গারো পাহাড়ের চিঠি: সাধু আন্দ্রিয়ের মিশন ও শান্তিধামে আড্ডা

ফাদার ডেভিড মৃথার উঠানে বৃত্তের মতো গোল হয়ে চলছে খোশ গল্প। সমতল থেকে একটু উঁচুতে টিনসেডের ইটের ঘরে তিনি থাকেন। টিলার একপাশ দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি- মাটি কেটে কেটে বানানো। উপরে উঠার পাশেই সমতলে স্কুল- লম্বা স্কুলঘর। লালচে মরীচিকা নিয়ে ঢেউ টিনের দোচালা ঘর। সামনে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ঘাসের কার্পেটে। হাতের ডানে অতিথিদের বসবার জন্য শান বাধানো গোল ছাতার মতো উদাম ঘর আর ঘাস বিছানো প্রশস্ত পরিসর চোখের কোনে ঝুলে থাকে।

সিনা টান করা নানা গাছের সংসার এখানে- কী নেই এখানে? শালের সাথে আম, জাম, কাঁঠাল, চালতা, বেল, জামরুলের সমাহার। আছে হরেক ফুলের পাশাপাশি বাস। বাতাসে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়লেও যে যার মতো করে ফুটছে আর ঝরে পড়ছে। বাগান মানে তো আর এক ফুলের বাগান নয়- বাগান মানে শত ফুলের বাগান। এখানে সব কিছু জড়িয়ে ছড়িয়ে একটা ধ্যানমগ্ন চাতাল। অনেকখানি উঁচুতে চৌকোনা ইটের গাঁথুনির গলায় ঝুলে আছে গীর্জার ঘণ্টা। কতদূর- কতদূরে ছড়িয়ে পড়ে গীর্জার গম্ভীর ঢং ঢং ঢং। কাছের থেকে অনেক দূরে থেকে ঢং ঢং ঢং শুনতে দারুণ লাগে।

ক্রশ চিহ্নিত গেইটে লেখা- সাধু আন্দ্রিয়ের মিশন ও শান্তিধাম। ঢুকতেই চোখে পড়ল মথি লিখিত সুসমাচারটি ‘knock the door and it will be opened unto you.’ সত্যিই তো দরজায় কড়া না নাড়লে কে আর কবে দরজা খুলেছে? আমি কি তোমার দরজায় একাধিক বার কড়া নাড়িনি?

গোল ছাতার মতো বসবার উদোম ঘরের পাশে ঝুলিয়ে রাখা সাইনবোর্ডে ‘হরিনী যেমন জলস্রোতের আকাঙ্ক্ষা করে, তেমনি, হে ঈশ্বর,আমার প্রাণ তোমার আকাঙ্খা করিতেছে’- মোটা হরপে নীল জমিনে সাদা রঙে আঁকা। শুধু কি ঈশ্বরের টান- তোমার জন্য কি আমার মন জলস্রোত না? অথবা যে তুমি ধ্যানমগ্ন যে তোমার মন গভীর অতল অকম্পিত মন সেই মন কি জলস্ৰোত না? তোমার মন কার দিকে ধাবিত সেটিই শুধু আমি জানি না।

মনে পড়ে গেলো শেষ বার যখন তুমি আমার সাথে এলে খুব নীরবে বসে রইলে টিলার চূড়ায় যীশুর সমাধি চিন্তিত শান বাঁধানো বেদীর উপর। কেমন লাগছে বলতেই তুমি ভারি গলার বলে উঠলে বড্ড কথা বলো তুমি। বাচাল কোথাকার- শুনে আমি চোখ ছানাবড়া করে থ মেরে বসে রইলাম টিলার কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা পাকুড় গাছের দাঁতের মতো বেড়িয়ে থাকা শেকড়ের ওপর।

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: ভরা বর্ষার জলে যৈবতী বিলকন্যা

এমন ধ্যানী তো তুমি নও। তুমি তো কলকলিয়ে ওঠো। এখানে এলেই এই টিলার উপরে এলেই তুমি এক- অন্য তুমি। এক অপরিচিত তুমি। টিলার গায়ের মাটি আর পাথর শরীর কেটে উপরে উঠবার সিঁড়ি। টিলার ঢালু পথ থেকে প্রতিটি বাঁকা এক একটি স্তম্ভ। ক্রসের স্তম্ভে যিশুর কষ্ট ভোগের প্রতীকী রূপায়ণ। প্রথম থেকে সমাধি পর্যন্ত চৌদ্দটি ধাপ।

উঠবার সময় তোমার উচ্ছলতা তোমার লকলকে বেড়ে ওঠার স্বভাব প্রথম ধাপে এলেই তুমি অন্য কেউ হয়ে ওঠে। ছলছল করে ওঠে নবম ধাপে যিশুর তৃতীয় বার পতনের আগে অষ্টম ধাপে জেরুজালেমের ‘স্ত্রীগণের’ সাথে তুমি বিলাপে বিলাপে তোমার বুক ভাঙে। সে বার তুমি বলছিলে, ‘আমি সে সময় ইহাদের সাথে ছিলাম। আমি ইহাদের কেউ একজন।’

যিশুর পোশাক খুলে নেবার দশম ধাপে এসে তুমি মাটি আঁকড়ে বসে পড়লে। তুমি চোখ তুলে দেখলে যিশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হচ্ছে। রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে জেরুজালেম থেকে গারো পাহাড়ের এই টিলার উপর থেকে বয়ে যাচ্ছে কংস নদে ভোগবতী নদীর বাঁকে বাঁকে…

প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে ঠিক এই খানে এই টিলাতে ক্রুশ থেকে নামানো মৃতদেহ থেকে বিচ্ছুরিত আলোর মিহিদানা রশ্মি মেখে সর্বোচ্চ চূড়ায় চৌদ্দতম ধাপে সমাধির পাশে তুমি করে বসে রইলে। নিশ্চলা হয়ে বসে রইলে।

আজকের এই সান্ধ্য আড্ডায় চুপ করে বসে থেকে ভাবছি সে দিনের কথা। ঢেউয়ের মতো কথা একবার উপরে উঠছে আরেকবার নামছে আবার সমস্বরে হাসির বলকে কথা ছড়িয়ে পড়ছে বৃত্তকার আড্ডার পরিসরে। ঢেউয়ের চাপান উতরে আমি স্রেফ নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক। কোন কথাই মনে ঠাঁই পাচ্ছে না।শুধু আড্ডার গোলকে কথার ফোয়ারায় আমার শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে।

সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ম্যাসেজ করলে ‘এমন ধ্যানমগ্ন বলয়ে নীরবতাই একমাত্র ভাষা। ‘Just sit and do nothing.’ তখনই বুঝলাম। আমার কয়েকটি শব্দে কেন এতো বাচালতা ছিল! আজ অনেক দিন পর এসে সে কথা মনে পড়ে গেলো। আজকের ফাদারের উঠানে সবাই উচ্ছল আমিই শুধু বোবা। এই বোবা শারীরিক বোবা। কথা বলছি না শুধু। দেহকে চেয়ারে আটকে রেখেছি বটে- মন আমার বিশ্ব চরাচরে ঘুরছে। যে মন ধ্যানস্থ নয় দেহের স্থীরতা সেখানে কেবলই জড়- অনড় জড়। নিষ্ফলা জড়।

তুমি যখন এই উঁচু টিলার সমাধি ফলকের পাশে জাস্ট বসে থাকো- বসে থাকার জন্য বসে থাকো; তোমার মন কি তোমার ভেতর থাকে? এই প্রশ্নটি কখনোই করা হয়নি তোমায়। আমি কোন ভাবেই আমার মনকে আমার কাছে আমার পাশে আমার ভেতর রাখতে পারছি না। এই মন বিচ্ছিন্ন দেহ জড় হয়ে আছে নদীতে ছড়িয়ে দেয়া জেলের জালের মতো। ছড়িয়ে যাওয়া মন কি করে গুটিয়ে আনব? এই জটিল প্রশ্ন নিয়েই আড্ডায় বসেছি- বসে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে প্রশ্ন থেকেই সরে যাচ্ছি। প্রশ্ন ভুলে যাচ্ছি। অন্য কথা অন্য ভাবনা ছড়ানো জালে ওঠে আসছে- যেমন জেলে জাল টেনে টেনে তীরে তুলে এনে জাল ছাড়াতে ছাড়াতে দেখে মাছ ধরা পড়েনি- রয়েছে শুধু কালো কুচকুচে ভাঙা ডাল পঁচা এঁটেল মাটির দলা ভাঙা চিরুনি শামুক কিংবা কবেবার ফেলা দেয়া ন্যাকড়া আর অর্ধবৃত্তের চাপের মতো কাঁচের চুড়ি।

উঠানের অন্য পাশে রান্নাঘর- বয়সের ভারে ভেঙেচুরে গেছে। তারপাশে ছোট্ট একটা গেস্টরুম- এটাচাড বাথ। ক্লান্তি ও অবসাদে এই অতিথি ঘরে কখন যে চলে এসেছি মনে করতে পারছি না। মনই এখানে নিয়ে এসেছে না দেহ- তা ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পাটছি না। ছোট্ট বারান্দা- গোটা চারেক জন দাঁড়াবার মতো একটা বর্গক্ষেত্র। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। ছোট্ট পরিসর। রঙিন ফুলে ছাপমারা বেড শিড বিছানো খাট। রয়েছে কোল বালিশও। টেবিলের উপর দেয়ালে হেলান দেয়া ক্রুশ বিদ্ধ যিশুর ফোটোগ্রাফ- সাদা কালো; দশ বাই ষোল ইঞ্চি কাঁচের ফ্রেমে বাঁধা। যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখশ্রী একটু ঝুঁকে আছে ডান দিকে। কতক্ষণ যিশুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধ হয়। শুধু কোন এক দূর থেকে সেই কবে শোনা হরি হরণের স্বর ও সুর ভেসে আসছে ভেসে আসছে…
‘Darkness coming round
And everybody fighting with their brothers
Everybody wants control
Don’t hesitate to kill one another
So come back Jesus
Come back and save the world.’

আড্ডার শোরগোল কানে ভেসে আসতেই আচমকা ঘুম ভেঙে যায়।সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়েছি মনে আছে; ঘুমদেবী কখন কোলে টেনে নিয়েছেন তা জানি না। জানলা খুলে উঁকি দিতেই দেখি তখন আলাপ চলছে। হাত মুখে জল দিয়ে মুখ তোয়ালে মুছতে মুছতে আমি আড্ডা বৃত্তের বিন্দু হয়ে গেলাম।

ফাদার ডেভিড দিল খোলা মনের মানুষ। যখন হাসেন চোখে মুখে হাসির ঝর্ণা নিয়েই হাসেন। চমৎকার লাগে। বুকে ক্রুশ ঝুলিয়ে পাদ্রী পোশাক পরা রাশভারী ফর্সা চামড়ার ফাদারের যে ছবি আমার ভেতর খোদাই করা ছিল তা নিমিষেই ভেঙে খান খান হয়ে গেল ফাদার মৃধাকে দেখে। ফাদার ডেভিড পায়ের উপর পা রেখে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছেন। হাফ হাত প্রিন্টের শার্টের সাথে কালো প্যান্ট। ইন করা। বেল্টের বকলস ডান দিকে সরে গেছে খানিকটা। পায়ে বাটা কোম্পানির ছইঅলা স্যান্ডেল। পোলিশ নেই মনে হলো অনেকদিন। ধুলায় সাদা হয়ে আছে। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলার ফাঁকেই দেখলাম গলায় ক্রুশের চিহ্ন কালো তাগিতে ঝুলছে। হাতে ঘড়ি। চুলে এখনো পাক ধরেনি। ছেলেরা বাইরে- ঢাকায় পড়ছে। কোয়াটারে স্ত্রী থাকেন। আর ফাদারকে সহায়তা করার জন্য রয়েছে কয়েকজন। ইসকিয়া সাংমা তাদেরই একজন। ফাইফরমাশ খাটেন। বাজারঘাট করে আনে। ঘর দোর পরিস্কার- এমনকী গেইট পাহাদারও- সবই তাঁকে করতে হয়; চাকরি বলে নয়- সেবা; খ্রীস্টের সেবা।

অনেকের মাঝে বসলে যা হয় আমার এখানেও তাই হলো। আবিষ্ট শ্রোতা হয়েই বসে থাকি। কথা বলতে পারি না। জড়িয়ে আসে শব্দাবলি। ঠিকঠিক শব্দে সাজাতে পারি না কোন বাক্য। অপরকে আকৃষ্ট করতে পারি না। ঠিক কোথা থেকে শুরু করব এমন ভাবতে ভাবতে আধেক কথা ঢোক করে গিলে ফেলি কিছুটা লজ্জায় কিছুটা বাহুল্য মনে হয়- কী হবে এতোটুকু বলে; বরং এখান থেকে শুরু করি। আর তখনই- বিপত্তি ঘটে। মুখের ভেতর শব্দ জড়িয়ে যায়। নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক হয়ে ওঠে।

তুমি আজকে থাকলে আমিও একটু পরিসর পেতাম। খুব করে ভেবেছি তোমাকে।শুধু পাশাপাশি বসে সঙ্গ দেয়া নয় বরং চা চক্র মাতিয়ে তোলার জন্য তোমাকে খুব করে চেয়েছি। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই তুমি কেমন জানি প্রানবন্ত হয়ে ওঠো। আড্ডা হয়ে ওঠে সপ্রাণ আড্ডা। এমন তরতাজা আড্ডার জন্যই তো আমরা মুখিয়ে থাকি। আড্ডা আড্ডারুদের ফিলিংস স্টেশন।

টিলা যেখানে থকে উপরে উঠে গেছে সেখানকার তুমি আর সমাধি ফলের পাশের তুমি কিংবা সমতলে গোলক আড্ডার তুমি- কোনটার সাথে মিল নেই। আকাশ পাতালের যে অমিল তার চেয়ে অধিকতর অমিল এই স্থান ভেদে তোমার বিভাব।

অনুভবে যতটুকু ছুঁয়ে যাই ঠিক ততটুকু শব্দে আঁকতে পারি না। এটি আমার ব্যর্থতার ফর্দে এক নম্বর। সেটি জানি বলেই শুধু মুগ্ধতায় মুখরিত থাকি। সঙ্গ দোষে দোষ গুণ নিয়ে চলি তোমার সাথে। তোমার সঙ্গ ভালো লাগে। তোমার অনুপস্থিতি ফাঁকায় এমন পূর্ণ থেকে যে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। ক্লান্তি আর অবসাদ নিজেরা মিলে আমার পথ করে দেয়। তুমি তো জানো তোমার সাথে মুখোমুখিতে যত খানি সড়গড়- অধিক মানুষের সাথে ততই আমার আড়ষ্টতা।

চায়ের কাপ আর প্লেটে দুটি বিস্কুট দিয়ে হাতে তুলে দিলে চা পান করা যায় বটে কিন্ত চা রান্না ও পরিবেশনেও যে একটা আর্ট- একটা স্টাইল ফাদারের নিমন্ত্রনে না এলে আমার জানাই হতো না। সকলের সাথে মিলে মুখরিত চা চক্র বুঝি একেই বলে। ঘাম ঝরে যেমন জ্বর নেমে যায়- শরীরে আলতো পালকের ঠাণ্ডা ছোঁয়া নিয়ে আসে তেমনি যেন দূর হয়ে গেল চা চক্রে মেতে ওঠে। এমন মাতুয়ায় তোমাকে চেয়েছি মনে মনে। চায়ের স্বাদ নানা জনের হাতে নানা সুবাস ছাড়ায়। এই মিশনের চা তেমন। শুকনো বেলের কড়া গন্ধের চা।

চা পানে স্পষ্টই এক্সাট্রা ফ্লেবার মুখ গহ্বরে নাচতে থাকে। বিজ্ঞাপনের ভাষায় যদি বলি প্রতি চুমুকে সতেজতা আর উচ্ছ্বসিত মনের সপ্রাণতা।ফাদার ডেভিড চা চক্রের এক পরিধি থেকে ছুঁড়ে দিলেন ইতিহাসের ছেঁড়াতার। সেই কবে মিশন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সময়ে ফাদার ভূপাল চন্দ্ৰ সরকার শুকনো বেলশুটির চায়ের রেসিপি শুরু করেছিলেন। আজও চলছে সেই বেলশুটির চা আর চায়ের পরিবেশনার স্টাইল। চা চক্রের বৃত্ত।ফাদার ডেভিডের ছুঁড়ে দেয়া ছেঁড়াতার ছুঁয়ে গেলো সম্পূর্ন বৃত্তের জমিনে।

তখন সন্ধ্য। উঠানে চাঁদের আলো ত্রিমুখি বেল পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে কোথায় বরফি কাটা আলো কোথাও ছুপছুপ অন্ধকার। টানা একঘেয়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাক কানের ভেতর নিয়ে আমরা ফিরে এলাম- প্রীতি নমস্কার জানিয়ে। সৌজন্যতার হাসিখুশি ঠোঁঠের কোনে ঝুঁলিয়ে…

চলবে…

ছবিঋণ: জ্যোতি পোদ্দার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!