শিল্পকলা, সাহিত্য, সংগীত, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের জীবন। আর এই সবকিছুর সঙ্গে মানুষের জীবন জড়িয়ে রয়েছে বলেই পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রয়েছে সুন্দরভাবে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিবিড়। প্রকৃতি ব্যতিরেকে মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষের জীবন এই পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান সামগ্রী। আমরা জানি যে এইসমস্ত কিছুর সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের মেলবন্ধন যখন হয় তখন হয়ে ওঠে এক কথায় অনন্য। জগৎ ও জীবনের প্রধান ও অন্যতম আধার হল প্রাণ। যে কোনো বিষয় বস্তুজগৎ থেকে উপলব্ধির স্তরে উত্তীর্ণ হলে তখন তা হয়ে ওঠে পরম আস্বাদনযোগ্য। আমরা আরও জানি যে মানবিকবোধ হল মানুষের মহৎ গুণ। এই গুণের দ্বারা মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে। সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিকে জয় করে। যে কোনো বিদ্যা চর্চা করতে গেলে তার আত্মীকরণ বিশেষ প্রয়োজন। তাই মানবিকবিদ্যা হোক, বিজ্ঞান হোক কিংবা সমাজবিজ্ঞান হোক সমস্ত শাখারই অশেষ মূল্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে সমস্ত বিষয়কেই Interdisciplinary-হিসাবে চর্চার উপর বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞানও তার বাইরে নয়।
কোনো একটি নির্দিষ্ট কৌমসমাজ দীর্ঘদিন একই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে একই সংস্কৃতি লালন পালন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তখন তাদের সংস্কৃতিকে লোকসংস্কৃতি বলে। আর তাদের মধ্যে যে বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞাকে পরিলক্ষিত হয় তাকে লৌকিকবিজ্ঞান বা লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান বা Folklore science বলে। গণিত হল সাংকেতিক ভাষা। মানুষ কতগুলো চিহ্নের সাহায্যে মনের অব্যক্ত ভাবরাশিকে অন্য মানুষের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে। এই ভাষা তাই সিমবলিক। তাই সারা পৃথিবীর মানুষের ভাষার উৎসধারাতে স্বভাবিকভাবেই অনেক মিল আছে।
জাতিগত গণিত গণিতেরই একটি বলিষ্ঠ শাখামাত্র। এবং তার সঙ্গে মানবিক বিদ্যার যথেষ্ঠ মিল রয়েছে। জাতিগত গণিত বা Ethnomathematics গণিত ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান গণিতশিক্ষা চর্চার ক্ষেত্রে এবং লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান আলোচনাতে অনিবার্যভাবে এই জাতিগত গণিত বা এথনোম্যাথামেটিক্স এসে পড়ে। সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান উপলব্ধির ব্যাপার এবং আঙ্কিক মহাক্ষেত্রে উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই জাতিগত গণিত বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যূথবদ্ধ মানুষ সমাজ সৃষ্টি করেছে তাদের নিজস্ব তাগিদে, জীবনযাত্রার প্রয়োজনে। আর আদিম উপজাতীয় মানবশ্রেণিও বা তাদের বিবর্তিত জনজাতিও নিজেদের অজান্তে প্রাত্যহিক জীবনে বংশ পরম্পরায় গণিতের চর্চা করে আসছে। তারফলে এদের নিজস্ব ভাবনা চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে বাস্তবজীবনে এবং কর্মকাণ্ডে। এবং সেইসমস্ত কাজকর্মে প্রকাশ পেয়েছে তাদের বৈজ্ঞানিক চেতনাবোধ। পরিমাণবোধ, পরিমিতিবোধ প্রভৃতি উপলব্ধির জগতে স্থান পেয়েছে। মননশীলতায় ও সৃষ্টিকর্মে শৈল্পিক ধারণা যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি বাদ যায়নি বিজ্ঞানভাবনাও। তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্মে এবং জীবন চর্যায় গণিত সম্পৃক্ত হয়ে থেকেছে। এই গণিত তাই মানুষের জীবন, সমাজ, সংসার ও সভ্যতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এবং তা মানুষের বহির্বিশ্ব ও অন্তরজগতের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ও অনিবার্যভাবে মিশে রয়েছে সেই আদিকাল থেকে।
জাতিগত গণিত বেশি পুরানো শব্দ নয়। এই শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন ব্রাজিলের গণিতজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ ডি’ অ্যাম্ব্রোসিও (D’ Ambrosio), ১৯৭৭ সালে আমেরিকার Association for the Advancement of Science-এ। তারপর থেকে অ্যাম্ব্রোসিও এই জাতিগত গণিত নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে চর্চা করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়ে একটি যথাযথ সংজ্ঞা প্রদান করতে সমর্থ হন। তিনি জাতিগত গণিত সম্বন্ধে বলেন, “The mathematics which is practiced among identifiable cultural groups such as national-tribe societies, labour groups, children of certain age brackets and professional classes.” (D’Ambrosio, 1985)
পৃথিবীর বিভিন্ন জনজাতি ও আদিবাসীদের মধ্যে নিজস্ব কিছু হিসাব নিকাশের পদ্ধতি রয়েছে। যেমন পেরুভিয়ো ভাষায় ‘কুইপাস’ (Quipus) বা ‘কিপাস’ (Kipes) নামের একটি গাণিতিক পদ্ধতির কথা জানা যায়। তারা দড়িতে গিঁট দিয়ে দিয়ে সমস্ত রকমের হিসাব রাখত। আবার বাংলাদেশের যশোর জেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বিশেষত চিত্রা নদীর পারে মল্ল বা মালোরা বসবাস করে। এইসব মালো পরিবারের মহিলারা নিরক্ষর কিন্তু তারা বংশ পরম্পরায় গণিতের চর্চা করে আসছে যার সঙ্গে জীবন মরণের হিসাবও রক্ষিত থেকে গেছে। বাড়ির পুরুষেরা মাছ ধরতে নদীতে, সমুদ্রে বা বাদাবনে যায়। আর তখন তাদের বাড়ির মহিলারা হাতের শাঁখা নোয়া ও পলা খুলে রাখে। এবং বতরের হিসাব রাখে চালের কলসী থেকে রান্নার সময়ে এক মুঠো চাল আলাদা একটা পাত্রে সরিয়ে রেখে। সারা বতর ধরে তারা প্রতিদিন এক মুঠো করে চাল পাত্রে রাখার মধ্যে তাদের মনের লোকবিশ্বাস কাজ করে। ২ মাসে বা ৬০ দিনে এক বতর হয়। অর্থাৎ এক ঋতুতে এক বতর। এই বতরের হিসাব রাখে তারা তাদের নিজস্ব রীতিতে, নিজেদের কায়দায়। এই হিসাবের সঙ্গে বিশ্বাস জড়িত যদি এই দিনের মধ্যে সমুদ্র-বাদা থেকে তাদের পুরুষেরা ঘরে ফিরে না আসে, তখন সেই মল্ল বা মালো পরিবারের এয়ো স্ত্রীরা বৈধব্য বেশ ধারণ করে, অর্থাৎ জাতি হিসাবে তারা পিছিয়ে পড়া হলেও সংস্কারের দিক থেকে তারা হয় ত্যাগী। এইভাবে বাঘের পেটে যাওয়া মৎস্যজীবীদের স্ত্রীরা বিধবা হয়ে যায়। তারা তাদের স্বামীর বতর বাওয়া শেষে ফিরে না এলে নিজস্ব সংস্কার মেনে বৈধব্য বেশ ধারণ করে। এই প্রথা কেবল এদের মধ্যেই দেখা যায়। এই গণিত চর্চাকে জাতিগত গণিত বলে।
এই হিসাব রাখার পদ্ধতি একেবারেই নিজস্ব। এবং এই গণিত জাতিগত গণিত নামে পরিচিত। একে P. Cobb (1986) তার বিভিন্ন আলোচনাক্ষেত্রে এথনোম্যাথামেটিক্স বলেছেন। তবে ব্রাজিলের ডি. অ্যাম্ব্রোসিও জাতিগত গণিতের প্রবক্তা। তিনি দীর্ঘকাল ধরে এই জাতিগত গণিত নিয়ে চর্চা করেছেন। ক্রমশ জাতিগত গণিতকে একটি পরিমার্জিত রূপ প্রদান করেছেন। একে আবার পরবর্তীকালে স্বয়ং সৃষ্ট গণিতও বলেছেন কেউ কেউ। তবে P. Cobb তিনি তার বক্তব্যকে সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন Contexts, goals beliefs and learning mathematics প্রবন্ধে।
আবার আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল উপজাতিদের রমণীরা মহুয়া তৈরি করে। এই মহুয়া তৈরিতে বাকড়ের প্রয়োজন হয়। বাকড়ের হিসাব সাঁওতাল রমণীরা গণ্ডা গণ্ডা ধরে মনে রাখে। কতটা পরিমাণে জলে কত গণ্ডা বাকড় দিয়ে তাতে তাপ দিলে যে বাষ্প হবে এবং সেই বাষ্পকে শীতল করে একটি পাত্রে ধরে রাখার জটিল রাসায়নিক গাণিতিক প্রক্রিয়া সাধিত হয় নিরক্ষর সাঁওতাল রমণীর দ্বারা, পরিমাণবোধ, আঙ্কিক চেতনা এইসব নিরক্ষর সাঁওতাল রমণীরা বংশপরম্পরায় বহন করে চলেছে, তাদের এই গাণিতিক চেতনাকেও এথনোম্যাথামেটিক্স-এর আওতায় ফেলা হয়।
নৌকো সভ্যতার আদিমতম যানবাহন। প্রাচীনকালে গাছের গুঁড়িকে প্রথম মানুষ যানবাহন হিসাবে কাজে লাগায়। ধাপে ধাপে সভ্যতার অগ্রগতিতে কালক্রমে গাছের গুঁড়ি পরিণত হয় ভেলাতে। এবং অবশেষে সেই গুঁড়ি, ভেলা নৌকোতে রূপান্তরিত হয়। এই নৌশিল্প লোকসংস্কৃতির একটি বলিষ্ঠ আঙ্গিক। নৌকো তৈরির প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নির্ভর এবং গাণিতিক জ্ঞাননির্ভরও বটে। তবে এই গাণিতিক প্রজ্ঞাকে জাতিগত গণিত বা লোকগণিত বা এথনোম্যাথামেটিকস বলে। বাংলাতে নৌকো তৈরি করে যে সকল জনগোষ্ঠী তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাজবংশী, জেলে, কৈবর্ত ও মালো প্রভৃতি। এই সকল জনগোষ্ঠী বংশ পরম্পরায় এই নৌকো তৈরি করে আসছে। তারা প্রথাগত শিক্ষা না নিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বিদ্যাচর্চা করছে। নিরক্ষর বা স্বল্প অক্ষর জ্ঞান নিয়ে তারা অবলীলাক্রমে এই প্রযুক্তিবিদ্যার চর্চা করে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। নৌকো তৈরি করে প্লবতার তত্ত্বকে তারা হাতে কলমে প্রয়োগ করছে। অথচ প্লবতার নাম তারা হয়তো কোনোদিন শোনেনি। নৌকো তারা তৈরি করে বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে। নৌকো ভেসে থাকে জলকে অপসরণ করে। নৌকোর অপসারিত জলের ভরের সমান নৌকোর ওজন বা ভর। তাদের এই গাণিতিক প্রজ্ঞাকে জাতিগত গণিত নামে অভিহিত করা হয়।
নৌকো তৈরি করার সময় প্রথমে একটি পনেরো ইঞ্চি চওড়া এবং চল্লিশ ফুট লম্বা পরিমাপের একটি তক্তাকে দাঁড়া হিসাবে নেওয়া হয়। তারপর সেই কাঠের খন্ডকে রাখা হয় ভূমির সমান্তরাল সরলরেখা বরাবর করে। অগ্র ভাগ ও পশ্চাদ্ ভাগ তিনফুট উঁচু করা হয় দুটি কাঠের দন্ড দিয়ে। তারপর তলি থেকে দুই পাশ বরাবর কাঠ আটকানো হয় জলুই দিয়ে। গুঁড়া দেয়া হয় চল্লিশ ফুট নৌকোয় কুড়িটি। গুঁড়া হয় বাঁকানো আঁকশির মতো। এরফলে কাঠকে ধরে রাখে জোড়ালোভাবে। নৌকোর দুই পাশে বাতা থাকে। নৌকোর সামনের অংশকে বলে আগানৌকো। পিছনের অংশকে বলে পাছানৌকো। পালের জন্য নৌকোর মাঝের অংশে থাকে গর্ত করা। আর পাটাতনে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে চালি করা থাকে। নৌকোর তলির কাঠ জোড়া দেয়া হয় কাটা বা জলুই দিয়ে। জলুই বসানোর জন্য বাঁটালি দিয়ে তক্তাতে খাঁজ কাটা হয়। এই খাঁজ কাটার মধ্য দিয়ে নৌশিল্পীরা তারা তাদের জ্যামিতিক জ্ঞানের পরিচয় দেয়।
চাষি মাঠে চাষ করে। কিন্তু তাদের মধ্যেও থাকে গাণিতিক প্রজ্ঞা। এই গাণিতিক প্রজ্ঞা তারা বংশ পরম্পরায় বহন করে। চাষাবাদের ক্ষেত্রে তারা জ্যামিতিক জ্ঞানকে কাজে লাগায়। এই জ্যামিতিক জ্ঞান তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আহরণ করে না। তারা বাস্তবজীবন থেকে আহরণ করে এই গাণিতিক প্রজ্ঞা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাণিতিক চেতনাকে তারা বংশ পরম্পরায় কাজে লাগায়। এই গণিতকে বলা হয় জাতিগত গণিত বা এথনোম্যাথামেটিকস। ধানচাষের সময় তারা ধানের চারাকে এক বিঘাত অন্তর দুটি বা তিনটি ধানের চারা রোপন করে। সব চারা ধানের গাছ থাকে সরল রেখাতে অবস্থিত। প্রতিটি চারাগাছ সরলরেখাতে অবস্থান করে। তাদের পরিমিতিবোধ এবং পরিমাণবোধ যা কিনা আঙ্কিক বোধিকে প্রকাশ করে। তা আমাদের চমৎকৃত করে। এবং চাষাবাদের জন্য যে জমি তারা করে থাকে তার পরিমাপ হয়ে থাকে আয়তক্ষেত্র বা বর্গক্ষেত্রাকার।
গোরুর গাড়ির চাকা তৈরির ক্ষেত্রে যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয় মিস্ত্রিরা তা বেশ আকর্ষক। তারা লোহার বেড়ি তৈরি করিয়ে আনে কর্মকারের কাছ থেকে। কাঠকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাঁকিয়ে বেড়ি পড়ায়। কাঠের পরিমাপ তারা নির্ধারণ করে নিজেস্ব হিসাব মতো। চাকার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সমান মাপে চারদিকে কাঠের বৃত্ত তৈরি করে। এই চাকা তৈরি করার পদ্ধতি তারা বংশ পরম্পরায় চর্চা করে আসছে। তারা তাদের কর্মের মধ্য দিয়ে গাণিতিকবোধের পরিচয় দিয়ে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
বাঁশের ঝুড়ি বোনার কাজ করে বেদে সম্প্রদায়। এরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে তাদের পসরা বিক্রি করে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুরুষ ও মহিলারা অবসর সময়ে ঝুঁড়ি বোনে। একটি কেন্দ্রবিন্দু থেকে অধিবৃত্তাকারে বাঁশের পাতলা চোছকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্রমশ ঘর বাড়িয়ে একটি ঝুড়ি তৈরি করে। এই ঝুড়ি বোনার ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্নিহিত গাণিতিকবোধ কাজ করে। যাকে বলা হয় জাতিগত গণিত বা এথনোম্যাথামেটিকস। তারা বংশ পরম্পরায় এই ঝুড়ি বোনার কাজ করে আসছে। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তারা যে গাণিতিক চেতনাকে কাজে লাগাচ্ছে তা তাদের সহজাত প্রজ্ঞার প্রকাশমাত্র। এই গাণিতিক চেতনা তারা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করে না। নিত্যদিনের কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে এই বিদ্যা তারা চর্চা করে। এই প্রজ্ঞা তাদের জীবন চর্যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
সাঁওতাল নৃত্যের মধ্যে যে গাণিতিক চেতনা পরিলক্ষিত হয় তাও এই জাতিগত গণিতের দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সাঁওতাল মেয়েদের দেহবিক্ষেপ ও পদচালনা এক Rhythm-এ চলার জন্য তাদের নৃত্যের মধ্যে অপার সৌন্দর্য দৃষ্ট হয়। তাদের পায়ের তাল ও মাত্রা সুষম বোধের প্রকাশ করে। কখনও তারা একটি সরলরেখা বরাবর নাচে আবার তারা কখনও অর্ধবৃত্ত বা বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নাচে। তাদের এই জ্যামিতিক জ্ঞান বংশ পরম্পরায় বহন করছে। এরজন্য তারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আলাদা করে পাঠ গ্রহণ করে না। এই গভীর সহজাত প্রজ্ঞা প্রবাহিত হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যদিয়ে।
কুম্ভকার সম্প্রদায় মাটির ভার তৈরি করে। তারা বংশ পরম্পরায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কাজ করে আসছে। একটি কাঠের চাকতির উপর মাটি রেখে চাকতিটিকে প্রচন্ড গতিতে ঘোরায়। ঘূর্ণায়মান চাকতির উপরের মাটিকে হাতের আঙুলের মৃদু চাপের সাহায্যে মাটির ভার তৈরি করে অপূর্ব দক্ষতায়। মৃদু চাপের মধ্যদিয়ে তাদের গাণিতিক পরিমিতিবোধ প্রকাশ পায়। দুই হাতের আঙুলের অপূর্ব কৌশলে তারা ঘূর্ণায়মান চাকতির উপরের মাটিকে ভারের রূপ দেয়। এটি একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বা গাণিতিক প্রক্রিয়া।এই গাণিতিক প্রজ্ঞা তাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। যে গাণিতিক চেতনাকে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে লাগায় তা তারা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করে না। তারা নিজস্ব কিছু কায়দা কানুন রীতি নীতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে নিয়ে চলে। বংশ পরম্পরায় গাণিতিক প্রজ্ঞাকে এই কুম্ভকার সম্প্রদায় বহন করে নিয়ে চলেছে। তাদের এই গণিতকে জাতিগত গণিত বা এথনোম্যথামেটিকস বলে।
আধুনিক গণিতবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র অনেক বেশি প্রসারিত। এবং তার অজস্র শাখাপ্রশাখা। সমাজে বসবাসকারী মানুষের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে রয়েছে গণিত। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নক্ষেত্রে ভয়, ভীতি মিশে থাকার জন্য ছাত্রছাত্রী আজকাল গণিত বিমুখ হয়ে পড়েছে। জাতিগত গণিত গণিত চর্চার একটি বড় অধ্যায়। জাতিগত গণিত বা এথনোম্যাথামেটিকস দিনের পর দিন এইভাবে চর্চিত হতে হতে ক্রমশ তা বিবর্তিত হচ্ছে। বহুল ব্যবহারে এই গণিত মার্জিত রূপ পরিগ্রহ করছে ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাধ্যম হয়ে উঠছে। এবং তা অধ্যয়নের বিষয় হয়ে নিত্যনতুন রূপ লাভ করে তা গবেষণার বিষয় হচ্ছে। কালক্রমে বিবর্তিত হতে হতে এইভাবে এইসময়ে তা মার্জিত রূপ লাভ করছে। এবং এই জাতিগত গণিত বা এথনোম্যাথামেটিকস কালের পরম্পরায় উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণার বিষয় হয়ে যেমন বিশেষ মাত্রা পাচ্ছে তেমনি এই চিত্তাকর্ষক বিষয় জনমানসে সাড়া ফেলছে।#