ফিরে দেখা: এসে গেল আবার এক নারী দিবস!

আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে নারীদিবস। নারীরা সর্বক্ষেত্রে বিরাজিত, তথাপি তারা এখনও বঞ্চিত এবং অনেক কম সুরক্ষিত। আজ আমরা সচেতন এবং নারীর মানবিক অধিকারের দাবী নিয়ে সোচ্চার। আশ্চর্যের বিষয় এক্কেবারে শুরুতে নারীর এইরূপ সামাজিক অবস্থান ছিলনা। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে কখনও প্রয়োজনে এবং অবদমিত করে রাখার লক্ষ্যে নারীর অস্তিত্বকে অবমূল্যায়ন ও উপেক্ষা করা হতো। নারীকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত করা হয়েছে। আর সন্তান জন্ম দেওয়া, পরিবার গড়ে তোলা, পরিবার আঁকড়ে থাকা নারী সব বুঝেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তার অসম্মান ও মূল্যবোধের অবক্ষয়। বরেণ্য লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী বলেছেন– ‘মেয়েমানুষ যতই মুখ্যু হোক তাকে ঠকানো বড় শক্ত, সে সব জেনে বুঝেও চুপ করে থাকে, পাছে তার পাখির বাসাটুকু ভেঙে যায়।’

নারীর মানবাধিকার বঞ্চিত জীবনের ইতিহাস একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলে একটা বই লিখেও শেষ করা যাবে না। তাই ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে আদিমধ্যযুগ ও মধ্যযুগের নারীদের সামাজিক স্থিতি কিছুটা বিবৃত করার চেষ্টা করছি।

একাদশ শতকের শুরু। ভারতে আসছেন বহির্বিশ্বের পর্যটকরা। তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছেন- যা আমাদের দেশকে চিনতে ও জানতে সাহায্য করেছে। আবু রায়হান আল-বেরুনি ছিলেন ইরানিয়ান পর্যটক। তারপর চতুর্দশ শতকে মরক্কো থেকে এলেন ইবনে বতুতা। ভারত ভ্রমণ করে তৎকালীন ভারতের সমাজব্যবস্থা ও নারীজাতির দুর্দশার কথা উল্লেখ করেছিলেন নিজের লেখায়। মধ্যযুগীয় ভারতের স্মৃতিকার ও ভাষ্যকাররা নিজেদের লেখায় সেই সময়ের নারীদের অধিকার নিয়ে লিখেছিলেন। তৎকালীন বিবাহ ব্যবস্থা ও সম্পত্তির অধিকার, পরিবারে নারীর মর্যাদা ইত্যাদি নিয়েও লিখেছিলেন। স্মৃতিকারদের বক্তব্যে স্ববিরোধিতা ও অস্পষ্টতা লক্ষণীয়। আল-বিরুনীর বিবরণে হিন্দুদের আত্মীয়ের ভিতর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত, বিবাহ বিচ্ছেদের চল ছিল না। বিবাহ ছিল আমৃত্যু বন্ধন। অসবর্ণ বিবাহে ‘অনুলোম’ প্রথা স্বীকৃত ছিল। কিন্তু সে কেবল পুরুষদের জন্য। দুশ্চরিত্রা স্ত্রীকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হত। পুরুষকে নয়। সমকালীন লেখক ও মার্কোপোলোর তথ্য অনুযায়ী মেবারের রাজার পাঁচশো স্ত্রী, আরও একজনের তিনশো স্ত্রী নিয়ে সংসার ছিল। ছিল ‘স্বয়ম্বর প্রথা’। সমকালীন সাহিত্যেও এর উল্লেখ আছে। পশ্চিমের চালুক্যরাজ ‘ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য’ শিলহার রাজকন্যাকে সেভাবেই বিবাহ করেন। তবে তা সাধারণের জন্য নয়। সাধারণ মানুষের একটি স্ত্রী থাকত। তৎকালীন স্মৃতিভাষ্যে উল্লেখ আছে মহিলাদের স্বাধীনতা ছিল না।স্ত্রী মনে ও প্রাণে শুদ্ধতা বজায় রাখবে। স্বামীদের প্রতি নির্দেশ ছিল স্ত্রীকে অলংকার, পোশাক পরিচ্ছদ ও ভাল আহার দিবে। স্বামী কোন কারণে বিদেশ গেলে স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হত। ঐ সময়ে স্মৃতি চন্দ্রিকায় বলা হয়েছে একজন স্ত্রী থাকতেও স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে যদি স্ত্রী অসুস্থ, বন্ধ্যা বা মৃতবৎসা হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই প্রথমা স্ত্রীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব স্বামীকেই নিতে হবে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই পুরুষের অবাধ স্বাধীনতা ছিল।

তবে স্বামী যদি কোন সতী সাধ্বী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতেন, তাহলে তাঁকে শাস্তি পেতে হত। শাস্ত্রের নির্দেশ ছিল যে, সেক্ষেত্রে রাজা যেমন অন্য অপরাধীকে শাস্তি দেন, ঠিক তেমনভাবেই স্বামীকে শাস্তি দেবেন। সেরকম ক্ষেত্রে রাজা নির্যাতিতা স্ত্রীকে সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ দিতে স্বামীকে বাধ্য করতে পারতেন। স্ত্রীকে সকল ক্ষেত্রেই স্বামীর প্রতি আনুগত্য রাখতে হত। ‘পুরুষ জাতির হৃদয় জয় করার জন্যই কি নারীর জন্ম?’ …প্রশ্ন করেছিলেন আশাপূর্ণা দেবী।

তখনকার দিনে শাস্ত্রোল্লিখিত বিধি- বিধানই একমাত্র পালনীয় কর্তব্য ছিল। মধ্যযুগীয় শাস্ত্রকারদের রচনায় ধর্মাচরণ ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীজাতির নিম্নস্তরে অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘হারিত’ মহিলাদের দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন- ‘ব্রহ্মবাদিনী’ ও ‘সদ্যবধূ’। ব্রহ্মবাদিনীরা ছিলেন সংস্কৃতিবান, শিক্ষিতা; যাঁরা বিভিন্ন ধর্মীয় কাজকর্মে অংশ নিতেন। অন্যদিকে সদ্যবধূরা সংসারের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তবে স্মৃতিচন্দ্রিকা থেকে জানা যায় যে, সেই ব্যবস্থা ছিল আগের যুগের। শাস্ত্রকারেরা গৌরীদানের নিদান দিলেন। মধ্যযুগের ভারতে কোন হিন্দু কন্যা অপহৃতা হলে তিনি সমাজচ্যুতা হতেন। এই অপহৃত মহিলারা শুধু সমাজচ্যুতাই হতেন না, বিচারব্যবস্থায় তাঁদের সাক্ষ্যও অগ্রাহ্য করা হত। সে যুগের শাস্ত্রকারেরা স্বামী ও পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকার করেছেন। বিধবা স্ত্রীদেরও সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হয়। সেযুগে নারীর প্রাপ্ত উপঢৌকনে তার একার অধিকার ও স্বাধীনতা স্বীকৃত ছিল।

আদিমধ্য যুগের ইতিহাসে অনেক বুদ্ধিমতী প্রভাবশালী মহিলার উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা রাষ্ট্র পরিচালনাতে অংশ নেন। এই প্রসঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অংশের কথা উল্লেখ্য। কাশ্মীরে রানী ‘সূর্যমতী’ শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতেও তখন অনেক বিদুষী মহিলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। চালুক্য বংশের রানীরাও অনেক সময়ে প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে কর্ণাটকের এক রানী ‘বল্লমহাদেবী’ তো ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি নিয়ে শাসনকার্য্য পরিচালনা করেছিলেন। ‘কাকতীয়’ রাজ্যের রানী ‘রুদ্রাম্বা রুদ্রদেব’ও ‘মহারাজ’ উপাধি নিয়ে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে শাসন করেছিলেন।

আবার, তুর্কি শাসনে ভারতীয় নারীর সামাজিক অবস্থানেও পরিবর্তন দেখা যায়। তখন থেকে হিন্দু মহিলারাও তুর্কি মহিলাদের মত পর্দা প্রথার আশ্রয় নিয়েছিলেন, মহিলাদের বাইরে ঘোরাফেরা অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। ‘মদন পারিজাত’ ও ‘পরাশর মাধব’ গ্রন্থে সেইসময়কার নারীদের সামাজিক অবস্থানের অনেক ছোটখাট বিষয় উল্লিখিত আছে। অপরাধের ক্ষেত্রে ‘কাত্যায়ন’ বলেছিলেন যে, পুরুষের অর্ধেক শাস্তি নারীর প্রাপ্য। তবে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে নারীর শুধু অঙ্গচ্ছেদ হবে, নারীর উপরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না। ‘প্রায়শ্চিত্তসার’ গ্রন্থে বিভিন্ন অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত্তের বিধান নির্দেশ করা হয়েছিল। পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির ওপরে মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে সে যুগে বিস্তৃত বিধি-বিধান তৈরি করা হয়েছিল। অপুত্রক স্বামীর মৃত্যুতে তাঁর বিধবা স্ত্রীকেই তার সম্পত্তির প্রথম দাবীদার করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে স্বামীর সব পারলৌকিক কাজকর্ম তার স্ত্রীকেই সম্পন্ন করতে হত। ‘বৃহস্পতি’র উদ্ধৃতি দিয়ে সেযুগের শাস্ত্রকারেরা ও টীকাকারেরা নারীর পক্ষ নিয়েছিলেন। তখন সমাজ নারীজাতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। ‘কাত্যায়ন’ অনুসারে একজন বিধবা তার মৃত স্বামীর সম্পত্তিকে প্রয়োজন মত সৎকার্যে ব্যয় করতে পারবেন। ওই সময়ে ‘যাজ্ঞবল্ক্য’ থেকেও উদ্ধৃতি দিয়ে নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। যে কোন কারণেই হোক তৎকালীন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে নারীদের পক্ষে অনেক বিধান ছিল। স্ত্রীধন সীমিত রাখবার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও, তখন স্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃতি লাভ করেছিল। বেশিরভাগ টীকাকারই স্ত্রীধনের ওপরে স্ত্রীর একাধিপত্য স্বীকার করে নিয়ে বিধি-বিধান তৈরি করেছিলেন। তাদের মত ছিল যে, স্বামী কোনো অবস্থাতে স্ত্রীধনের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারেন না। ‘মিতাক্ষরা’ গ্রন্থে সেই স্ত্রীধন কীভাবে বণ্টন করা হবে, সেটারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। তুর্কি শাসনে আবার এই সকল ব্যবস্থা ও নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হয়। মধ্যযুগের ভক্ত সাধকেরা (যেমন কবীর, নানক, চৈতন্যদেব) নারীজাতির সামাজিক অসাম্য ও অবিচারের বিপক্ষে ছিলেন। ইসলামের সাম্যের আদর্শই সম্ভবতঃ ভক্তিবাদীদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। বঞ্চিত, শোষিত, অত্যাচারিত, অধিকারহীন সেই মানবগোষ্ঠীর অবস্থা অনেক সংস্কারককেই বিচলিত করে তুলেছিল। তারাই ভারতে আধুনিককালের নারীমুক্তি আন্দোলনের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন।

তবে প্রায় একহাজার বছর সময়কালের (৬৫০-১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ), নারীজাতির অবস্থা একরকম ছিল না। সর্বত্র এবং সব সমাজে নারীজাতি সম্মান ও মর্যাদা পেত না। উচ্চবর্ণের ও নিম্নবর্ণের নারীদের অবস্থান ও অধিকারে প্রভেদ ছিল। নিম্নবর্ণের নারীরা পুরুষের সাথে মাঠে ও কারখানায় কাজ করতেন। মধ্যযুগে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গেও ভারতীয় মহিলারা যুক্ত ছিলেন। ওই সময়ের কুটির ও হস্তশিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থায় মহিলাদের অবদান অনস্বীকার্য।

তুর্কি শাসনের সময় ভারতে নারী দাসদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ‘ইবন বতুতা’র রচনায় ভারতীয় নারী দাসদের নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সুলতান বা রাজন্যবর্গ বা কোনো সম্মানীয় ব্যক্তিকে নারী দাসী উপহার দেওয়ার প্রচলন ছিল। উল্লেখ্য যে, দিল্লীর উজির ইবনে বতুতাকে দশজন দাসী উপহার দিয়েছিলেন; এবং বতুতা’র মতে তারা অপরিচ্ছন্ন, অশিক্ষিত এবং রুচিহীন ছিলেন। বতুতা সেই দাসীদের অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তৎকালীন বঙ্গদেশে নারী দাস প্রথা প্রচলিত ছিল বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তিনি নিজেই বাংলার বাজার থেকে ‘আসুরা’ নামের একজন সুন্দরী ক্রীতদাসীকে স্বল্পমূল্যে কিনেছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন। ইবনে বতুতা সেই সময়ের ভারতের ক্রীতদাসী প্রথার অকাট্য প্রমাণ রেখে গেছেন। পরবর্তীতে মুঘল শাসনেও এর দৃষ্টান্ত আছে।

ইবনে বতুতার সময়ে সহমরণ ছিল, এবং তা হতো সরকারি অনুমোদন নিয়ে। তিনি তিনটি সহমরণ দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো জানান যে সেই সময়ে অনেক বিধবা স্বেচ্ছায় যেমন সহমরণে যেতেন, তেমনি অনেকে আবার শেষ মুহূর্তে ভয় পেয়ে যেতেন। একবার তিনি নিজেও সেই বীভৎস, অমানবিক প্রথা দেখতে দেখতে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবী করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সময়ে সহমরণের সঙ্গে স্বামীর প্রতি আনুগত্য ছাড়াও আরো অনেক মনোভাব যুক্ত হত। নিজেদের সুরক্ষার ভয়েও অনেকে রাজী হতেন সহমরণে। সামাজিক খ্যাতিলাভও একটা কারণ ছিল, আবার ছিল মৃতের আত্মীয়দের সম্পত্তির লোভে চক্রান্ত। সহমরণ কখনোই কোন নির্ভেজাল ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল না।বেদ, উপনিষদে সহমরণের উল্লেখ নেই।

তুর্কি শাসকগোষ্ঠী নিষ্কণ্টক শাসন করার জন্য সামাজিক রীতিতে জোর করে বিধিনিষেধ আরোপ করতেন না, নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করতেন। ‘জিয়াউদ্দিন বারানি’ আলাউদ্দিনের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার যে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে তিনি দাসদের সঙ্গে দাসীদের বাজার দরের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। বারানি শুধু দাসী নয়, উপপত্নীদের বাজার দরের কথাও তার লেখায় জানিয়েছিলেন। তখন সম্পন্ন পরিবারে উপপত্নী রাখবার প্রথা ছিল, সেজন্য খোলা বাজারে উপপত্নী বিক্রি করা হত। তাই আদিমধ্য যুগের তুলনায় মধ্যযুগের ভারতে নারীজাতির অবস্থার অবনমন ঘটেছিল সেটা স্পষ্ট।

তবে মধ্যযুগের নারীদের মধ্যে অনেকে বিদূষী ও মহীয়সী ছিলেন, তারা নানা সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলি হল মীরাবাঈ, অন্ডাল, দয়াবাঈ, সহজোবাঈ ও ক্ষেমা। সেইসময় মুসলিম সমাজের অভিজাত মহিলাদের মধ্যেও অনেক বিদুষী ও বুদ্ধিমতী মহিলা রাষ্ট্রবিপ্লবে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। ‘সুলাতানা রাজিয়া’ ছিলেন মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের সেই ধরনের এক চরিত্র। তখন উচ্চবর্গের মুসলমান মহিলারা রীতিমত লেখাপড়া শিখতেন, এমনকি তাদের যুদ্ধবিদ্যাও শেখানো হত। বিজয়নগরের মহিলারা নানা বিদ্যা শিক্ষা করতেন; নৃত্য, সঙ্গীত ও যুদ্ধবিদ্যায় তারা পারদর্শিনী ছিলেন। ‘বাবরে’র আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ায় স্ত্রী-পুরুষ সকলেই নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন, সেখানকার সামাজিক জীবন ভারতের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দময় ছিল। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যে, ভারতের এদেশি মুসলমানেরা তখন পর্দানশীন ছিলেন না, তারা এদেশীয় আচার-আচরণই অনুসরণ করতেন। কারণ বেশিরভাগই ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কঠোরতার ফলে ধর্মান্তরিত মুসলমান। মধ্যযুগে ভারত ভ্রমণে আসা বিভিন্ন পর্যটকের লেখায় এই একই তথ্য পাওয়া যায়। মধ্যযুগের ভারতে হিন্দু ও মুসলমান নারীদের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। সেই সময়ের সুফি দরবেশদের রচনাতেও নারী ও পুরুষের সাম্যের কথাই প্রকাশিত হয়েছে।#

তথ্যসূত্র:
১- Alberuni’s India, Munshiram Manoharlal Publishers.
২- The Customs of the Kingdoms of India, Marco Polo.
৩- Riḥlat Ibn Baṭtūṭah, Ibn Battuta.
৪- Tarikh-I Firoz Shahi: An English Translation, Ishtiaq Ahmad Zilli.
৫- তর্কপ্রিয় ভারতীয়, অমর্ত্য সেন।
৬- History of Medieval India, Satish Chandra.

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!