ঘোড়ার প্রতি আমার পক্ষপাত কে না জানে? আমার শৈশবকাল ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ার দ্বারা আচ্ছন্ন। আমার ঘরের টিনের বেড়ায় জিগার আঠা দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি পেপার কাটিং- কোনটা সাদা কালা কোনটা রঙিন– সিনেমার পোস্টার থেকে মাপে মাপে কেটে ঝুলিয়ে রাখা টগবগ ঘোড়ার ছবি।
কোন ঘোড়ার পিঠে নায়ক মাহমুদ কলি কোনটায় ওয়াসিম বা ঘোড়ায় সামনের পা উঁচিয়ে ভিলেন জসিম হুংকার দিচ্ছে– মুখ হা করে রণ হুংকার। দরজার কপাটে আঠা দিয়ে লেপ্টে রেখেছিলাম নেতাজী সুভাষ বসুর ছবি। একটা তাগড়া ঘোড়ার পীঠে সওয়ার হয়ে নেতাজী এক হাতে লাগাম ধরে আছে আর ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে রেখেছে আকাশে দিকে। সশস্ত্র নেতাজী সচিত্র দেখার চেয়ে আমি বারবার তাকিয়ে দেখতাম– তাগড়া ঘোড়ার ঘাড়ে কেশর ক্ষিপ্র গতির সাথে কাশ বনের মতো দুলছে দুলছে…
রওশন সার্কাস আমাদের এলাকায় তাবু ফেলার আগে অবশ্য টগবগ শব্দ আমি কানে শুনিনি। আটের দশকের গোড়ার দিকে রওশন সার্কাস আমাদের এলাকায় এলো। কী সাজ সাজ উত্তেজনা। অগ্রায়হনের ধান কাটার পর পতিত জমিতেই আকাশ সমান উঁচু করে অনেক বড় জায়গা নিয়ে লাল রঙের ত্রিপলের ছাদ হলো।
সেখানে নানা রঙের নানা সাইজের ঘোড়া মাথা নিচু করে গামলায় জলে খৈলে মিশানো খাবার খাচ্ছে। রেলিঙের এপাশ থেকে বন্ধুদের সাথে আমিও দেখছি– ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে।
আরও পড়ুন: পাতিল হাঁটি ও জ্যোতির শৈশব
ঘোড়ার খাবারের পরই একেক জন সাওয়ার হয়ে রাস্তায় নামে। সবাইকে দেখাতে সবাইকে জানাতে– ”দেখ, দেখো গ্রামবাসী আমরা এসেছি আমরা এসেছি। চলে এসো সার্কাস মাঠে” বিজ্ঞানের।
তখনই টগবগ শব্দটি কানে এলো। মাইকম্যানের ঘোষণায়। এমনি আমাদের মফস্বল শহরের ইটের সলিং করা রাস্তায় গোটা দশেক ঘোড়া লাফাতে লাফাতে চলছে এই মাথা থেকে অন্য মাথা। দুই পাশে নানা বয়সের মানুষজন। তাগড়া ঘোড়া টগবগিয়ে চলছে খুরের আঘাতে আঘাতে।
এর আগে এতোগুলো তাগড়া ঘোড়া আমার মফস্বল দেখেনি। যে কটা ঘোড়ার গাড়িতে করে গণপদ্দী থেকে ধান বা পিয়ারপুর হতে মুদী মহাজনের সওদা অথবা ইসলামপুরের মুটা গুড়– সেই সকল ঘোড়া কেবলই ক্লান্ত ভগ্ন স্বাস্থ্য– তেজহীন।
টগবগের শব্দের সাথে আমরা শিখলাম চিঁচিঁ চিঁচিঁ ডেকে ওঠা তাগড়া ঘোড়ার ফুলে ওঠা কেশর। লাল কালচে লোমে ঢাকা ঘোড়া পিঠ আমাদের মাথাকে ছাড়িয়ে গেছে; গোড়ালি উঁচু করেই তবে ঘোড়া পিঠে পাতা ঝালরযুক্ত আসন ঝুলে পেটের নীচে চলে এসেছে।
ঘোড়ার লাগাম ধরে যখন লম্বা লোকটি আমাদের চোখের সামনে দিয়ে দাবড়িয়ে গিয়েছে তখন আমার চোখ ছানাবড়া। আহা! আমি যদি ঘোড়সওয়ার হতে পারতাম! তারপর সকলের সাথে সার্কাসে দেখেছি ঘোড়ার নানা ক্যারদানি।
শৈশব থেকে ঘোড়া আমার সঙ্গী– স্মৃতি আর স্বপ্নে। চাবুক হাতে লাফ দিয়ে ঘোড়ার পীঠে ওঠবার ক্ষীপ্রতা আর জিনে পা রেখে লাগাম ধরে ছুটবার সময় শরীর ও ঘোড়া দুলকি চালের ছন্দ তা আমার এখনো স্মৃতি আর স্বপ্নে। জেগে থাকি কিংবা আমাকে জাগিয়ে রাখে।
পিকনিক স্পটে গেলে ঘোড়ার পিঠে উঠে এক চক্কর না দিলে আমার চলে না। ২ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম এখন ২০ টাকা নেয়।
ঘোড়ার লাগাম ধরে যখন চক্কর দেই নিজেকে তখন মাহমুদ কলি বা ওয়াসিমের মতো লাগে। আমার কুট্টিকালের নায়কেরা ঘোড়ায় চড়ে বাঁকানো তলোয়ার দিয়ে মারামারির সিন দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তাম রূপালী সিনেমা হলে।
চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, টক্কর, সিপাই সিনেমা দেখে দেখেই ঘোড়ার প্রতি পক্ষপাত। বছর কয়েক আগে এক থালা আগুনরোদ মাথায় নিয়ে আমার শহরে খুব জোরে জোরে হাটছিলাম রাগে কষ্টে যন্ত্রনায়– তখনই দেখি টকটক করে কালো রাস্তা কাপিয়ে লেবু মিয়া আসছে।
পাক্কা সড়কে ঘোড়ার টগটক শুনতে শুনতে মনটা ভরে উঠল। ভেতরে ভেতরে নিজেকে ওয়াসিম ওয়াসিম মনে হচ্ছিল। হাত উঁচু করতেই লাগাম টেনে মুচকি হাসল।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন
লেবু মিয়া– পেশায় কাঠমিস্ত্রি;বলেছিলেন, “আমি হেড মিস্তিরি।” সাকিন হাতি আগলা– গ্রাম নন্দী বাজারের উত্তরে। অনেকদিন পর সেদিন হঠাৎ লেবু মিয়ার মুখোমুখি। ছুটছেন তিনি নতুন যে বাসায় কাজ নিয়েছে সেখানে। যোগালি আগেই পৌঁছে গেছে।
দুই সংসারেও তিনি ঘোড়সওয়ার। দুই স্ত্রীর প্রতি সমান পক্ষপাত। দিন ভাগ করা। টোটকা গাছন্ত ঔষধও দেন। কবিরাজ হিসেবেও প্রান্তিকে নাম ডাক আছে।
কথাতে ঝাঝালো জমিদারী টান। ছোট বেলায় থেকেই ঘোড়ার প্রতি অসীম মমতা। ঘোড়ার স্নান খাওয়া আস্তাবলে রাখার পর নিজের খাওয়া দাওয়া। ঘোড়ায় চড়তে আপনার কেমন লাগে। বললেন “শাহেনশাহ।”
“যখন কাজ করি তখন কামলা আর যখন ঘোড়া নিয়ে টগবগ টগবগ করে ছুটি তখন আমি শাহেনশাহ” লেবু মিস্ত্রীর বাপেরও ছিল তাগড়া বাদামী ঘোড়া। ইসলামপুর মাদারগঞ্জে, দেওয়ানগঞ্জে ঘোড়া নিয়ে হাটে যেতেন।
বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না।পায়ে গুতা দিয়ে আবারো ছুটলেন লেবু মিয়া। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক থালা আগুনরোদে আমার মাথা পুড়ে খাক। মনের ভেতর একটা ঘোড়া নিয়ে টকবগ টগবগ করে আমি যেন কুদ্দস বয়াতি– গুনগুন করতে করতে বাড়ি ফিরে এলাম।
“আমার পাগলা ঘোড়া রে
কই মানুষ কই লইয়া যাও।।
ওলু গুলু নদী নালা খাল বিলা
পাহাড় পর্বত টানা টিলা
গেরাম বাড়ী দারুণ ঘোরা চলে ধীরে ধীরে
মাঝে মধ্যে টক্কর মাইরা শুন্যে উড়াল মারে।।”