ভুল বালুচরে

আজিম এবং প্রকাশ দুই বন্ধু। গলায় গলায় ভাব। বন্ধুত্বটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে, ছোটবেলা থেকে নয়। সাধারণতঃ ছোটবেলায় যে বন্ধুত্বটা হয়, সেটা সত্যিকার অর্থে নিঃস্বার্থ এবং বিশ্বস্ত হয়, অনেক কাল পর্যন্ত তা অটুট থাকে। সেখানে স্বার্থের চাহিদা কম থাকে তাই একে অপরের সুখ দুঃখ ভাগ করে জীবন কাটিয়ে দেয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অর্থাৎ পরিণত বয়সে মানুষ তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং স্বার্থকে বিবেচনা করে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধুর জন্য যদি কোনো কিছু করার প্রয়জোন মনে হয় তাহলে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তা করা হয় না। উপরন্তু অনেকে আবার সময়-ক্ষণ বুঝে বিপদ আপদে সাহায্যের বদলে সরে পড়তে লজ্জিত বা কুণ্ঠিতবোধ করে না। তার মানে বয়স কালে যে বন্ধুত্ব হয় সেটা ছোটবেলার বন্ধুত্বের মত অতটা গভীরতা পায় না। অবশ্য এর ব্যতিক্রম রয়েছে, আজিম এবং প্রকাশের বন্ধুত্ব এর প্রমাণ। তাদের মাঝে যে বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়েছে তা রীতিমতো ঈর্ষা করার মত।
বন্ধুত্বের শুরুটা নাটকীয় ভাবে হয়েছিল। যে মুহূর্তে ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটি লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছালো, ঠিক সেই সময়ে এয়ারপোর্টের ‘ইনফরমেশন টেকনোলজির’ যন্ত্রপাতি অকেজো হবার কারণে ভ্রমণ ক্লান্ত যাত্রীদের মধ্যে বিমানের ভিতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি শুরু হলো। বিমানের ভিতর কয়েক ঘন্টা অসহায় অবস্থায় থাকাকালীন তাদের দুজনার মধ্যে পরিচয়ের সূত্রপাত। পরিচয় সূত্রে তারা জানতে পারলো উভয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটির ‘কুইন মেরি’ কলেজে ছাত্র হিসাবে যোগদান করার জন্য লন্ডনে এসেছে। আজিমের সাবজেক্ট ‘একাউন্টেন্সি’ আর প্রকাশের সাবজেক্ট ‘ল’। এভাবেই প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সাঙ্গ হলো। প্ৰকাশ তার দিদির বাসায় এবং আজিম কলেজে থেকে পাঠানো এক প্রতিনিধির সাথে কলেজে হোস্টেলে চলে গেলো। আজিম ঢাকা থেকেই কলেজের হোস্টেলে থাকার ব্যাবস্তা করে রেখেছিলো।
প্রকাশের দিদি পূর্ব লন্ডনের এক মিউনিসিপ্যাল অফিসে ‘সোশ্যাল ওয়ার্কার’ আর জামাই বাবু একজন ডাক্তার। সে বোনের বাসা থেকে ক্লাস করে। কলেজে দুজনের সখ্যতা ক্রমে বেড়ে চললো, ফলে প্রকাশের দিদি আজিমকেও নিজের ভাই হিসেবে সমাদর করে গ্রহণ করলো এটা ভেবে নিজের দেশের ছেলে বিদেশে বিভুয়ে একা আছে। তাছাড়া আজিমের ব্যবহার এবং আদব-কায়দা অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত। সময়ের সাথে ওদের দুজনের একের প্রতি অপরের সম্ভাষণ “আপনি” থেকে “তুমি”তে দাঁড়ালো। সময় গড়িয়ে এক বছর পার হলো। কলেজ হোস্টেলের চুক্তি অনুসারে নবাগত ছাত্রদের জন্য কলেজের রুম খালি করে দিতে হয়। আজিমের বেলায়ও তা হলো। তাই বলে তাকে “হোমলেস” হতে হয়নি। আজিমকে কলেজের কর্তৃপক্ষ অন্যান্য ছাত্রের মত কলেজের আসে পাশের পরিবারের সাথে “পেয়িং গেস্ট” হিসাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিল।

আজিম যে পরিবারের সাথে থাকা শুরু করলো, তারা মূলত “গ্রিক-সিপ্রিয়ট। তাদের একটা গ্রোসারির দোকান আছে। ওই গ্রোসারি দোকানের আয়ে নিজেদের সংসার চালিয়ে নিচ্ছে। তাদের একটি মাত্র টিন-এইজ সন্তান- নাম তার সিলভিয়া পাপাডোপোলাস। দেখতে খুবই সুন্দরী, যে রকম চেহারা তেমনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী।
এমনি করে আরো বছর দুই পার হয়ে গেল। প্রকাশ ‘ল’ পাশ করে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ভর্তি হলো। আজিম একাউন্টেন্সি পাশ করে মোটা বেতনে লন্ডনের একটা মার্কিন মার্চেন্ট ব্যাংকে চাকরি নিলো। এদিকে মন্থর গতিতে নিজেদের অজান্তে আজিম এবং সিলভিয়ার মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালো লাগার আবেগ থেকে তা ভালোলবাসায় রূপ নিলো। আজিম ,এ বিষয় নিয়ে প্রকাশের সাথে আলাপ করলো এবং এও জানালো সে সিলভিয়াকে বিয়ে করতে চায়। ব্যাপারটি শুনে প্রকাশ বাকহারা। কি যে বলবে, কিছুই মাথার মধ্যে আসছিলোনা। শুধু বললো, ‘বন্ধু, তুমি মুসলিম আর সিলভী হলো কট্টর রোমান ক্যাথলিক। তোমার মা বাবা কি ভাববে, এ ব্যপারে কিছু বিবেচনা করেছো?’
‘আমরা একে অপরকে মনে প্রাণে ভালোবাসি, এটাই কি যথেষ্ট নয়!’ আজিম তার অভিমত ব্যক্ত করলো।
-শুনো আজিম, মানুষের জীবনে ধর্মটা একটা বিরাট সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার। জীবনের চলার পথে একটা বিশ্বাস নিয়ে আগাতে হয়। কোন ধর্ম খারাপ বা ভালো সেটা বিবেচনার বিষয় নয়। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। সব ধর্মের একই বিধান, ‘সদা সত্য কথা বলিবো একে অপরের সাথে অযথা বা অকারণে বৈরীভাব রাখবেনা, সবাইকে সম্মান করতে হবে, সে যেকোনো ধর্মের লোক হউক না কেন। আরো অনেক মৌলিক গুন যা সব ধর্মেই সমান ভাবে প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়া ভালোবাসা ক্ষণিকের মোহ হতে পারে, যে কোনো সময়ে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিয়েটা সারা জীবনের বন্ধন, সেটা হেলা ফেলা করোনা। দুজনের বিবাহ বন্ধন ততই অটুট থাকার সম্ভবনা থাকে যত বেশী নিজেদের মধ্যে কমনগ্রাউন্ড থাকে।
– এখানে ধর্মকে টেনে আনা আমি সমীচীন মনে করিনা। পৃথিবী অনেক বদলেছে, আধুনিক যুগে অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, তাই ধর্মকে ভালোবাসার মাঝে টেনে হেচঁড়ানোটাকে আমি হীনমনের পরিচয় মনে করি।
– ঠিক আছে, মানলাম। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা তো তোমাকে ভাবতে হবে। ওরা কোন ধর্ম নিয়ে বাঁচবে? কোন বিশ্বাস নিয়ে ওরা ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা ধর্মাচরণে পদ্ধতি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করবে? ওদের কৃতকর্মের জন্য তোমরা দায়ী থাকবে। কারণ বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এক প্রকার এবং সারা জীবন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থেকে ছেলে মেয়েদের মানুষ করা অন্য প্রকার।
-ভবিষ্যতের কথা কি আর চিন্তা করবো, যখন আসবে তখন দেখা যাবে।
প্রকাশের আর কিছুই বলার রইলোনা। দিদির এবং জামাই বাবুরও একই অভিমত, কোথায় যেন আজিম ভুল করছে। সচারচর যা হয়ে থাকে, প্রেমে পড়লে মানুষ কে কার কথা শুনে!
আজিম যখন সিলভীকে বিয়ে করার প্রস্তাব সিলভীর মা বাবার কাছে পেশ করলো, তখন তাদের কাছে মনে হলো, তারা যেন হাতে চাঁদ পেলো। যেখানে তাদের হবু জামাতা একজন শিক্ষিত, পেশাজীবী একাউন্ট্যান্ট সেখানে তারা প্রায় অর্ধ শিক্ষিত গ্রোসারি দোকানের মালিক। এর চেয়ে আনন্দ আর সুখের বিষয় কি হতে পারে?
খুব ধুমধাম করে আজিম এবং সিলভিয়ার বিয়ে হলো, এক্কেবারে বাংলাদেশের রীতি অনুযায়ী। দেশ থেকে আজিমের মা-বাবা যোগ দিলেন, যদিও এই বিয়েতে তাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তবুও ছেলের খুশীতে উনারাও খুশী। হল ঘরটি এতো সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল যেন সেখানে আনন্দ মেলা হচ্ছে। এই আয়োজনের সব কৃতিত্ব ছিল প্রকাশের নিঃস্বার্থ অবদান। বিয়ের অনুষ্ঠানে শাড়ীতে কনেকে বেশ সুন্দর লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো বিউটি কন্টেস্টে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিয়েটা নিশ্চয় দুজনের জীবনে এক স্মরণীয় দিন, যার মাঝে লুকিয়ে আছে অনাবিল আনন্দ এবং প্রশান্তি। অতিথিদের মধ্যে সবাই তাদের সুখী জীবন কামনা করে সেদিনকার মত বিদায় নিলেন।
আজিম এবং সিলভিয়ার বিবাহিত জীবন আর পাঁচটা সংসারের মত চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রকাশ ব্যারিস্টারী পাশ করে বাংলাদেশে ফিরে গেছে। উদ্দেশ্য দেশে প্রাকটিস করবে আর এদিকে আজিমরা এক কন্যা সন্তানের বাবা-মা হয়েছে। মেয়ের নাম রেখেছে কেয়া। কেয়াও মার মত সুন্দরী হয়েছে। কেয়ার যখন আড়াই বছর বয়স তখন কেয়াকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসেছে। সিলভীর বাংলাদেশ ভালো লেগেছে, বিশেষ করে আজিমের আত্মীয়দের অতিথিপরায়ণতায়। বাঙালি খাবার দাবার ও তার কাছে সুস্বাধু লেগেছে। ইলিশ মাছের কাটা নিজের হাত দিয়ে বেছে তবে খেয়েছে, কারোর সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। সময়ের সাথে সাথে তাদের সংসার সুখে শান্তিতে চলে যাচ্ছিলো।
কেয়ার বয়স যখন প্রায় এগারো বছর তখন তাদের সংসারে প্রথম ঝড় শুরু হলো। হালকা ভাবে চিন্তা করলে ঝড়টা নিতান্তই স্বাভাবিক গোছের। একদিন রোববার সকাল বেলায় আজিম ‘জিম’ থেকে বাসায় ফিরে এসে দেখলো কেয়া বাসায় নেই। সিলভীকে জিজ্ঞাসা করে সে জানতে পারলো কেয়া ‘সানডে স্কুলে’ গেছে।
– সানডে স্কুলটা আবার কি?
– সানডে স্কুলটা হলো যেখানে ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়া হয়।
– ভালো কথা, সেখানে কি কি শেখানো হয়?
– সেখানে বাইবেল পড়ানো হয় এবং যীশুখ্রিস্টের সমন্ধে নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয়। মেয়ে বড় হচ্ছে ,তাই আমাদের খ্রিস্টান ধর্ম সমন্ধে সবিস্তারে তার জানা দরকার।
– তাহলে তাকে তো মসজিদে পাঠানো দরকার। সেখানে সে কুরআন শরীফ এবং নামাজটা শিখে ফেলতে পারে।
– তা হয় না।
– কারণ?
– আমি কেয়াকে আমার খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দিতে চাই, অন্য কোনো ধর্ম, বিশেষ করে জঙ্গি ইসলাম ধর্মে লিপ্ত হতে দিতে চাই না।
– সেটা তো তোমাকে আমাদের বিয়ে করার আগে থেকেই চিন্তা করা উচিৎ ছিল। এখন ওসব বিষয় বাদ দাও। ধর্ম -টর্ম নিয়ে মাথা ঘামানো আমাদের এখন সাজেনা। বর্তমান জীবন যেমন চলছে তেমন করে চালিয়ে নাও।
– তোমার এসব কথা আমি মানিনা। আমি ক্যাথলিক, তাই আমার মেয়েকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা দিয়ে গড়ে তুলবো।
সিলভীর কথাগুলি শুনে প্রকাশের সেই ভবিষ্যৎ বাণীর কথা মনে পরে গেলো, ‘নিজেদের ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করো আজিম।’
এই সাধারণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সংসার জীবনে চির ধরতে শুরু করলো। ক্রমে বড় আকারে তাদের দাম্পত্য জীবন সংকট কাল হয়ে দাঁড়ালো। প্রকাশের দিদির পরামর্শে তারা এক বিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী কাউন্সিলার এ কাছে গেলো। কাউন্সিলের মনোযোগের সাথে দুজনের কথা শুনলেন। কিন্তু তিনি কারো কোনো দোষ খুঁজে পেলেন না। দুজনে দুজনের যে যুক্তি কাউন্সিলরের কাছে দাঁড় করালো তাতে যে যার জায়গায় রীতিনীতির আদর্শ অনুযায়ী সঠিক।
এরই মধ্যে একে অপরের প্রতি যে ভালবাসা ছিল, সেই ভালবাসার বাঁধ ভেঙে পড়েছে। পরিণামে তারা ডিভোর্স নিতে বাধ্য হলো। সিলভিয়া, কেয়াকে সাথে নিয়ে আজিমের জগৎ থেকে চিরতরে বিদায় নিলো।
আজিম এ ব্যথা সহ্য করতে পারলোনা। তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। মানসিক হাসপাতালে তার সাথে এক মাদ্রাজি রোগীর পরিচয় হলো। সে আজিমের জীবন কাহিনী শুনে হিন্দীতে বললো, ‘ইয়ার, তুমি জীবনের পথে চলতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছো, আমার ও সেই একই অবস্থা। এটাই হলো জীবনের খেলা। কেন যে দেশ ছেড়ে বিদেশে রয়ে গেলাম, হয়তো ভাগ্যে ছিল বলে।’#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!