মধ্যবয়সে বিদ্যাসাগর

১৮৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর জীবনের মধ্যভাগে, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখছিলেন। তাঁর বয়স তখন ৩৬-৩৭ বছর, বয়সের কাজগুলির মূল্যায়নের সময়। দেড়শ বছর অতিক্রান্ত বিদ্যাসাগর মধ্য বয়সে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাজ করে গেছেন।

বিধবাবিবাহ আন্দোলন:
রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগ ও আন্দোলনের ফলে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও বিধবাদের ভবিষ্যৎ কী এ সম্পর্কে তেমন কোন উদ্যোগ তাঁর পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।এ বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

(i) বিধবা বিবাহের পক্ষে জনমনে চেতনার প্রসারে বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রথম বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রবন্ধ লেখেন। পরের বছর ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে বিদ্যাসাগর বলেন— বিধবা বিবাহ সম্পূর্ণভাবে শাস্ত্রসম্মত।

(ii) বিদ্যাসাগর বিধবার পুনর্বিবাহ নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়েন শোভাবাজার রাজবাড়ির রাধাকান্ত দেব ও তাঁর ধর্মসভা।বিদ্যাসাগরের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে এসময় কমপক্ষে তাঁরা ৩০টি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। লেখক হয়েও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এই বিরোধ নিয়ে ছড়া লিখলেন—
“বাঁধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল
বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।”

(iii) সমালোচনার ও বিদ্রুপের জবাব দিতে বিদ্যাসাগরও পিছপা হলেন না। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রকাশ করলেন ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে দ্বিতীয় পুস্তিকা।শুধু তাই নয় বিধবা বিবাহকে আইন সিদ্ধ করার জন্য ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদন পত্র ভারতীয় আইন সভায় পেশ করেন।

(iv) রাধাকান্তদেবও চুপচাপ বসে রইলেন না,তিনি বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করে বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ৩৬,৭৬৩ জনের স্বাক্ষরিত এক দরখাস্ত সরকারের কাছে পাঠালেন।

অন্যদিকে কর্মীরা কত বোঝেন। শান্তিপুরের তাঁতিরা এ সময় বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কাপড়ে লিখলেন—
“সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে,
সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে।”

(v) রাধাকান্তদেব ও রক্ষণশীলদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও বড়লাট ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই ১৫ নং রেগুলেশন জারি করে বিধবা বিবাহকে আইন সিদ্ধ করেন।

সাফল্য: বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত আন্দোলন এবং এ বিষয়ে সরকারের আইন পাশ বিদ্যাসাগরের এক বড় সাফল্য। কেবল আইন পাশ করে নয়, বিধবা বিবাহকে বাস্তবে কার্যকরী করতেও তিনি উদ্যোগী হন।

বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় প্রথম বিধবাবিবাহ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় ১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২৪ অগ্রহায়ণ(৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৬)। পাত্র: শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। তিনি সে-সময় সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন। পাত্রী: বর্ধমান জেলার পলাশডাঙ্গার কালীমতী দেবী। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় ৪ বছর বয়সে।বিধবা হন ৬ বছর বয়সে।বিধবাবিবাহের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর।

কালীমতি দেবী হলেন বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী থানার অন্তর্গত পলাশডাঙা গ্রামের স্বর্গীয় ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা। তখন অবশ্য সোনামুখী থানা বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।কালীমতি দেবীর মায়ের নাম লক্ষ্মীমণি দেবী। তিনি ছিলেন নদীয়া জেলার শান্তিপুরের আনন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা। ব্রহ্মানন্দ তাঁর কন্যা কালীমতির বিবাহ দিয়েছিলেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের কাছে বাহিরগাছি গ্রামের রুক্মিণীপতি ভট্টাচার্য্যের পুত্র হরমোহন ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে। স্বামী মারা যাবার পরেও কালীমতি শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন।কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে তাঁর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।ইতিমধ্যে বাবা ব্রহ্মানন্দ গত হয়েছেন। মা লক্ষ্মীমণি শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের কষ্ট দেখতে না পেরে নিজের কাছে এনে রাখেন।একে তো লক্ষ্মীমণি নিজেই বিধবা, তার ওপর বালিকা বিধবা কন্যাকে নিয়ে কষ্টেই দিনাতিপাত করতে হতো। পলাশডাঙায় লক্ষ্মীমণি দেবীর প্রতিবেশী ছিলেন দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায়।কর্মজীবনে দুর্গাদাসবাবু ছিলেন কলকাতার আইন ব্যবসায়ী। থাকতেন কলকাতার বেলতলায়। সেই সূত্রে দুর্গাদাসবাবুর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের আলাপ ও বন্ধুত্ব। দুর্গাদাসবাবু বিদ্যাসাগরকে এই বিধবা কন্যার হদিশ দেন। সেই যুগে কোন ছেলে বিধবাবিবাহ করবে! তখন তা যেমন ভাবা যেত না, তেমনি কোনও পরিবার তাদের বিধবা মেয়েকে আবার বিয়ে দেবে; তাও ছিল চিন্তার অতীত। যাই হোক বিদ্যাসাগর নিজে আসেন পলাশডাঙা গ্রামে।এসে চারদিন ছিলেন দুর্গাদাসবাবুদের বাড়িতে।এমনই দাবী করেন দুর্গাদাসবাবুর বংশধরগণ। লক্ষ্মীমণি দেবী রাজি হন তাঁর বিধবা কন্যা কালীমতির দ্বিতীয়বার বিবাহ দিতে।এই সিদ্ধান্ত কম বৈপ্লবিক ছিল না। সাধারণ এক পড়াশোনা না জানা মহিলা কোথা থেকে যে এতো সাহস পেয়েছিলেন! সমাজপতিদের রক্তচক্ষু ও এতদিনের সংস্কারকে উপেক্ষা করে বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। হয়তো বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠত যদি লক্ষ্মীমণি দেবী তাঁকে পলাশডাঙা থেকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দিতেন।

ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে আজও লক্ষ্মীমণি দেবী বা কালীমতি দেবীর ভগ্ন ভিটে পলাশডাঙা গ্রামে বর্তমান। বর্তমানে পলাশডাঙা গ্রাম সোনামুখী ব্লকের ডিহিপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন।কিন্তু সেদিনের কোনও লেখকের কলমে লক্ষ্মীমণি দেবীর এই সাহসী পদক্ষেপের কথা সেভাবে ফুটে ওঠেনি।

প্রথমে বর্ধমান রাজ মহতাবচন্দ্‌ বিধবাবিবাহের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হলেও পরে পক্ষাবলম্বন করেন এবং পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নেন। বর্ধমানরাজের আনুকূল্য পেয়ে উৎফুল্ল বিদ্যাসাগর জেপি গ্রান্টকে চিঠি লেখেন এবং মহতাবচন্দ্‌কে ‘দ্য ফার্স্ট ম্যান অব বেঙ্গল’ বলে উল্লেখ করেন। বর্ধমানরাজের সমর্থন ফলাও করে ছাপা হয় গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ সম্পাদিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় (সম্পাদকীয়। ১৮ ডিসেম্বর ১৮৫৬। ১০৫ সংখ্যা)।

‘…অভিলাষ করি উৎসাহ প্রদানার্থ শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে এক রৌপ্য থালা এবং বেশ নামক এক রৌপ্য পাত্র যৌতুক দিব, রৌপ্য থালার উপরে বেশ পাত্র রক্ষিত হইবে,থালে এবং বেশ পাত্রের চতুদ্দিগে এইরূপ বিবরণ লেখা থাকিবে এতকালের পরে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন হিন্দু বিধবা বিবাহের পুনর্জ্জন্মের জন্মদাতা হইলেন…মহারাজ আরো কহিয়াছেন যে কোন দেশে যে কেহ বিধবা বিবাহ করুন তাহাতে যদি বিপদে পড়েন তবে তাঁহার নিকটস্থ হইলে তিনি তাঁহাকে রক্ষা করিবেন, ঐ ব্যক্তি যদ্যপি স্বদেশে থাকিতে না পারেন তবে বর্ধমানে বাসস্থান দিয়া বৃত্তি প্রদান করিবেন, বয়ঃক্রমে বালক হইলে রাজ কলেজে পড়াইবেন।’ বিনয় ঘোষ, ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৩৫৬-৫৭)।

(i) রক্ষণশীলদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও এরপর বিদ্যাসাগর নিজ উদ্যোগে ৬০টি বিধবাবিবাহ দেন, এমনকি নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রকেও ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন। বিধবাদের বিবাহের জন্য বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালের ১৫ই জুন ‘হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড’ তৈরি করেন।

(ii) বিধবাবিবাহকে বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর নিজের কথায়- ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবেক, তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।’ এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন ১৮৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে।বিদ্যাসাগরের অনুভব করেছিলেন, সমাজের অনুশাসন মূলতঃ ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত ব্রাহ্মণদের হস্তগত। নিজেদের অবস্থান কায়েম রাখার জন্য এই অবস্থান অচলায়তনেয় মতো আগলে রাখছেন একটি বিশেষ শ্রেণি। প্রথমাবস্থায় অবশ্য মহতাবচন্দ্‌ বিধবাবিবাহের সপক্ষে সরাসরি মত দেননি।বিদ্যাসাগর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।বিধবার পুনর্বার বিবাহের সমর্থনে বিদ্যাসাগরের যুক্তি ছিল। যুক্তি বিস্তারও ছিল।

এক। পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ের যে শ্লোকটি তার বিদ্যাসাগরকৃত অনুবাদ হল- ‘স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে স্ত্রীদিকের পুনর্ব্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত’। এই যুক্তি খণ্ডন করার জন্য পদ্মলোচনের অস্ত্র ছিল মনুসংহিতার নবম অধ্যায়ের যে শ্লোক,তাঁর করা অনুবাদ হল- ‘বিবাহ বিষয়ক যত বৈদিক মন্ত্র আছে তাহার কোন মন্ত্রে কথিত হয় নাই যে একের স্ত্রীর সন্তানোৎপাদনার্থ অন্য পুরুষ নিয়োগ করিবে। এবং বিবাহ বিষয়ক যত বৈদিক বিধি আছে তাহার কোন বিধিতে বিধবার পুনর্ব্বার বিবাহ বিহিত নয় নাই।’

বিধবাবিবাহ আইন পাস হয় ১৬ জুলাই, ১৮৫৬।

অনুসরণ: বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে দক্ষিণ ভারতের সমাজ সংস্কারক বীরশালিঙ্গম পানতুলু বিধবা বিবাহকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ‘বিধবা বিবাহ সমিতি’ গড়ে তোলেন। এই কাজের জন্য তাঁকে ‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর’ বলা হয়।

*জ্যোতিরাও ফুলে ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৮৭৩ সালে সত্যশোধক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজের মাধ্যমে তিনি বর্ণপ্রথা, মূর্তিপূজার বিরোধিতা করেন এবং পুরোহিতের প্রয়োজনীয়তার নিন্দা করেন।

বহুবিবাহ প্রথা রোধ করার প্রচেষ্টা:
বহুবিবাহরোধে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৮৫৫ খ্রিস্টার ২৭ ডিসেম্বর বহুবিবাহ রোধে ভারত সরকারের প্রেরিত আবেদনপত্রে বর্ধমান জেলার অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন মহতাবচন্দ্‌ এবং সারদাপ্রসাদ সিংহরায়।এই কাজটিও প্রায় একই সময় শুরু করেছিলেন, কিন্তু আইন পাশ হয়নি। বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন বহুবিবাহ বন্ধ না হলে নারী পীড়ন থাকবে। হয়তো সেই সঙ্গে নারীর জন্য বিদ্যালয় স্থাপন অনিবার্য ছিল।

প্রকাশক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর:
সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের চাকরি তখন ছেড়ে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিরোধটা বেধেছিল সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে।কী ভাবে পড়ানো হবে ছাত্রদের, তাই নিয়ে! রসময়বাবু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করতে লাগলেন আড়ালে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর খাবে কী!বিদ্যাসাগর শুনে বললেন, ‘রসময়বাবুকে বলো বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে।’

আলুপটল অবশ্য বেচেননি বিদ্যাসাগর। কিন্তু বই বেচেছিলেন। নিজের বইয়ের স্বত্ত্ব প্রকাশককে বেচা নয়। রীতিমতো প্রকাশনা-ব্যবসা খুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বাণিজ্যে বাঙালি তখনও বীতরাগ। আর মুদ্রণ বা প্রকাশনার ব্যবসায় তো সে ভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি তখন আসেইনি।

কিন্তু পথ কেটে চলাটাই যে বিদ্যাসাগরের স্বভাব। নিজেদের বই নিজেদের মতো করে ছাপবেন বলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার দু’জনে মিলে ছাপাখানা খুলেছিলেন ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নাম দিয়ে। কাঠের প্রেস, দাম ছ’শো টাকা। কিন্তু সে কালের বাজারে ছ’শোটাকাই বা বিদ্যাসাগর পাবেন কোথায়? শেষে ধার করলেন বন্ধু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কিছু দিন পরেই সে টাকা শোধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিদ্যাসাগর। গেলেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের মার্শাল সাহেবের কাছে। বললেন, ‘আমরা একটি ছাপাখানা করিয়াছি,যদি কিছু ছাপাইবার আবশ্যক হয়, বলিবেন।’

মার্শাল কাজ দিয়েছিলেন। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ছাপার কাজ।অন্নদামঙ্গল তখন ছাপা ছিল না এমন নয়। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পড়ুয়া সিভিলিয়ানদের যে বইটি পড়ানো হত তা ছিল ‘অত্যন্ত জঘন্য কাগজে ও জঘন্য অক্ষরে মুদ্রিত, বিশেষত অনেক বর্ণাশুদ্ধি আছে।’অতএব মার্শাল সাহেবের অনুরোধে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে আদি, অথেন্টিক অন্নদামঙ্গলের পুথি আনিয়ে ছাপলেন বিদ্যাসাগর আর মদনমোহন।ছ’টাকা প্রতি কপি দামে একশ বই কিনে নিল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ।ওই ছ’শো টাকায় শোধ হল নীলমাধবের ধার। বাকি কপি বিক্রির টাকা রইল প্রেসের উন্নতির জন্য। সাহিত্য, ন্যায়, দর্শনের নানা বই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য ছাপতে লাগলেন বিদ্যাসাগর। প্রেসেরও সম্বল বাড়তে লাগল।

সিলেবাসের বইই ছাপতেন বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত প্রেস থেকে। তাঁর বইয়ের দোকান সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি ছিল কলেজ স্ট্রিটে। ‘বইপাড়া’ হয়ে ওঠা তো দূর অস্ত, কলেজ স্ট্রিটে তখন বইয়ের দোকানই ছিল না। তখন বটতলার বইওয়ালাদের যুগ।প্রধানত চিৎপুর এলাকায় ছাপা হত বটতলার বই। বিক্রি হত বই ফিরিওয়ালাদের মাধ্যমে। অর্থাৎ বই পৌঁছে যেত ক্রেতার কাছে। সে ইতিহাস আজকের বই-ব্যবসায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে।কলেজ স্ট্রিটের গণ্ডি ছাড়িয়ে সরাসরি সম্ভাব্য ক্রেতার ঘরে হানা দিচ্ছেন প্রকাশকেরা। কিন্তু আজকের মতো সংগঠিত, গতিময় হোম ডেলিভারি বটতলার যুগে ছিল স্বপ্নেরও অতীত। সুতরাং, তখন দরকার ছিল, বইয়ের একটা স্থায়ী ঠিকানার। আর সে দরকারটা ধরা পড়েছিল বীরসিংহের সিংহশিশুর দূরদর্শিতায়। এতটাই সে দূরদর্শিতা এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধি যে তাঁর সময়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন পাঠ্যবইয়ের রীতিমতো তাক-লাগানো ব্যবসায়ী।

১৮৫৫ সাল নাগাদ বইয়ের ব্যবসা থেকে মাসে অন্তত হাজার তিনেক টাকা আয় হত বিদ্যাসাগরের।বছর দুয়েক পরে কলকতার ছেচল্লিশটি প্রেস থেকে ৫৭১৬৭০ কপি বাংলা বইয়ের মধ্যে সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা বই ছিল ৮৪২২০টি। এক বছরে বিদ্যাসাগরের বইয়ের ২৭টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন:
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উডের নির্দেশনামায় স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। স্ত্রী-শিক্ষায় সরকারের আগ্রহ দেখে বিদ্যাসাগর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মাত্র সাত মাসের মধ্যে নিজ ব্যয়ে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশুনো করতো। এর আগে বাংলার ছোটোলাট স্যার ফ্রেডারিক হ্যালিডে ঈশ্বরচন্দ্র দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শক নিযুক্ত করেছিলেন।বিদ্যাসাগর তখন থেকেই নারীশিক্ষা কেন প্রয়োজন উপলব্ধ হন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাঁর চার সাব-ইন্সপেক্টর হরিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধবচন্দ্র গোস্বামী, তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন (বিদ্যাসাগরের ভাই)কে বিদ্যালয় স্থাপনের উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। প্রথমে ২২ আগস্ট ১৮৫৫ থেকে ১৪ জানুয়ারি, পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৬ সময়পর্বে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর—এই চার জেলার প্রতিটিতে পাঁচটি করে মোট ২০টি আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যাসাগর।

দুই: নভেম্বর, ১৮৫৭ ই থেকে মে, ১৮৫৮—মাত্র সাত মাসের মধ্যে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন বিদ্যাসাগর।সর্বাধিক ২০টি ছিল হুগলি জেলায়। তারপর বর্ধমান, ঐ জেলায় ছিল ১১টি, মেদিনীপুরে ৩টি এবং নদীয়ায় একটি।বর্ধমান জেলায় বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির অবস্থান হল- রানাপাড়া, জামুই, শ্রীকৃষ্ণপুর, রাজারামপুর, জ্যোত-শ্রীরামপুর, দাঁইহাট, কাশীপুর, সানুই, রসুলপুর, বন্তীর এবং বেলগাছি।

কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর নতুন ডিরেক্টর গর্ডন ইয়ং নতুন স্কুলগুলিকে অর্থ বরাদ্দ করতে অস্বীকার করলে তিনি পরিদর্শক ও সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেন। তবে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে বিদ্যালয়গুলির জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা আদায় করেন।

না। বিদ্যাসাগর ধনীর দুলাল ছিলেন না, মন ছিল উচ্চাসনে আসীন। প্রাণে ছিল সমাজে নতুন পথ নির্মাণের ক্রম প্রচেষ্টা। আর তখন গড়গড়া টানা বাঙালি প্রচুর ছিল, তিনি প্রচুর অর্থ পেতেন, কিন্তু মধ্য বয়স তাঁকে আরো আরো ঠেলে দিলো সমাজের কাজে। এমনই উচ্চাসন দিলেন বা দিতে চাইলেন বাঙালিকে, এখনো যা এতটাই উচ্চে তাঁকে স্মরণ করতে হয়।

বিদ্যাসাগরের মত না হলেও একটু প্রচেষ্টা যদি করতো মধ্যবয়সী বাঙালি!#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!