মতির বাড়িটা তত বড়ো না হলেও ভিতরটা বেশ ছিমছাম। সামনে এক চিলতে উঠোন। দুধারে দুটো মাঝারি সাইজের পাতা বাহারের গাছ। সূর্যের আলো পড়লে তাতে রোমাঞ্চ জাগে যা মতির জীবনে নিত্যকার অনুপ্রেরণার উৎস, যাতে খোঁজ মেলে নিটোল শিল্পী জীবনের, যাতে কোনো কৃপণতা নেই, কাউকে অবহেলা করার বিকৃত চেতনা নেই। তার জীবনটা সোজা ব্যাট চালানোর মতো। পাবলিক রিলেশন ভালো বলেই আম-মানুষের মধ্যে তাঁর উঁচু ইমেজ রয়েছে।
বিকেলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ডুরানিকে বলে গেল, ফিরতে হয়তো একটু রাত হতে পারে, সন্ধের পরে পাপানকে পড়াতে বসাবেন। পরের মাস থেকে একজন নতুন শিক্ষক আসছেন। কথা বলেছি তাঁর সাথে। রাজি হয়ে গেছেন। এ ক’দিন আপনাকেই একটু বেশি যত্ন নিতে হবে। ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। এত কম বয়সে বেশ মননশীল হয়ে উঠেছে।
শুনে ডুরানি শুধু একটু হাসলেন। বাবা হয়ে আকাশ পাপানকে নিয়ে যা কখনো ভাবতে পারে নি, মতি তা করে দেখাতে পারছে। খাঁটি জীবনবোধ না থাকলে এভাবে পরোপকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় না। ডুরানি মনে মনে পুলকিত। সূর্য ডোবার আগে পাপানকে তাড়া দিয়ে বললেন, তোমার কাকুর কড়া হুকুম, একটু পরে পড়তে বসতে হবে।
তাহলে দাদু, তুমি পুলিশটার মতো কাকুকেও ভয় পাও?
ডুরানি কোনো জবাব দিলেন না। মনে মনে গভীর করে বুঝলেন, ভয় পাওয়াতেই জীবন গড়ার স্বপ্ন রয়েছে। শুধু লেগে থাকতে পারলেই হল। যে গড়ে উঠছে, যে গড়ে তুলছে— দুজনেই সমান সার্থক হতে পারে।
পাপান হাতমুখ ধুয়ে বারান্দার একধারে বইপত্র নিয়ে পড়তে বসল। ডুরানি ঘরের ভিতর থেকে পায়ে পায়ে এসে পাপানের পাশে বসে বললেন, কোনটা আগে পড়েবে বলো?
একটু কবিতা কবিতা খেলব?
বেশ, তাই হয়ে যাক।
গরমের সময়। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। মাঝে মধ্যে সেই ঢেউ দুজনের গায়ে লাগছে। ডুরানি উচ্চারণ করে জোরে জোরে পড়লেন,
সেজ দ্য ক্লক
টিক টিক টিক
হোয়াট ইউ ডু
ডু ইট কুইক।
পাপানকে হুকুম করলেন, জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়ো। আমি শুনছি, কোথাও ভুল থাকলে বলে দেব। পাপানের মধ্যে নতুন উৎসাহ। কবিতা কবিতা খেলতে তার খুব ভালো লাগে। মনোযোগ দিয়েই পড়ছে। উচ্চারণের তারতম্য ডুরানি মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বেশ কয়েকবার পড়াও হয়ে গেছে। ডুরানি বললেন, এখন মুখস্থ বলতে পারবে দাদুভাই?
পারব দাদু।
তাহলে বলো শুনি।
পাপান গড় গড় করে মুখস্থ বলে দিল। ডুরানি বেজায় খুশি। মতির কথা বার বার মনে পড়ছে তাঁর। পাপানের যে যথেষ্ট মেমরি পাওয়ার আছে, তা মতি প্রথম আবিষ্কার করতে পেরেছিল। ভাবার সময় আরেকটা গোপন গর্ব দোল খাচ্ছে বুকের ভিতরে। অস্ফুটে বললেন, কার নাতি দেখতে হবে তো। সেই সূত্রে আকাশের কথা মনে পড়তেই মুখ বাঁকিয়ে ডুরানি মনের অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। পাপান চেয়ে রয়েছে দাদুর মুখের দিকে।
ও দাদু, ইংরেজি তো পড়লুম, এর মানে তো জানতে পারলুম নে।
তাহলে মন দিয়ে শোনো—
বলছে সোনার ঘড়ি
টিক টিক টিক
যা কিছু করতে হবে
করে ফেলো ঠিক।
পাপানের মনে অন্য কৌতূহল, বলল, তুমি তো বেশ কবিতার ঢঙে মানে করে দিলে। একটু বুঝিয়ে দাও না দাদু।
সময় বয়ে চলেছে ব্যস্ত সমুদ্রের মতো। কেবল সামনেই ছুটছে। কোনো বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। ক্লান্তিহীন তার পথচলা। সময়ের দামকে ঠিক সময়ে ধরা মানুষের জীবনে খুব মূল্যবান। ভেবে নিতে হবে, প্রতিটিা মানুষের জীবন অনন্ত সময়ের মধ্যে ক্ষুদ্রতম গণ্ডিতে বাঁধা। তার মধ্যে স্মৃতি রেখে যাওয়ার জন্যে প্রত্যেককে যথাসাধ্য কাজ করতে হবে।
তাহলে কী দাদু পুরনো কখনো ফিরে আসে না?
আসতে পারে না দাদুভাই। সময় জানে না পিছন ফিরে চলতে। তার গতি কেবল সামনের দিকে।
আমরা তো বেশ সামনে পিছনে ছুটতে পারি।
তা পারি, কিন্তু পিছনে ছুটলে তার কোনো দাম নেই।
কেন দাদু?
তাতে যে মানুষের সমাজের কোনো উপকার হয় না।
আমাকে বুঝিয়ে বলো, কবি ‘ঠিক সময়’ বলতে কী বলতে চেয়েছেন?
যেমন সন্ধে হলেই তোমাকে মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে হবে। তা না করে যদি টিভি দেখো, বা খেলা করো, তাহলে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে হবে। তখন সময়ের কোনো মূল্য থাকবে না জীবনে।
পাপানের মুখে হাসি। ডুরানির দুচোখ তার দিকে। উঠোনের এক কোণে পাতাবাহারের গাছের নীচে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। বারান্দার আলো সেখানে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেনি। সময়ের স্বাভাবিক টানে নিজের জীবনেও আরেকটা পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন ডুরানি। সময় এগিয়ে চললেও কেবল মনের টানে তাঁকে কখনো কখনো আকাশের জন্যে পিছন ফিরে তাকাতে হচ্ছে। তা থেকে এড়িয়ে চলার কোনো পথ নেই। সকলকে আড়াল করে চলা গেলেও নিজের মনকে কিছুতেই আড়াল করা যায় না। পুরনো স্মৃতিগুলো ডুরানির মনের ইজেলে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এর মতো। দাঁতের যন্ত্রণা বাড়ে ফির ফিরে বাতাসে, ডুরানির ভিতরের যন্ত্রণা বাড়ছে আকাশের কারণে।
পাপান ডুরানির গায়ে হাত দিয়ে বলল, ও দাদু, অমন বিড়বিড় করে কী বলছ শুনি?
হেনা ঘরের মধ্যে এল চা বিস্কুট দিতে। ডুরানির প্রশ্ন, পাপানকে কিছু খেতে দিলে না?
ওর জন্যে টিফিনের ব্যবস্থা করেছি। না মানে মতি সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আজ থেকে রোজ চলবে। হেনা আবার পাপানকে উদ্দেশ্য করে বলল, খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি পড়তে বসো। —আপনাকে কী চানাচুর দেব? এ ব্যবস্থাও মতির। গতকাল বাজার থেকে তিন প্যাকেট চানাচুর কিনে এনেছে। হাতে দিয়ে বলল, মেসোমশাইকে চায়ের সাথে রোজ খেতে দিও।
মতি আমাকে নিয়ে এত ভাবে বৌমা?
ও আপনার মধ্যে নিজের পিতৃত্ব দেখতে পেয়েছে। কথায় কথায় গত পরশু আমাকে বলল, জানো বুবান, আমার তো বাবা-মা নেই। মেসোমশাইকে সেই শূন্যস্থানে বসিয়ে ফেলেছি। সেই কারণে আমাকে কিছু করতে হবে। কেবল ভাবছি, আমার এই প্রচেষ্টার মধ্যে অকালে ঝরে যাওয়া পিতার আত্মা কিছুটা শান্তি পেতে পারে।
হেনা, তোমার মুখে এ সব শুনে এক অর্থে ভালো লাগলেও অন্য অর্থে শিউরে উঠছি। এত ঋণ শোধ করব কী করে? আমার তো এখন দেওয়ার কিছু নেই, শুধু নেওয়ার আছে। এভাবে জীবন চলে না হেনা। এ ঋণ বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠলে সেই ভার বয়ে বেড়ানো বড়ো কঠিন হয়ে উঠবে। ভাবছি, তখন দাঁড়াবো কোথায়?
পাপান টিফিন খাওয়া শেষ করে বলল, তুমি তো বলো, সব কাজ সময় মতো শেষ করতে হবে, কাকু তোমার কথা শোনে? সেই সকালে বের হয়ে গেছে, এখনও বাড়িতে ফেরে নি। হাত দিয়ে দ্যাখো, আমার বুকের ভিতরটা কেমন করছে। এত বাজে কাজে কেন যে সময় নষ্ট করে আমার কাকু, তুমি একটু বকে দিতে পারো না?
ক্লাবে অনেক কাজ থাকে রে, যা সারাদিনেও শেষ করা যায় না। এ সব দেশের মানুষের খুব উপকারে লাগছে। সেজন্যে বকে দিতে পারি না।
পাপান হাসছে খিলখিল করে। কিছুতেই তা থামছে না। ডুরানি অবাক। ভেবে পাচ্ছেন না, এভাবে পাপান হাসছে কেন? হাসির মতো তিনি তো কিছু বলেন নি। পাপান তখনও হেসে চলেছে। বাধ্য হয়ে ডুরানি বললেন, এভাবে হাসছিস কেন রে?
জানো দাদু, কাকু দারুণ অভিনয় করতে পারে। আমি তা দেখে ফেলেছি। হাত পা নাড়ার যা বহর, খুব মজা পেয়েছি মনে মনে। আমাকে দেখে কাকুও ভীষণ লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল।
কী করে দেখলি, তাই বল।
পরশু রাতে খাওয়ার পরে কী মনে করে কাকুর ঘরে ঢুকে দেখি, অভিনয় শুরু হয়ে গেছে। ডান হাত সামনে ঝুঁকিয়ে ঘুসি মারার ভঙ্গীতে বলছে, ওরে বিভাস, তোকে আমি ছাড়ছি নে। তোর দুটো চোখ আমি ডালকুত্তাকে দিয়ে খাওয়াবো।
হেনা ঘরে ঢুকে ধমকে দিল পাপানকে, পড়তে পড়তে কাকুর অভিনয় দেখিয়ে এভাবে সময় নষ্ট করছিস্ কেন? সময় পার হয়ে গেলে ফিরে আসে না রে।
রাত আটটা। তখনও মতি বাড়িতে ফেরে নি। পাপান না বললে হয়তো এ প্রসঙ্গ ডুরানির মাথায় আসত না। হেনাকে বললেন, বৌমা, পারলে কাউকে দিয়ে একটু খোঁজখবর নাও। মতি তো রোজ আটটার মধ্যে বাড়িতে ফেরে। আজ এত দেরি হচ্ছে কেন? অন্য কোনো কারণ নেই তো?
একটা প্রসঙ্গ বলতে ভুলে গিয়েছি তোমাকে? রায়চক চর থেকে বালি তুলে নিয়ে যাওয়া নিয়ে নতুন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে মতি। ওর বিপক্ষে রয়েছে বিভাস সামন্ত। লোকটা আদপে ভালো নয়। যে কোনো খারাপ পথে চলতে পারেন। তাঁর কাজকর্ম্মে এমন অনেক রেকর্ড রয়েছে। উঠে পড়ে সাহায্য করছে স্বরূপনগর থানার ওসি। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। তাই ভিতরের পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো। অবশ্য আম-মানুষের সমর্থন রয়েছে মতির পক্ষে। রাজনীতির হুমকি আর প্রশাসনের কারচুপি রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে জনসমর্থনের মূল্য অপরিসীম।
ডুরানি বুকে হাত চেপে ধরে বললেন, বড়ো ভয়ের কথা শোনালে বৌমা। এখন আর এসব আমার মাথায় ঢুকছে না। বুকের ভিতরে আবার সেই যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছে। বাড়লে বড়ো কষ্ট হয় রে মা।
তাহলে এভাবে আর বসে থাকবেন না। পাশের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিন। এত টেনশন নিতে যাচ্ছেন কেন?
আমাকে ধরো বৌমা। খবরটা আমাকে না শোনালে ভালো করতে। যে মতি আকাশের পূর্ণ বিকল্প হয়ে উঠেছে, তার সামনে এত বড়ো বিপদ কেন? গোলাপে কীটপতঙ্গ বসলে আমার বুকের ভিতরে কেমন যেন ধড়পড়ানি শুরু হয়ে যায়।
আর কথা না বাড়িয়ে আমার হাতের উপর ভর করে উঠে দাঁড়ান।
হেনার কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ডুরানি বললেন, এ সব কীভাবে সম্ভব হচ্ছে বৌমা? কিছুতেই দুষ্ট গ্রহ আমাদের পিছু ছাড়ছে না! আজকাল জীবনে কী সাদার চেয়ে কালোর দাম বেড়ে গেছে? কিছু মানুষ কেন যে আলো বাদ দিয়ে কালোকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে, তা মাথায় আসে না।
আর কথা বলবেন না আপনি। বিছানার উপর বাম পাশ পেড়ে শুয়ে পড়ুন। চুপচাপ বিশ্রাম নিন। আমি ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। শরীরটাকে আলগা করে রাখুন, ম্যাসেজ করতে সুবিধে হবে।
যেভাবে বলছ, সেভাবেই শুচ্ছি বৌমা।
হেনা ডুরানির বুকে ম্যাসেজ করতে থাকল। ডুরানির অনুভূতির গভীরে নতুন রিংটন বাজছে। হেনা তার বৌমা, না, নিজের মেয়ে? এক অদ্ভুত দোলাচলে দুলতে থাকলেন ডুরানি। পুঁটিরামের ছেলে গুণধর তখন মতির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে কী ভাবছে। কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করতে চায়, তার আসাটা ঠিক হয়েছে কিনা। ক’দিন ধরে খুঁজতে খুঁজতে সে আজই মতির বাড়ির সন্ধান পেয়ে গেছে। একটু পরে গুণধর দেখল, একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে সামনে হেঁটে আসছে। হেঁকে দাঁড় করালো তাকে, শুনছ, আমি পুঁটিরামের ছেলে, এ বাড়িটা কী মতির? ক্লাবের সেকরেটারি গো।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে লোকটা চলে গেল। গুণধর নিজের মনে বক্বক্ করছে, এ হে, এ কী বাড়ি, আমার বাবার বাড়ি এর চেয়ে ঢের ভালো। নামে সেকরেটটারি, এই তো বাড়ি।
পাপান বাড়ির বাইরে এসে বলল, এখানে কেন?
এ্যাই ছেলে, এ রকম বলছ কেন? আমার বাপটার জন্যেই তো আসতে হল। তুমি জানো না, রাতে কী কষ্ট পাচ্ছে লোকটা।
গুণধরের ন্যাকা ন্যাকা কথায় পাপান খুব কৌতূহলী হল। উৎসাহ চাপতে না পেরে বলল, তুমি কী গো, এ রকম হাফ প্যান্টেলুন পরে আছ?
আবার গুণধরের ন্যাকা ন্যাকা কথা, কিস্সু জানো না হে, এটা পরলে আমাকে ভারি সুন্দর মানায়, রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগে।
পাপান হেসে কুটি কুটি। কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না। লোকটা বলে কী? রাজপুত্রের ছবি সে অনেকবার দেখেছে। কী দামি দামি পোষাক পরে থাকেন তারা, লোকটার পোষাক তুলনায় ভিখিরির মতো।
এ্যাই খোকা, বিড় বিড় করে কী বলছ?
তোমার চেয়ে রাজপুত্র দেখতে অনেক ভালো।
তাই হয় নাকি?
তুমি তো প্যাচার মতো দেখতে।
আমাকে প্যাচা বলে ডাকলে? বাবাকে এ সব বললে কী হবে জানো? লোকটাকে চেনো না তুমি। কী সাংঘাতিক। শুনলে বদমেজাজি হয়ে তোমার মুখটা ভেঙে দেবে।
পাপানকে সামলাতে বাড়ির বাইরে এসে হেনা গুণধরকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। ছেলেটা আবার এখানে কেন? কোনো অঘটনের মতলব নিয়ে আসে নি তো? নিজের বাবার সম্পর্কে খারাপ কথা বলতেও জিভে বাধে না। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, এখানে এসেছ কেন?
ওই ছেলেটা আমাকে প্যাচা বলে ডাকল।
শুনে হেনার হাসি পেল, সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কিছু মনে করো না বাবা, ছেলে মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলেছে।
পাপান হেনাকে থামিয়ে বলল, আগে আমার কথা শোনো মা। ওই হাফপ্যানটুনওয়ালা বলছে, ও নাকি রাজপুত্রের মতো দেখতে। কী বাজে বকছে বলো? তুমি তো আমাকে অনেকবার রাজপুত্রের ছবি দেখিয়েছ। তাদের মাথায় পাগড়ি থাকে, হাতে তলোয়ার থাকে, হাব্বাজোব্বা পোষাক পরে, আর এই লোকটা হাফপ্যান্টেলুন পরে নিজেকে রাজপুত্তুর ভাবছে।
হেনা হাসি গোপন করে বলল, হ্যাঁ বলো, কী জন্যে এসেছ।
তোমাকে একটা খবর দিতে এলুম। আমার নচ্ছার বাবা তোমাকে নিয়ে নটু গুন্ডার সাথে কী সব পরামর্শ করছিল। শুনে আমার খুব রাগ হয়েছে, তাই বলতে এলুম।
এভাবে নিজের বাবাকে বদনাম করছ?
খুব রাগ হয়েছে গো আমার। চরিত্রের ঠিক নেই তো আমার বাবার। চোখদুটো খুব খারাপ। সামনে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বললে কী হবে, পিছনে শুধু শুধু লোককে ক্ষতি করতে চায়। বাউরি পাড়ার কমলাকে আমি ভালোবাসতুম। বাবা তা জানত। তারপর কী করল জানো? নটুর সাহায্যে তাকে তুলে নিয়ে কোথায় পাচার করে দিয়েছে। আর খুঁজে পাইনি। লোকে বলে, পাচার করার আগে বাবা নাকি ওকে….। কী রাগ হয় বলো তো। তোমার উপরও আমার বাবার নজর পড়েছে। শুধু সুযোগ পাচ্ছে না বলে….।
পাপানের প্রশ্ন, এই হাফপ্যানটুনওয়ালা, পাচারের ইংরেজি শব্দ জানো?
গুণধর চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছে। এটুকুন ছেলে আবার ইংরেজির খবর নিচ্ছে? ভিতরে ভিতরে রাগ বাড়ছে নিজের বাবার উপর। লোকটা তাকে স্কুলে যেতেই দিল না। এ নিয়ে কী একরোখা মনোভাব। কেবল এক কথা, স্কুলে গিয়ে টাকা নষ্ট করে কী লাভ শুনি?
আবার পাপান বলল, তাহলে শিখে নাও, পাচারের ইংরেজি শব্দ সাপ্লাই। তোমার বাবা তাহলে সাপ্লাই করে?
হেনা ধমকে দিল, ওর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? আমাকে কথা বলতে দে। তোমার নাম তো গুণধর? তা এসেছ কেন বলো?
সেটাই তো বলতে দিচ্ছে না ছেলেটা, আমাকে শুধু শুধু বাধা দিচ্ছে। তুমি তো বাউরি পাড়ার স্কুলে পড়াতে যাও। আমার বাবা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখে। চোখদুটো খারাপ হলে যা হয়। তাই তোমাকে সাবধান করে দিতে এলুম। তোমার দশা কমলার মতো হলে আমি খুব কষ্ট পাবো।
হেনার মধ্যে বিপর্যয়ের ঝড়। একটা অকারণ অস্বস্তির সুনামি শুরু হয়েছে। মতি তখনও বাড়িতে ফেরে নি। চিন্তার ঢেউ এসে মনের বাঁধন ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। গুণধরকে সুধিয়ে বলল, ঠিক আছে বাবা, তুমি এখন যাও, খবর দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ।
আমার আসার খবর কোথাও বলো না যেন।
এভাবে বলছ কেন?
বললুম তো, বাবার উপর রাগ করে এখানে এসেছি। এসব জেনে বাবা আমার উপর রাগ করুক, তা চাইনে। ওই বাবাকে নিয়েই তো চলতে হবে আমাকে।
পাপানের মন ছটফট করছে মতির জন্যে। হেনাকে বলল, কাকু তো এখনও এল না মা? আমার খুব মন খারাপ করছে। হেনা আনমনে সামনে চেয়ে দেখল, মতির বন্ধু আনন্দ হনহন পায়ে এগিয়ে আসছে। তার সাথে রয়েছে নয়ন। একটা কিছু যে ঘটেছে তা বুঝতে হেনার কোনো অসুবিধা হল না। সেই কারণেই কী এত রাত পর্যন্ত মতির পক্ষে বাড়ি ফেরা সম্ভব হয় নি? আনন্দের বিবর্ণ মুখ তা প্রকাশ করছিল। একেবারে সামনে আসতেই হেনার প্রশ্ন, কোনো খারাপ খবর নেই তো?
আনন্দের কণ্ঠস্বর ততক্ষণে কান্নায় বুজে গেছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। আবার হেনার প্রশ্ন, কী হয়েছে বলবে তো?
পুলিশ এসে মতিদাকে তুলে নিয়ে গেছে। স্বরূপনগর থানার ওসি নিজে এসেছিলেন।
ওর অপরাধ কী?
তা জানি নে, শুধু এটুকু জেনেছি, বিভাস সামন্ত মতিদাকে ধরিয়ে দিয়েছেন।
কারণটা জানতে পারলে না কেন?
ওম ঝুনঝুনওয়ালা লোকজন নিয়ে আবার জোর করে রায়চক চর থেকে বালি তুলে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। আমরা মতিদার নেতৃত্বে বাধা দিতে গিয়েছিলুম। তখন পুলিশ এসে….।
বড়ো দারোগাবাবু নিজে এসেছিলেন?
সব কিছু তো আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। ওসি এসেছিলেন নিজের গাড়ি নিয়ে। কোনো কথা না বলে মতিকে তুলে নিয়ে গেলেন। ফিরে যাবার আগে হুকুম দিলেন, দশ মিনিটের মধ্যে রায়চক ফাঁকা করে দিতে হবে।
হেনা ক্রোধে কাঁপছে। ভিতরের আগুন বের হয়ে আসছে হল্কা হয়ে। দাঁত দাঁত চেপে বলল, তোমরা এখন বাড়িতে যাও, বিশ্রাম নাও, দেখছি, ওই দারোগাবাবুর বাহুতে কতটা বল্ আছে।
এসব বলবেন না বৌদি। ক্লাবের ছেলেরা ইতিমধ্যে জড়ো হতে শুরু করেছে। থানা ঘেরাও করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
আনন্দ, আমার কথা শোনো, মতি নেই, আমার উপরে একটু ভরসা করতে পারছ না? যা করার আমিই করব। আগে থানা পর্যন্ত যেতে দাও। এক্ষুণি ঘেরাও করার দরকার নেই। মনে রেখো আনন্দ, আমি গেলে মতিকে থানার লক-আপে বন্দী করে রাখবে, এত ক্ষমতা ওই দারাগোবাবুর বাহুতে নেই।
আনন্দ মতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এতদিন ধরে জেনে এসেছে, প্রশাসনকে কব্জায় রাখতে গেলে বিক্ষোভ ঘেরাও ছাড়া পথ নেই। পরিবর্তে হেনা বৌদি কী নতুন কথা বলছে না? সন্দেহের দোলায় দুলছে আনন্দ। ঝাঁঝালো স্বরে প্রতিবাদ করে বলল, বৌদি তুমিও শেষ পর্যন্ত মতিদার বিপদের দিনে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারলে? মতি তোমার কেউ নয়, আমার নেতা, তার চোখ দিয়ে দেশকে ভালোবাসতে শিখেছি। মতিদা হাত ধরে শিখিয়েছেন মানুষকে উপকার করার মন্ত্র। আর তুমি এত বড়ো বিপদের দিনে আমাদেরকে বাড়িতে বসে থাকতে বলছ? নয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলে আয় রে, মতিদার কাছে জেনেছি, চরম বিপদের দিনে সুবিধাবাদীরা সবার আগে সরে পড়ে।
আনন্দ, আমার কথা মন দিয়ে শোনো, এভাবে রাগ করে চলে যেও না। যা বলতে চেয়েছি, তার ভিতরে ঢুকতে হবে তোমাকে। শুধু থানা ঘেরাও করে ওই হিংস্র জানোয়ারটাকে মানুষ করা যাবে না। আমাকে একটু সাহায্য করো, দেখো, কেমন করে ওই জন্তুটাকে নিজের হাতে বধ করি। আমাকে চেনো না বলেই তুমি এভাবে রাগ করতে পারছ। কঠোর সত্যিটা জেনে নাও, নিজের হাতে বধ করলে ওই জানোয়ারটা নড়তেও পারবে না।
নয়ন আনন্দের হাত ধরে টানছে, হেনার ফাঁকা বুলিতে তার বিশ্বাস নেই বলেই। মাটি কাদার বুক থেকে উঠে এসেছে বলেই অহেতুক কাব্যিকতা তার ভালো লাগে না। এতদিন রিয়ালিটির পথে চলতে চলতে হেনার নতুন কথাকে মিথ্যে আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছে না।
চলবে…