একটা সূক্ষ্ম পর্যালোচনার দোল শুরু হয়েছে ভিতরে ভিতরে। তাতেই আকাশ দুলছে। জীবনে সে যত অপরাধ করেছে, তাতেই তার জীবন অপরাধ অনুভূতির সমুদ্র হয়ে উঠেছে। চারিত্রিক শক্তি মানুষের মূল পরিচয়। সেটাকেই সে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে নি। এমনিই দুর্ভাগ্য যে হেনার সঙ্গে দেখা হলেও নিজের বাড়িতেও আনতে পারল না সে। দুচোখের সামনে তার যে কালো হাতটা ভাসছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি বলেই সে হেনার উপর তেমন জোর খাটাতে পারল না। বাবা ডুরানি মহাপুরুষের মতো মহৎ প্রাণ। তাঁকেও সে কম অপমান করে নি। তার কালো ডান হাতটাই সেজন্যে দায়ী। অন্যায় পথে রোজগারের জন্যে যে হাত সে পরম আগ্রহ নিয়ে ব্যবহার করেছে, সেই কালো হাত দিয়ে সে রাগের মাথায় বাবার গালে আঘাত করেছিল। প্রতিদিন যাকে মনে মনে অর্ঘ্য দিলে জীবনে ধন্য হওয়া যায়, সেই পথ থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে নিজের দোষেই। বার বার মনে হতে থাকে, নিজস্ব মানসিক বিকৃতির জন্যে যেভাবে অন্যায় পথে চলেছিল সে, তার প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতেই হবে। বৃষ্টির সময় মাথার উপর ছাতা লাগে, না হলে ভিজতে হয়। আকাশের মাথার উপরে দেবতুল্য ডুরানি যতদিন ছাতা হয়ে ছিলেন, ততদিন তার জীবন ঠিক পথে চলেছিল। সারাজীবন কেরানি হলেও কখনো অর্থের লোভে ন্যায়পথ থেকে সরে দাঁড়ায় নি লোকটা। সেই সম্পদকে সে ঠিকমতো মূল্য দিতে পারে নি।
হেনা তার বিবাহিতা স্ত্রী কিন্তু তাকে সে একমাত্র কামনার ধন হিসেবে গ্রহণ করতে পারে নি, বরং প্রেমের নামে একাধিক নারীদেহ ভোগের পথ বেছে নিয়েছে বার বার। এতে যে দাম্পত্য জীবন বাঁচতে পারে না, হেনা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তা প্রমাণ করে দিতে পেরেছে। হেনার নিটোল ভালোবাসাকে নিজেও বুকের মধ্যে বরফ গলা জলের মতো গ্রহণ করতে পারে নি। নীরজ মল্লিক তার শিক্ষক। লোকটা সারা জীবন তার মঙ্গল কামনা করে এসেছেন। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁকেও সে ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ হয়ে চরম অপমান করেছে। অনুশোচনার আগুন আকাশকে বার বার ছ্যাকা দিতে থাকল। আত্মধিক্কার বড়ো হয়ে উঠছে বুকের মধ্যে। হেনা একবার বলেছিল, কালো হাতটাই তার জীবনে কাল্ হয়ে উঠেছে। আত্মনিগ্রহণের তীব্র বান শুরু হল আকাশের মধ্যে। আর অন্য কিছু ভাবা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। চেয়ারে বসে পকেট থেকে পিস্তল বের করে বাম হাতে শক্ত করে ধরে ট্রিগার চেপে পর পর গুলি চালিয়ে দিল ডান হাতে। একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ব্যারাকে থাকা পুলিশরা চমকে উঠল থানার ভিতরে গুলির শব্দে। ছুটে এসে সকলে দেখল, অজ্ঞান হয়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে আকাশ। দ্রুত পুলিশ ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার জন্য। জ্ঞান ফিরল প্রায় বারো ঘন্টা পরে। তারপর থেকে অতীত জীবনের রোমন্থন নিয়ে পড়ে রয়েছে আকাশ।
বদনকে বেডের পাশে দেখে আকাশের প্রশ্ন, মতিকে কী খবর দিতে পেরেছ?
দিয়েছি স্যার। তার প্রতিক্রিয়াও ভারি অদ্ভুত। কী করে এমন ঘটনা ঘটল, সেটুকুও জানতে চাইল না। কিছু সময় চুপ করে থেকে ভারী গলায় শুধু বলল, এও কী সম্ভব?
আমি কেমন আছি তা জানতে চাইল না?
আর কিছু বলে নি স্যার। আমার কেবল মনে হচ্ছে, ডান হাতটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে চাকরি থাকবে তো?
শোনো বদন, শরীরের যে অংশটা দিয়ে সবচেয়ে বেশি অপরাধ করেছি, সেটাই সরিয়ে দিতে পেরেছি নিজের ইচ্ছেয়। এতে অনুশোচনার কী আছে? বাম হাত রয়েছে, ওটাকেই সম্বল করে সব কাজ চালিয়ে নিতে পারব।
বদনের মুখে কোনো উত্তর নেই। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল বুকের গভীর থেকে। বেডের পাশে উদাসীন মুখে দাঁড়িয়ে। ভিতরের সব ভাবনা আবর্তিত হচ্ছে আকাশকে কেন্দ্র করে। একটু পরে অত্যন্ত বিমূঢ় মুখে মতি এসে দাঁড়ালো বেডের পাশে।
আকাশ কষ্ট করে উঠে বসার চেষ্টা করলেও ডান হাত নেই বলেই তা সম্ভব হল না। শেষে বদনের কাঁধে ভর করে বিছানার উপরে উঠে বসতেই মতি কাঁদু কাঁদু হয়ে বলল, এ কী করলেন স্যার?
তোমার মনে নেই মতি, এই হাত দিয়েই আমি তোমাকে অন্যায়ভাবে চড় মেরেছিলাম?
স্যার, ওটা যেমন সত্যি তেমনি সত্যি রায়চক চর থেকে আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে ওই হাত গর্জে উঠেছিল। ওই হাত দিয়েই আপনি ট্যারা চক্রবর্তীকে গুলি করে মেরেছেন। ওই হাত দিয়ে আপনি নটুকে গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছেন। ভালো মন্দ মিশিয়েই তো মানুষের জীবন স্যার।
তুই আমাকে আর স্যার বলে ডাকিস নে। আজ থেকে দাদা বলে ডাকতে পারিস। তোকে আরেকটা কথা শুনিয়ে রাখি, বিভাস সামন্তের সহযোগিতা নিয়ে যে ওম ঝুনঝুনওয়ালা রায়চক চর থেকে জোর করে বালি তুলে নিয়ে গিয়েছিল আজ তাকে এ্যারেস্ট করেছি। দুজনে এখন জেল হাজতে। ভাবলুম, যাবার আগে স্বরূপনগর থানাকে একটু ঠান্ডা করে দিয়ে যাই।
তার মানে আপনি এ থানাতে আর থাকবেন না? কোথায় যাবেন শুনি?
এখনও ভাবি নি মতি। নীল আকাশের নীচে আমার জন্যে অনেক জায়গা রয়েছে।
এভাবে বলছেন কেন স্যার? মতির কণ্ঠস্বর বুজে এল। আকাশের বাম হাত চেপে ধরে বলল, আমার বাড়িতে চলুন দাদা।
তুই একা ক’জনকে পুষবি? সব খবর জেনে ফেলেছি রে। তুই আমার পাপানকে খুব ভালোবাসিস। ছেলের জন্যে বাপ হয়ে নিজে যা করতে পারি নি, তুই কাকু হয়ে সেটাই করে দেখাতে পেরেছিস। তোর এ সাফল্যের আলোয় আমার ব্যর্থতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এও জেনে ফেলেছি, পাপানের মাকে খুব যত্নে রেখেছিস। এতে অন্য ধরণের মজা আছে রে। স্বামী হিসেবে হেনাকে আমি যে স্বাধীনতা দিতে পারি নি, তুই তা দিতে পেরেছিস। আমরা শুধু মুখে নারী মুক্তির কথা বলি, তারপরেও দ্যাখ, প্রশাসনে থেকেও এতদিন সেই বার্তা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছি। এখন ভাবি, নিজে না পারলেও সেই দায়িত্ব সগর্বে পালন করতে পেরেছিস তুই। এও এক নতুন ধরণের গর্ব। একটা অভিযোগ করি, সব দেখে শুনে তুই হেনাকে কেন বলতে পারলি নে আমাকে ক্ষমা করে দিতে। রায়চকে তোকে কৌশল করে বাঁচানোর জন্যে কী এটুকু ভিক্ষে হিসেবে চাইতে পারি না? এ নিয়ে আরেকবার ভাবিস। জানিস তো, পাপ করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। হেনার জন্যে একটা হাত খুইয়ে সেই প্রায়শ্চিত্তটুকু সেরে ফেলেছি। তার পরেও এভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকলে কঠোর বাস্তবে কেমন বেমানান লাগে রে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু থেমে আবার শুরু করল আকাশ, আমার বাপিকে তুই শুধু মেসোমশাই বলে ডাকিস না, ভালো থাকার জন্যে সব রকম যত্ন নিয়েছিস, যেন ছোটো ছেলের আর এক নতুন ইতিহাস। চ্যবনপ্রাস যাতে ফুরিয়ে না যায়, তার জন্যে তোর মনের তাগিদ প্রমাণ করেছে, ওসি হিসেবে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ, ক্লাবের সম্পাদক হিসেবে তুই অনেক বেশি সফল। নিজে যে মূল্যবোধ নিজের কাজে কম্মে ধরে রাখতে পারি নি, সেই মূল্যবোধ নিয়ে ক্লাব চালিয়ে আমাকে একেবারে তুচ্ছ করে দিতে পেরেছিস। জানিস মতি, পাপেরও একটা ছোবল থাকে। তাতেই খুবলে গেছে আমার ডান হাতটা। বিছানার নীচে প্রেসক্রিপশনটা রয়েছে, ওটা হাতে নে, বালিশের নীচে মানিব্যাগ রয়েছে, ওখান থেকে টাকা নে। ডাক্তারবাবু অনেকগুলো ওষুধ কেনার কথা বলে দিয়েছেন। বাজারে যা, সবগুলো কিনে নিয়ে আয়।
বিছানা তুলে প্রেসক্রিপশন নিলেও মতি বালিশের তলা থেকে মানিব্যাগ বের না করে বাজারে যেতে উদ্যত হল। আকাশের প্রশ্ন, টাকা না নিয়ে বাজারে যাচ্ছিস?
বুবান, পাপান, মেসোমশাইয়ের জন্যে অনেক কিছু করেছি, আপনার জন্যে আজও কিছু করতে পারি নি। সেই ঘাটতি পূরণের সুযোগ এসেছে আমার হাতে। ক্লাব করি, একটা সেবার অভ্যেস গড়ে উঠেছে, এত বড়ো অফার কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারছি নে দাদা।
মতির কথার গোলাকধাঁধায় আটকে গেল আকাশ। কী বলবে ভেবে পেল না।
আসছি দাদা, বলে মতি চলে গেল বাজারে। আকাশের কেবল মনে হতে থাকল, তার অন্তরপ্রকৃতি মতির ঢঙে গড়ে উঠলে জীবনে এভাবে হারতে হত না। যত বড়ো ইমারত হোক, তা মাটির তৈরি ইঁটের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দুঃখ, সেই মাটি চিনতে ভুল করে ফেলেছে সে। হেনা বিধ্বস্ত মুখে হাসপাতালের কেবিনে ঢুকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, তাহলে তোমার ডান হাতটা কনুই থেকে নেই?
এর চেয়ে বড়ো কোনো পুরস্কার তোমাকে দিতে পারতুম না হেনা।
এসব কী বলছ?
যে হাত নেই বলে আজ কষ্ট পাচ্ছ তুমি, মনে করিয়ে দিই ওই হাত দিয়ে তোমাকে অন্যায়ভাবে আঘাত করেছিলাম। এখন সেই অন্যায় ইচ্ছেটুকু একেবারে বন্ধ করতে পেরেছি। এজন্যে তোমার খুশি হওয়া উচিত। আঘাত করার মূল মাধ্যমটুকু আজ আর আমার শরীরে নেই। আবার বাপি সত্যের প্রতীক। সেই ব্রতটুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম, তা ফিরে পেতে এছাড়া দ্বিতীয় পথ ছিল না হেনা।
হেনা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। বার বার বলছে, কেন এমন করতে গেলে বলো তো?
ওই হাতটাই ছিল তোমার মূল শত্রু।
এ সব আমি চাই নি গো। শুধু নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তোমাকে নিজের মতো করে চলতে সাহায্য করেছি। কত মানুষ তো এমনি পাপ করে, সময়ের টানে তা শুধরেও নেয়। তুমি কেন তা বুঝতে চাইলে না?
কেঁদ না হেনা, বরং বলো, মন থেকে আজ আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছ তো?
হেনা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কোনো সান্ত্বনা তাকে শান্ত করতে পারছে না। এ অবস্থা দেখে কোনো স্ত্রীর পক্ষে স্থির থাকাও সম্ভব নয়।
আকাশের প্রশ্ন, তাহলে আমাকে মনে মনে ক্ষমা করতে পেরেছ তো?
হেনার মুখে কোনো উত্তর নেই। দুচোখ থেকে ঝরে পড়া জল অন্য কথা বলছে। পাপানকে সাথে নিয়ে ডুরানি কেবিনে প্রবেশ করেও কোনো কথা বলতে পারলেন না। দুঃখের গভীরতায় পাথর হয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বললেন, এভাবে নিজের হাতে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারলি?
বেইমান হাতটাকে আর কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলুম না বাপি। এটাই ছিল বলে নিরীহ শ্রমিকটাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে। আরও অনেক কিছু আছে, ছেলে হিসেবে যা তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারছি নে। এখন বলো, খুশি হতে পেরেছো তো?
মতি ফিরে এল বাজার থেকে। তার হাতে ওষুধের প্যাকেট। আকাশের দুচোখ তার দিকে। মুখে মৃদু হাসি। হাসি যে কত করুণ হতে পারে, তা দুচোখ ভরে দেখল হেনা, ডুরানিও। তোমাকে একটা কথা এখনও শোনানো হয় নি হেনা। মতি আজ প্রথম আমাকে দাদা বলে ডেকেছে। টাকা না নিয়ে বাজারে গিয়ে গেঁটের টাকা দিয়ে আমার জন্যে ওষুধগুলো কিনে এনেছে। আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রতিপালন করতে চাচ্ছে। একটা হাতের বিনিময়ে এত সব বড়ো বড়ো পাওনা, তা নিয়ে একবারও ভাববে না?
মতি আর কিছুতেই নিজের কান্না চেপে রাখতে পারল না। হেনা গুম হয়ে চেয়ে রয়েছে মতির দিকে। ভেঙে পড়া পিতৃসত্তা নিয়ে সেলিম ডুরানি কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। একমাত্র ছেলে আকাশ তখন মনে মনে নিজের মূল্যায়ন নিয়ে ব্যস্ত। চারদিকে এত দূষণের মধ্যে তার বাপি কখনো সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হন নি। সেও পারল ভুলের মাসুল দিয়ে সেই বৃত্তে ফিরে আসতে। একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা আকাশের মনের অন্ধ গলিপথে ঘুরপাক খাচ্ছে। পাপানকে একইপথে গড়ে তুলতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা জল যে বড়ো নদীর জন্ম দেয়, তা চলতে চলতে কখনো উপনদীতে মিশে যায় কিন্তু কখনো নিজের বৈশিষ্ট্য হারায় না। পাপান ডুরানির ডান হাত চেপে ধরে বলল, সত্যি গল্পটা এত আগভাগে কী ভাবে বলতে পেরেছিলে? উপনদী বেশ তো মিশে গেল বড়ো নদীর সাথে।
ডুরানি তালে তালে মাথা নাড়ছেন। বেশ বুঝতে পারছেন, উৎসমূলে সত্যের নির্যাস থাকলে তা কখনো একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে না। জীবনের বিশেষ স্তরে সেই উদ্দীপনা নতুন করে দেখা দিতে পারে ঐতিহ্যের স্মরণীয় স্মারক হিসেবে।
এ এক অন্য আঁধার (পর্ব ১৬)