চার.
এই এই মাঠ প্রান্তর গহিন চরাঞ্চল জুড়ে কেবল গান আর গান। কোথাও অদৃশ্য বাদ্য ও বাজনার ঘোর। চরের অন্দরে কন্দরে এক চিরায়ত পৃথিবীর নবজন্ম হয়। মানুষের জন্ম মরন নিয়ে কি অদ্ভুত বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকবার পরিসর জুড়ে জুড়ে জীবনের বহমান প্রবাহে শরীর ডুবিয়ে দেয় সেই কবেকার জোড়া মহিষ। তখন মাথায় বহুবর্ণ গামছা জড়িয়ে রূপকান্ত হেঁটে যেতে থাকে তালুক মুলুক আর নয়া কোন জেগে ওঠা চরের দিকেই। তার দু চোখের মণিতে তখন জীবনের খুব মায়া খুব নিবিড় হয়ে জায়মান থাকে। আর তাকে জড়িয়ে ধরে হাজার বছরের কি এক সুতীব্র আলো। সেই আলোর ভেতর আমরা দেখে ফেলি উজান দেশের রঙ্গিলা সব পাখপাখালিদের। যাদের ডানায় ডানায় মিশে থাকে জন্মান্তর থেকে উড়ে আসা গানের সুর_
“ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে
কোনদিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাও রে”
গান গড়ায় গান থামে আবার শুরু হয় গানের পরবর্তী পর্ব_
“বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে”
রূপকান্ত হেঁটে যেতে থাকে।আর তার বুকের খুব গভীরদেশে ঢুকে পড়তে থাকে বটবৃক্ষের আবহমান ছায়া।
আরও পড়ুন: এই উত্তরদেশ, এই জোড়া মহিষের দেশ (প্রথম পর্ব)
পাঁচ.
গরুজলদেওয়া ঘাটের সোতা পেরিয়ে যেতে যেতে রূপকান্ত সোজা উত্তরের দিকের পথ ধরলে দূরাগত পাখিদের কলরবের ভেতর একটা মত্ততা এসে গেলে আমরা জায়মান বিস্তারের মধ্যে দেখতে পাই নদীতে আষাঢ় মাসের নয়া জল ঢুকছে। সেই জলস্রোতের উপর দিয়ে কত কত দিন মাস বছর উজিয়ে পুনরায় জেগে ওঠে ইদ্রিস মোল্লার চরে শুনে ফেলা নাজনিন খালার কণ্ঠের বারমাস্যা গানের কলি_
“আরে জৈষ্ঠ্য মাসের মিষ্ট ফল
আষাঢ় মাসের নয়া জল রে
কত পাষাণ বন্ধিছেন পতি মনতে”
সেই গানের আকুল করে তোলা,ব্যাকুলতা জাগানো
সুরের দোলায় দোলায় এভাবেই রচিত হতে থাকে
এক অনন্য মহাজগৎ কথা!
রূপকান্ত উজান আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে তাকে জাপটে ধরে খানিকটা ভ্রম কিংবা বিভ্রম।
চরের প্রান্ত থেকে হাওয়া বাতাস হাহাকারের মতন ছুটে আসতে থাকে কেন্দ্রভূমে, আর উড়ে বেড়ানো ঘুরে বেড়ানো ধুলোর ঘূর্ণি মাইল মাইল ব্যপ্ততায় বিস্তারতায় এক অপরূপ রূপকথার জন্ম দিতে থাকে।
ছয়.
সমস্ত সীমা পরিসীমার পরিধি ভেঙে হাওয়াকে একটা মস্ত পটভূমির ভেতর টেনে এনে রূপকান্ত তার যাত্রাটাকে অব্যাহত রাখলেও একসময় তাকে কেমন স্বপ্নময় মনে হয়। স্বপ্নতাড়িত মনে হয়। স্বপ্নের পীড়নে তার হেঁটে যাবার ছন্দে কখনো দ্রততা আসে,কখনো মন্থরতা আসে।
তার নাভির মূল থেকে উঠে আসে গান, জীবন নিংড়ানো_
“আঞ্চলত মুছিলুং হয় তোর
সোনা মুখের ঘাম”
এই গানের ছন্দে চিরদিনের এক দুলুনি খেলা করে যায়।রূপকান্ত তখন গানকেই টেনে নিতে থাকে তার সব ও সমস্তটুকুর ভেতরে।এভাবে
নুতন গানের জন্ম হয় জন্মান্তরের মতন করে_
“বইল মাছে
খেইল খেলায়।”
দৃশ্য দৃশ্যায়ন মুছে ফেলে রূপকান্ত তার যাতায়াতের রাস্তায় বিছিয়ে দিতে থাকে ধনীবাড়ির খোলানের মস্ত এক মায়া।
চলবে…
ছবিঋণ: সুবীর সরকার