উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: বিবর্ণ অভিযোজন: শেষ পর্ব ১১
।। শেষ পর্ব ।।
সম্পাদক সাগরের বাড়ির সামনে সুসজ্জিত প্যান্ডেল, উপচে পড়া ভিড় ও আলোর অপূর্ব রোশনাই। সাগর খুব খুশি অনুষ্ঠানের আগে বন্ধুবর সেরফাকে দেখে। বললেন, অভিনন্দন জানালাম অগ্রিম আসার জন্যে। আজকের দিনে একটাই অনুরোধ, শুভদিনকে মন খুলে আশীর্বাদ করো যাতে ও কর্মজীবনে আরও সাফল্য লাভ করতে পারে। আমরা কেউ ভুলে যেতে পারি না, শুভদিনের সব কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজয়বাবুর মতো গুরু পেয়েছিল বলেই। তাই আমার স্থির বিশ্বাস, শুভদিন আজ শিক্ষক বিজয় সামন্তকে উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা দিতে এতটুকু ভুল করবে না। এখনও তো বিজয়বাবুকে দেখতে পেলুম না। আসতে এত দেরি করছেন কেন? মধ্যমনি আগে না এলে অনুষ্ঠান জমবে কী করে?
আরও মিনিট পাঁচেক পরে বিজয় সামন্ত এসে বললেন, আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।
আজ তো আপনার দিন। মন খুলে শুভদিনের কাছ থেকে যেমন খুশি গুরুদক্ষিণা চেয়ে নিতে পারেন।
ব্যক্তিগতভাবে কোনো গুরুদক্ষিণা চাই না, তবে শুভদিনের উপর আমার একটা দাবি রয়েছে। সেটাই আজ চেয়ে নেব সকলের সামনে।
আপনি যে অন্যায্য কিছু বলতে পারেন না, তা নিয়ে আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।
আমি চাচ্ছি, শুভদিন এবং সাহানি বিবাহ বন্ধনে ধরা পড়ুক। আশা করি, আমার কথা ও উপেক্ষা করতে পারবে না।
বিজ্ঞ সাগরের মুখে খুশির বন্যা। থেমে থেমে বললেন, আপনি তো দেখছি পাকা জ্যোতিষী হয়ে গেছেন। মনে মনে এতদিন যা ভেবে এসেছি, সেটাই বলে দিতে পারলেন? থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। প্র্যাক্টিক্যালি আপনার ভাবনার পথে আমার ভিতরের চাপ অনেকখানি কমে গেল। গুরুর দাবি শিষ্যকে তো মানতেই হবে। তারপর খুকখুক করে একটু হেসে মিষ্টার সাগর নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন।
সাহানির বাবা সেরফা মিষ্টার সাগরের হাসি দেখে সহজে বুঝে গেলেন, প্রিয় বন্ধুর একশো ভাগ সম্মতি রয়েছে সাহানিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। ভিতরে ভিতরে প্রবল খুশির বন্যায় ভাসছেন। চাহিদা সহজে পূরণ হলে যে কেউ এমনি করে মনে মনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকে। সেরফার ভিতরের ইচ্ছা সেভাবেই বিস্তার লাভ করছিল।
সাগর তখন স্মৃতির সমুদ্রে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছেন। কত কথা মনে পড়ছে পরপর। সেরফা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্কুল জীবন থেকে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা, এক সঙ্গে খেলেছে, ঝগড়া করেছে, আবার মিলে গিয়েছে। কেবল মনে মনে ভাবছেন, শুভদিন এবং সাহানির মিলনের মধ্যে তাদের পুরনো বন্ধুত্ব নতুন রূপ লাভ করবে। গলার স্বর উঁচু করে ডাকতে শুরু করলেন, এ্যাই গাবলু, কোথায় গেলি রে ?
কর্তাবাবু, এই তো আমি।
শুভদিন আর তোর গিন্নিমাকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে চলে আয়। আর দেরি করা চলে না।
কিন্তু তখনও একটা প্রসঙ্গ মিষ্টার সাগরকে বার বার কম্পিত করছে। অনুষ্ঠান শুরু হতে চলল, তানুস্যার এখনো এলেন না কেন? তাহলে কী কারুর মাধ্যমে তাঁর পবিকল্পনা আগাম জেনে ফেলেছেন? না হলে এত দেরি করছেন কেন? শেষ পর্যন্ত আসবেন তো? প্যান্ডেলের চারদিকে হাঁটছেন আর ভাবছেন। লিজা তার মনের কথা তানুস্যারের কাছে প্রকাশ করে দেয়নি তো? মিষ্টার সাগর মুখটা কঠিন করে থমকে দাঁড়িয়ে আছেন, বার বার ভাবছেন, তানুস্যার উপস্থিত না হলে সমগ্র অনুষ্ঠানটা ভীষণ জলো হয়ে যাবে। বৈপরীত্যের বাহার জীবনকে সব সময় উজ্জ্বল করে রাখে। তানুস্যারের অভাবে সেটাই বেশি করে টের পেতে হবে। আজকের অনুষ্ঠানে তিনি খুব আন্তরিকভাবে তানুস্যারকে সাবপ্লটের নায়ক হিসেবে পেতে চাচ্ছেন। তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতে চান বিজয় সামন্তের অসামান্য কৃতিত্বের কথা। তিনি যে তানুস্যারের পরিবর্তে বিজয়বাবুকে গ্রহণ করে এতটুকু ভুল করেননি, তাও প্রমাণ হয়ে যাবে তানুস্যাররের কথায়। জীবনে এর চেয়ে বড়ো সাফল্য আর কিছুই হতে পারে না।
আরও মিনিট দশেক পরে অনুষ্ঠান শুরুর সময়ে তানুস্যার এসে উপস্থিত হলেন। শুধুমাত্র তিনি আসেননি, মেয়ে ফিজাকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ব্যস্ততার সঙ্গে মিষ্টার সাগর সামনে এগিয়ে এসে বললেন, ওয়েলকাম স্যার, এতক্ষণ ধরে আপনার জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম। এসে গিয়েছেন দেখে খুব ভালো লাগছে। আপনাকে অভিনন্দন জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। এও জানি, আপনি একসময় শুভদিনের শিক্ষক ছিলেন, না এসে যে পারবেন না, সেই বিশ্বাস আমার মধ্যে ছিল। আপনিই আজকের অনুষ্ঠানে চিফ-গেষ্ট। আপনাকে সাক্ষী রেখে সব কাজ আবর্তিত হবে, এটা ভেবে খুব গর্বিত হচ্ছি।।
সাগরদা, শুভদিন আমার ছাত্র, ওকে নিয়ে আমার শুভ ভাবনা অন্তহীন। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা সব সময় ওর সঙ্গে রয়েছে।
শুভদিনের কথা যে এভাবে মনে রাখতে পেরেছেন, সে জন্যে অশেষ ধন্যবাদ।
শিক্ষকের মূল কাজ হলো ছাত্রকে মনে রাখা, তার কৃতিত্ব স্বরণ করে নিজেই গর্বিত হওয়া।
মিষ্টার সাগর মনে মনে ভাবছেন, আপনিই আমার শুভদিনের খাতা পরীক্ষার হল থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন, মারধোর করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নি। কিন্তু তা বাইরে এতটুকু প্রকাশ না করে বললেন, চলুন স্যার, আর দেরি না করে অনুষ্ঠানের কাজ শুরু করি। মঞ্চের উপরে উঠে বসুন।
একটা বিশেষ বাতাবরণ, বিশেষ ভাবচেতনা, সাগরের মনে বিশেষ উচ্ছ্বাস। তিনি যেন যুদ্ধজয়ের আগাম খবর পেয়ে গিয়েছেন। তানুস্যার যেন সেই যুদ্ধ জয়ের উপযুক্ত খলনায়ক, মিষ্টার সাগর মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে আবেগঘন গলায় ঘোষণা করলেন, আজ বিজয়বাবুকে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্যে এত বড়ো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শুভদিনকে সেই গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। উপরে উঠে এসো শুভদিন। নিজের হাতে পরম গুরু বিজয়বাবুর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দাও। লিজা মঞ্চের একধারে দাঁড়িয়ে। শুভদিন কিন্তু মালা হাতে বিজয়বাবুর কাছে গেল না, তানুস্যারের চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো।
কী হল শুভদিন, ওখানে কেন? সাগরের মুখে চাপা প্রশ্ন। সকলের মধ্যে অন্য কৌতুহল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। তাহলে কী আজ শুভদিন অন্য কারুর গলায় মালা পরিয়ে জীবনের অন্য বিশেষ সত্য প্রকাশ করতে চলেছে?
ঠিক তাই ঘটল। শুভদিন পরম মানসিক ভক্তি নিয়ে মালাটা তানুস্যারের গলায় পরিয়ে দিল। মাথা নীচু করে শুধু বলল, আপনার আশীর্বাদ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ।
সম্পাদক সাগর রাগে গরগর করতে করতে বললেন, এ কী করলে শুভদিন?
বাপি, আমার প্রকৃত শিক্ষা চেতনা গড়ে উঠেছে তানুস্যারের প্রশিক্ষণে। মা সেকথা তোমাকে জানায় নি কেন?
সাগর দু’চোখ লাল করে চেয়ে থাকলেন লিজার দিকে। কেবল ভাবছেন, শুভদিন যা বলল, তা কী আদৌ সত্যি? সত্যি হলে লিজা তা প্রকাশ করেনি কেন?
সাগরের প্রসঙ্গ কিন্তু লিজাকে এতটুকু স্পর্শ করল না। হনহন পায়ে মঞ্চে থেকে নেমে এল। একটু পরেই ফিজাকে সঙ্গে নিয়ে আবার মঞ্চের উপরে উঠে গেল। সামনে সরে এসে নিজেই ঘোষণা করল, অনেক দিন ইচ্ছে করেই চেপে রেখেছিলাম। তা আজ পূরণ করার জন্যে বলছি, আমি আজ শুভদিনের হাতে তুলে দিচ্ছি ফিজাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে। আপনারা সকলে আশীর্বাদ করুন যাতে ফিজা আর শুভদিনের জীবন সুখের হয়ে উঠতে পারে।
সম্পাদক সাগর হতবাক। এসব কী হচ্ছে মঞ্চের উপর? তাকে না জানিয়ে লিজা এত বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারল? নিজের ইচ্ছার কথা কেন তাকে একবার বলতে পারল না? তানুস্যারের দু’চোখ ছলছল করে উঠল। প্রকৃত গুরুদক্ষিণা এত কঠিন বাস্তব? প্রতিফলিত হতে এত সময় লাগে? ভাবালুতায় দুলতে লাগলেন তানুস্যার। কেবল ভাবছেন, তাহলে শুভদিন তাকে একেবারে ভুলে যেতে পারেনি? জীবনের সত্যিগুলো দেরিতে হলেও এভাবেই শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ লাভ করে?
মিষ্টার সাগরের মাথায় তখন কূটনীতির ভুল হিসেব সজোরে কিক খাওয়া বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে বারপোষ্টের পাশ দিয়ে মাঠের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোনো পর্যবেক্ষণ মিলছে না। জীবনটা যে শেষ পর্যন্ত এত গরমিলের খেলা হয়ে উঠতে পারে, আগে তা কখনো ভাবেননি। তবে একটা নতুন মূল্যায়ন থেকে আর পিছনে সরতে পারছেন না। লিজা তাকে ঠায় দাঁড় করিয়ে এভাবে হারিয়ে দিতে পারল? জোর করে যে ভালোবাসা পেতে নেই, সেই প্রতীতী সাগরকে বার বার ছ্যাকা দিয়ে চলেছে। এও বুঝলেন তিনি যেভাবে আজ লিজার রুঢ় আঘাতে কেঁপে উঠতে পারলেন, অন্তত শুভদিন ফিজাকে সঙ্গে পেয়ে সেই আঘাতে কখনো জর্জরিত হবে না। কূটনীতির রিকটার স্কেলে মনের ভালোবাসা যে ঠিক ঠিক ধরা পড়ে না, তাও বেশ বুঝতে পারলেন। নিজে যে ভুল করেছিলেন তা শুধরে নিতে লিজা যেন ছেলেকে দিয়ে তাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতে পারল। একটাই সান্ত্বনা, সারা জীবন ভুলের মাসুল গুণতে গুণতে অন্তত শেষ মুহূর্তে তিনি প্রকৃত জীবনবোধের দোরগড়ায় এসে দাঁড়াতে পেরেছেন। আগামি দিনে এ দৃষ্টান্ত অন্য সকলের ক্ষেত্রে যে পরম প্রাপ্তি হয়ে দেখা দেবে, তা নিয়ে মিষ্টার সাগরের মধ্যে কোনো সংশয় থাকল না।
তানুস্যারের সৌজন্যে হাসানপুর থেকে অনেক দর্শক শ্রোতা এসেছিল এ অনুষ্ঠানে। পিছনে দল বেঁধে বসে ছিল। তাঁর অসামান্য সম্মানপ্রাপ্তিতে তারা এত বিহ্বল হয়ে পড়ল যে মাথা দোলাতে লাগল তালে তালে। বি এ প্রথম বর্ষের ছাত্র। নাম—মিনি গুগল। তার মধ্যে তখন অন্য মূল্যায়ন শুরু হয়ে গেছে। আবেগ তাড়িত হয়ে কান্না ভেজা গলায় শুধু বলতে পারল, তানুস্যারের পথ ধরে হাসানপুর সত্যি সত্যি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। জয়তু তানুস্যার। জয়তু হয়ে উঠুক আমার গ্রাম।
সমাপ্ত