পরব ভাঙা হাটের হাটুরে ২

।। দুই।।

যে কোনো বড় হাট মূলত বহুরূপী হাট। একটি পরিসরকে কেন্দ্র করে পরিধিতে নানা কিসিমের কায়কারবার। যার যেটা প্রয়োজন সে খুঁজে খুঁজে ঠিক ঠিক জিনিসই বেছে নিচ্ছে কিংবা বলা ভালো বেছে নিতে হয়। পুরাতন হাটের এখানে ওখানে বেড়াতে বেড়াতে আমি ঠিক-ই টের পাচ্ছি এক সময় হাট-ই ভরসা। হাট-ই আশ্রয়। হাট শুধু তখন একটি স্থানবাচক হিসেবে হাজির থাকে না— মন ও যাপনের নানা হিসাবও থাকে। তারিখের চেয়ে হাটকে মাথায় রেখে যাপনের গননা করে এই জনপদের মানুষেরা। হাটকে সূত্র ধরে ঠিকঠাক তারিখ সময় মাস বের করে ফেলে।

এই রকম হিসাবের কথা গত শতকের আটের দশকের শুরুতে শুনেছিলাম। আমাদের দোকানের সামনে রাখা একটা টুলে বসে থাকতাম এই রকম হাটের দিনে। বাইরের ‘ভাইল’ দেয়া জিনিসপত্র মানে সাজানো জিনিসপত্র কেউ যেন নিতে না পারে চুরি করে। তখন বয়স্ক হাটুরেদের মুখে শুনতাম– ’গত হাটবারের আগের হাটবার মাইনে যে হাটবার ঝড় হইল হেই হাটবারের পরদিন নাতি অইছে।” অথবা ‘কার্তিকের হাটবারগুলো যাউগগা। অগ্রান মাসের পত্থম হাটবারেই তোমারে তুমার ট্যাহা দিয়া দিমু– জবান দিলাম।”

জ্বরজারি কিংবা খোঁচপাচড়া বা চোখওঠার মতো অসুখে খুব একটা চটজলদি না হলে ঔষধপত্রও কেনে হাটকে মাথায় রেখে। ‘সামনের হাটে বাজারে যামু। হামিদ ডাক্তারের সাথে আলাপ কইরা দেখি। ’তখন চোখওঠা ও খোঁচপাচড়া প্রায় সকল বাচ্চাদেরই হতো। হাত পায়ে দগদগে ঘা হয়ে যেতো। পুঁচ পড়তো। মাছি ভনভন করতো ঘায়ের চারদিকে। আর ঘায়ের মাঝে চুলকানি তো ছিল-ই। চুলকাতে আরাম লাগে বটে– তবে সেখানেও ঘা হয়ে যেতো– দগদগে সাদা মাংসের ঘা আর রক্তপূজ।

হাটবারে ডাক্তার হামিদের চেম্বারে উপচে পড়া ভীড়। তিনি চোখওঠা আর খোস পাঁচড়া জন্য নিজস্ব কায়দায় মলম উদ্ভাবন করেছিলনে। টেকসই–কার্যকরি। দ্রুত রোগী সেরে ওঠার কারণে ‘নেত্রবিন্দু’ ও ‘প্রীতিমলম’ এর নাম ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গা। সেই সময়ে ডাক্তার হামিদ ছাড়াও ছিলেন গোগাল ডাক্তার ও হোমিওপ্যাথির দলিল ডাক্তারও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন হাটুরেদের মাঝে।

আরও পড়ুন: পরব ভাঙা হাটের হাটুরে

ডাক্তার গোপাল দত্ত অল্প কথার স্বল্পভাষী মানুষ। চৌরাশী বছর জীবনের প্রায় পঞ্চাশ বছর এই পাণ্ডববর্জিত তল্লাটে তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেছেন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। হাতের কাছে ডাক্তার মানেই গোপাল ডাক্তার। দীর্ঘদেহি মানুষটির পায়ে পালিশ করা কালো জুতা আর চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরে বাম হাতে ধুতির কুঁচি একটু উচিয়ে যখন হাঁটতেন দারুণ এক স্নিগ্ধতা ও লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ত।

আর টোটকাটুটকি কবিরাজও ছিলেন হাটে। পশ্চিমমুখী মুখ করে ঝাঁড়ফোঁকও করতেন। হাটের মাঝে ছোট্ট একটা জলচৌকির উপর গোটা পাঁচেক কাঁচের বোতলে কালো রঙের কী যেন কী বিক্রি করতেন ভানু ভট্টাচার্য। লোকে বলত সালসা। তিনি মূলত ছিলেন, গৃহ শিক্ষক। কোন না কোন বাসায় আশেপাশের গোটা দশেক বাচ্চা একত্রিত হয়ে তার তত্ত্বাবধানে পড়ত। আমিও ছিলাম সে দলে। উঁচালম্ব লোকটা বেতও ছিল বেশ লম্বা। চেয়ারে বসেই ছাত্রদের পেটাতে তার অসুবিধা হতো না। এই তিনি আর্য়ুবেদিক চর্চা করতেন। নিজেই বানাতেন অর্জুনারিস্ট কিংবা বলারিস্ট ইত্যাদি যা সালসা।

তবে এই ক্ষেত্রে আরেকটি লোক ছিল। নামটি আজ মনে নেই। ইয়া বড় বাঁশের আগায় মাইক বেঁধে আসর বসাতেন বাউল গানের। সেখানেই তারা বাউলের প্রথম গান শুনি। গোল হয়ে মানুষ জমে গেলেই গান থামিয়ে তিনি বলতে শুরু করতেন কৌষ্টকাঠিন্য থেকে শুরু করে বদ হজম পুরাতন আমাশা শরীরের দূর্বলতা ধ্বজভঙ্গ লিঙ্গ আগামোটা গোড় চিকন সহ নানা জাতের কথা। রসিয়ে রসিয়ে বলে বলে শ্রোতের বসিয়ে দিতেন। এমন মিষ্টি করে ছন্দে ছন্দে বলতেন যে বসিয়ে শোনা ছাড়া কোন পথ খোলা থাকে না। তার তৈরিকৃত সালসা খুব জনপ্রিয় ছিল।

গুরুদাস সাহার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক কবিরাজের দোকান। পরিশ্রমী মানুষ। তার খামারে ছিল নানা ঔষধী গাছের বিস্তার। চিনতেনও বটে। জানতেনও ব্যাপক। তাঁর তৈরিকৃত হজমী শুধু আমাকে না–  প্রায় সকলকেই দিতেন। দোকানে বসে আমরা বলাবলি করতাম তার দোকানে নিশ্চয়ই হাজার দশেক কৌটায় আছে কোন না কোন ঔষধের কাঁচালাম। রঙ দিয়ে লিখে রেখেছেন তিনি। কৌটার পেছনে কৌটা তার পিছনে কৌটা– নাম শুনেই ওঠে গিয়ে চট করে নিয়ে আসতে পারতেন তিনি।

এখানে বসে থেকে থেকে কত গাছন্ত ঔষুধের নামই না মুখস্ত করেছিলাম। গুরুদাস কাকা ছোট ছোট কালো বটিকা বানিয়ে রোদে দিতেন। কী দিয়ে কী বানাতেন তা আমরা জানতাম না। তবে শুনেছি মেয়েদের মাসিককালীন তল পেটের ব্যথা রোধ করার এক মহার্ঘ বস্ত এই বটিকা। মঙ্গলে শুক্রে এখানে হাটুরেরা কেনাকাটা করতেন। কিভাবে বটিকা বা তেল মালিশ করতে হবে তার নিদান দিতেন গুরুদাশ কাকা।

আরও পড়ুন: আজ মুক্তিযোদ্ধা, ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিত্ত হালদার’র ৪৬তম প্রয়াণ দিবস

হাটের লাবণ্যতার আরেকটি দিক হলো আলতা পাওডার লাল নীল কালো ফিতে আর ক্লিপ আর নানা রঙের নানা বর্ণের রেশমি চূড়ি। কাঁচের গায়ে লাগালাগির ঝনঝন রিনিঝিনির ঝঙ্কার আর টিপ– নেইল পালিশ কিংবা লিপস্টিক। সব কালেই মেয়েরা তার তার সময়ের আয়োজনের সাথে তাল ও টাল রেখেই নিজেকে সাজাবার উপকরণ কেনবার আকুলতা থাকে। আটের দশকে এই মধ্য বাজারের ঢাকাইয়া পট্টি এমন এমন কসমেটিকস পণ্যে বাহারে বাজার রঙিন হয়ে ওঠে। ঢাকাইয়া পট্টি গড়ে ওঠে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিক্রমপুর মুন্সিগঞ্জ নোয়াখালী থেকে আসা মানুষদের প্রযত্নে।

হাটুরে এখানে কিছুটা যত্নবান। যদিও তখনও হাটে নারী হাটুরেদের প্রবেশ ঘটেনি। মেয়ে বা স্ত্রী বলে দেয়া রঙ ও নির্দেশনায় মেনে হাটুরেরা এখানে কেনাকাটা করেন। কিনেন ‘বাসনা’ সাবান কসকো, হাবীব সাবান, কাপড় কাচার ১০ নং বাংলা সাবান বা ৫৭০ সাবান অথবা তিব্বস স্নো, তিব্বত টেলকম ঘামাচি পাওডার।

ভীড় আর হল্লার ভিতর… এই পান পান… খয়ের সুপারি পান… অথবা আরে ভাই নিয়া যান নিয়া যান ভাবি সা’বের জন্য নিয়া যান… জায়গায় খাইয়া জায়গায় মইরবে… নিয়া যান…সুই সুই আরে সুই সুই… দশ সুই এক টাকা। আবার সেই হয়ত বা ‘আতর আতর সুগন্ধী আতর। আতর দেয়া কোন বিলাসিতা নয়– আতর ব্যবহার সুন্নতে রসুল’’। একজনকে এই পট্টিতে দেখি তো অন্য জনকে অন্য মোড়ের ভীড়ের ভেতর চেঁচিয়ে বিক্রি করছে। তাকে মাঝে রেখে হাটুরে কিনছে ইঁদূর মারার ঔষধ বা আতর অথবা মাথা ব্যথার মলম কিংবা কাঁথা সেলাই করার সুঁই।

গলায় রশি দিয়ে ঝুলানো মুখখোলা টিনের বাক্সের মাঝে থরে থরে সাজানো পন্য সামগ্রী।চৌরাস্তা মোড়ে আসা মাত্রই আমার কানে বাজছে। পান পান… এই পান পান.. যেন এই সেদিনের কথা। পরব ভাঙা হাটুরে আমি ভাঙা হাটের ভিতর উঁকি দিচ্ছে প্রাণবান হাট। আরেকটু গিয়ে গেলেই করিমের পেঁয়াজের দোকান। আহা! কী সুভাস। খেতেও দারুণ। বড় ১০ নং কড়াই পেঁয়াজু ভাঁজছে আর নিমিষেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি যেখানে বসতেন পাশেই ছিল ইঁদারা– বড় ইন্দারা। গোটা বিশেক লোক চারদিকে দাঁড়িয়ে জল তুলতে পারতেন। তখন পানীয় জলের উৎস বলতেই তো পাতকুয়া বা ইঁদারা।এই ইন্দারাটি গত শতকের গোড়ায় দিকে সংস্কার করা হয়। তবে খনন তারও আগে। সরকারি ইন্দারা–দরকারি পানীয় জলের আধার। এই হাটুরে মানুষের জন্যেই নির্মিত হয়েছিল।হাটুরেরা যেন তিয়াস মেটাতে পার। আটের দশকে যখন আমি দেখি তখন ইন্দারা ময়লা ফেলার ডাস্টবিন। প্রায় ভরে গেছে।

আরও পড়ুন: চর্যাপদের ভাষা বিতর্ক 

বাঁশের তৈরি ডুলি, কুলা, খালুই, খাঁচা, রান্না ঘরের খাবার রাখার কয়েক থাক বিশিষ্ট মাচা, চাটাই, ধারী, গোলা, ঝুঁড়ি, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, দরমা বা মাথাল যখন হাটের খোলা জায়গায় সাজিয়ে রাখে– তখন দেখতে দারুণ লাগে। নয়া বাঁশের কাবাড়ি চেঁছে তৈরি জিনিসে সূর্যের আলো পড়তেই চকচক করে ওঠে।

তারাগঞ্জ বাজার হাটে এই বাঁশের তৈরি পণ্যের যে চাহিদা ছিল তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। হাজং বা রাজবংশী বা হদি ডালু ও প্রান্তিক মুসলিম কৃষকই ছিল মূলত এই শিল্পের কারিগর। এখন আর তার উপযোগিতা নেই। প্রান্তিক সমাজে দীর্ঘদিন ধরে এরা রাজত্ব করে গেছে। এখন যে নেই তা নয়। হয় জাদুঘরে অথবা ড্রয়িং রুমে শোপিস হিসাবে।

প্রাত্যহিক যাপনে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র নেই– নেই পাতিল হাটির বাজার। ঘট পট হাঁড়ি পাতিল বাটি থালা মুচি সরা মাটির ব্যাংক টেপা পুতুল মাটির ঘোড়া গোরু হাতি কলস মটকা সহ নানা মাটির তৈরি জিনিসে সয়লাব হতো এই পাতিল হাটিতে। সারি সারি গেরুয়া রঙের মাটির ব্যবহার্য সামগ্রী দেখতে দারুণ লাগত। তখন তো মুড়ি বা খই ভাঁজবার একটা চল ছিল কোন না কোন বাড়িতে। গেরস্তের এই হাটবারগুলোই ভরসা। নদী পার হয়ে খালভাঙা কম দূরে নয়– সেখান থেকেই আসত এই সব– নৌকা বোঝাই করে আমবাগানের ঘাটে– ছোট হাটে অথবা বড় হাটের সকালে। এখন সে সব দিন গেছে পর্দার অন্তরালে।

প্রয়োজনের খাতিরে সব কিছু আয়োজিত হয়। আয়োজক তার উপায় সেই সেই সময়ের গর্ভ থেকেই নেয়— নিতে হয়। এক সময় বড় বড় মটকা শুটকি সংরক্ষণে ছিল প্রয়োজন। তারাগঞ্জের হাট শুটকি কেনাবেচার একটা প্রসারিত পরিসর। এখন সে বাজার আরো প্রসারিত হয়েছে। শুধু হাটবার নয়– এখন প্রতিদিনের বাজার। প্রতিদিনের সওদা।

চেপা শুটকি ইঁচা মাছের শুটকি হিদল পুটি বা মলার শুটকি এই তল্লাটে চাহিদা রয়েছে। তবে নোনা ইলিশে আমার পক্ষপাত পরিবারবাহিত। হলদেটে হয়ে যাওয়া নোনা ইলিশের পেট মালার মতো ফালা ফালা করে কাটা। দেখতে দারুণ লাগে। আস্ত নোনা ইলিশ কে আর কেনে? এক পোয়া আধা পোয়া। হলদেটে শটি গাছের পাতায় মুড়িয়ে সুতলি দিয়ে বেঁধে হাটুরের চটের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয় পুটলা। এখন আর তা নয়– এখন পলিতিন– সর্বত্র পলিথিন।

এখন অবশ্য দূর দূর থেকে শুটকির আমদানি হচ্ছে। প্যাকেট জাত। নানা জাতীয় সামদ্রিক মাছের শুটকি আসে। রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে। মটকা থেকে বের করার সময় যে উটকো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সেটা আমার ভালো লাগে না। বমি বমি ভাব হয়। নাক চেপে দ্রুত পাড় হই শুটকিপট্টি।

পাতিলহাটি থেকে দক্ষিনে এগিয়ে গেলেই কামার পট্টি। পাশেই বড় পুস্করিণী। সারা বছর-ই জল আর মাছে টইটুম্বুর। এখন অবশ্য নেই। শুধু এটি নয় আরো আরো জলাধার ভরাট হয়ে গেছে। দুমদাম হাতুড়ি পেটা আর হাপরের অগ্নিমুখে লোহার লাল শরীর পিটিয়ে পিটিয়ে বানাচ্ছে নরুন, দা, কোদাল, শাবল, কুড়াল ছোট বড় বটি, চাকু, ফলা, রামদা, চিমটি, ফলা, নিরাণী, খুন্তি, বাকানো কাস্তে।

ধান কাটার মৌসুমে কাস্তের মিহিদানা দাঁত দারুন দক্ষতায় বানাত আমার ক্লাসমেট হারাধন কর্মকার। পাশে বসে থেকে কতদিন দেখেছি উবু হয়ে ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে কাস্তের দাঁত তুলছে হারাধন। কাস্তের দাঁত যত সুক্ষ্ম ধানের গোছা কাটতে তত সহজ। হাটের দিনে অবসর নেই এই কামার পট্টির গোটা দশকে দোকানদারদের।

আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার হলেই কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে?

তবে কামার পট্টিতে ব্যস্ততা থাকলেও গোটা চারেক স্বর্ণকারের দোকানে তত তাড়া নেই। সোনার ব্যবহার সবাই কি করে? তবে রূপার মল নাকের দুল নথ নোলক ছোট ছেলেমেয়ের কোমরের বিছা গড়িয়ে ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে দিতে কার না ইচ্ছে জাগে?

ঠাণ্ডু পোদ্দারের দোকানে ভীড় কমই বটে। কামারের চেয়ে আকারে ছোট চুল্লির ছোট্টো হাতুড়িই তার হাতিয়ার। পিতলের ফুকনি বা বাঁকনল দিয়ে কুপির শিখা সোনা রূপার টুকরোতে ফেলেই নানা গড়ন করেন সোনারু। কামারের এক ঘা আর সোনারুর ছোটো ছোটো হাজার ঘা। দুইজনেই বিশ্বকর্মার শিষ্য কারিগর।

বলছিলাম মফস্বলি হাটের কথা। পরব ভাঙা হাটের কথা। এখনও এখানে দাঁড়িয়ে তখনকার কথা। সেদিনকার কথা। হাটের বহুরূপের কথা। এক হাটের শরীরে যে কত কথা কত সুর। এই যেমন গণিতের বিএসসি’র কথা। লোকমুখে ফিরে তার নাম ডাক। অমুক বিএসসি’র অংকের ডাক মুখস্ত। আরে সেই অংকের কী উত্তর হবে সেটাও তার কলমের ডগায়। আবার গণিতের যেমন থাকে তেমনি ইংরেজির শিক্ষকেরও। উনি তো ইংরেজির জাহাজ। ডিকশিনারি মুখস্ত। তাদের এই প্রতিভার কথা রাষ্ট্র হয়ে যায় এই হাটেই হাটুরেদের মুখে মুখে। অপরে অনুপ্রাণিত হয়। তারাই মফস্বল সমাজের রোল মডেল।

তেমন থাকে পাগল। সকলেই চেনে জানে–জানে পাগলের বিরক্তিকর আচরণ। কেউ একটা বিশেষ কিছু বলে না। পাগল সমাজের অংশ।সমাজের প্রচল মানের সাথে খাপ খায়িয়ে নিতে পারে না। সমাজের শিকার হয়েই প্রখর অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ চিড়ে চেপ্টা হয়ে যায়। তার নিজের মতো প্রকাশকেই তখন আমরা বলি পাগলামী। ভবঘুরে। ভেগাবণ্ড।

আটের দশকে তেমন আমাদের তল্লাটে দুটি পাগল ছিল। আচরণে আলাদা। নিজস্বে ঢঙে তাদের পাগলামী। হাটে বেশী মানুষ দেখেই তাদের পাগলামি একটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতো। সবচে অবাক এই যে এই হাটের ভীড়ও তাদের সহ্য করে নিতে।

একজন মোহাম্মদ আলী পাগল। কালো ছিপছিপে হালকা গড়ন। থুতনিতে হাত রেখে ঘাড় কাৎ করে ঈষৎ বেঁকে দাঁড়িয়ে পড়ত যেখানেই তার মন চায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ মাউথপিসের মতো হাতমুঠি করে নেতাদের মতো করে বক্তৃতা শুরু করতেন। কথার চেয়ে চিৎকারই করতেন বেশি। মাঝে মাঝে গোটা দশেক ইংরেজি বাক্যও বলে ফেলতেন। সেটি-ই ছিল আমাদের আগ্রহ। কেউ বলতেন পাগলা বিএ পাস– বউ ধুতরাবীজ খাইয়িয়ে পাগল করে দিয়েছে।

অনেক বছর পর দুই দোকানের মাঝখানে ছোট্ট একটা চা-স্টলে দেখি বুড়িয়ে যাওয়া মোহাম্মদ আলী পাগলা পায়ের উপর পা রেখে চা পান করছে। এগিয়ে গিয়ে ”পাগলা ভাই কেমন আছেন? জিজ্ঞেস কড়তেই,মুচকি হেসে বললেন, “পাগলা বলতে নাই। বলো আলী ভাই কেমন আছেন।”

আরেক জন কডু পাগলা। বয়স্ক। সারা শরীরে কালিঝুলি মাখা। আগুনে পুড়ে যাওয়া চট লুঙ্গির মতো করে পরা–উদোম গা। গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে নানা কিছু। কী নেই সেখানে। নারকেলের মালা। ছেঁড়া স্যাণ্ডেল, মগ, ভাঙা কড়াই, কেরোসিনের বোতল আর কোমরের চারপাশে নানা ছিট কাপড়ের টুকরোটাকরা। কাপড় পট্টিতে যে খলিফারা রিপুকাজ করে লুঙ্গি সেলাই করে বা বাচ্চাদের ফ্রক বানানোর সময় যে ছাটকাপড় পড়ে থাকে নিচে সেগুলোই কডু পাগলা তার কোমরে জড়িয়ে রেখেছে।

আরও পড়ুন: আজকের বাংলায় লেখকদের পরিস্থিতি

তার ফ্যাসফ্যাস গলায় হে হে হৈ হৈ করতে করতে নেচে নেচে একবার উত্তরমুখী আবার দক্ষিনমুখী। এই দুই কাজই তার একমাত্র কাজ। তবে কেউ কিছু বললে বা ঢিল দিলে তার আর রক্ষা নেই– মুখ থেকে বেরুতে থাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ। সেটাই বিরক্তিকর। আমাদের হাটের শরীরে মোহাম্মদ আলী বা কডু পালগা অলঙ্কার।

খা..খা রে বক্ষিলারে খা.. বলে যখন ছোট কাঠের ঝাঁপি থেকে গোখরো সাপ বের করে আনে তখন তো আমরা আহ্লাদে আটখানা। পিদিম জ্বলবার আগেই যেমন সলতে পাকাতে হয় তেমনি সাপুড়িয়ার শিষ্যের বীণ বাজানোতেই লোক জমে যায়। গোল হয়ে যায়। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে মঙ্গলবার হাটের হাটুরে। কেনা কাটা গোল্লায় যাক। ফণা তোলা সাপের নাচ দেখতে দেখতে হাটুরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আসর জমে ক্ষীর হলেই আসে ওস্তাদ। শুরু হয় আসল বয়ান।সুতানলী সাপ হাতের মাঝে পেচিয়ে শুরু করে নানা তাবিজ বিক্রি। বশিকরণ গোটা। শত্রুকে নাশ করার নিদান। বাণ মারার নানা ফন্দি ফিকির। দীর্ঘক্ষণ সঙ্গমের বটিকা। বাঞ্জা মাইয়া মাইনসের পোয়াতি হবার কামরুপ কামাক্ষা থেকে আনা জংলা গাছের শেকড়। ওস্তাদ উরুতে ঠাস ঠাস থাপড় দিতে দিতে বলছে, ”বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর… উপস্থিত মিয়া..চিনলে জংলার জরি, না চিনলে জংলার খড়ি।” ভীড় জমে কথা সপ্তমে আর কথার যাদুতে বিক্রিও বাড়ে।

হয়তো আরেকটু ভীরের ভিতর এগিয়ে গেলে শুনতে পাবো মা কামাক্ষ্যা থেকে সিদ্ধিলাভ করা আরেক বাবা যাদুখেলা দেখাছেন। বায়ান্ন তাসের তেপান্ন প্রকারের হাত সাফাই। আমি সাপ খেলা দেখে ফিরতেই এখানে আটকে যাই। আমি তখন পঞ্চমে। লোক জমে পরতে পরতে। যাদুকর মাথায় লাল গামছা বেঁধে বাঁকা হাড় দিয়ে সীমানা ঠিক করে দিচ্ছিল। বাচ্চা লোক তালিয়া বাজাও… হে বাচ্চা লোক তালিয়া বাজাও। বড়দের পায়ের কাছে বসে পড়ে তালিয়া বাজাতে থাকি আমরা নিরন্তর। দুই হাতের ভিতর কড়ি লাফাতে লাফাতে মার্বেল হচ্ছে আবার মার্বেল থেকে কড়ি বানিয়ে বানিয়ে তাক করে দিচ্ছে আমাকে। আমি চোখ ফেলতে পারছি না।

রক্তজবা চোখমুখী যাদুকর ডমরু বাজাতে থাকে জোড়ে জোড়ে। ডমরুর শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো হাট। দুই পা ছড়িয়ে নাচে যাদুকর। লালসালুর নীচে শুয়ে থাকা ছেলেটার বুকে ততক্ষনে চাকু চালিয়ে দিয়েছে যাদুকর। চাকু কিছুক্ষণ আগেও মাটিতে গাঁথা ছিল। রূপালি রঙের চিকচিক করা চাকু।আর সেই চাকু কিনা এখন ছেলেটা বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে? ডমরু বাজাচ্ছে যাদুকর জোড়ে জোড়ে। বাচ্চা লোক তালিয়া বাজাও। তালিয়া বাজাও। কেউ হাতের মুঠী খুলবেন না। খুললেই ছেলেটার প্রাণ আকাশে উড়ে যাবে। তার রক্তাক্ত হাতে তাজা রক্তের স্রোত।

ছেলেটা কাতর গলায় গোঁ গোঁ করে গোঙরাচ্ছে। যাদুকর আস্তে আস্তে লাল রক্তে ভেজা সালু টেনে তুলছে। কাটা মুরগীর মতো ছেলটির পা দাপরাচ্ছে। রক্ত ভেসে যাচচ্ছে মঙ্গলের হাট… ওগো মঙ্গলের হাট ছেলেটার মঙ্গল হোক…. মনে মনে বলি। আমি মনে মনে জপছি। …বাচ্চা লোক তালিয়া বাজাও… হাতের মুষ্টি খুলে রাখুন। ছেলেটার রুহু এখনই ওড়ে যাবে। আপনার পকেটে ছেলেটার সদগা রয়েছে। মাটিতে ছুঁড়ে দিন ছুঁড়ে দিন… আপনার পকেটে ছেলেটার সদগা। মাটিতে ছুঁড়ে দিন। পকেটে যা আছে… ছুঁড়ে দিন…

বার বছরের আমি ভয়ে সংকচিত। হাত পা কাঁপছে। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। আমি দৌড়াচ্ছি। দৌড়াচ্ছি। মানুষের ভীড়ের কারণে আমি আর দৌড়াতে পাচ্ছি না। ইটের সলিঙের রাস্তা ভেঙে গেছে কবে।এবড়োখেবড়ো এখানে সেখানে। পড়ে যাই আমি। ওষ্টা খেয়ে পড়ে যাই আমি। আজ এতো বছর পর আমি ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। কত বছর আগের কথা। মনে হয় এই তো সেদিন। হাঁটু অব্দি ছিঁড়ে গেছিল। আমার কালো ধুলো পায়ে রক্তের স্রোত নেমেছিল।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!