প্রাচীন সভ্যতাকে ঘিরে স্ত্রীজাতির এই প্রাধান্যের ধারা বেয়ে চলে আসা পরবর্তী ইতিহাসকেও নারী বহু সময়ে তাব ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। এবং যে সমস্ত পিছিয়ে পড়া সমাজে সামাজিভাবে, ধর্মীয়ভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরুষ প্রাধান্য চেপে বসেনি, সেখানেও নারীর ভূমিকা পুরুষের থেকে গৌণ কোন স্থানে দেখতে পাওয়া যায় না।
নিউকালেডোনিয়াতে পিছিয়ে থাকা সমাজে দেখা যায় টোংগা উপজাতির ছেলেরা মেয়েদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে। সামোয়াতে মেয়েদের আদর এখনও বেশী। নাইজেরিয়াতে ছেলেমেয়েরা গৃহ তৈরীর কাজে সমান ভাবে অংশ নেয়। বহু বর্বর জাতির ভিতর শিকারে মেয়েদের অংশ নিতে দেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারিতে বুশমেন মেয়েরাই খাদ্য সংগ্রহের মূল দায়িত্বে থাকে। খাদ্য সংগ্রহের জন্য দশ-পনের মাইল পর্যন্ত অনায়াসে হেঁটে তারা যাতায়াত করে। অষ্ট্রেলিয়ার তিউই মহিলারা স্থলভাগের জন্তু শিকার করে। ছেলেরা জলভাগের ও আকাশের প্রাণী শিকার করে। এস্কিমোদের শীল মাছ শিকারে মহিলারা অংশ নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বা-থোংগা মেয়েরা কুমারের কাজ করে। কালিফোর্নিয়ার মেয়েরা বাস্কেট তৈরী করে।
সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীজাতির এই-জাতীয় ভূমিকা ক্রমশঃ কমে এসেছে। সেখানে প্রাধান্যে এসেছে পুরুষ, একচ্ছত্র পুরুষ। পুরুষের দ্বারা নারী জাতিকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে বহিষ্কার করা এবং জীবনের বিকাশশীল ক্ষেত্রগুলিতে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে নারীকে সংসারের একঘেয়ে বিরক্তিকর পরিবেশে ঠেলে দেবার পীড়নমূলক ব্যবস্থাটাই হল পিতৃতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র নারীকে কেবল গৃহবন্দী করেই ক্ষান্ত হয় নি, উপরন্ত নারী জাতিকে মানসিকভাবে রুগ্ন, কৃশ ও পঙ্গু করে ফেলেছে। তাকে সম্পূর্ণ পুরুষের সেবা দাসে পরিণত করেছে। নারীর সাংস্কৃতিক জীবনকে, যৌন জীবনকে সম্পূর্ণভাবে পুরুষের অনুসঙ্গে পরিণত করেছে।
কী ভাবে নারীজাতি কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিল, কী ভাবেই বা পুরুষ-তন্ত্রের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হল তার সুস্পষ্ট কোন রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যায় না।
উনবিংশ শতাব্দীতে মেইন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের তত্ত্ব দেন তাঁর ‘প্রিমিটিভ ল’ গ্রন্থে। তিনি বলেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হল আসল সমাজ, এটাই চিরকালীন ধারা। এই তত্ত্ব দিতে গিয়ে তিনি অবশ্য বাইবেলকে উৎস হিসাবে ব্যবহার করেন।
সেই একই সময়ে বেকফেন নর-নারীর অবাধ মেলামেশার তত্ত্ব থেকে মাতৃতান্ত্রিকতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মানব সমাজে প্রথম ছিল মাতৃতন্ত্র। তারপর পিতৃতন্ত্রের আবির্ভাব। পরে বেকফেনের তত্ত্বের সপক্ষে ম্যাকলিনান ‘থিওরি অফ, ম্যাট্টিখাকি’ গ্রন্থে এবং মেইনের তত্বের সপক্ষে ওয়েস্টারনমার্চ ‘হিষ্টি অফ হিউম্যান ম্যারেজ’ গ্রন্থে যথাক্রমে মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের সম্পর্কে নানা প্রমাণ উপস্থাপন করেন। কিন্তু মাতৃতন্ত্রের তত্ত্বই ক্রমশঃ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। মর্গান, রবার্টসন, স্মিথ, টেলর, ব্রিফল্ট প্রমুখ সকলেই নানাদিক থেকে প্রাচীন সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে আবিষ্কার করেন এবং পিতৃতন্ত্রকে পরবর্তী স্তর বলে চিহ্নিত করেন।
পরবর্তী আবো নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় অবশ্য মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের ধারাতে সরলরৈখিক কোন সহজ সমাধানের ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায় নি। বহু জায়গায় অনুমান করা হয়, মাতৃপ্রাধান্য ও পিতৃপ্রাধান্য জটিলভাবে বদলিয়েছে। সর্বত্র একইভাবে পরিবর্তন ঘটেনি। কোথাও কোথাও পিতৃপ্রাধান্য ও মাতৃপ্রাধান্য পর্যায়ক্রমে দেখা দিয়েছে। অষ্ট্রেলিয়া ও মিলেনেসিয়াতে অনেক আদি গোষ্ঠীর মধ্যেই মাতৃতন্ত্র রহস্যজনকভাবে অনুপস্থিত। মাতৃধারায় ও পিতৃধারায় বংশানুক্রমের কোনটা যে এগিয়ে থাকা আর কোনটা পিছিয়ে থাকা তা বলা শক্ত।
আরও পড়ুন: পিতৃতন্ত্রের পূবাপর ১
উত্তর আমেরিকার সিমসিয়ানদের ভিতর পিতৃপ্রাধান্য থেকে পরে মাতৃপ্রাধান্য দেখা দেয়। ছামবুলিদের মধ্যে পিতৃধারায় বংশ চিহ্নিত হলেও মেয়েরা পুরুষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিম নিউগিনির ডোবু এবং উত্তর পশ্চিম আমেরিকান উপকূলের কাওয়াকিউলদের মধ্যে দেখা যায় পিতৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য-ব্যক্তিগত আদর্শ অত্যন্ত বড়। পক্ষান্তরে মেক্সিকোতে জুনু গোষ্ঠীর মধ্যে সমষ্টিগত উন্নতির আদর্শ ভীষণ ভাবে প্রাধান্য পায়। তাদের মধ্যে পদ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মৃত্যুকে পর্যন্ত ব্যক্তির শোক মনে না করে গোষ্ঠীর ক্ষতি ভাবা হয়।
এ সব কিছুই নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ভিতর দিয়ে ঘটনা হিসাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবুও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ ক্ষেত্রে গণ্য করার প্রয়োজন তা হল, সামাজিক গতি বিজ্ঞানের নিয়মের ন্যায় আঙ্কিক ভেক্টরের মত পথ অনুসরণ করতে পারে না। এখানে সামাজিক বিকাশের একটা সাধারণ রূপরেখা পাওয়া যায় মাত্র। যেমন ইউরোপে যা সামন্ততন্ত্র এশিয়ার নগর সভ্যতা মেসপটেমিয়া বা অন্যত্র তা ঠিক অবিকল দেখতে পাওয়া যায় না। দাসব্যবস্থা রোমে যেভাবে ছিল ভারতে সে ভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এমন কি দাসদের পণ্য হিসাবে আমেরিকাতে যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা দাস যুগের বহু পরে ঘটেছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ পুজিবাদী সমাজের গরবর্তী স্তর হিসেবে সর্বত্র আসে নি। এমনকি সমাজতন্ত্রও পিছু হটেছে এমনও দেখতে পাওয়া যায়।
এই অবস্থায় পিতৃপ্রাধান্য ও মাতৃপ্রাধান্যের পরস্পরে জটিল অবস্থান থাকলেও সামাজিক ইতিহাসের একটা স্পষ্ট গতিমুখ দেখতে পাওয়া যায়। সমষ্টিগত মঙ্গলামঙ্গলের চিন্তা ও তার বাস্তব অস্তিত্ব একবার ভেঙ্গে পড়ার পর অর্থাৎ শ্রেণী বিভাজন ঘটে যাবার পর, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর সেই সমাজকে আর সমষ্টিগত সাম্যের দিকে মুখ ফেরাতে দেখা যায় নি। বংশধারার ক্ষেত্রে মাতৃপ্রাধান্য ও পিতৃপ্রাধান্য নানাভাবে দেখা গেলেও এমনকি উন্নত নগর সভ্যতায় এসেও মাতৃপ্রাধান্য বহু ক্ষেত্রে দেখা গেলে ও তা ছিল বিক্ষিপ্ত। নারীকে পুরুষ একবার নিপীড়নের পর্যায়ে নামিয়ে ফেলার পর তা আর বদলায় নি। পিতৃতন্ত্র তন্ত্র হিসাবে চেপে বসার পর আর মাতৃ প্রাধান্যের সাম্যাবস্থা দেখা দেওয়া সম্ভব হয় নি।
পুরুষতন্ত্রের আগে মাতৃতন্ত্র ছিল কিনা, নাকি চিরকালই পুরুষতন্ত্র নারীর বিধি হিসাবে চলে এসেছে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে পুরুষতন্ত্র ভাল না মাতৃতন্ত্র মঙ্গল, তা নিয়েও। সব মিলিয়ে পিতৃতন্ত্র ও মাতৃতন্ত্রকে কেন্দ্র করে অতীত বর্তমান-ভবিষ্যতকে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। সব বির্তকেরই একটা জায়গা স্বীকৃত যে বর্তমানে যে-সমাজটা চলে আসছে তা হল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অর্থাৎ পুরুষপ্রাধান্যের সমাজ। কী ভাবে এই সমাজটা সৃষ্টি হল, চিরকালই এমনি ধারা ছিল কিনা, কিংবা ভবিষ্যতে কী ধরনের সমাজ সৃষ্টি হবে বিতর্কটা তা নিয়েই।
মানব সমাজের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতকে কেন্দ্র করে পাঁচটি দিক থেকে এই ধারাগুলি লক্ষ্য করা যেতে পারে:
এক: অতীতে পিতৃতন্ত্র-বর্তমানে পিতৃতন্ত্র-ভবিষ্যতে কোন-তন্ত্র নয়- সাম্য।
দুই: অতীতে পিতৃতন্ত্র-বর্তমানে পিতৃতন্ত্র- ভবিষ্যতে আবার পিতৃতন্ত্র।
তিন: অতীতে মাতৃতন্ত্র-বর্তমানে পিতৃতন্ত্র-ভবিষ্যতে আবার মাতৃতন্ত্র।
চার: অতীতে মাতৃতন্ত্র-বর্তমানে পিতৃতন্ত্র-ভবিয়তে কোন তন্ত্র নয়- সাম্য
পাঁচ: অতীতে কোন তন্ত্র নয়, সাম্য-বর্তমানে পিতৃতন্ত্র- ভবিষ্যতে আবার কোন তন্ত্র নয়-সাম্য।
প্রথম দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে বলা যায়, স্ত্রী ও পুরুষের গঠন প্রকৃতির ভিন্নতার দরুণ স্ত্রী জাতির পক্ষে স্বাভাবিক কারণেই অনেক দিক থেকে আগুয়ান হয়ে দেখা দেওয়া সম্ভব হয় নি। এই অসুবিধাজনক অবস্থাটাই পুরুষতন্ত্রের উদ্ভবের কারণ। সুতরাং অতীতেও পুরুষ প্রাধান্য ছিল যেমন আজও রয়েছে। তবে মানুষের নিজের চেতনার বিকাশের ফলে এই অন্যায় বৈষম্যকে সে ধরে রাখতে পারে না। তা ছাড়া সমাজের উন্নতি, প্রযুক্তিক বিকাশ সমাজ জীবনে নারীকে পুরুষের মত জায়গায় নিয়ে আসতে সাহায্য করবে। কাজেই অতীত থেকে আজ পর্যন্ত -চলে আসা পিতৃতন্ত্রের ভবিষ্যতে অবসান ঘটবে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ধারার এই চিন্তার আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি হল, যে-কারণে অতীতে এবং বর্তমানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ চলে এসেছে সে কারণ দেহগত ও মস্তিষ্কগত দিক থেকে এত মৌলিক যে কেবল সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন দিয়ে তাকে বদলান যাবে না। সুতরাং পিতৃতন্ত্র ছিল, আছে এবং থাকবে।
অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও পিতৃতন্ত্রের, অনিবার্য অস্তিত্বের তত্ত্ব হল চরম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফল। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এই মত প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে নারী চিরকালই পুরুষের তুলনায় পশ্চাৎপদ। দেহ ও মস্তিষ্কের এই পশ্চাৎপদতার কারণেই চিরকাল পুরুষ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল, বর্তমান তারই প্রকাশ এবং ভবিষ্যতও এই পথ ধরেই চলবে। সুদূর অতীতের মানব সমাজেও নারীর ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু দৃষ্টান্ত দেখিয়ে, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাজাল বিস্তার করে চরম পুরুষতান্ত্রিক এই চিন্তাধারা তুলে ধরা হয়ে থাকে।
ক্রমশ…