এবং সবিতা

বাইরে বিষ্টি হচ্ছে; রাউটির মধ্য থেকে মাথা বের করে সবিতাদিকে ডাকতে গেছি এমন সময়ে ইকবালদা ডাকল,
–ভাই সুবীর খাওয়া হইছে ?
আমি বললাম,
–না এখনও খাইনি। যা বিষ্টি, রান্নাই শেষ হয়নি।
আমাদের সর্ষের তেল কম আছে। তাই মাথা বের করে সবিতাদির রাউটির দিকে তাকিয়ে কর্জ করার চেষ্টা করছিলাম। সবিতাদির বাদামের দোকান। আমাদের হরেকমাল সাড়ে ছ’ টাকার। আমাদের বামপাশে সনৎদার রাউটি। সনৎ চ্যাটার্জী মনোহারির দোকান করে। ইছেবাছার বিষেহরির ঝাপান উপলক্ষে মেলা। এই মেলাতেই দোকান দেব। ইছেবাছার দীর্ঘকালের ঐতিহ্যবাহী বিষহরির এই ঝাপানের মেলা। হাওড়া বর্ধমান মেইন লাইনের দেবীপুর স্টেশনে নেমে উত্তর—পশ্চিম দিকে যেতে পথে পড়ে ইছেবাছা। এখানে একটি বড়ো দিঘির তীরে তিনদিনের এই মেলা বসে।
বছরের বাংলা মাসের দ্বিতীয় মাসে দশহরাতে এই মেলা হয়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ এই মেলাতে আসে। জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরায় নাগপঞ্চমীর পুজো হয়। সেই উপলক্ষে এখানে ঝাপানের মেলা বসে। ইছেবাছার এই বিষহরা আসলে সর্পদেবী মনসারই আর এক রূপ। ইনি লৌকিক দেবী হিসাবে পূজিত হন। ইছেবাছার এই বিষহরা লৌকিক দেবী। এবং ভীষণ জাগ্রত বলে প্রচলিত। তাই দূর—দূরান্ত থেকে এসে এখানে মানত করে যায়। ফল পেলে পাঁঠা বলি দিয়ে পুজো দেয়।
সবিতাদি ও ইকবাল, সনৎদা, কেদারদা, আমি ও সুকুমারদা আমরা এক ট্রলিতেই এসেছি এর আগের মেলা মেমারির আজাপুর থেকে। কেদারআলির কাঠের নাগরদোলা। সবিতাদির বাদামের দোকানে ইকবালদা থাকে। সবিতাদিই বাদামের দোকানের মালিক। শেখ ইকবাল। সেও সবিতাদিকে দিদি বলে ডাকে। ইকবালদা সবিতাদির ফাইফরমাশ খাটে। ইকবালদা শক্ত সমর্থ যুবক। বস্তা বস্তা বাদাম মাথায় করে আনে। কয়লা কেনে। বাদাম ভাজে। দোকান বাধে। আবার বেচাকেনাও করে।
আমাদের হরেকমালের দোকানে আমি আর সুকুমারদা থকি। সুকুমারদা প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। কোলকাতায় মাল আনতে যায়। আর আমি রান্না করি। দুভাই মিলে বেচাকেনা করি—আনন্দে দিন কাটে। আগামী কাল বৃহস্পতিবার। মেলা শুরু। দুপুরে খাওয়ার সময় এসে গেছে। বাইরে বিষ্টি থামলেই দোকান বাধব। আমি আলু সেদ্ধ ও ডাল রান্না করেছি। একটু বাদে খাব। এই সময়ে সবিতাদি ইকবালদাকে একটাবাটিতে করে বাটামাছের তরকারি আমাদের রাউটিতে পাঠিয়ে দিল।
দুপাশে চারটি চায়ের পেটি দাঁড় করিয়ে উপরে আড়াআড়িভাবে টিন দিয়ে ছাউনি করা ছোট ছোট রাউটি। যার সামনের দিকে খোলা থাকে। পিছন ও দুপাশ ত্রিপল বা পলিথিন দিয়ে ঘেরা থাকে। এর মধ্যে বসা যায়। কিন্তু দাঁড়ানো যায় না। আমাদের চায়ের পেটিতে স্টিলের মাল ভর্তি। এক একটা পেটি ভীষণ ভারী। ওজন প্রায় এক মণ দেড় মণ। মাথায় করে, কাধে করে ট্রলিতে তুলতে হয়। বয়স আমার চৌদ্দ। এইকাজ করি মনের আনন্দে, বাঁচার তাগিদে। আমার সামনে এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সুকুমারদার বয়স ত্রিশ। সে আমার অগ্রজ সহোদর।
মেলার জীবন বৈচিত্র্যেভরা। এক এক মেলাই যাই—বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মোলাকাৎ ঘটে। বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসার সুবাদে অনেক রকমের অভিজ্ঞতা হয়। আমরা একরাতের মেলাও করি, আবার দু—তিন দিনের মেলাও করি। কেদারদার কাঠের নাগরদোলা ক্যাচকোচ ক্যাচকোচ আওয়াজ তুলে যখন ঘোরে, আর কেদারদা দুইহাতে করে এক একটা চেয়ার ধরে হেইও হেইও বলে ঘোরাতে থাকে—তখন আমার দেহে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে, মনে এক অজানা পুলক সঞ্চারিত হয়। বিস্মিত হই, অবাক হই এই ভেবে যে যারা মেলার জীবনকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছে, তাদের অমানুষিক পরিশ্রম দেখে। কী পরিশ্রমই না করতে পারে এরা জীবন অতিবাহিত করার জন্য না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
ইছেবাছায় মেলাপ্রঙ্গণের পাশে খোলা মাঠ। তারপাশে গ্রাম। গ্রামে রয়েছে একটি জমিদার বাড়ি। উত্তর—পুবে চাষ, এখানে লক্ষীর বাস। দক্ষিণ—পশ্চিমে বামুন পাড়া। পাড়ায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের বসবাস।
মেলার আগেরদিন বিকেলে বিষ্টি থামলে সকলে নিজের নিজের দোকান বাধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দোকান বেধে রাত্রি দশটা নাগাদ রান্নাবান্না চাপানোর আয়োজন হয়। রান্না করে বাইরে এসে কৌতূহল নিয়ে সবিতাদির দোকানে উঁকি মারি। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। হতভম্ব হয়ে যাই। এ আমি কি দেখলাম। বাইরে থেকে জোরে জোরে দম নওয়ার, হাসফাস করার আওয়াজ আগেই পেয়েছি। সেই কারণে উঁকি মেরেছি। দেখি ইকবালদা সবিতাদির দেহের উপরে। দুজনেই বিবস্ত্র। ইকবালদার পুরুষাঙ্গ সবিতাদির যোনিতে প্রবেশ করছে আর বের হচ্ছে। সবিতাদি গোঙানোর মতো চাপাস্বরে আঃ—আঃ—আঃ করে শীৎকার করছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ভাবছি এ আমি কি দেখলাম। কোন জগতে এসে পড়লাম। ইকবালদা সবিতাদিকে দিদি বলে ডাকে। আর সবিতাদিও বয়সে অনেক বড়ো। আমি দোকানের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে পলিথিন হাত দিয়ে ধরে খচমচ করে ফেলি নিজের অজান্তে। সবিতাদি বলে ওঠে,
–কে রে!
আমি ভয়ে লজ্জায় সংকোচে মাথা নিমেষে বের করে আনি। আলোছায়ার মাঝখান দিয়ে দ্রুত দোকানে ফিরে আসি। সেই রাত্রে ঘুমোতে পারিনি অজানা আশঙ্কায়। অন্ধকার পিছল পথের ইশারা বড়ো মায়াবী। মন অবচেতনে আকৃষ্ট হয়। সুকুমারদাকে কিছু বলতে পারিনি মুখ ফুটে। পরদিন মেলা।
ভোরবেলা প্রাতঃকৃত সেরে দোকানদারি করতে শুরু করি। রাতের সেই ঘটনা যেন স্বাভাবিক। ইকবালদাও বাদাম সাজিয়ে বিক্রি করতে শুরু করেছে। সবিতাদি বাদাম ভাজছে। পাশেই সনৎদা মনোহারি দোকান দিয়েছে। আমাদের দোকান সামনের সারিতে।
বেলা বাড়তে থাকে। রোদ্দুর—বিষ্টির খেলা চলতে থাকে। দশহরা তাই বিষ্টি হবেই হবে এটা এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস। আশেপাশের দু—দশটা গ্রামের মানুষেরও তাই ধারণা। খানিক বাদে আমি উঁচ্চস্বরে চেঁচাতে থাকি—
–হরেক মাল সাড়ে ছ টাকা। আসুন, যা নেবেন সাড়ে ছ’ টাকা, স্টিলের থালা, গেলাস, বাটি প্লাস্টিকের খেলনা। যা নেবেন সাড়ে ছ’ টাকা। আসুন, আসুন নিয়ে যান।
এইভাবে আমি আর আর সুকুমারদা দশহাতি দোকানে সারাদিন দোকানদারি করতে থাকি। এরপর সন্ধ্যা নামে নিয়ম মেনে। অন্ধকার বাইরে ঘনিয়ে আসে। তখন মনে হয় আমার জীবনেও এই নিকষ ঘন অন্ধকার নেমে আসছে। জীবনের সব আলো এক একটা করে নিভে যাচ্ছে। রাতের রান্নাবান্না করতে শুরু করি। রাত্রে যথারীতি সবিতাদি মাংস রান্না করে ইকবালদাকে দিয়ে আমার জন্য একবাটি পাঠিয়ে দেয়। সুকুমারদা প্রচণ্ড হিসেবি। ডালভাত আলুসেদ্ধ ছাড়া আর কিছু খেতে নারাজ। আমাকে জানি না কেন সবিতাদি এত স্নেহ করে। ইকবালদাও ভাই বলতে অজ্ঞান। আবার তাদের এই সম্পর্কের রসায়ন দেখে আমি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছি। রাত্রে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। দুদিন পড় ইছেবাছার মেলা শেষ হয়।
আমাদের দোকানের পিছনে বড়ো দিঘি। তার একপাশে পদ্মবন। সেখানে অজস্র সাপ। তাই রাত্রে জীবন হাতে নিয়ে শুতে হয়। এই মেলায় দোকানদারি করি কারণ এখানে প্রচণ্ড বেচাকেনা হয়। ইছেবাছার মেলা শেষ হয়। দোকান গুটিয়ে ফেলি। আবার ট্রলি করে বাগিলার দিকে রাত্রে রওনা দিতে হবে। রাত্রের ফরয-এর নামাজ শেষ করে ইকবালদা ট্রলি ছাড়তে বলে।
রাস্তার দুপাশে সারি সারি লম্বু, সেগুন, জারুল, অশ্বথ, পাকুড়, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপ্টাস এবং নিমগাছ। রাস্তায় কোনো আলো নেই। অপ্রশস্ত রাস্তা। ঢিকি—ঢিকি করে আমরা কচ্ছপের মতো অতি মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছি গন্তব্যের দিকে। প্রায় চার—সাড়ে চার ঘন্টা সময় লাগল। রাস্তা খুব খারাপ। যখন পৌঁছলাম তখন আকাশে শুকতারা দেখা দিয়েছে। পরদিন সকালে বাগিলা গিয়ে রাউটি করে ঘুম দিলাম। বাগিলায় পনেরো দিনের মেলা।
এই মেলায় এসে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। শুনলাম সবিতাদি প্রেগন্যান্ট। কে যে এই কাজের জন্য দায়ী তা কেউ জানে না। সবিতাদি কুমারী। মেলায় নতুন নতুন ঘটনা ঘটে এটাই স্বাভাবিক। দেখলাম ইকবালদা ব্যস্ত দোকান বাধতে। কারণ কাজ না করলে খাবে কি। এটাই তো মানব জীবনের ধর্ম।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!