গারো পাহাড়ের চিঠি: নাজনীনের নকশা!

বছর বিশেক আগে যে-সকল ছনে ছাওয়া মাটির ঘর এই তল্লাটে দেখেছিলাম; এখন ক্রমেই সেই সব পড়তির দিকে। এখন সেখানে দু’চালা চৌচালা টিনের ঘর। কোথাও কোথাও আবার হাফ-বিল্ডিং। রঙ করা। দেয়ালে সবুজ রঙের কাজ করা লতাপাতা আর ফুলের সমাহার। এই উত্তর প্রান্তিকে নয়া নয়া দালান নতুন সংযোজন। সদরের সাথে যোগাযোগ ভালো। পিচের রাস্তায় সাঁই সাঁই করে চলছে মোটরগাড়ি। গত শতকের আটের মাঝামাঝিতে যখন আমি সীমান্ত অঞ্চলে আসি তখন ইটের সলিঙের রাস্তা আবার কোথাও কাঁচা… সাইকেল আর দুই পা শেষ ভরসা।

মাটির ঘরে একবার রাত কাটিয়েছিলাম। সেইবার ছিল গরমকাল। এপাশ ওপাশ করছি তবুও ঘুম আসছিল না। মাটির দেয়ালে তেছরা করে কাটা ছোট্ট জানালা- বরং বলা ভালো খুপড়ি- সেই খুপড়ি দিয়ে চাঁদের আলো গোল হয়ে কখনো মেঝের একপাশে কখনো অন্য পাশে সরে যেতে যেতে পুরো ঘর যখন অন্ধকার গুহা তখনই আস্তে আস্তে নেমে এলো শীতলতা। শরীর জুড়ানো শীতলতা।

এখানেই ছনে ছাওয়া মাটির ঘরের অনন্যতা। গরমে ঘরের ভেতর শীতলতা আর শীতে একটু বেশিই উষ্ণতা। আর বর্ষার জবজবে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। আজ অনেকদিন পর সেই বাড়িতেই ফিরে এসেছি।পাল্টে গেছে সময়ের সাথে সবকিছু। চারদিকে গোটা পাঁচেক মাটির ঘরের মাঝখানে টানটান মলন দেবার উঠানটি আর নেই। সেবার কী আনন্দই না পেয়েছিলাম এই জল মাটি আর গোবরে তৈরি ফকফকা ধবধবে মলন দেবার উঠান দেখে। এখন সিমেন্টের চাতাল।

উঠানের একপাশে গোলাঘর। বড় বড় ডুলা পাশাপাশি। তাতে সারা বছরের ধান। সিদ্ধ করো আর ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল করো। সিদ্ধচাল। আতপ চাল। কালো জিরা চালের আতপ। ঘ্রাণওঠা আতপ। বাঁশের বেতের ডুলায় মাটি আর গোবরের লেপাপোঁছা। অন্যপাশের বাতায় ছিক্কায় ছিক্কায় রাখা বীজধান- আগামী মৌসুমের বীজধান মাটির হাড়িতে রেখে দিয়েছে প্রায় একটা অন্ধকার কোনে।

সেই গোলাঘর আর নেই। মেশিনে ছাঁটাই হতে না হতেই ক্রেতা হাজির। নিমিষেই বেচাকেনা শেষ। কৃষক বাড়ির কৃষিজাত পন্যের আহরণ ও সংরক্ষণ নিয়ে যে হাড়ভাঙা খাটুনির উৎসব ছিল- সে সব আর নেই। মলন দেবার তাগড়া গরু নেই; নেই তেল-মাখা কুচকুচে বড় বাঁকানো শিঙের মহিষ।

প্রশস্ত উঠানে যখন নগেন রাজবংশি গোটা পাঁচেক তাগড়া গরুর নিয়ে মলন দিতো, দেখতে দারুণ লাগত। চক্রাকারে ঘুরছে গরুগুলো। আর মাড়াইয়ের পরও ধানের আঁটিতে থেকে যাওয়া ধানগুলো আলাদা করার জন্যই মুলত মলন দেয়া। বারবার ঘুরছে গরুগুলো। চক্রাকারে। পেছনে হিসহিস হুসহুস হেঁট হেঁট করে নগেন কখন গরুর লেজে গোড়ায় গুঁতো দিচ্ছে আবার কখন পাজনের মারে পায়ে পায়ে ঘুরছে গরুর দল।

একটা বিষয় খুব খারাপ লাগত আমার। ইচ্ছে হতো দৌড়ে গিয়ে খুলে ফেলি গরুর মুখে পরানো ঠুসিগুলো। তুমি কি ঠুসি দেখেছো? আচ্ছা বলছি, বাঁশের কাবারি দিয়ে বানানো ছোট্ট এক ধরনের খাঁচা। মলনের সময় মুখে পরিয়ে দেয়। দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে শিং পেঁচিয়ে গলার দড়ির সাথে। যাতে করে ধানের ছরায় গেলে থাকা ধানসমেত খড় খেয়ে ফেলতে না পারে। আবার খেতে শুরু করলে নিমিষেই সাবাড়। তাঁকে আর চক্রাকারে ঘুরানো যাবে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খড় খেতে খেতে জাবড় কাটবে মুখে ফনা তুলে।

সময়ের দাপটে সব নকশা পাল্টে গেছে। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন নকশা। পুরাতন নকশার ভেতর এখনো আমার যাপন বলেই এখানে আসার কিছুক্ষণ পরই এক ধরনের অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। নতুন নকশার সাথে পুরাতন নকশার দ্বন্দ্ব থেকে চাগিয়ে ওঠা অস্বস্তি। অবশেষে ফিরে এলাম- আমি ফিরে এলাম। যেন কোন জরুরি কাজ ফেলে এসেছি। এক্ষুনি ফিরতে হবে। অথচ একরাত থাকব বলেই গিয়েছিলাম- কিংবা ক’টাদিন!

তোমাকে লিখতে লিখতে নাজনীন হকের মেইল পেলাম। বার দুয়েক পড়ে মনে হলো তোমাকেও পাঠাই। তুমিও প্রাপক হও। প্রাপক প্রেরক সম্পর্ক একটি ব্রিজিং সম্পর্ক। পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক। প্রাপকে প্রাপকে একটি আন্ত:প্রাপক সম্পর্কের প্লাটফর্ম। এমন সম্পর্কের গণিত দিয়ে আমাদের রসায়ন- আমাদের জীবনের রসায়ন।

আজকাল কী নিদারুণ এই সম্পর্কের ব্রীজগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে জাস্ট অহংবোধের তাড়নায়- অপর সত্তার প্রতি সম ও সহ মনোভঙ্গির চর্চা আর চর্যা নেই বলে। মনের ভেতরে ‘পরস্পর পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ডাকার’ ভাব ও ভাবনার বীজ তো থাকতে হবে, তাই না? রোপিত বীজ তো মাটি ফুঁড়ে দু’টি পাতার চারা চোখ মেলে।

নাজনীন একটা স্কুল চালায়। বাচ্চাদের। একপাশে বসতঘর অন্যপাশে স্কুল- অরণি স্কুলের কক্ষ। মাঝের জায়গাটিই উঠান। বাচ্চাদের উঠান আর বসতের উঠান একাকার। স্কুলের সময় বাচ্চাদের অন্যসময় নাজনীনের।চারদিকে নানা গাছের বিস্তার আর ধানক্ষেত- কখনো বিরান কখনো উন্মুখ পোয়াতি ধানক্ষেত।

অরণী নামটি চমৎকার না? তুমি শুনলে খুশি হবে যে, এর অর্থটিও চমৎকার। নামে যেমন ম্যাজিক ও মিউজিক- অর্থেও- ‘যে কাঠের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে’- নাজনীনের অভিস্পাও তাই। নিজের মতো করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আনন্দে চালাচ্ছে অরণী স্কুল।

নাজনীন উচ্ছ্বাস প্রবণ- শিক্ষার্থীদের পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বৃষ্টি এলে স্কুলের উঠানে; নাজনীনের বসতের উঠানে দলবেঁধে নেমে পড়েন বৃষ্টিজলে স্নাত হতে। বর্ষা তো শুধু বইয়ে পড়া বর্ষা নয়- বর্ষা ঝরঝর ধারাপাত বৃষ্টির জলে হাপুসহুপুস করাও বটে। মন দিয়ে প্রাণ দিয়ে বাদল দিনকে আবাহন করা অবগাহন করা। আবার কখনো বিকেলের ছায়া মেলে দেয়া উঠানে চলছ গান বা নাচের ক্লাশ।

সবকিছুর সাথে সবাইকে নিয়ে যৌথ আনন্দভোজ- এই উঠান- এই নাজনীনকে ভালো লাগে। এমন কাজে কমিটমেন্ট লাগে- ডেডিকেশন লাগে আর লাগে কিছু মানুষের নানা কুকথা অকথা শুনবার ধৈর্য। সে যাক- চল, নাজনীন হকের চিঠি পড়ি।

‘আমার স্কুল ঘরগুলোর চারপাশে ধানের ক্ষেত থাকায়, আমার বেডরুমেও বহু রকমের কীট পতঙ্গের বাস। এদের সবটাকেই আমার ভালো লাগে এমন নয়, তবে, তাড়ানোর উদ্যোগ নেবো এমন ভাবনাও মাথাতে আসেনা কখনও।

রাতে আলো নেভালেই দলবেঁধে জোনাকিরা ঢুকে পড়ে আমার ঘরে। আমাকে তাদের সাথে খেলতে হবে এমন আবদার নিয়ে! ভাবছো, জোনাকি কী ভাবছে তা আমি ক্যামনে জানলাম?

আরে না!
ওমনটা হলে আমার ভাল লাগবে তাই ওভাবে ভাবা! কে জানে হয়তো তাদের কাছে আমার অস্তিত্বই নেই! না থাকলে নাই!

আর ঘরে গোটা কয়েক কুনোব্যাঙ আছে। এরাও সন্ধ্যার পর বের হয়ে আমার সামনে আসে লাফাতে লাফাতে।
অসংখ্য সাপও আশেপাশে।
ধানের ক্ষেতে করা ইঁদুরের গর্তে তাদের বাস- গোখরা সাপের বাস।
আমি এদের সাথেই কথা বলি!
এক্কেবারে যে মনের কথা তা কেবল এদেরকেই বলা যায়। গুইসাপটা কাজ সেরে আমার অফিসকক্ষে সোজা ঢূ্ঁকে পড়ে। তার অবলীলায় যাতায়াত আমাকে প্রাণিত করে। অথচ দেখো, কতক মানুষ আমার কাছে চা খেতে আসবে শুনলেই কেমন যেন অনিরাপদ বোধ করি।

হায়রে!
মানুষ কিনা শেষে অনিরাপদ প্রাণীর খাতায় নাম লিখিয়ে ফেললো
এ লজ্জা কোথায় রাখি!’

নিমিষেই পড়ে শেষ করা যায় বটে- কিন্তু নিউরণে রেশ থেকে যায়। আবেশ থেকে যায়। ভাবনা থেকে যায়। অস্বস্তিও থেকে যায়। নাজনীন নিত্য হাসি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটের কোণে মায়ায় ও মায়াবীতে। নাজনীনের নকশা সকলের সাথে সকলকে নিয়ে- তবুও কোন প্রাণী- কোন কোন প্রাণী; কেউ কেউ গোখরা সাপের চেয়ে বেশি আরো অধিক অনিরাপদ।

চলবে…

ছবিঋণ: জ্যোতি পোদ্দার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!