আমি যখন ক্লাস এইটে, তখন থেকে আমার জন্য একটা আলাদা ঘর। ঘরটা ছোট্ট, কিন্তু জানলা দুটো অনেক বড়। একটা জানলা দিয়ে সেরকম কিছু দেখা যেত না, আরেকটা দিয়ে বাড়ির পিছনের উঠোন , একটা কুল গাছ আর মফস্বলের ভাঙাচোরা আকাশ। লোডশেডিং হলে ফ্যাকাশে চাঁদটাকে একটু উজ্জ্বল লাগত। অন্ধকারের মধ্যে একটা নেশা আছে, অন্ধকার মনের ভিতর আলো জ্বেলে দেয়। ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকারে গলা ছেড়ে গান গাইতে খুব ভালো লাগতো। আর আমার গান শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করত না জেনেও গলা ছেড়ে গান গাইতাম। কুমার শানু আর নচিকেতা ছিল টপ প্রায়োরিটি। নীলাঞ্জনা নামের কোন মেয়েকে আমি চিনতাম না, কিন্তু আমি যতবার নীলাঞ্জনা গানটি গেয়েছি বাস্তবের কোন নীলাঞ্জনার প্রেমিকও অতবার গায়নি। পাশের বাড়ির দাদা ফাস্ট বয়, তাই লোডশেডিং হলেও পড়া বন্ধ থাকত না, কিন্তু আমার মত মিডিওকার ছাত্রের সুবিধা হল ফাস্ট হওয়ার ইচ্ছেটাই নেই, তাই রাতে লোডশেডিং মানেই “লাল ফিতে সাদা মোজা”, নয়তো “বস এক সনম চাহিয়ে আশিকি কে লিয়ে।” গল্পটা গান নিয়ে নয়, গল্পটা আকাশ নিয়ে। সাইড রোলে অবশ্য লোডশেডিং আছে। আরেকটি কিশোর ছেলের অহংবোধের বিচূর্ণতা লেগে আছে……
হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল রাতের আকাশে উল্কা বৃষ্টি হবে। মাঝে মাঝে উল্কাপাত হয় বইতে পড়েছি আর শাহরুখ খানের সিনেমায় দেখেছি টুটতা তারা কিভাবে মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ করে দেয়। কিন্তু এ নাকি বৃষ্টির মত ঝরে পড়বে অজস্র উল্কা। ভাবলাম রং মশালের মতন ছড়িয়ে পড়বে উল্কা। সে এক দেখার মত দৃশ্য হবে। টুটতা তারার কাছে যা চাওয়া যায় তাই নাকি পাওয়া যায়! তাহলে সেদিন তো কারোর কোন চাওয়া আর অপূর্ণ থাকবে না! পূর্ণতার ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেলে জীবনটা আগের মত সুন্দর থাকবে তো?
রাত এল রাতের মতন। প্রতিটি বাড়ির ছাদে উৎসবের গন্ধ। চপ- মুড়ি- চা, টর্চ, রেডিও, লুডো, তাস, বাগাডুলি, এমনকি বাতের ব্যথায় মালিশ করার জন্য কবিরাজি তেল — এই সব কিছু নিয়ে ছাদে উঠে এলো গোটা শহর। আজ সকলের সমস্ত স্বপ্নপূরণের দিন। হঠাৎ লোডশেডিং। ঝুপঝুপে অন্ধকারে গোটা শহর আজ ছাদে রাত জাগার জন্য প্রস্তুত। আমাদের বাড়ির পাশে মস্ত বড় একটা বাগান, লক্ষ্মীপেঁচার চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে, আর চাঁপা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে তারা ভরা আকাশের দিকে। মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য থাকলেও আকাশে কোন চঞ্চলতা নেই। এলোমেলো হাওয়া বইছে, মৃত তারাদের আলো মেখে নিভে গেছে জোনাকিরা। অন্ধকারে জমে উঠতে থাকে করুণ কিছু মন খারাপ। আলো মাখা যে মুহূর্ত তৈরি হতে পারতো প্রকৃতির অজানা উদাসী খেয়ালে রাতের গভীরে তা হারিয়ে যায়। ভেঙে যায় টুটতা তারার স্বপ্ন। ছাদের মানুষেরা মুছে যেতে থাকে। সবকিছু না পাওয়ার মতন এও যেন স্বাভাবিক ছিল। গানের লড়াই, রেডিওর শব্দ, যৌথ আড্ডা, আবছায়া প্রেম – সব থেমে যেতে থাকে। কবিরাজি তেলের শিশিটা গড়িয়ে যায় এক কোনায়, প্রেমিক প্রেমিকার গোপনে আঙ্গুলের ছোঁয়া লেগে থাকে ছাদের কার্নিশে। একটা তারাও খসতে দেখিনা, ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। এক সময় মাদুর বিছিয়ে একটা বালিশ নিয়ে সটান শুয়ে পড়ি আকাশের নিচে। এত বড় আকাশ দেখিনি কোনদিন । চোখ ভরা আকাশ, তারা ভরা আকাশ, স্বপ্ন মাখা আকাশ, ভাঙ্গা স্বপ্নেরও আকাশ…. আমি অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলাম, একটা ঘোর এসে গেল। তখন আমার জীবনে নারী প্রেম আসেনি, তবু মনের ভিতর অদ্ভুত এক আকুলি বিকুলি করছিল। আমার তো কোন না পাওয়া নেই! যৌথ পরিবারের অনাবিল আনন্দ, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা, খেলার মাঠে রঙিন বিকেল, সাদা কালো টিভিতে রামায়ণ আর সুপারহিট মোকাবিলা, রবিবারের মাংস ভাত, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে ফেরা, নিজের ঘরের দেওয়ালে শচীন, স্টেফি গ্রাফ আর বরিস বেকারের পোস্টার, বিছানা জুড়ে ইন্দ্রজাল কমিকস আর স্বপন কুমার– সব , সব কিছু আছে আমার কাছে। কিন্তু ওই নক্ষত্র খচিত বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি যেন না পাওয়ার বেদনা মনকে আচ্ছন্ন করে তুলছিল, মনে পড়ছিল সেই লাইন, “সুখ নেইকো মনে/ নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে/ হলুদ বনে বনে।”
এই বিশাল গ্যালাক্সি, অজস্র গ্রহ নক্ষত্রের সমাবেশের পরেও কত শূন্যস্থান! ছোটবেলায় শুনতাম মানুষ মারা গেলে তারা হয়ে যায়। দাদুকে অনেক খুঁজেছি আকাশে, পাইনি। মারা যাওয়ার আগের রাতেও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, আকাশের মত বড় হও দাদুভাই।
ভোররাতে যখন ঘুম ভাঙলো দাদুর শ্বাস নেওয়ার কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না। আগের রাতেও ঘর ঘর শব্দ হচ্ছিল বুকে । শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকে কান পাতলাম, ঠান্ডা নিস্তব্ধ একটা চওড়া বুক, যা চিরকাল আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভোরের হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আমার সেই নির্ভরতা। আমার এক পৃথিবী ভালোবাসা চলে গেল। দাদু কি আছে ওই নক্ষত্র খচিত আকাশে? পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যই কি গ্যালাক্সির ওই শূন্যস্থান? জানিনা । তবে ওই বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল এই বিশাল গ্যালাক্সির লক্ষ হাজার নক্ষত্রের মাঝে একটি ছোট্ট গ্রহ পৃথিবী, সেই পৃথিবীর তিনভাগের এক ভাগ মাত্র মাটি, সেই মাটির অনেকগুলি মহাদেশের মাঝে একটি হল এশিয়া, এশিয়া মহাদেশের একটিমাত্র দেশ ভারতবর্ষ, সেই সুবিশাল ভারতবর্ষের অনেক রাজ্যের মধ্যে একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলার মধ্যে একটি উত্তর 24 পরগনা, সেই জেলার একটি থানা দমদম, দমদম থানার একটি পোস্ট অফিস রবীন্দ্রনগর, রবীন্দ্রনগর পোস্ট অফিসের একটি সরু রাস্তা শ্রীমা রোড, শ্রীমা রোডের একটি গলির শেষ প্রান্তে ১৫ নম্বর বাড়ি, আর সেই বাড়ির বারো জন সদস্যের মধ্যে আমি সামান্য একজন। এত ক্ষুদ্র, এত সামান্য! এই সুবিশাল গ্যালাক্সির মাঝে আমি কোথায়? একটি ধুলো কণাও নয় । আমার চোখের সামনে প্রসারিত হতে লাগলো দিগন্ত আর আমি নিজে সংকুচিত হতে হতে নেই হয়ে গেলাম। আমি কিছু নই, আমি কোথাও নেই, এটা ভাবতে ভাবতে নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছিল। এই মহাবিশ্বের মাঝে নিজেকে শূন্য মনে হচ্ছিল। সদ্য গজিয়ে ওঠা অহম বোধ টুটতা তারার মতো ভেঙে পড়ছিল! হয়তো আমার দৃশ্যের বাইরে একটি তারা সেদিন খসে পড়েছিল!
ভোরবেলা যখন আলো ফুটছে, সব হারিয়ে একটি কিশোর ছেলে টুটতা তারার ভাঙ্গা স্বপ্ন নিয়ে মায়াবী পৃথিবীর দিকে একা একাই এগিয়ে চলল।
পুনশ্চঃ আগের দিন ওয়ারলেসের মাঠে বিকেলের ক্রিকেট ম্যাচে আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। কল্লোল অনেকবার আমার কাছে বল করতে চেয়েছে আমি তাচ্ছিল্য ভরে ওকে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে পাঠিয়ে নিজেই বল করছিলাম বারবার। নিজেকে আমি পাড়ার কপিল দেব ভাবতাম। আজকের ম্যাচে কল্লোলকে যেই বোলিং ওপেন করার জন্য ডাকলাম ও অবাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে হাসতে লাগলো আমার চোখের দিকে ভালো করে তাকালে ও দেখতে পেত জলভরা দুটো চোখ আর সব হারানো এক শূন্য মানুষ।#