নারীমুক্তি ভাবনার সঙ্গে অবশ্য মন্দোদরী, সীতা ও সরমার সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। তবুও উনিশ শতকের নারীশিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল যে শিক্ষিত পুরুষের সহযোগী হিসেবে ‘Enlightened Partner’ গড়ে তোলা, এই তিন নারী চরিত্রে মধুসূদন যেন সেই উদ্দেশ্যকেই চরিতার্থ করেছেন। সেকালে নারীশিক্ষা ছিল নারীমুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। মধুসূদন হয়তো সক্রিয়ভাবে নারীশিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনে সক্রিয় হননি, কিন্তু চিরকাল সেই শিক্ষার আনুকূল্য করে গিয়েছেন। শুধু ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর চিত্রাঙ্গদা কিংবা প্রমীলা চরিত্রের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় মডেল অনুসরণ করা নয়, চিত্রাঙ্গদার মতো স্বামীর প্রতিবাদী নারী চরিত্রাঙ্কনে তাঁর সিদ্ধি ঘটেছে ‘শর্মিষ্ঠা নাটক’-এ দেবযানী চরিত্র নির্মাণেও। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য-কন্যা দেবযানীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছে পুরুবংশীয় রাজা যযাতির; কিন্তু তারপরেও গোপনে রাজা বৃষপর্বার কন্য শর্মিষ্ঠার সঙ্গে রাজার প্রণয় ও পরিণয় সংঘটিত হলে এবং তা দেবযানীর গোচরে এলে তিনি স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। সমাজে যে সময়ে বহুপত্নীক পুরুষের অস্তিত্ব ছিল, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে নাটক রচনা করেও মধুসূদন দেবযানীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করলেন নারীর এক স্বাধীন চিন্তাকে। পুরুষ যেমন মনে করে বিবাহিতা পত্নী তার নিজের সম্পত্তি, সেখানে যেমন দ্বিতীয় পুরুষের আবির্ভাবকে সে কখনই মেনে নিতে পারে না, তেমনি স্বামীর ওপর নারীর নিঃসপত্ন অধিকারের দাবিও একটি ন্যায়সঙ্গত দাবি। কেননা দুইয়ের পারস্পরিক প্রেম ও স্বাধিকার অভিন্ন মানদণ্ডে বিচার্য হওয়া উচিত। এমতাবস্থায় স্বামী নিজের সুখের জন্য, ভোগের জন্য যদি দ্বিতীয় নারী গ্রহণ করে, তবে তাতে পত্নীর স্বীয় মর্যাদা ধূল্যবলুন্ঠিত হয়, তার নারীত্ব অপমানিত হয়। এমন পত্নীর কাছে স্বামীর মূল্য তুচ্ছ হয়ে পড়ে। মধুসূদন দেবযানীর চরিত্রের মধ্যে আধুনিক চেতনাদীপ্ত এই অবস্থানটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন নাটকের শেষভাগে, যখন দেবযানী জানতে পারেন স্বামীর ব্যভিচারিতার কথা। তিনি স্পষ্টত বলেন— ‘এমন পতি থাকা না-থাকা দুইই তুল্য।’ এমন বিদ্রোহাত্মক কথা প্রাচীনকালে তো বটেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেও উচ্চারণ করা বিবাহিতা নারীর পক্ষে এক দুঃসাহসিক স্পর্ধা বটে! স্বামীর বিরুদ্ধে পত্নীর অসহনীয় অসন্তোষ ও কটু মন্তব্যের সূত্র ধরে, অনেক সমালোচকই দেবযানীকে রাবণ-পত্নী চিত্রাঙ্গদার পূর্বসূরি রূপে গণ্য করেন।
‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’-এ যে দুটি নারীচরিত্রের মধ্য দিয়ে মধুসূদন তাঁর নারীচিন্তার অনন্যতা প্রকাশ করেছেন, তারা হল রাজগণিকা বিলাসবতী ও তার পরিচারিকা মদনিকা। মদনিকা নারী হয়েও তার বুদ্ধিকৌশলে সে পুরুষ ধনদাসকে পরাস্ত করেছে। তাছাড়া পুরুষের ছদ্মবেশ গ্রহণের মতো দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মদনিকার লিপ্ত হওয়ার পিছনে কোনো সুকুমারী প্রেমবোধ নয়, বরং গৃহকর্ত্রীর প্রতি প্রবল আনুগত্য ও সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। সে যেন বিলাসবতীর অপমানিত প্রেমবেদনার শরিক। অন্যদিকে বিলাসবতীর মধ্যে মাইকেল ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন একনিষ্ঠ প্রেমের মাধুর্যকে। রাজগণিকার ক্লিন্ন পরিচয়েই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি নাট্যকার এই ব্যথাহতা নারীকে। বিলাসবতীর মধ্যেও যে ক্ষোভের আগুন ছিল, ধনদাসের প্রতি প্রযুক্ত একটি উক্তিতে তা ধরা পড়ে। এতে কেবল বিলাসবতীর চরিত্রই আলোকিত হয়নি, আলো পেয়েছে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের অন্ত্যেবাসী পতিতারাও। ধনদাসকে বিলাসবতী বলেছে–- ‘হ্যাঁ — আমি কলিকালের মেয়ে বটি; কিন্তু তুমি যে স্বয়ং কলি অবতার। … তুমিই না অর্থের লোভে আমার ধর্ম নষ্ট করালে? আমি যদিও দুঃখী লোকের মেয়ে, তবুও ধর্মপথে ছিলেম। এখন ধনদাস তুমিই বলো দেখি, কোন দুষ্ট বেদে এ পাখিটিকে ফাঁদ পেতে ধরে এনে এ সোনার পিঞ্জরে রেখেছে?’
আরও পড়ুন: বাংলার নবজাগরণ ও মাইকেল মধুসূদন (পর্ব- ৪)
পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে অন্তরের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনের হরকামিনীও। নবকুমারের পত্নী হরকামিনী, যে-নবকুমার নব্যশিক্ষার বড়াই করে হাফ-লিটারেট বাবুদের মতো মদ্য গোমাংস ইত্যাদি অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে ও বারাঙ্গনা বিলাসে মত্ত হয়ে আধুনিক হয়ে ওঠার ভড়ং করত। স্বামীর এ হেন দুশ্চরিত্রতায় ক্ষোভ জন্মালেও এতদিন সে কোনো অভিযোগ জানায়নি, বরং নীরবে সহ্য করেছে সে অদৃষ্টের ফের বলে। কিন্তু একদিন সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে হরকামিনীকেও স্বামীর আনুগত্যের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে স্বামীর লাম্পট্য নিয়ে কষে সমালোচনা করতে দেখা যায়। মধুসূদন তার এই প্রহসনে যেন এক হরকামিনীর মধ্যেও শত সহস্র হরকামিনীকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যারা পুরুষ-শাসিত ব্যভিচার-ক্লিষ্ট কলকাতায় নিজেদের দুর্ভাগ্যের নিগড়ে বন্দিনী হয়ে সেদিন গুমরে গুমরে মরছিল। হরকামিনীর মুখের তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও বিদ্রূপ যেন স্বামীসৌভাগ্যবঞ্চিতা সেইসব ব্যথাতুরা নারীর উচ্চারিত স্বর। মেয়েদের স্বাধীন সত্তা জেগে ওঠার এটা পূর্বলক্ষণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
মধুসূদনের সাহিত্যে নারীমুক্তির স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়ে আলোচক মাত্রেই নির্ভর করেছেন তাঁর পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর ওপর। মাইকেল-প্রতিভার অসামান্য প্রকাশ এই রচনা। কী ভাবের দিক থেকে, কী আঙ্গিকের দিক থেকে, কী ছন্দের দিক থেকে এমন নিটোল রচনা সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই দুর্লভ। এক্ষেত্রে কবির আদর্শ রোমান কবি পাবলিয়ুস ওভিডিয়াস নাসো বা সংক্ষেপে ওভিড, যিনি পুরোনো সময়ের বেশ কিছু নারী চরিত্রকে, যাঁরা পত্র রচনার মাধ্যমে তাঁদের প্রণয়ী, দয়িত, জীবনসঙ্গীদের কাছে নিজেদের নিভৃত মনের অনেকখানি উজাড় করে দিয়েছিলেন। কাব্যিক এই কৌশলটিই গ্রহণ করেছিলেন মধুসূদন। তবে এটাও লক্ষণীয় যে, ওভিড যেখানে নারীর জৈবিক সত্তাকে বেশি মাত্রায় ক্রিয়াশীল করে দেখিয়েছিলেন, ‘বীরাঙ্গনা’র কবি নারীকে সেই সংকীর্ণ ভাবনার ঊর্ধ্বে ঠাঁই দিতে চেয়েছেন। শরীরী কামনার আকাঁড়া আবেগ প্রকাশে মধুসূদনের নায়িকারা যেমন অকুণ্ঠ, অলজ্জ, তেমনি পুরুষের আধিপত্যকে ছিন্ন করবার প্রেরণায় উন্মুখ, সমর্থ। কাব্যের নাম ‘বীরাঙ্গনা’ হলেও কবি যেসব নারীদের প্রসঙ্গ তাঁর পত্রকাব্যে এনেছে, তাঁরা সকলেই বাস্তবত বীরের পত্নী বা কন্যা নন। তাছাড়া বীরত্বের কথা উঠলে পুরুষের যে শারীরিক বলশালিতার ছবি ভেসে ওঠে, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ উপস্থাপিত সব নারীর মধ্যে সে ধরনের পুরুষোচিত বলদৃপ্ততা মেলে না। কিন্তু তবুও স্রষ্টা মধুসূদনের চোখে এরা সবাই বীরাঙ্গনা। এর কারণ আছে। মধুসূদন নারীর বীরত্বকে শরীর সংস্থানের ওপর নির্ভরশীল কোনো বিষয় বলে গণ্য করেননি, বরং তাঁর চোখে নারীর তেজস্বিতা, নির্ভীকতা, লজ্জাহীনতা তার বীরত্বের প্রমাণ। যে-নারী অকপটে নিজের অনুভবকে দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারে কিংবা অনায়াসে পুরুষের পাশে সমশক্তি প্রদর্শন করতে পারে সে-ই নারী তাঁর বিবেচনায় বীরাঙ্গনা। অর্থাৎ নারীর পূর্ণ নারীত্ব প্রকাশই বীরত্বের লক্ষণ, যা রেনেসাঁসের অন্যতম বাণী। নারীও যে পূর্ণ মানুষ এই প্রতীতি আধুনিকতার স্মারক। প্রাগাধুনিক ধারণায়, নারী ছিল পুরুষের অবর (subordinate) বা অধীন, তার নর্মসহচরী, সমস্ত রকম পদক্ষেপের ছায়ানুসারী। কিন্তু আধুনিক চিন্তায় নারীর পুরুষ-নিরপেক্ষ অস্তিত্ব বর্তমান। তার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালোবাসা-যৌনতা, পরিগ্রহ-প্রত্যাখ্যান সম্পূর্ণ তার নিজের বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। ‘বীরাঙ্গনা’র কল্পিত পত্রগুলি লেখা হয়েছে পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলিকে এতটা স্বাধীনতা দিয়ে, যা উনিশ শতকে তৃতীয় পাদে ছিল প্রায় অভাবনীয়। কবি এখানে কোথাও কোথাও তাঁর যুগের আধুনিক মননকেও অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। নারীমুক্তি ছিল বাংলার নবজাগরণের অন্যতম বিজয়ধ্বজা, আর সেটি স্বস্কন্ধে বিনা আয়াসে যিনি প্রথম বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি মাইকেল মধুসূদন।
প্রাচীন সাহিত্যের নবায়ন ঘটানো রেনেসাঁসের একটি প্রকল্প। এই পথ দেখিয়েছিলেন ইতালীয় কবি-সাহিত্যকেরা। ‘বীরাঙ্গনা’য় কিংবা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ যেমন তা দেখিয়েছেন, তেমনি সেই প্রবণতার প্রকাশ ঘটেছে ‘ব্রজাঙ্গনা’তেও। এটি একটি গীতিমুখ্য কাব্য— বহিরঙ্গের বিচারে যাকে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলির গোত্রভুক্ত করা যায়। এখানে রয়েছে পূর্ববর্তী বৈষ্ণব পদের চরিত্রসমূহ, নিসর্গ প্রকৃতি, পুষ্পকানন, নিকুঞ্জকুটির, যমুনাপুলিন, তমালতল, মলয় পবন, মোহনবাঁশির বংশীধ্বনি; কিন্তু তবুও কবির মনোধর্মের পার্থক্যের কারণে ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ হয়ে উঠেছে আধুনিক চেতনাদীপ্ত এক গীতিকাব্য। ব্রজমণ্ডলের অনুসারকদের লেখায় বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের যে অঞ্জনটুকু মাখানো ছিল, মধুসূদনের হাতে তা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়েছে। নবজাগরণের মূল যে বাণী মানবতাবাদ, তার দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে কবি মধুসূদন রাধাকে এখানে তুলে ধরেছেন সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিতে। তিনি স্পষ্টত একটি চিঠিতে লিখে জানিয়েছেন, এই রাধা তাঁর কাছে ‘Mrs. Radha’ । নারীর এই ‘Mrs.’ অভিধাটি কেবল একটি বিদেশি পরিভাষামাত্র নয়, তা অন্যরকমের আধুনিকতার দ্যোতকও বটে। বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলির কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির সারভূত রূপ রাধা মাইকেলের হাতে পড়ে হয়ে উঠেছেন রক্তমাংসের একজন মানবী।
আরও পড়ুন: বাংলার নবজাগরণ ও মাইকেল মধুসূদন (পর্ব- ৩)
সবশেষে বলা যাক বাংলার রেনেসাঁসের চতুর্থ বৈশিষ্ট্যের কথা, যাকে আমরা আগেই চিহ্নিত করেছি স্বদেশপ্রেম তথা দেশচেতনা বলে। ইংরেজরা এদেশে শাসক হয়ে বসার আগে দেশপ্রেমের ধারণা বলতে কিছুই প্রায় ছিল না। ভারতবর্ষে তখন খণ্ড ক্ষুদ্র প্রদেশে স্বাধীন অথবা করদ নরপতি ও ভূস্বামীদের শাসন চলত। সম্রাট ছিলেন সমগ্র রাষ্ট্রশক্তির সর্বেসর্বা। দেশের শাসন সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট বোধ কিংবা সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না সাধারণ মানুষের। সরকার ভাঙা-গড়ার ক্ষেত্রে জনগণের কোনো সরাসরি ভূমিকা ছিল না। ফলত তাদের মধ্যে দেশচেতনা গড়ে ওঠার অবকাশ সৃষ্টি হয়নি। এই চেতনা প্রথম সঞ্চারিত হল ইংরেজি শিক্ষায়, বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকার ইতিহাস পঠন-পাঠনের ফলে। পড়াশোনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশের নানান বিপ্লব ও আন্দোলনের বহুমুখী তাৎপর্য অনুভূত হল। এটা সহজেই অনুমেয় যে, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম বা ফরাসি বিপ্লবের মতো সাফল্যযুক্ত রাজনৈতিক ঘটনা সেকালের শিক্ষিত স্বদেশভাবুক বাঙালিদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিল একধরনের সচেতনতা ও স্বাধীনতালাভের আকাঙ্ক্ষা। পাশাপাশি এদেশে ঘটে চলেছিল কিছু বিদ্রোহ, আন্দোলন। সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়ার প্রেরণা যেমন ঘনীভূত হয়েছে, তেমনি ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’র ধারণা ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। ছয়ের দশক থেকে গঠিত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এইসব সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার নাগপাশ থেকে স্বদেশকে মুক্ত করা। মধুসূদনের সাহিত্যে সরাসরি দেশাত্মবোধের প্রকাশ না ঘটলেও (যেমনটা দেখা যায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কিংবা নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ অথবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’-এ) আকারে-ইঙ্গিতে, ভাবে-ভঙ্গিতে পরাধীনতার গ্লানি ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা লক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ রাবণের ও ইন্দ্রজিতের একাধিক উক্তি স্মরণীয়।
রামচন্দ্র কর্তৃক সীতা উদ্ধারের জন্য লঙ্কাপুরী অভিযান ও তার পরিপ্রেক্ষিতে রাবণ কর্তৃক লঙ্কাবাসীদের মধ্যে দেশচেতনার উদ্বোধন প্রয়াসকে কেউ কেউ তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির রূপক বলে বিবেচনা করেন। রাবণ যে চিত্রাঙ্গদার কাছে ‘দেশবৈরী নাশ’-এর কথা বলে বীরবাহুর মৃত্যুকে গৌরবান্বিত করতে চেয়েছেন, তাকে সদর্থকভাবে বিবেচনা করলে, রাবণের ওই উক্তিতে দেশপ্রেমের আভাস পাওয়া যায়। এছাড়া বীরবাহুর মৃত্যু-সংবাদ শুনেই রাবণ যেভাবে সভাসদদের নিয়ে সেই করুণ দৃশ্য দেখতে গিয়েছেন ও যে-ভাষায় বিলাপ করেছেন, তাতে বিষণ্ণ এক দেশনায়কের মূর্তি পরিস্ফুট হয়েছে। শোকাতুর রাবণ মৃত পুত্রের উদ্দেশ্যে বলেছেন—
‘যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ, কুমার
প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে
সদা! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়; শত ধিক্ তারে!’
এই শেষ কথাগুলি যেন দেশমাতৃকার মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত প্রাণ বলিদানে উৎসুক শহিদদের মুখের বাণী। পরবর্তীকালে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনির উদাত্ত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে অনেক দেশভক্ত যুবক অকাতরে তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন নির্ভীক চিত্তে। রাবণের এ উক্তি যেন তারই পূর্বাভাস।
মধুসূদন ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’-এ রাজপুতানার একটি বিশেষ সময়পর্বের ইতিহাসকে তাঁর নাট্যকাহিনির বিশেষ উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সেখানে দেখানো হয়েছে— উদয়পুরের রানা ভীমসিংহ তাঁর কন্যা কুমারী কৃষ্ণার বিবাহকে কেন্দ্র করে এক গভীর রাষ্ট্রীয় সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছেন। একদিকে জয়পুরের রাজা জগৎসিংহ ও অন্যদিকে মরুদেশের রাজা মানসিংহ কৃষ্ণার পাণিপ্রার্থী। দুই যুযুধান রাজার দ্বারা দেশ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় বিপন্ন ভীমসিংহের উক্তিতে ভীতি-ত্রস্ততার সঙ্গে খুব ক্ষীণাকারে ছোঁয়াচ লেগেছে স্বদেশ-ভাবনার। যদিও তাঁর হা-হুতাশময় নিশ্চেষ্টতা চরিত্রটিকে মেরুদণ্ডহীন করে তুলেছে।
এ বছর (২০২৪) মধুসূদন পূর্ণ করলেন তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ। এই দীর্ঘ সময়পর্বে তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে চর্চিত হয়েছেন। অসামান্য প্রতিভার সূত্রে যে কবিখ্যাতি ও সম্বর্ধনা তাঁর প্রাপ্য ছিল সর্বাংশে যে তিনি তা লাভ করেছিলেন— এমনটা মনে হয় না। তাঁর ওপরে নানা দৃষ্টিকোণে জীবনী লেখা হয়েছে কয়েকটি। তাঁর সাহিত্য নিয়ে কয়েকটি নিবিড় গবেষণাও হয়েছে। কবির স্রষ্টাজীবনকে জানতে তাঁর লেখা পত্রগুলি খুবই মূল্যবান। যে সব রচনায় তাঁর সর্বাত্মক সিদ্ধি এই একবিংশ শতকের বাঙালি আজও সেগুলিকে শিরোধার্য করে রেখেছে তাদের নিত্যপাঠে ও প্রগাঢ় চর্চায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনি যে একটি শক্তিশালী স্তম্ভ এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।#