের প্রথম ট্রিপ ছেড়ে গেছে সকাল সাত টায়। পরের ট্রিপ সকাল নয় টায়। বোয়ালিয়া বাজার সংলগ্ন ব্রিজের উপর থেকে দু’দিকে তাকালে শুধু জল আর জল। জল দেখলেই আমি আমি আপ্লূত হই। দু’দিকে তাকিয়ে হাওড়ের রূপ দেখছি, আর পরিকল্পনা করছি, সন্ধ্যায় নেত্রকোণা ফিরে আমার টিমের অন্য দুই সদস্যকে বলব, আপনারা জানেন না, আপনারা কি মিস করলেন! কিন্তু ট্রলার যাত্রা শুরু করতেই মনটা বিষিয়ে গেল। হাওড়ের সৌন্দর্য ভূলে আমাকে মন দিতে হল যাত্রীদের একাংশের আলোচনায়।
ছবি: অপূর্ব দাস
– থানায় ক্যন যাইবা? থানায় ঢুকতেই তো লাগে পাঁচ হাজার টাকা। এলাকাতেই মিটায়ে ফালাও না…মুরুব্বিকে গো ডাক, চেয়ারম্যান-মেম্বাররে জানাও। থানায় গেলে ট্যাহা ছাড়া পুলিশ আইবো মনে করছ?
– এবার মুখ খুললেন একজন নারী। আপনারা যা কইতাছেন, আপনারার চাইতে তো আমি বেশি বুঝি, তা না। তয় আপনারা একবার দ্যাখেন, বলে তিনি পিঠ থেকে কাপড় সরিয়ে মারের দাগ দেখালেন। এই নিয়ে তিন বার আমারে মারছে। আপনারা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কথা কইতাছুন, তারারা কয়, হেই লাঠিয়াল পরিবারের বিচার আমরারা করতে পারুইন না। তোমরারা থানায় মামলা করুন, আমরারা সাক্ষী দিবাইন।
– হ, হ…থা ঠিক। হ্যারা হইল লাইঠেল, কারো ক্থা শুনে না। এবার এতক্ষণের উপদেশের ধরণ পরিবর্তন হয়ে গেল।
আমি ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম, ওই নারীর সাথে কোলের বাচ্চা সহ তিনজন বাচ্চা, কারো বয়সই সাড়ে তিন, চার পেরিয়েছে বলে মনে হল না। দুইজনকে তো যমজ মনে হল। সাথে উনার স্বামীও রয়েছে। তাহলে মেরেছে কে? যতটুকু বুঝলাম, তার স্বামীর ভগ্নিপতি। এই দেশে এখনও জোর যার মল্লুক তার নীতির কি দারুণ প্রয়োগ! লাঠির জোর থাকলে একজন নারীকে এভাবে মারা যায় এবং নির্যাতকের বিরুদ্ধে কথা বলতে কথিত জনপ্রতিনিধিরাও ভয় পান। লাঠির জোর, গায়ের জোরের কাছে পরাজিত একজন নারী, যাকে একটা পরিবারকে, ছোট শিশুদেরকে নিয়ে ট্রলারে চেপে জীবনের ঝুকি নিয়ে হাওড়ের অপর পারে পুলিশের কাছে যেতে হয় নালিশ জানাতে, মামলা করতে। আজকের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ যে বুলি আমরা আওড়াই, সেই শিশুদের তালিকায় এই তিনজন শিশু যে নাই, এদের মত হাজারো শিশু যে নাই, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
ট্রলারে খালিয়াজুরিতে নেমে বাজার থেকে দুই কিলোমিটার মত দূরে চারদিকে জলবেষ্টিত একটা গ্রামে পৌঁছে গেছি। জলের ভেতর থেকে বাঁশ এবং কাঠের খুটির উপর বসানো কয়েকটা টং দোকান। একটাতে বসে কথা বলতে বলতে হাওড়ের মাঝে দূরে লাল রঙের স্থাপনা মনে হল অনেকটা এলাকাজুড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, ওইটা কি? যিনি উত্তর দিলেন তিনি ওই এলাকার অগ্রসর মানুষদের একজন। একটু আপ্লুত হয়েই বললেন, ওইটা সরকারের ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। তিনশ ঘর। এ মাসে মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হবে। আগামী এক মাসের মধ্যেই লোক পার করা হবে বলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। আমি বললাম, বাহ! বেশ ভাল উদ্যোগ।
– এই জায়গাটা কি হাওড়ের অংশ ছিল নাকি, হাওড়ের মধ্যে উচু জায়গা ছিল?
– না হাওড়েরই অংশ, তবে তুলনামূলকভাবে একটু উচু ছিল। প্রকল্পের জন্য মাটি ফেলে আরো উচু করা হয়ছে।
– আমি বললাম, তিনশ পরিবারকে যে ওখানে পাঠানো হবে, এখান থেকে একটি গাছও তো নজরে পড়ছে না। আশেপাশেও তো জল আর জল। কয়েক বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই কোনো গাছ নাই। জায়গাটা মানুষের বসবাসের জন্য খুব উপযোগী হবে?
যিনি এতক্ষণ কিছুটা আপ্লুত ছিলেন, তিনি বললেন,
– তাই তো। এভাবে তো ভেবে দেখিনি। নিজেরা কথা বলছি, অন্যদের কথাও শুনছি।
যিনি আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে আপ্লুত ছিলেন, তিনি দোকানে বসা জেলেদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ভাই এখন কি আর ইছা পাওয়া যায়?
– খুব কম, নাই বললেই চলে।
– জানতে চাইলাম, ভাই ইছা কি জিনিস?
– চিংড়ি, গলদা চিংড়ি। আগে খুব পাওয়া যাইত? এখন যায় না।
– যাইব ক্যামনে ট্যাবলেট দিলে কি আর সেই এলাকায় ইছা থাকব, না জন্মাইব?
– আগে আমরা লাখ টাকা দিয়েও জলে নামতে ভয় পাই নাই, অহন দশ হাজার টাকা দিতেও বুক কাঁপে।
– টাকা দিয়ে জলে নামতে হয় কেন? কাদেরকে টাকা দিতে হয়?
– যারা ফিশারী কিনছে।
– বুঝলাম যারা ইজারা নিয়েছে। জানতে চাইলাম, ভাই আপনারা তো জেলে সম্প্রদায়, ফিশারী তো আপনাদের পাবার কথা। জাল যার, জলা তার নীতি তো তাই বলে।
– হ, আমগো সমিতির নামেই তো ইজারা হইছে। টাকা দিছেন, অমুক অমুক চেয়ারম্যান।
– ও আচ্ছা। তা এই ট্যাবলেট দিয়ে ইছা কি উনাদের লোকজন ধরেন?
– না, পাবলিকে ধরে চুরি কইরা।
– ট্যাবলেট কোথায় পাওয়া যায়? কি নাম? এই ট্যাবলেট দিলে অন্য মাছ মরে না?
– ফার্মেসিতেই পাওয়া যায়। কি যেন নামডি। না, অন্য মাছ মরে না। কোন জায়গাতে হেই ট্যাবলেট দিলে কেবল ইছাডিই ভাইসা ওঠে।
এইটা একটা এলাকার কিছু খন্ডচিত্র। বাংলাদেশের খুব কম এলাকায় আছে যেখানে, এই চিত্রগুলির কোনো না কোনও টা দেখতে পাওয়া যাবে না। সেটা তুলনামুলকভাবে অগ্রসর জেলা কুস্টিয়া, যশোর কিংবা চুয়াডাঙ্গা হোক অথবা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট কিংবা ঠাকুরগাঁও হোক।
দেশে এত এত উন্নয়নের পর দেশের মানুষের একটা বড় অংশ কেন বঞ্চনার শিকার? কারণ উন্নয়ন যেটা হচ্ছে সেইটা হল উপর কাঠামো’র উন্নয়ন। ভেতরকাঠামো’র উন্নয়ন উপরকাঠামোর সাথে তাল মিলিয়ে তো হচ্ছেই না বরং কিছুক্ষেত্রে ভেতরকাঠামোর অবনমন ঘটছে।
ছবি: অপূর্ব দাস
ভেতরকাঠামোর প্রত্যেকটি জায়গা তো আমরা আলাদা করে বলতে গেলে অনেক বিষদ হয়ে যাবে। আমি শুধু একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমাদের এমনও শিক্ষক ছিলেন, যাকে ক্লাস নেবার জন্য ডাকতে গেলে তাঁর রুমে বসিয়ে যে গল্প শুরু করতেন, ঘন্টা পেরিয়ে যেত আমরা ক্লাসের কথা ভুলে যেতাম, কারণ সেই গল্পের মধ্যে এত নানামাত্রিকতা থাকত। যে শিক্ষকের কথা বলছি, সেই শিক্ষকদের রুমের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ত। তারা বসতেন সাবেক আমলের চেয়ারে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি, বিভাগীয় সভাপতির রুমে বাহারি টাইলস, এসি, সোফাসেট আরও কত কি। শিক্ষকদের রুমেও ডেকোরেশনে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু শিক্ষকদের বেশির ভাগের সাথে কথা আগাই না, আলাপ জমে না, আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা শুনবার মত শিক্ষকের দেখা মেলা ভার। আজ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দারুণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী , হুমায়ন আজাদ, কবি মোহাম্মদ রফিক, সেলিম আল দীন, আনু মুহাম্মদদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভবন, শিক্ষকদের কক্ষ, সেমিনার কক্ষে টাইলস, এসি এগুলি উপর কাঠামো। কারা পড়াচ্ছেন, কি পড়ানো হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল হচ্ছে ভেতরকাঠামো।
নতুন ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, স্কুল ভবন, রাস্তাঘাট, কার্ল্ভাট এগুলি উপর কাঠামো। এগুলি দিয়ে সমাজের ভিত রচিত হতে পারে না, শক্তপোক্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের এখন প্রায় সব ইউনিয়নে মোজাইক করা টাইলস বসানো ওয়াশরুম আছে কিন্তু সেগুলির ৮০ শতাংশের উপর ব্যবহার অনুপযোগী। আমি যে স্কেলের  কথা বলেছি, সেইটা হয়ত ব্যতিক্রম, বাথরুম এখন প্রায় সব স্কুলেই আছে, কিন্তু শিক্ষকেরা যেটা ব্যবহার করেন, সেটা ব্যতীত অন্যগুলি ব্যবহার উপযোগী এমন দাবী জোর দিয়ে কেউ করতে পারবেন না। আমি মফস্বলের কথা বলছি। তার মানে আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু সেগুলির যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য মানুষ আমরা তৈরি করতে পারছি না। এই উন্নয়ন কি টেকসই হতে পারে? অবকাঠামোগত উন্নয়নও কেন্দ্রে প্রান্তে সমানভাবে হচ্ছে না। কেন্দ্রের মধ্যেও সমভাবে হচ্ছে না। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল এর ঢাকা শহরের অন্য সরকারি হাসপাতাল কিংবা মেডিক্যাল কলেজগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একই সাথে উপর কাঠামো এবং ভেতরকাঠামোর উন্নয়ন না হলে সেই উন্নয়ন টেকসই হয় না, জাতি হিসাবে সামনের দিকে এগোনো যায় না। সেই উন্নয়নের জন্য দরকার রাজনৈতিক  সদিচ্ছা, নীতি নির্ধারকদের প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা। সেজন্য দরকার সুশিক্ষা, জীবনবোধ, পরিবেশ প্রতিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা আর সবকিছুর কেন্দ্রে থাকা মানুষের কল্যাণ এবং সেই কল্যাণ নিশ্চিত হতে হবে পরিবেশ, প্রতিবেশের ক্ষতি না করেই। ঘরহীন মানুষের মাথার উপর চাল কিংবা ছাদ নিশ্চিত করার আগে এগুলি নিশ্চিত করতে না পারলে, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন কি সেটা বুঝে উঠার আগেই মায়ের সাথে থানায় যাত্রা, গাছহীন ধুধু বালুচরে টিনের ঘরে বসবাসের জন্য যাত্রা, জাল যার জলা তার না হবার ব্যত্যয় এগুলি চলতেই থাকবে এবং একই সাথে উন্নয়নের ফাঁকাবুলি শুনতে শুনতে আমরাও বলতে শিখব আহা উন্নয়ন!
প্রকৃত পক্ষে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই পড়ে থাকব!#

 

Comment
Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!