পরিবর্তন

বান্টির আজকাল মাকে দেখলে একইসাথে রাগ হয় আর কষ্টও হয়। কেন মা কিছু বুঝতে পারেনা! কেন এত বিশ্বাস মায়ের! অন্ধবিশ্বাস কথাটাও যেন মায়ের কাছে হেরে যায়। মা কবে বুঝবে সব? কবে প্রশ্ন করতে শিখবে? কিন্তু সেদিন কি হতে পারে, তা ভেবেও বান্টির গায়ে কাঁটা দেয়। কিভাবে সামাল দেবে মা তখন সব? পারবে মা সহ্য করতে? কি করবে তখন মা? ভাবতে ভাবতে বান্টির মাথায় জট পাকিয়ে যায়। আজকাল অংকগুলো একদম মেলাতে পারেনা বান্টি। অথচ পলাশ স্যার বলেন, সব ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অংকের মাথা সবচেয়ে ভালো বান্টিরই। অনেক সময় স্যার অনেক অংক নিয়ে হিমশিম খান, কিন্তু বান্টি ঠিক করে দেয়। স্যারের বড় ভরসা বান্টি বোর্ড এর পরীক্ষায় অংকে একশোতে একশো পাবেই পাবে। কিন্তু বান্টি পারছেনা বেশ কিছুদিন ধরে। দৃশ্যটা ভুলতে পারছেনা কিছুতেই। কাউকে বলতে পারছেনা। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। পরীক্ষার আর বেশী দেরী নেই। কি হবে জানেনা। সব কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। সহজ সুন্দর জীবনটা হঠাৎই কেমন জটিল ধাঁধা হয়ে উঠলো। কেন সেদিন গেল বন্ধুদের সাথে একদিনের জন্য বেড়াতে। বন্ধুরা বলল একদিন তো, সকালে যাব রাতের মধ্যেই ফিরে আসব। ঘুরে এসে সবাই মন দিয়ে পড়ব তারপর। মা অনেক বারণ করেছিল। তাও যে কেন গেল, মায়ের কথা শুনলেই কি ভালো হত? তাহলে আজ এই জঘন্য দুশ্চিন্তাগুলো মাথায় জট পাকাতো না।

মায়ের কাছে বাড়ি আর বাড়ির লোকগুলোই সব। ছাদের বাগান তো মায়েরই হাতে তৈরী। কত রকম ফুল ফলের গাছ সেখানে। মা বলে, ছাদ বাগান নাকি মায়ের আর এক সন্তান। কী যে যত্ন করে মা গাছগুলোর। সেইজন্যই বাগান ভরে ফুল ফোটে রোজ। বাবা টাকা দেয় অবশ্য। কিন্তু বাড়ির কোনো দিকে খেয়াল নেই বাবার। বাবা ভালো চাকরি করে, অনেক দায়িত্ব সেখানে। বাবা সব সময় ব্যস্ত। বাড়িতে থাকেই কম। মাঝে মাঝে শুধু বান্টিকে জিজ্ঞেস করে পড়াশোনা ঠিক মতো হচ্ছে কিনা। আর কিছু না। বাবা খুব গম্ভীর। কথাও কম বলে। বাবাকে খুব ভয় পায় বান্টি কেন জানেনা। বাবার সাথে কোনো দিন গল্প করেনি। অথচ মায়ের সাথে সব কথা না বললে বান্টির ভালো লাগেনা। মা মাঝে মাঝে বলে, “এবার তোর গল্প থামা বাবা,আমার অনেক কাজ পড়ে আছে যে। কে করবে সে সব?” মা কখনো শাড়ি ছাড়া কিছু পরেনা। বান্টির বন্ধুর মায়েরা কত আধুনিক পোশাক পরে, কত সাজে। মায়ের একঢাল লম্বা কালো চুল। ফর্সা উজ্জ্বল মুখ। চোখ দুটো বড় বড়। কপালে সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করে। সিঁথিতেও চওড়া করে সিঁদুর। মাকে এতেই খুব ভাল লাগে। বাড়িতে কেউ এলে মা খুব আপ্যায়ন করে সবাইকেই। বান্টির বন্ধুরা, বাবার বন্ধুরা, আত্মীয় স্বজনেরা এলে মা নিজের হাতে বানিয়ে খাবার খাওয়ায়। মাকে সব সময় খুব খুশি খুশি লাগে। সংসারের শত কাজেও মা ক্লান্ত হয় না কখনো। কিন্তু বান্টি ঠিক মত পড়াশোনা না করলে মায়ের তখন খুব রাগ হয়। বলে, বাবা সারাদিন এত পরিশ্রম করে সংসার চালায়, যদি বান্টি মানুষ না হয় তাহলে তো সব বৃথা। মা বাবাকে বড্ড ভালবাসে, বান্টি বোঝে। বান্টি মাকে খুব মানে। সবচেয়ে বেশী ভালবাসে মাকেই। তাই মায়ের কথা অমান্য করেনা। কিন্তু বাবাকে বুঝতে পারেনা ঠিক। কেমন যেন রহস্যময় লাগে। কিন্তু সে কথা কাউকে বলতে পারেনা। মাঝে মাঝে অবশ্য বেড়াতে নিয়ে যায় বাবা দু একদিনের জন্য। সেটাও খুবই কম। বেড়াতে গিয়েও তেমন একটা কথা বলেনা বাবা। মা অবশ্য বেড়াতে তেমন ভালবাসেনা। মায়ের বাড়িই পৃথিবী। বাবাকে অফিসের কাজে ছুটে বেড়াতে হয়। আজ এখানে, কাল ওখানে।

দু বছর হল ঠাকুমা নেই। ঠাকুমারও যত্ন করতো মা খুব। ঠাকুমা চোখে হারাতো মাকে। মায়ের হাতেই জল খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ঠাকুমা। বাবা বাড়ি ছিলনা সে সময়। মায়ের হাতে এখন সময় থাকে একটু বেশীই। ঠাকুমার অভাববোধ করে মা। গাছগুলোতে আরও মন দেয়।

বাবা মাঝে মাঝেই অফিস ট্যুরে যায়। মা গুছিয়ে দেয় সব। এবারো গেল বাবা কয়েক দিনের জন্য। এরই মধ্যে বান্টির বন্ধুরা মিলে ঠিক করল একদিন সারাদিন ঘুরে আসবে সমুদ্রে। রাতে ফিরে আসবে। বান্টিও মায়ের কাছে বায়না শুরু করল বন্ধুদের সাথে যাবার জন্য। মা কিছুতেই যেতে দেবেনা। বাবার অনুমতি নিতে বলল মা। বাবাকে কিছুতেই ফোনে পাওয়া গেল না। অনেক কষ্টে মাকে রাজী করালো বান্টি। ফিরে এসে খুব ভাল করে পড়বে কথা দিল মাকে। এক বন্ধুর বাবার গাড়িতে করে সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে সমুদ্রে পৌঁছলো। খুব হুটোপুটি করে স্নান হল। একটা ভালো রেষ্টুরেন্টে খাবে বলে সবাই মিলে খুঁজতে খুঁজতে একটা বড় রিসোর্টে গেল ওরা। রিসোর্টে খাবার অর্ডার দিয়ে রিসোর্টে এদিক ওদিক ঘুরছিল সবাই মিলে। হঠাৎ বান্টি দেখল ওর বাবাকে। একদম অন্য মুডে। যে বাবা বাড়িতে রাশভারী মেজাজ নিয়ে থাকে সব সময়। সেই বাবা হেসে হেসে কথা বলছে এক আধুনিকা সুন্দরী মহিলার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। বাবার তো অফিস ট্যুরে যাবার কথা অন্য জায়গায়। বান্টি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। ভাগ্যিস বান্টির বন্ধুরা কেউ চেনেনা তার বাবাকে। কোনোদিনই বন্ধুরা দেখেনি বাড়িতে এসে তার বাবাকে। বান্টি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওখান থেকে সরে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেলল। বন্ধুরা ভাবলো সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে হয়তো জল খেয়ে ফেলেছিল তাই এমন হচ্ছে। সবাই মিলে ঠিক করল তখন অন্য কোথাও গিয়ে খাবার খাবে বান্টি ঠিক হয়ে গেলে। ওখান থেকে রওনা দিল সবাই।

বাড়িতে ফিরে যেন বান্টি অন্য রকম হয়ে গেল। খেতে ইচ্ছে করে না,  ঘুমোতে পারেনা। পড়তে তো একদম ইচ্ছে করে না। মা বারবার জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। খুব রাগও করল। বুঝতে পারল পড়াশোনায় মন বসছেনা বান্টির একদম। মা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাবাও বকলো এসে। বান্টির বাবাকে দেখলেই রাগে শরীর জ্বলতে লাগলো।

বাবা ছিল না একদিন বাড়িতে, মা সেদিন খুব বকলো বান্টিকে। বলল, নিশ্চয়ই কোনো বাজে সঙ্গে মিশছে সে। নিশ্চয়ই কোনো অন্যায় করেছে। বান্টি এই প্রথম মায়ের মুখে মুখে উত্তর দিল। মা রেগে বান্টিকে খুব মারলো। বান্টি মায়ের হাত মুচড়ে দিল। তারপর বলল, “আমাকে বিশ্বাস করোনা না? বাবাকে বিশ্বাস করো? বাবা তোমাকে ঠকাচ্ছে দিনের পর দিন। বুঝতে পারোনা? আমি নিজের চোখে দেখেছি বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়ে। আর কিছু বলতে পারব না আমি।” বলে বান্টি মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। মা হঠাৎ চুপ করে গেল। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না বান্টিকে। বাবা আর মায়ের বেডরুমে গেল। বাবা আর মায়ের একটা সুন্দর ছবি আছে। সেই ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখল। তারপর ঠাকুর ঘরে গেল ধীর পায়ে। সেখান থেকে ছাদ বাগান। বান্টির এই প্রথম মাকে ভয় করতে শুরু করল। মা আর কথা বলছে না। চুপচাপ শুধু শূন্য দৃষ্টিতে দেখছে বাড়ির সবকিছু। বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে মা দরজা খুললো, হাতে বাবা আর মায়ের সেই ছবি। বড় বড় চোখ লাল আর জলে ভরা মায়ের। বাবা আজ অন্য একজনকে দেখছে যেন। জিজ্ঞেস করলো বাবা, “কি হয়েছে মাধু? শরীর খারাপ লাগছে?” মা ছবিটা দেখিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “এই ছবিটার কি কোনো পরিবর্তন করতে চাও? কি পরিবর্তন করতে চাও বলো।” বাবা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “মাধু তুমি মনে হয় ভুল বুঝছো আমায়। তেমন কিছু ঘটেনি তো। তেমন কিছু কি?” আর কোনো কথা বলতে পারল না বাবা। মা ছবিটা নামিয়ে রাখলো মাটিতে। তারপর শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বান্টি আর বান্টির বাবা দরজা ভাঙতে ভাঙতে, বান্টির মা আর রইলো না।

বান্টি তারপর জীবনের অনেক সময় পেরিয়েও আজও বুঝতে পারেনি, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? সে নাকি তার বাবা?♦

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!