১৩.
আপাতত পুরোন সময়ের সমুদ্র থেকে তুলে আনা যাক কবেকার সেই সিকান্দার মিস্ত্রিকে। সিকান্দার ছিলেন গৌরীপুরের রাজা প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়ার পাট হাতির মাহুত।
হাতি শিকারের বা হাতি ধরবার কাজে গোয়ালপাড়া অঞ্চলে তিনি ছিলেন বিখ্যাত ফান্দি।
লালজি রাজার “হাতি ধুরা” ক্যাম্পে জংলী হাতিকে পোষ মানানোর কাজে সিকান্দার ছিলেন পারদর্শী।
তামারহাটের ভেঙে যাওয়া হাটের বাইরে আসতে আসতে সিকান্দার মিস্তিরি তার ঝাঁকড়া চুল নাড়াতে নাড়াতে বেশ মজাদার এক ভঙ্গি তার দীঘল শরীরে বহন করে আনতে থাকে আর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়েই গানের দু এক কলি কিংবা গেয়েই ওঠে_
“ও কি মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তির শিকারে”
এই গানের হাহাকারের মতন সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত লয়ে।গঞ্জ বাজার খেত খামার আর মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে এই গান তার সুরসমেত মিশে যেতে থাকে গঙ্গাধর নদীর মস্ত বালার চরে।
সিকান্দারের চোখ ভিজে ওঠে। এই জীবন এই জীবন মায়া নিয়েই তো আবহমান বেঁচে থাকা মানুষের।
সিকান্দার হাঁটতেই থাকে। লিলুয়া বাতাসে দোল খায় সিকান্দারের মাথার বাবরি চুল।
ফাঁকা প্রান্তরে সে আচমকা দু তিন পাক নেচেই ওঠে আর ঝুঁকে পড়ে নুতন গানের ওপর_
“বিনা বাতাসে ভাসা
ঢোলে রে”
সিকান্দার সিকান্দার হয়েই থেকে যায়। দূরে ক্রমে আবছা হয়ে আসে তামারহাটের ভরসন্ধ্যাবেলা।
গঙ্গাধরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিকান্দার মিস্তিরির শরীরের পুলক সহসা ভেঙে যায়। তার প্রাচীন কালের কালো পাথরের মত কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সে কি তবে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়!
আরও পড়ুন: এই উত্তরদেশ, এই বাওকুমটা বাতাসের দেশ (পঞ্চম পর্ব)
১৪.
সিকান্দার আসলে নৌকো বানানোর দক্ষ এক কারিগর। পাশাপাশি রাজা প্রভাত বড়ুয়ার হাতির মাহুত সে। আর এই জল ও জলার দেশে ধনী বল জোতদার বল জমিদার বলো বা গৌরীপুরের রাজাই বলো, নৌকো বানাবার কাজে প্রায় সারা বছরই ডাক পড়ে সিকান্দারের। প্রায় পঞ্চাশ বছর জুড়ে এই কাজ করে চলেছে সে। এই জনপদ তাকে সিকান্দার মিস্তিরি বলেই জানে। চেনে। পাশাপাশি তার পরিচিতি সিকান্দার মাহুত নামেও। একসময় সিকান্দার কালু বয়াতির দলে সারিন্দা বাজাতো। তার সারিন্দা কত কত ভরযুবতী নারীকে উন্মনা করেছে! কত নারীকে এক সংসার থেকে অন্য সংসারে ঠেলে দিয়েছে! কত চেংড়াকে বাউদিয়া করেছে! তার কোন ঠায় ঠিকানা নাই।
তাকে দেখলে এখনও কত মানুষ মজা করে গেয়ে ওঠে_
“কি ডাং ডাঙ্গালু বাপই রে
নাঠির গুতা দিয়া”
তবে কি সিকান্দার তার সারিন্দার জীবনের কথা ভাবছিল! না কি গয়েশ্বর ধনীর জোতজমি আর বাইচের নাও তাকে আরো আরো এক ভাবনার জটিলতায় ঠেলে দিচ্ছিল!
সিকান্দারের মনে পড়ে সেই কবে কুচবিহারের মহারাজার ডাকে গৌরীপুরের রাজা প্রভাত বড়ুয়ার সঙ্গী হয়ে ‘বোচামারি জঙ্গলে’ শিকার যাত্রায় অংশ নেবার ঘটনাটি। সেবার রাণী সরোজবালাও ছিলেন।
সেখানে এসেছিলেন লর্ড কার্জন। সেই প্রথম তার এত্ত বড় সাহেব দেখা।
দুই দুই খানি বিশাল বাঘ মেরেছিলেন কার্জন সাহেব।
এভাবে আখ্যান শেষ হয়ে যায়। না কি নুতন কোন আখ্যান জেগে উঠতে থাকবে এই আপাত শেষ হওয়া আখ্যানের মধ্য থেকেই।
আরও পড়ুন: প্রাচীন ধর্মমঙ্গলকাব্যের দুই কবি
১৫.
এই ঢোল বাঁশি সারিন্দা ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়া যায় বুঝি! এই সব গঞ্জহাটের মায়া ছেড়ে কোথাও কি যাওয়া হয় মানুষের! জীবনের আবহমানতায় লিপ্ত হতে হতে মানুষের ঢুকে পড়া একটা বুধবারের হাটে। বুধবারের হাটে আজিজ কবিরাজের কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে মানুষকে প্রবেশ করতে হয় একটা শুক্রবারের হাটে। সেখানে গুনেশ্বর লাঠিয়াল চলে আসেন কালি পড়া লন্ঠন হাতে। আসেন খড়ম জোতদার। আর পাইকার তার কাধের পেশি থেকে নামিয়ে রাখেন গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
এভাবেই নদীর উজানে নদীর ভাটিতে গান গড়ায়।
গল্প গড়ায়। লোকমানুষের ম্যাজিকল্যান্ডে জীবনের পর জীবন এইসব চিরকালীন গল্প বেঁচে থাকে। জেগে থাকে। দূরের হাওয়ায় তখন বুক নিংড়ানো গানের সুর ভাসে_
“ওরে মালসিরা ধানের ভাত খোয়ামো
থাকেন দিনা চারি
ও মোর সোনা বন্ধু রে”