এ এক অন্য আঁধার (পর্ব ১৬)

সকাল আটটা। রায়চক চরের ঘটনাস্রোত তখনও শেষ হয় নি। থানার চারপাশে বহু লোকের আনাগোনা। মানুষের কৌতূহল চরমে। আবার নতুন করে কখন কী ঘটে যায়, সেই ভাবনা সকলের মনে। তারা জানে, মতির যথেষ্ট লোকবল রয়েছে। আকাশ থানায় ঢুকল সাতটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। নিজের ঘরে বসে ফাইল দেখছে একমনে। ভিতরে ভিতরে কেমন যেন বিড়ম্বিত। কোনো হিসেব মিলছে না। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পুঁটিরাম। ভিতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না সে। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করার পর ভিতরে মুখ বাড়িয়ে বলল, নমস্কার স্যার, একবার ভিতরে আসতে পারি?
একদম নয়, get out.
পুঁটিরাম শুধু থমকে গেল না, ভয়ে পিছনে সরে দাঁড়াল। তারও হিসেব মিলছে না। এখন তো বড়ো দারাগোবাবুর মন এত খারাপ থাকার কথা নয়। অথচ কেমন যেন বিচলিত। বাইরে বারান্দার বেঞ্চে বসে হিসেবগুলো নতুন করে মিলিয়ে নিতে থাকল। বার বার মনে হতে থাকল, দারোগাবাবুর তো খুশি হয়ে থাকারই কথা। বাস্তবিক সে দেখছে উল্টো কিছু। মিনিট কুড়ি পরে আবার দরজার ফাঁকে মুখ দিয়ে বলল, আমি পুঁটিরাম বড়বাবু, একটু ভিতরে আসব?
গম্ভীর মুখে আকাশের উত্তর, এস।
পুঁটি ওসির ঘরে ঢুকেই দেখল, লক্আপের মধ্যে মতি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে। তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিল, বেশি ঢ্যামনামি করলে এভাবেই ঘানি টানতে হয়। এত বাড় বেড়েছিল যে ওসির উপরে কথা বলতে শুরু করেছিল। তাকে বলেছিল, তুই কোথাকার হুতি? বাছাধন এবার বুঝুক, নিজেকে সামলে চলা কত বেশি প্রয়োজন। ক্লাব করে বলেই মনে মনে এমন রাজত্ব কিনে ফেলেছিল যে সীমানা মেনে কথা বলার অভ্যেস হারিয়ে ফেলেছিল। ঢ্যামনার ব্যাটা ঢ্যামনা। ক্লাবটাকে দেশের রাজনীতির মূল অংশ হিসেবে ভাবলে দশা এমনিই হয়। আমি ভেবেছিলুম স্যার, আপনিও অন্য সব দারোগাবাবুর মতো মতিকে দেখে সিঁটিয়ে যাবেন। কিন্তু তা হয় নি। অনেকবার পিছন থেকে ওকে সাবধান করে দিয়েছি স্যার। পই পই করে বলেছি, দারোগাবাবুর সাথে লাগিস নে। তো আমার কথা শুনবে কেন? ক্লাবের হিরো, নিজে ঠকে গেলেও কারুর কথা শুনবে না। বিদেশ থেকে টাকা আসছে, সেই জোরে দেশের মানুষকে তুচ্ছ ভাবতে শিখেছে। বেচারা এখন বুঝুক, কত ধানে কত চাল।
আকাশ গম্ভীর হয়ে বলল, আইনের চোখে অন্যায় করলে যে কেউ এমন শাস্তি পেতে পারে পুঁটিরাম।
ঠিক বলেছেন স্যার। আপনাকে দেখেই এই বিশ্বাসটুকু আমার মধ্যে জন্মেছে। যদি অনুমতি দেন তো, এত বড়ো কাণ্ড নিয়ে আমি নিজের মতো করে একটু প্রচার করতে পারি। খাঁচায় বন্দি মতিকে দেখিয়ে বলতে পারি, এ দারোগাবাবু অন্য মানুষ, মতির মতো পান্ডাকে হাজতে পোরার ক্ষমতা রাখেন। এতে স্যার আপনার সুনাম ফুরফুরে বাতাসের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এতদিন মতি ঢ্যামনাকে দেখে এলাকার মানুষের মধ্যে যে ভয় ছিল, তাও কেটে যাবে। এসেই একটা দারুণ সাহস দেখাতে পারলেন স্যার।
আকাশের মুখে হাসি। প্রতিবার এই লোকটা একটা সাধারণ ইস্যু নিয়ে কথা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত কৌশল করে নিজের দায় সেরে নেওয়ার তালে থাকে। আজ আবার কী বায়নাক্কা নিয়ে এসেছে কী জানি। খাঁটি মিছরির ছুরি। পুঁটিরামকে আরেকটু বাজিয়ে নিতে নীচু গলায় বলল, আমাকে আরেকটা তথ্য দিতে পারবে পুঁটি?
কেন পারব না স্যার। মতি সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানা আছে। এখনিই বলে দিতে পারি। আপনি যদি দয়া করে এসব ডায়েরিতে লিখে রাখেন তো সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
মতি সম্পর্কে আর কিছু জানার নেই পুঁটি। ও তো এখন থানার লক্-আপে বন্দি। পিটুনি দিলে সব কিছু গড় গড় করে বলে দিতে বাধ্য হবে। আমি জানতে চাচ্ছি, কমলা নামের মেয়েটা নাকি আপনার ছেলে গুণধরকে খুব ভালোবাসতো। তারপর কী এক অজানা কারণে তাকে পাচার হয়ে যেতে হয়েছে। যদি কিছু জানা থাকে, আমাকে বলে সাহায্য করতে পারো। তাহলে খুব উপকার হয়। দেখছ না, মতি বাড়াবাড়ি করছিল বলেই ওকে ধরে এনে লক্-আপে ঢুকিয়ে দিয়েছি। কমলাকে যে বা যারা পাচার করেছে তাদেরকেও এভাবে শাস্তি দিতে চাই। নেতাজী সংঘের পক্ষ থেকে কদিন আগে একটা দরখাস্ত থানায় জমা পড়েছে। তাতে তো তোমার নামে অভিযোগ রয়েছে। তুমি নাকি ওই পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছ?
কী যে বলেন স্যার! কোন্ কমলার কথা বলছেন, তাও তো বুঝতে পারছি নে।
ভাজা মাছ উল্টে না খাওয়ার ভান করছ পুঁটি? নরেন বাউরির মেয়ে কমলা। সেই মেয়েটার সাথে তোমার ছেলে গুণধরের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারপর কেমন করে একদিন মেয়েটা পাচার হয়ে গেছে। সেটা জানার জন্যে তোমাকে এত কথা বলছি।
এ তো স্যার অন্য আরেকটা ব্যবসা। আমি তেজারতি করি, তাতেই দুপয়সা আসে। পাচার নিয়ে এত খবর রাখব কী করে?
তাহলে কিছুই জানো না?
কী করে জানব স্যার? আমি খুঁদে ব্যবসায়ী, এত বড়ো জাহাজের খবর রাখব কী করে? যারা পারে, তারা পারে।
তোমাকে শেষ খবরটা শুনিয়ে রাখি, গত পরশু মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এখনও পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে, এ ঘটনার সাথে তোমার নাম জড়িয়ে যেতে পারে। পুরো তথ্য আসে নি বলে তোমাকে এক্ষুণি দোষ দিতে পারছি নে। তবে ঘটনার গতিবিধি তোমার বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। কেস যখন আমার হাতে এসেছে, অবশ্যই তলিয়ে দেখব। মনে রেখো পুঁটি, যেই জড়িত থাক, জানাজানি হয়ে গেলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। মনের অজান্তে এসবের সাথে জড়িয়ে পড়লে আমাকে গোপনে বলতে পারো। তাহলে অনেকখানি সামলে নিতে পারব। চেষ্টা করে তোমার নামটাও বাদ দিতে পারি।
কী যে বলেন স্যার। পাচার শব্দের মানেই বুঝি না। জানতে পারলে আপনার কাছে প্রথম আসব। এখন আসছি স্যার। মতিকে সহজে ছাড়বেন না স্যার। ও ঢ্যামনা সাপের মিষ্টি কথায় গলে যাবেন না স্যার। ধরা পড়ার পরে সমগ্র এলাকায় যে শান্তি এসেছে তা আপনার জন্যেই স্যার।
আকাশের মুখে অদ্ভুত হাসি। পুঁটিরামের দ্রুত সরে পড়ার মধ্যেই তার অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে। পড়ল কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। পুঁটির অবস্থা তেমনি। আবার একটু হেসে পায়ে পায়ে লক্-আপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভিতরে মতি মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে। ভীষণ থমথমে মুখ। যেন গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। একটা দুরত্ব যে দুজনের মধ্যে তৈরি হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে আকাশ। মতিও। আকাশ একবার মতির দিকে চোখ রেখে থেমে থেমে বলল, আমার উপর যে খুব রাগ করেছ, তা জানি। কিন্তু কেন তোমাকে তুলে আনতে হল, তা নিয়ে ভাববে না? যদি ভাবো, দেখবে, পুলিশ লাইনে থেকে গতকাল প্রথম একটা মহৎ কাজ করতে পেরেছি। আর যদি মূল্যায়ণ করতে না পারো, আমার ভাবনা বা কাজ তোমার কাছে চরম মিথ্যে বলে মনে হবে।
মতি ব্যঙ্গ করে একটু হাসল। তার মধ্যে তির্যকতার সুর বইছে তিরতির করে। বলল, কৌশলে নতুন ধরণের গরম দেখাচ্ছেন স্যার? হাইকোর্টের অর্ডার মেনে যাদের ধরার কথা তাদেরকে না ধরে আমাকে থানায় ধরে এনে এভাবে বাঁকা মনোভাব দেখাচ্ছেন? ভেবে ঠিক করতে পারি না, আপনি কী পারেন, আর পারেন না।
তোমার কী মনে হয়, পুলিশের কোনো কাজে এতটুকু প্রাণের দায় থাকতে নেই? এমনও তো হতে পারে, বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই জেনেও স্রেফ তোমাকে বাঁচানোর জন্যে তুলে আনা হয়েছে।
আপনি পুলিশ লাইনের লোক, প্রয়োজনে বড়ো বড়ো নীতিকথা বলতে পারেন, প্রয়োজনে নীতি ভাঙার খেলাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। প্রশাসনের অন্দর মহল থেকেই এ স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের উপর ভালো চাপিয়ে দিতে পারেন। আসলে আম-মানুষ কী ভাবে জানেন? এ সব কথা আপনাদের মুখে আদৌ মানায় না। পুলিশ লাইনে থেকে এভাবেই মহাপুরুষ হতে চাচ্ছেন? আপনার ধারণা সত্যি হলে স্বামী বিবেকোনন্দ পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। একান্ত অনুরোধ, আমাকে কোর্টে চালান করে দিন। সেখান থেকে জামিন নিয়ে নেব। মন আর মুখের এত দুরত্ব রেখে কথা বলছেন যে আপনাকে দেখে মনের ভিতরে শুধু ঘৃণা জেগে উঠছে।
খুব সত্যি কথা বলেছ মতি। এতদিন এ লাইনে সেটাই চল্ হয়ে আসছে। নতুন কিছু করার চেষ্টা করলেও লোকে তা বিশ্বাস করবে না। দীর্ঘদিনের ঘৃণা। এত সহজে যাওয়ার নয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে যে পুলিশকে বাধ্য হয়ে অনেক কিছু করতে হয় তা নিয়ে এতটুকু ভাববে না? বাইরে যে পুলিশটাকে দেখে এত ঘৃণার কথা বলছ, তার ভিতরে আরেকটা নতুন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে মতি। সাধারণ মানুষকে হয়তো তা বোঝানো যাচ্ছে না। কিন্তু তুমি তো একটা বড়ো ক্লাবের সম্পাদক, এ সব নতুন ভাবনা তোমার মধ্যে আসবে না কেন? তাহলে অন্তত গোপন সৃষ্টির উৎস খুব তাড়াতাড়ি আম-মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারত।
আপনিও শুনে রাখুন, দেশের সবচেয়ে বড়ো মাস্তানের নাম পুলিশ। কাঁধে সরকারের বন্দুক ঝুলিয়ে নিজেকে ক্ষমতার অন্যতম উৎস হিসেবে ভাবতে শিখেছেন মাত্র। এর বাইরে যে জীবনের অনেক বড়ো সত্যি লুকিয়ে রয়েছে, তা অন্তত আপনাদের মাথায় আসার কথা নয়। কখনো নরম হয়ে, কখনো গরম দেখিয়ে কথা বলেন। আপনারা এমনিই মাস্তান যে প্রয়োজন মনে করলে একজন জনদরদি মন্ত্রীকেও এ্যারেস্ট করতে পারেন। অবশ্য ব্যক্তিগত স্বার্থে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা করেন না। পদোন্নতির হাতছানি তার মূল কারণ। পার্টির নেতাদের কাছে মাথা বিকিয়ে বাঁচাই পুলিশ লাইনের আর এক ধাপ্পা।
আকাশের বুঝতে অসুবিধা হল না যে তার প্রতি মতির ভিতরের ঘৃণা আকাশের মতো উঁচু হয়ে উঠেছে। নিজের খোলস ছেড়ে কিছুতেই বের হতে পারছে না। আকাশের মনে অনুশোচনার বিন্দু বিন্দু ঘাম। এত কিছু করেও কোনো মূল্যায়ন পেল না সে। সামনের বারান্দায় এসে পায়চারি করতে শুরু করল। কয়েক মিনিট পরে সামনে চোখ রেখে চমকে উঠতে বাধ্য হল। হেনা দ্রুতপায়ে থানার দিকে এগিয়ে আসছে। ভীষণ গুরুগম্ভীর মুখ। ঝড়ের আগে থমথমে পরিবেশের মতো। তখনও আকাশ ভাবতে পারে নি যে মতির জন্যে হেনা থানায় আসতে পারে। বরং আসতে পারে না বলেই তার স্থির বিশ্বাস ছিল। অনেকদিন হেনাকে দেখে নি আকাশ। কাছে আসতেই ডাকল, হেনা….।
মতি লক্আপের ভিতর থেকে কান্না ভেজা গলায় ডাকল, বুবান এসেছ?
হেনার মেজাজ তখন পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠেছে, আকাশের অবস্থান আড়ষ্টতার সমুদ্রে। মতিকে শুনিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, শুধু একা থানায় আসি নি, ক্লাব থেকে পাঁচশ ছেলে এসেছে আমার সঙ্গে। ওদেরকে নিয়ে আনন্দ আর নয়ন থানার বাইরে অপেক্ষা করছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত না করে ফিরব না। আনন্দরা চাচ্ছে, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হোক। আমি নিষেধ করেছি। ভালো করেই জানি, থানায় আগুন জ্বললে অনেক সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হবে। তারপরেও থানার মূল চেয়ারে বসে থাকা পশুরুপি মানুষটাকে শেষ করা যাবে না।
আকাশ আবার চাপা স্বরে ডাকল, হেনা….।
কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই হেনার। মতিকে উদ্দেশ্য করে আবার বলতে শুরু করল, মানতেই হবে, পৃথিবীতে জন্তু জানোয়ার না থাকলে পরিবেশে ভারসাম্য থাকত না। থানাও সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে পড়ে। সেখানেও জন্তু জানোয়ার থাকতে পারে। আমাদের মূল কাজ হল হিংস্র জানোয়ারগুলোকে বধ করে সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা।
আমার কথা শোনো হেনা। আকাশের গলার স্বরে ততক্ষণে দুর্বলতার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু তা হেনাকে এতটুকু ছুঁতে পারছে না। কঠিন কণ্ঠে হেনার ঘোষণা, আমি মতিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। কোথায় সই করতে হবে বলুন। এর বাইরে কোনো কথা নয়।
এভাবে আমাকে ভুল বুঝ না হেনা।
দারোগাবাবু শুনুন, এখানে আপনার সাথে এয়ার্কি করতে আসি নি। আপনি আমার রসের নাগরও নন। আপনার মতো পশুরুপি মানুষের মধ্যে সেই জীবনবোধও নেই। খাতা খুলুন, সই করে দিচ্ছি। রসের গল্পে মজে থাকার সময় আমার নেই। আমাকে নাম ধরে ডাকার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আমি হেনা নই, আমার নাম রেহানা।
সমগ্র পরিস্থিতি যে তার বিরুদ্ধে চলে গেছে, তা বুঝতে আকাশের এতটুকু অসুবিধা হল না। চাপা স্বরে বদনকে বলল, লকআপের দরজা খুলে মতিকে বাইরে আনো।
হেনা পায়ে পায়ে লক-আপের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দৃঢ় কণ্ঠে তার প্রশ্ন, তোমাকে কী মেরেছে থানার ওসি?
না না, তা নয়, বরং….।
এতো নতুন চরিত্র দেখছি, বিভাস সামন্ত এত টাকা দেওয়ার পরেও তোমার পিঠে দু’চার ঘা পড়ল না?
আকাশ থ্ হয়ে দাঁড়িয়ে। দুচোখ ভরে হেনাকে দেখছে। এই মেয়েটা এক সময় সারা রাত তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলত। বাড়ি ছেড়ে চলে এলেও শরীরটা ঠিক আগের মতো রাখতে পেরেছে। এখনও তেমনি চনমনে। রাগের মধ্যেও মুখের প্রতিভাসে অনুরাগের ছোঁয়া। হেনার জন্যে আকাশের ভিতরের পশুটা ছটফট করছে। কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলল, একবার আমার কথা শোনো হেনা।
কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই হেনার। কিছু শোনার অবকাশ নেই। মতিবুরকে বলল, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। পশুর সাহচর্যে মানুষ খুব বেশি সময় থাকতে পারে না।
মতি থম মেরে দাঁড়িয়ে। আকাশ পায়ে পায়ে মতির সামনে এসে দাঁড়ালো— একটা কথা শুনে যাও মতি। তোমাকে একটা ভালো খবর দিতে ভুলে গিয়েছি। জানতে পারলে এত বেশি ধন্দে থাকতে হত না। তোমাকে এ্যারেস্ট করার আগে রায়চক চরে আরেকটা লোক খুন হয়ে গেছে। তা কী জানো?
কী বলছেন স্যার?
তোমাকে তা বলতে পারি নি মতি কিন্তু ঠিক তাই ঘটেছে। লোকটার পরিচয় শুনলে তুমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।
মতি অবাক বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে খুব করে চাইলেও লোকটার কথা জিজ্ঞেস করতে পারল না।
নাম শুনে চমকে উঠবে না তো মতি? ট্যারা চক্রবর্তী। রায়চকে এসেছিল তোমাকে খুন করতে। ফলে তাকে না মারলে নেতাজী সংঘের সেক্রেটারীকে বাঁচানো যেত না। তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে তুলে আনা হয়েছে। ট্যারার মরার সাথে তোমার যে কোনো যোগ নেই, সেটাও প্রমাণ করে দিতে পেরেছি।
সেজন্যেই কী স্যার আমাকে এখানে জোর করে….।
বললাম তো, প্রশাসন ক্লাবের নীতি মেনে চলতে পারে না। তোমাকে সেফ করতে এটুকু করতে হয়েছে আমাকে। বাড়িতে ফিরে যাও, ভালো থেকো। প্রাণের দায়ে একটা ভালো কাজের জন্যে তোমার কাছ থেকে কোনো মূল্য আশা করি নি। পারলে মন থেকে ক্ষমা করে দিও।
মতি আবেগ তাড়িত হয়ে ডাকল, স্যার।
তোমাকে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিই, পুলিশ মাঝে মাঝে মাস্তান হয়েও প্রকৃত জীবন ভোক্তার ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা শুধু নিয়ম ভাঙার মাস্তান নই। আমাকে বিভাস সামন্তের সাথে মিল করে দেখলে ভুল করবে।
মতি চাচ্ছিল আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে আরও কিছু শুনতে কিন্তু হেনার মানসিক তাগিদে তা সম্ভব হল না। তখনও একটা বিস্ময়ের ঘোর থেকে সে বের হতে পারে নি। একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ তার মাথায় লাট্টুর মতো ঘুরছে। যে ওসি তার জন্যে এত কিছু করতে পারলেন, না জেনে সে অনেক বাজে কথা বলে ফেলেছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকল মতি।

চলবে…

এ এক অন্য আঁধার (পর্ব ১৫)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!