ধারাবাহিক: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ১১)

শুধু অনুরাগে মন দোলে না, কখনো কখনো অনিশ্চয়তার কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি দোলে। মতি চলে গেলেও বিভাস সামন্তের রাগ এতটুকু কমল না। মনের আকাশে কেমন যেন ছন্নছাড়া মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। প্রতি ইঞ্চিতে চরম বিরক্তির প্রকাশ ঘটছে। একজন সামান্য ক্লাব সেক্রেটারি, অন্যায় স্পর্ধা দেখানোর ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে আকাশে উঠে গেছে। রাজনীতির গুরুত্বকেও অস্বীকার করতে চাচ্ছে। আরেকটা প্রসঙ্গ এসে বিভাসকে বার বার ছ্যাকা দিতে থাকল। নটুকে পুষে রাখার আর কোনো তাৎপর্য নেই। মাসে মাসে নটুর জন্যে টাকা গুণতে হবে কেন? এতদিন ওকে মতির পিছনে লাগিয়ে রাখা হল। ভালোবেসে হোক, হুমকি দিয়ে হোক, মতিকে ভীষণ জব্দে রাখতে হবে। নটু তা পারল কই? মতির স্পর্ধা খুব সহজে প্রমাণ করে দিল, নটু ওর উপরে কোনো চাপ তৈরি করতে পারে নি। আসলে ভিতরে ভিতরে আলগা অবস্থান পেয়ে এখন মাথায় উঠে গেছে। যা খুশি তা করার মতো সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে। কোনো পরোয়া নেই ছেলেটার মধ্যে। আগে পিছনে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রতিবাদ করত, এখন সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দেওয়ার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
হরেন হন্তদন্ত হয়ে বিভাসবাবুর ঘরে ঢুকতেই শ্রী সামন্ত কোনো রকম ভূমিকা না করেই বললেন, তোমার সব কথা শুনব যদি এখনিই নটুকে ধরে আনতে পারো।
এখনিই যাব?
সেকথাই বলছি।
হরেন চলে যাবার পরে বিভাস সামন্ত ভিতরে ভিতরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন এই ভেবে যে নটুকে আজ বিশেষ ভাবে কড়িয়ে দিতে হবে। হয় কাজগুলো সত্বর সেরে ফেলুক, নতুবা সরে পড়ুক। গেঁটের টাকা খরচ করে শুধু শুধু ভূত পুষে লাভ কী?
বাড়ির ভিতর থেকে চা-বিস্কুট এল নতুন ট্রেতে। বিভাস সামন্ত তা তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছেন আর একমনে ভাবছেন। বার বার নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি মতি তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছুঁয়ে যাচ্ছে। আরেকটু পরে হন্তদন্ত হয়ে নটু এসে হাজির হল। দরজার সামনে এসে বলল, আসব সামন্তদা?
আর কত সময় নিবি বল্ তো? ছেলেটা আজ এসে সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যে সিনক্রিয়েট করে গেল, তা মেনে নেওয়া কত কঠিন জানিস? ক্লাব আর রাজনীতি এক হয়ে গেল রে। বরং মতি ভাবছে, ক্লাব করে রাজনীতিকদের দিব্যি কবজায় রাখা যায়। তুই একটু কড়া হতে পারলে মতি এতটা সাহস দেখাতে পারত না। রোজ ফিরে যাবার সময় বলে যাচ্ছিস, আর ক’টা দিন সবুর করুন। তোর কথাতে অনেক অপেক্ষায় থেকেছি, ফল কিছু পাই নি। এভাবে চলে না রে। তোকে টাকা দিয়ে পুষে লাভ কী হলো বল্‌তো?
ক’দিনের মধ্যে ফেলে দেব সামন্তদা? বুঝেসুঝে আজকের ফাইনাল করে দিন। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখবেন, মতি আর এ পৃথিবীতে নেই।
আঁতকে উঠলেন বিভাস সামন্ত। সামনে ভোট। অনেক সাবধানে চলতে হবে তাঁকে। নটুর কারণে দলের ইমেজ তলানিতে ঠেকে গেলে রাজনীতিতে তাঁর থাকা, না থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। বরং ছেলেটার অনুপস্থিতি তাঁর সামনে প্রবল প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে। সমাজে এক অর্থে মরা বাঘের দাম সবচেয়ে বেশি। জীবন্ত হিংস্র বাঘের ভয়ে সবাই এত ভীত যে তা মানুষের জীবনে নিছক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। অথচ সেই বাঘ মরে গেলে দেখার জন্যে মানুষের ঢল নামে। পার্থক্যের সূক্ষ্মতা বিভাস সামন্তকে কম বেশি ছুঁয়ে যেতে থাকল। এও বুঝলেন যে মাথারাগি নটুকে এখনিই শান্ত করা প্রয়োজন। শরীরের ছক সব সময় রাজনীতিতে কাজ করে না, কেবলমাত্র কূটনীতির ছক মূল খেলা ধরে রাখতে পারে। নটুকে বুঝিয়ে বললেন, ওরে, সামনে ভোট রয়েছে, এখন প্ল্যান-বি ছাড়া অন্য পথে যাওয়া যাবে না। তবে তোকে মনে করিয়ে দিই, বিভাস সামন্ত একবার প্ল্যান করে ফেলেছে যখন, জানবি, আজকাল পরশু, যে কোনো দিন। শুধু শুভ পরিস্থিতির জন্যে অপেক্ষায় আছি রে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, মতিকে নিয়ে আমরা সত্যি সত্যি খুব বিব্রত, কিন্তু ক্লাব করার সূত্রে বহু লোক রয়েছে ওর সঙ্গে। সবার আগে প্রয়োজন নির্বাচনের আগে মতির খপ্পর থেকে লোকগুলোকে বের করে আনা। তখন দেখবি, আমার প্ল্যান কার্যকর করা নিয়ে তত বেশি ভাবতে হচ্ছে না। এখন তুই একটু বাউরি পাড়াতে যা। ভোটের আগে তোকে আরেকটা মাইলস্টোন ছুঁতেই হবে।
নটু দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল বিভাস সামন্তের দিকে। ভাবনার ফাঁকে একবার ফিক করে হেসে ফেলল। সমাজের কোনো মানুষ নিজের গুরুত্বকে হেলাদেলা চোখে দেখতে চায় না, হুকুমের চাকর হলেও নটু সেই ভাবাবেগে কম্পিত না হয়ে পারল না।
অমন হাসলি কেন?
অন্যদিন দেখেছি, সিদ্ধান্তের কথা চটপট বলে দিয়েছেন, আজকে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলেন। আমার পক্ষে বিষয়টা খুব কঠিন হবে বলে ভাবছেন নাকি?
তা নয়, তবে বেশ কঠিন কাজ।
পেরে যাব বিভাসদা।
মানুষের মন ঘোরানো সবচেয়ে কঠিন কাজ রে।
তা অবশ্য ঠিক কথা।
আর দেরি করিস নে। বাউরি পাড়াতে ঢুকে প্রথমে অলচিকির সঙ্গে পরামর্শ সেরে নিবি। ছেলেটা কিছুতেই তোর কথা ফেলতে পারবে না। আমি জানি, অলচিকি তোর বোতলের সঙ্গী। দুজনে গিয়ে পাড়ার সকলকে নিষেধ করে দে, যাতে কেউ আর মতির স্কুলে না যেতে পারে।
কিন্তু জানব কী করে, কোন কোন বাড়ির কারা মতির স্কুলে পড়তে যায়?
তোর মাথাটা গেছে রে। এভাবে খোঁজখবর নিতে হবে কেন? যাতে পাড়ার কেউ স্কুলমুখো হতে না পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শুনে নে নটু, অনেক ভাবনা চিন্তা করে মানুষের সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথা চালু করা হয়েছে। যার কাজ, তাকে করতেই হবে। কেউ সেবা দেবে, কেউ সেবা পাবে। এর বাইরে ভাবাটা মুর্খামি। গরিবগুব্বোরা পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করতে যাবে কেন? তাদের তো নিজের কাজ রয়েছে। তোর নিজস্ব টিপসগুলো সঙ্গে রয়েছে। অলচিকিকে এখন অনেকে ভয় করে। দেখবি তাতেই কাজ হয়ে যাবে। লোকজন এত বোকা নয় রে। ঠিক বুঝতে পারবে, কার হুকুমে তুই এসব করছিস।
নটুর দু’চোখ বিভাস সামন্তের দিকে।
কাছে আয়, চুপি চুপি সব শুনে নে।
আজ তো বেশ নতুন নতুন ছকের কথা বলছেন।
নেতৃত্ব চালাতে গেলে এটুকু করতেই হবে। একটা খবর জেনে রেখে দে, রায়চক থেকে যাতে কেউ বালি তুলে না নিয়ে যেতে পারে, তার জন্যে মতি হাইকোর্টে রায় পেয়ে গেছে। অবশ্য এখনও সার্টিফিকেট কপি থানা পর্যন্ত আসে নি। যত দিন না আসছে, ওসির সাফ কথা, তত দিন একেবারে ফাঁকা ময়দান। আজ রাতে ওম ঝুনঝুনওয়ালা লরি নিয়ে আসবেন বালি তুলে নিয়ে যেতে। তোকে দলবল নিয়ে পাহারায় থাকতে হবে। শান্তিরক্ষার নামে পুলিশও তোদের সঙ্গে থাকবে। সেই অর্থে বাড়তি ভয়ের কোনো কারণ নেই। বেগতিক দেখলে দু’এক রাউন্ড চালিয়ে দিবি, পুলিশ সব সামলে নেবে।
পুলিশ কী সময় মতো আসবে?
সে দায়িত্ব আমার।
যদি না আসে, নিজের মতো করে ব্যবস্থা নিতে পারব তো?
এত ভাবছিস কেন? আজ রাতে যা ঘটবে, সবই পুলিশের নামে বিকিয়ে যাবে। তবে খুব কড়া নজর রাখতে হবে মতির উপর। কোনো বিশ্বাস নেই হারামিটাকে। যে কোনো সময় এসে নিজের মতো করে সিন ক্রিয়েট করতে পারে। একটা মতলববাজ ছেলে তৈরি হয়েছে। সমস্ত সুযোগ নেবে আমার কাছ থেকে, তারপর ভালো অবস্থান পেলে বিরোধিতা করতেও ছাড়বে না।
নটু মাথা নাড়ছে তালে তালে, বলতে চাইল, সেও মতিকে কম চেনে না।
বিভাস সামন্ত পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা নটুর হাতে দিয়ে বললেন, ড্রিঙ্কসের বোতলগুলো বড়ো সাইজের নিবি, সারা রাত চালাতে হবে তো।
নটু মাথা নেড়ে দ্রুত পায়ে চলে গেল। বিভাস সামন্ত মাথার একরাশ চিন্তা নামাতে সিগারেটে সুখটান দিতে শুরু করলেন। মতিকে যে কোনোভাবেই রেহাই দেওয়া যায় না, সেই ভাবনা মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। একটা নতুন সূত্র ভেসে এল মনের নদীতে। পুঁটি নিশ্চয় সন্ধে পর্যন্ত বাজারে আসা মেয়েটা সম্পর্কে অনেক খবর দিতে পারবে তাঁকে। এঁটো ঝুটো খেতে খেতে পুঁটি বেশ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। মতিকে নিয়ে তাঁর শেষ চিন্তা, নটুর চাপ নিতে গিয়ে ছেলেটা নাজেহাল না হয়ে পারবে না। দুদিকের চাপ সহ্য করতে না পেরে বেচারা শেষ পর্যন্ত পুঁটির ছেলের দিব্যাভারতীকে সামনে নিয়ে আসতে বাধ্য হবে। সামন্ত বিড় বিড় করে বললেন, ক্লাব করতে তো নিষেধ করি নি, মেয়ে মানুষ নিয়ে এভাবে নতুন খেলা শুরু করলি কেন? নটু তোকে সহজে ছাড়বে না রে।

চলবে…

পড়ুন: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ১০)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!