।। পর্ব – এক ।।
মঙ্গলবারে বড়হাট আর শুক্রবারে ছোট হাটবার। মঙ্গল-শুক্রবারে হাটের যেমন গুণগত আঁচ লক্ষ্য করা যায় তেমনই শুধু আচরণে নয়— পণ্য আমদানিতেও পরিমাণগত পার্থক্য চোখে পড়ে। মঙ্গলের বড়হাটে বেলা বাড়তে বাড়তে গমগম ডাক ওঠে। মানুষের হল্লা আর নানা শব্দে জীবন জেরবার হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছে মতো হাটবার জো নেই। ভীড়ই হাটুরেকে ঠেলে নিয়ে যায়। যে দিকে তাকানো যাক না কেন, মানুষ আর মানুষের মাথা। আর বাজারের দক্ষিণে গোটা তিনেক বট আকাশ ছুঁয়েছে— তাকেও দূর থেকে চেনা যায়।
যারা একটু লম্বা চওড়া গোড়ালি উঁচু করে উঁচু-মাথাঅলাকে দেখা যায় বটে; দৌড়ে ধরবার উপায় নেই। বড় হাটের হাটুরেদের দেয়ালের কারণে এগুবার উপায় নেই। তবে বটের পাতা সকল মাথাতেই ঝিরিঝিরি হাওয়া ঢেলে দেয়। তার কোন কৃপণতা নেই। হালকা বাতাসেই মিহিদানা পাতাগুলো নিয়ত কাঁপতে থাকে আর শীতলতা ঢালে শীতের চেয়ে ফাল্গুনে চৈত্র, বৈশাখ আর জৈষ্ঠ্যে তো কথাই নেই।
যে বা যারা সাত আট বছরের সন্তানকে হাটে নিয়ে আসে তারা বসে থাকে বাপের ঘাড়ে। দুই পা দুই পাশে ছেড়ে দিয়ে বাপের মাথা ধরে বড় বড় চোখে ভয়ার্ত চোখে সাধের হাট দেখে। বাপ কী আর সহজে নিয়ে এসেছে? বারো রকমের মানুষের বারোয়ারী হাটের কথা বাপের মুখে শুনতে শুনতে সে হাটে আসার বায়না ধরে; গোঁ ধরে থাকে– গোঁয়ার গোবিন্দের মতো হাত পা ছুঁড়ে কান্নাকাটির পরই মায়ের চাপে সন্তানকে হাট দেখতে নিয়ে আসে। হাটে কেনাকাটার পর দানাগোল্লা কিংবা গুড়ের জিলাপি অথবা চিনিতে ডুবানো গজার পোটলা একহাতে অন্য হাতে খেতে খেতে বাড়ি ফেরে সন্ধ্যার অনেক পর— কম দূর থেকে তো আসেনি!
কেউ এসেছে উত্তর পশ্চিম গ্রাম সমশ্চূড়া,লক্ষ্মীকুড়া বা পোঁড়াগাও অথবা উত্তরের গ্রাম খলচন্দা আন্ধারুপাড়, চাটকিলা, মানুপাড়া,ভটপুর, তারাণী বা পুব এলাকার বরুয়াজানি,সুতানলদীঘি কিংবা কিল্লাপাড়া থেকে অথবা দক্ষিণের গোবিন্দনগর নকশী,গাজীরখামারের নানা গ্রাম থেকে হাটুরেরা আসে।
অথচ শুক্রবারের হাট আলগা আলগা— ব্যস্ততা থাকলেও ত্রস্ততার দাপট নেই। হুড়োহুড়ি নেই। মন মতো দেখে শুনে দশটা পাঁচটা দোকান যাচাই করে করে ক্রেতার যেমন শান্তি তেমন দোকানদারেরও স্বস্তি। কোন কিছু হারাবার নষ্ট হবার বা হিসাবের ভুল হবার ঝুঁটঝামেলা নেই।
মঙ্গল আর শুক্রবার ছাড়া বাকি পাঁচ দিন বিরান মাটি। ঝাঁপ খুলে শুধু মাল সাজিয়ে রাখা। দুপুরে খেয়ে এসে দোকানদার ক্যাশবাক্সে মাথার নিচে হাত ভাঁজ করে ঘুমিয়ে জিড়িয়ে নিলেও কোন সুবিধা নেই। মধ্য বাজার জুড়ে সারি সারি একচালা ঘর। মঙ্গল আর শুক্র ছাড়া বাকি পাঁচ দিনের দোকানপাট ছালা দিয়ে বেঁধে রাখে অস্থায়ী দোকানগুলো।দিনে হাত সাফাইয়ের সুযোগ নেই। এই অস্থায়ী দোকানদারদের আস্থা আছে। বিশ্বাস আছে মানুষের প্রতি। যদিও রাতে ‘বস্তিঅলা জাগো জাগো’ বলে একজন পাহারাদার আছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে পাহারাদারের গলা শুনতে পেতাম। মনে হতো কতদূর.. কতদূর..কতদূর থেকে তিনি ডাকছেন।
আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: চুনিকণ্ঠি
সেই সব এখন নেই। পাল্টে গেছে সব। স্মৃতিও ঝাপসা। চালাঘর ওঠে গেছে। কনক্রিট ভবন চারদিকে। চেনাজানা আমার হাট পর্দার অন্তরালে চলে গেছে। যে যায় তা এক্কেবারে যায়। কালের প্রকোপে চলে যায়– যেতে হয় সময়ের ধর্ম মেনে।
বহুদিন পর আমার চেনাজানা হাটের পরিসরে হাঁটতে হাঁটতে আমার কেবলই মনে হচ্ছে পরব ভাঙা হাটের এক হাটুরে আমি। নানা পালাপার্বন শেষ হলে পরের হাট যেমন অনাহাটবার হয়— হোক সে মঙ্গলের হাট অথবা শুক্রবারের ছোটহাট; আজ এতোদিন পর এইখানে এসে বারবার তাই-ই মনে হচ্ছে আমি এক পরব ভাঙা হাটের হাটুরে। এ-কেমন অনাহাটবার। কোন পার্বন শেষ হলো? কাউকেই তো চিনতে পারছি না।আমাদের এই মফস্বলি যাপনে একে অপরের মুখ চেনাচেনি- ই শুধু ছিল না—গোষ্ঠী পরিচয় ছিল একে অপরের নখদর্পণে।
কালের দাপটে কত কিছু পাল্টে গেছে। ন’য়ের শুরুর দিকেই এই হাটের মুখরা মুখশ্রী পাল্টাতে শুরু করে উদলা বাজার নীতির কারণে। বড় বড় পূঁজি কেন্দ্র থেকে প্রান্ত ছড়িয়ে তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। পূঁজির সেটা ধর্মও বটে।যত তার ঘূর্নন তত তার স্ফীতি। ততই তার উছলে পড়া।তার চলার পথে কোন বাঁধাই সে রাখে না। তার চাই অবাধ গতি। পুঁজির দাপটে সনাতন ধ্যান ধারনা ভাঙতে থাকে। যে যৌথ পরিবারে একটি টিভি শুধু একই পরিবারে গোটা দশেক লোকই দেখতো তা নয় বড় ঘরে চট বিছিয়ে পাশের বাড়ির লোকজনও দেখত। কিন্ত পূঁজির সঞ্চালনে পরিবার কাঠামো শুধু ভাঙে না– একই পরিবার ভাঙার সাথে সাথে টিভি রুমও ভাঙে– একেক ঘরে ঢুকে একাধিক রঙিন টিভি। যার যার ঘরে তার তার টিভি।
সেই ভাঙার প্রভাব পড়শি-সম্পর্ক যাপনেও পড়ে—- হাটেও পড়ে বাজারেও পড়ে। এই সময়েই আমাদের মফস্বলে ঢুকে টাকার দোকান– প্রশিকা, ব্রাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংকসহ নানা কিসিমের টাকার দোকান। দল গঠন করো। উঠান বৈঠক করো। সঞ্চয় করো। ঋণ নাও আর পরের সপ্তাহ থেকে কিস্তির চাকা ঘুরাও। কোন জামানত রাখার দরকার নেই।বৈঠকিদের গণসম্মতি থাকলেই হলো। ঋণগ্রহিতা সহজেই ঋণ পেয়ে যাচ্ছে। কিস্তির চাকা যত ঘুরে তত টাকার দোকানের স্বাস্থ্য বাড়ে।অন্যদিকে ঋণগ্রহীতার কয়েক সপ্তাহের পর থেকেই মন ভাঙে দেহ ভাঙে। হাড়জিরজিরে শরীরের হাড় গোনা যায়। কিস্তি ঘুরতেই থাকে–ঋণচক্র শেষ হয় না। গ্রহীতার টাকা বিনিয়োগের পরিসর সংকোচিত।টাকায় টাকা না এনে– টাকা চলে যাচ্ছে ভোগে– অনুৎপাদনশীল খাতে। আয়ের চেয়ে সুদহার বেশি। এই অপরিকল্পিত বাধ্যতামূলক ঋণ হাট বাজারেও প্রভাব পড়তে থাকে দিনে দিনে। কিস্তির দাপটে লোপাট হতে থাকে অর্থ। সকলের সামনে অথচ স্থানিক কারবারিরা নিরুপায়।
যদিও গত শতকের আটের দশকে উৎসাহী পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিলে মিশে সমবায় সমিতি গঠনে করে ফেলেছে।’সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’— এই নীতিমন্ত্র নিয়েই নানা সমিতি গড়ে ওঠে তারাগঞ্জ বাজারে। কেউ কেউ সফল হয়। কেউ কেউ তহবিল তছরুপ করে পালায়। সর্বশান্ত হয় সমিতির মেম্বার আর ক্রমেই বাজারে নিজের দোকান ঢলে পড়ে। সমিতি গঠন ও তৎপরতার প্রভাব ব্যবসায়ে প্রত্যক্ষভাবে পড়ে। লোভ বাড়ে। অনেকে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দেন।পাইকারি দোকান থেকে খুচরা দোকানে নেমে আসে। কেউ কেউ ঋণের দায়ে পালায়। পালিয়ে বাঁচে। বাপের দোকান ভাইয়ে ভাইয়ে কলহে দোকান ভাগ হতে থাকে। একই দোকানের খরিদ্দারও ভাগ হয়ে যায়। বাপের ঋণ কেউ নিতে চায় না। আগের বকেয়া বারবার তাগদা দিয়ে দিয়েও ওঠে না। হিসাব তামাদি হয়ে যায়। এর প্রভাবও হাটে পড়ে।
আরও পড়ুন: আধুনিক ভারতীয় কথাসাহিত্য: প্রসঙ্গ ‘ময়লা আঁচল’
ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ী সমিতি আর বণিক সমিতি সফল হয়। ওঠে দাঁড়ায়। সমবায়ী তৎপরতা তাদের সাহস জোগায়। নিজস্ব ঠিকানা গড়ে তুলে।বহুতল ভবন গড়ে। মার্কেটে কাঁচের ঘেরা গার্মেন্টসের চোখ ধাধাঁনো দোকান। নিয়ন আলো দিনের বেলাও চকচক করে।
এখন বরং থাক একালের কথা। আমি বরং এই নালিতাবাড়ী বন্দরের পুরাতন হাটের কথা বলি। কেমন ছিল সেই সময়ের গমগম করা হাটের মন ও দেহ।হাটের ঔজ্জ্বল্য। হাটের রুক্ষতা। হাটের অলঙ্কার। হাটের বাটপারি। হাটের মাঝে ধরা পড়া পকেটমারের ত্রাহি অবস্থা। এই হাট এই তল্লাটের বারো গ্রামের বারো রকমের মানুষের বারোয়ারী হাটের মেলা।প্রাণের মেলামেলির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
পরব ভাঙা হাটের হাটুরে আমি স্মৃতির ঝাঁপি খুলে পরতে পরতে সাজিয়ে দেই বরং মঙ্গলবারের বড় হাটের কথকতা। নানা স্থানের হাট মূলত নানা স্থানিকতার চিহ্নে ভরপুর। এই চিহ্নে কোথাও মিল আবার কোথাও অমিল।এই মিল অমিল নিয়েই স্থানিকের হাট। স্থানিকের হাট স্থানিক মানুষের আদান প্রদানের ক্ষমতার বিকাশ কেন্দ্র। ছোট ছোট পুঁজির খেলাখেলির ভিতর বেঁচে থাকা। বিকশিত হয় স্থানিক অর্থনীতি। মুশকিল হয়ে পড়ে হাটুরে ক্রেতা হাটুরে বিক্রেতার মাঝে যখন মধ্য স্বত্বভোগীরা ঢুকে পড়ে;হাতে পায়ে বাড়তে থেকে আর ক্ষতি করে প্রান্তিক কৃষি উৎপাদক ও পণ্য— যেখানে গিয়ে সে নিঃশেষ হয় মানে ভোক্তাকে। দুইজনের-ই পকেট সাবাড়।
মাঝখান থেকে উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন দালালের গতরে বাড়ে। স্থানিক বাজার এক সময় মুখ থুবড়ে পড়ে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের এই এক উটকো ঝামেলা। সবাই জানি বুঝি অথচ নিরুপায়। মাঝখান থেকে স্থানিকতার দাগ মুছে যায়। সবাইকে একই মোড়কে সাজাতে গিয়ে হাটের স্বকীয়তা হারিয়ে যায়।
এক সময় স্থানিক হাটে তোকমাদানা, লেবু, তেঁতুল, লেবুপাতা দিয়ে এই তারাগঞ্জ হাটে গরমে বিক্রি হতো শরবত। নানা কথার তুবড়ি তুলে নানা স্বাদের শরবত চৈতের গরম আর হাটের ভাপে হাটুরেদের খেতে দারুণ লাগত। ঘামঝরা শরীর নিমিষেই ঠাণ্ডা। অথবা ভীড় ঠেলে ঘোষপট্টির ঘোল–দুধ থেকে ক্রিম বের করে দুধের বাকিটুকু মাটির মটকায় রেখে গ্লাস প্রতি বিক্রি হতো বারো আনায়। একেক হাটের শরবত বা ঘোল একেক রঙের– একেক স্বাদের। হাত যশের কারণে বিক্রি বাট্টা বাড়ত। আমিও ভীড় ঠেলে ডকডক করে বিট লবন মেশানো ঘোল খেয়েছে কতবার। এটি স্থানিক হাটের চিহ্ন। এখন সেই দিন গেছে। গোলশান-বারিধারা টু প্রান্তিকের কুটির–সর্বত্র কোকাকোলা পেপসি বিরাজিত। ডাকলেই হাজির। একই ধরনের স্বাদ। পার্থক্য শুধু গ্লাস।
খাবারের কথা যেহেতু উঠলই আরেকটু আঁচিয়ে দেখি। মধ্যবাজারের ভেতর দিকে সারি সারি ভাতের দোকান। মঙ্গলে শুক্রে উপচে পড়া ভীড়। হাটের দিন বলে কথা! সামনের টেবিলে রাখা গামলা রঙিন চালুন দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কোনটার চালুন ঈষৎ খুলে রাখা হয়েছে। দোকানে হলুদ আর পেঁয়াজের কড়া গন্ধ। গামলায় ভাসছে মাছ। খাসির মাংস। গরুর মাংস। কড়া রঙের ঝোল। উপরে তেল থৈ থৈ করছে। দেখলেই জিভে জল আসে। আসে মানে– আসতে বাধ্য। ক্লান্ত হাটুরেরা দুপুরে কিংবা দুপুর গড়িয়ে গেলেও এই দোকান বা পাশের ভাতের দোকানে ভীড় লেগেই থাকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত।
আরেকটা এগিয়েই গেলে দুধের বাজার। দোনায় আনা দুধ। কলা পাতা কচু পাতা দিয়ে মোড়ানো মাটির দোনায় দুধ। দুধের মাঝে বাঁশপাতা ডুবানো।বাবার হাতে ধরে দুধের বাজারে বারবার গিয়েও জানতে পারিনি দুধের ভেতর কেন সবুজ রঙের বাঁশ পাতা আধেক ডুবে আছে? কোনো দোনায় আবার মহিষের দুধ বা থকথক দৈ–সাদা ফকফকা দৈ। চিড়ামুড়ি দিয়ে এই থকথকে দৈ খেতে দারুণ মজা। তবে একটু লবণ বা মুটা গুড় দিলে স্বাদ একেবারে টাকরায় লেগে থাকে।
দুধঅলা বা দৈঅলাদের বাড়ি ততদূরে নয়– যোগানিয়া কালিনগর শিমূলতলা ছিটপাড়ায়। তবে কাঁচা চিড়ে হালকা গরম ভাপে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে যে নকুল তৈরি হতো তা আসত মানুপাড়া আন্ধারুপাড়া চাটকিয়া সিধুলী ভটপুর অঞ্চলের বর্মণ রাজবংশীদের ঘর হতে। দৈ বা দুধে দিয়ে খেলে পেটে ফুলতে থাকে নকুল। সকালে খেলে ‘সাইন্ধ্যাবেলাও খিদা লাগে না। তারাগঞ্জ বাজার হাটে এটি আলাদা চিহ্ন। জানি না এখন আর পাওয়া যায় কিনা?
হাটুরেরা রসগোল্লার চেয়ে দানাগোল্লা বা গুড়ের জিলাপির প্রতি পক্ষপাত বেশি। রস গোল্লার দাম বেশি।গোটা তিনেক খেলেও ‘হাউশ’ মেটে না–পেটও ভরে না। তারচেয়ে দানাগোল্লা ভালো।বুরিন্দা ভালো। গুড়ের রসে চবানো জিলাপি ভালো। আটার তৈরি তেলে ভাজা গোলগুলি ভালো। গজা ভালো। ’বিয়ানবেলা’ থেকে এতো দূর হেঁটে তবে হাটের পেটে ঢুকতে হয়।কেনাকাটার আগে বা পরে হাটুরেরা ‘সাগাইবাড়ি’ যাবার জন্য মাটির হাড়িতে কিনে নিয়ে যান।
চেয়ার টেবিলঅলা দুয়েকটা মিষ্টির দোকান থাকলেও হাটুরেদের ঝোঁক খোলা আকাশের নিচে ছড়ানো দোকানের বেঞ্চির দিকেই। দামে সস্তা।মাটিতে বসা দোকানিকে আপনার লোক ভাববারও কারণ জারি থাকে। অথবা কাঁচঘেরা আলমারির মিষ্টি দোকানে হারাবার বা ঠকে যাবার ভয় বুকের গভীরে থাকেই। নইলে এই কথা উঠবে কেন ‘বাজাইরা মানুষের ভাও রান্ধে ছালুন পাতে দেয় ডাউল।’
তাছাড়া আমার গ্রামের বন্ধুরা যারা তারাগঞ্জ স্কুলে পড়ত আমাদের সাথে একটু ফাঁক রেখেই মিশতো। আমাদের প্রগলভতা ওদের পছন্দ হতো না।আমাদের ইয়ার্কি ফাজলামো ওরা এড়িয়ে চলত। গোপনে আমাদের বলত ‘বাজাইরা ফাত্রা পোলা।’
দক্ষিণ বাজারের মাঝামাঝিতে গুড়হাটি। মঙ্গল বা শুক্রবার ভোর হবার আগেই দেখতাম একের পর এক গোরু বা মহিষের গাড়ি ঢুকছে তারাগঞ্জের পেটের ভিতর। গাড়ি বোঝাই গুড়।মুটা গুড়। পাড়ি গুড়।ইসলামপুরের গুড়। এই হাটে ইসলামপুরের গুড়ের নামডাক বহু আগে থেকেই। গুড় আসে মাদারগঞ্জ দেওয়ানগঞ্জ ইত্যাদি জায়গা হতে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা সারা মাসের জন্যেই গুড় কিনা রাখত। ঘরের মেঝেতে চট বা পাটি বা ধাড়ি বিছিয়ে সাজিয়ে রাখতো। আবার কেউ কেউ বড় তেলের ড্রামে গোল করে মুখ ও ঢাকনা বানিয়ে সেখানে মজুত করে রাখত।
শুধু যে পাইকারি সেল হতো তা নয়। গুড়ের উপর গুড় সাজিয়ে গুড়ের পিরামিড বানিয়ে হাটুরে বিক্রেতা বসত এখানে। আস্তও বিক্রি হতো আবার আধ পোয়া তিন ছটাকও বিক্রি হতো। চিনির চেয়ে মুটা গুড়ের বিক্রি বেশি। দামে কম। সাদা মিহিদানা চিনি তখন সব দোকানে পাওয়া যায় না। চিনি মানে মোটাদানার একটু লালচে চিনি। মিষ্টি বেশি। দামও। কেজি’র মাপ তখনও ঢুকেনি– আসবে আসবে করছে। কানাকানি বলাবলি শুনি। সেরের মাপ কেজি’র মাপ নিয়ে কুটকচাল শুনি। হাটুরে ক্রেতা ঠকবে শুনি। ওজন কম হবার ভয়ও শুনি।
আরও পড়ুন: মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: মধ্যযুগের কবিদের চোখে ৪
সারি সারি গোরুগাড়ির আঁড়বাঁশে গোরু বেঁধে রেখেছে। গুড়ের পাইকার গামছা দিয়ে গোরুর শরীর মুছাতে মুছাতে মাছি তাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে রাখা নাড়া খেতে দিয়ে নিজেও গরুগাড়ির চাতালে একটু জিরিয়ে নেন। এখানে সেখানে পড়ে আছে গরুর মূত্র— লালচে হলদেটে– গরুর গোবর।বেশিক্ষণ থাকে না। গোবর পড়তে না পড়তে ‘উড়ি’র ভেতর কেউ না কেউ নিয়ে যায়। পাটশলায় গোবরের মুটি দেবে অথবা তুষে মিশিয়ে গুটি।জ্বালানির জন্য। নিজের জন্য যেমন তেমনি বিক্রির জন্যও। সংসারের ‘মাইয়া মাইনসের’ দুই পয়সার রোজগার– এই ভাষাতেই আমাদের মফস্বলে রোজগেরে প্রান্তিক নারীদের অভিহিত করত।
গুড়পট্টি থেকে একটু এগিয়ে যে রাস্তা পশ্চিম দিকে আবাদি জমির দিকে গেছে এখানে বসতি কম। চামড়ার গোদাম– পঁচা চামড়ায় লবণ মাখিয়ে রোদে মেলে দেয় যে মাঠে সেখানে আমরা খেলি। ঘুড়ি ওড়াই। মাঠের দক্ষিণে গোটা চারেক ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষের ঘর। এই রাস্তায় গোরু গাড়ি ও গাড়িয়াল একই সাথে হাটের দিনে একটু জিরিয়ে নেন। ভীড়ভাট্টা কম। এই পথটি একটা গোপন নাম আছে। ‘উল্টাপট্টি’— নামটি বেশ।কৌতূহল জমে মনে। আসল ব্যাপার হলো শেষ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে কাছিম বিক্রি হতো। আমরা বলতাম ‘কাউট্টা’। ডালু বা হদিরাই চটের ব্যাগে করে নিয়ে এসে উল্টো করে কাছিম রেখে দিত কাঁচা রাস্তার পাশে। কাছিম চার পা উপর দিকে বারবার উঠিয়ে কী যেন ধরবার কসরত করতে করতে মাথাটি একবার ভেতরে টেনে নেয় আরেকবার প্রশস্ত গলা বের করত ছোট চোখের বড় চাহনি করে। উল্টো করে রাখা কাছিমের সাদা বুক জলের অভাবে হলদেটে হয়ে যেতো রোদের তাপে।
উত্তর দক্ষিণ বরাবর রাস্তা আর তার মধ্যম তল্লাট যেমনটা রাগী রাগী ব্যস্ত হাট পশ্চিমাংশ কিছুটা শান্ত। তবুও হাটের আঁচ পাওয়া যায়। এই দিকে কুলুপট্টি–গোটা দশেক পরিবার বংশ পরম্পরায় ঘানি তেলের ব্যবসা তাদের। সরিষা পিসে তেল করে। এই তল্লাটে বলে ‘খাস’ তেল। দাম একটু বেশি বটে তবে সকলের স্বাদ ও সাধ খাস তেলের দিকে। প্রত্যেক ঘানিতেই তাগড়া স্বাস্থবান গোরু। চোখে ঠুলি পড়ে ঘুরছে পায়ের খুরে আঁকা বৃত্তরেখা ধরে। আর ঘানি খুঁটির কোমরের গোল গর্ত দিয়ে টুপটাপ করে পড়ছে ঝাঁঝালো সরিষার তেল। অন্যপাশ দিয়ে খৈইল।
হাটে ডালডা ও পামওয়েলের পাশাপাশি এক ছটাক বা এক পোয়া ‘খাস’ তেল হাটুরেদের কেনা চাই-ই। তখন রান্নায় যে সবাই খাস তেল ব্যবহার করত তা না। খাস তেল মূলত স্নানের আগে শরীরে মর্দন করে মাথাভর্তি চুলে আর দুই কানে দুই নাকের গর্তমুখে আর নাভিতে ‘কেনে’ আঙুলে তেল ডলে আর গায়ে তেল জুবজুবে হয়েই তবে না স্নান। তেল তেল স্নাত শরীর কী সুন্দরই না দেখাতো পেলব শরীর! এটা মফস্বলের আচার। এখন নেই। উঠে গেছে।
একদিন কুলুপট্টি থেকে সাহাপাড়ার দিকে যেই পা দিয়েছি অমনি কানে এলো–
“সুবচনী মঙ্গল চণ্ডী যার বাড়িতে যায়
বাটা ভরা তেল সিদূঁর সেই বাড়িতে পায়।”
সুর কানে আসতেই দাঁড়ালাম। গায়ককে চিনি আমি। তিনি গোলাক নাথ বৈরাগী। নাথপন্থী সম্প্রদায়ের লোক। দেখেই হাসলেন। পরনে লাল সালুধুতি হাটু অব্দি তোলা। ধূলায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হাতাঅলা সাদা গেঞ্জি পরনে। শনি-মঙ্গলবারে আসে গৃহস্থের বাড়িতে বাড়িতে গান গাইতে গাইতে। সুবচনী মেয়েলীব্রত— এয়োতীরা স্বামী সন্তান সংসারের নানা বিপদ আপদে সুবচনীর কাছে মানত করেন। বার মাস চলে এই ব্রত।মঙ্গলবারে বড়ো হাট বলে গোলকনাথের বাড়তি সুবিধা। মাগুন তোলা আর তা বিক্রি করে কিছু পুজার জন্য রেখে দেয়া আর কিছু নিজের জীবিকার জন্য এই মঙ্গলের হাটে বিক্রি করে দেয়–রথ দেখার মতো কলা বেচাও হয়ে যায় গোলক নাথের।
এয়োতীরা কী কম কিছু দেয়? সুবচনীর মাটির মূর্তিতে তেল সিঁদূর ধান দুব্বা উলুধ্বনি আর রক্তজবা দিয়ে অঞ্জলি দিতে দিতে থালা ভরে দেয় ‘আলাচাল’। কলা।ঘরে থাকা সবজি। উঠানের মাঁচায় নতুন আসা লাউ বা পেয়ারা ছাড়াও চার আনা আট আনা পর্যন্ত সুবচনী’র পায়ে নিবেদন করে–’মা,আমার শাখা সিঁদূর অক্ষয় করো। সংসারের মঙ্গল করো” এয়োতির এইটুকু চাওয়া। এই টুকু প্রার্থনা। নানা উঠানে ঘুরে গোলক নাথের অর্জন কম হয় না। সেগুলোই শেষ বেলা হাটে বিক্রি করে নিজের সংসারের জন্য টুকটাক কিনে বাড়ির পথ ধরেন।
এতো এতো ধুলায় ধুসরিত পা— পায়ের সাথে পা লেগে ছুটছে অথচ পাথের নিচে থেকে ভীড়ের হল্লার ভেতর থেকে উঠে আসছে ‘দুয়ারে ফকির দাঁড়াইয়া আছে– আমার আল্লা নবীর নাম– আল্লার ওয়াস্তে বাবা, ও বাবাগো দুইডা ভিক্ষা দ্যান গো আমার আল্লা নবীর নাম।’ এক হাতে সিলভারের ঝনঝন করা থালাটি এগিয়ে দিচ্ছে— অন্যদিকে মাটিতে বসে একহাত মাটিতে রাখা নুলা পা সরিয়ে সরিয়ে… বাবা গো বাবা গো… আল্লা ওয়াস্ত…. করতে করতে গড়িয়ে যাচ্ছে চারজন ভিক্ষুর দল। হাটুরেদের এতো তাড়া থাকা সত্ত্বেও সিলভারে থালায় পড়ছে চারদিক থেকে নকশা কাটা দশ পাই চৌকোনা পাঁচ পাই চার আনা কিংবা আধুলি।
চলবে…