মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: মধ্যযুগের কবিদের চোখে ২

।।দ্বিতীয় পর্ব।। 

শুধু মঙ্গলকাব্যের ধারাতেই নয়, অনুবাদ কাব্যের নানা শাখাতেও কবি-বন্দনার সুপ্রচুর উল্লেখ মেলে। এগুলিতে কবিত্বের উৎকৃষ্টতা বিষয়ে যে-সব মন্তব্য করা হয়েছে তা নেহাতই সম্মান দেখানোর একটা হিড়িক। কাহিনি-বৃত্তের সুসঙ্গতি, ঘটনা-বিন্যাসের পারম্পরা, চরিত্র-নির্মাণের কুশলতা কিংবা রসসৃষ্টির সক্ষমতা প্রসঙ্গে আজকের সাহিত্য-রসিকেরা যেভাবে আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে বিচারে প্রবৃত্ত হন, মধ্যুযুগে তা খুব সম্ভব ছিল না। প্রতিভার পরিস্ফুরণও অপেক্ষাকৃত কমই ছিল। লেখনী চালনায় একটু সক্ষম হলেই সমস্ত আদর ও সম্মান বোধহয় পাওয়া যেত। সেই বোধ থেকেই হয়তো নিছক সম্মান দেখানোর সৌজন্য প্রচলিত হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’-এর কবি মাধবাচার্যের কাব্য সপ্তদশ শতকেও যে বিশেষভাবে সমাদৃত হত তার সাক্ষ্য মিলেছে জাহ্নবাদেবীর শিষ্য নিত্যানন্দ দাসের ‘প্রেমবিলাস’-এ। উনবিংশ বিলাসে কবি মাধবের শাস্ত্রচর্চার প্রশংসা করে লিখেছেন— ‘নানাবিধ শাস্ত্র পড়ি হইলা পণ্ডিত। / আচার্য উপাধিতে তিঁহো হইল বিদিত’।। এই পণ্ডিতের কাব্য যে শুষ্ক পণ্ডিতিয়ানার দ্বারা কণ্টকিত নয়, বরং কবিত্বের শীতলতায় স্নিগ্ধ তার উল্লেখ মেলে বৈষ্ণব পদকর্তা দেবকীনন্দনের বাচনে। খুব সম্ভব ভাগবতের অনুবাদের মধ্যে মাধবাচার্যের রচনা এক সময়ে বেশ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল।

একই ধরনের পূর্বাচার্য-বন্দনা চোখে পড়বে বৈষ্ণব জীবনীকাব্যগুলিতেও। এই বন্দনা উৎকৃষ্ট কবিকৃতির কারণে নয়, বৈষ্ণবীয় বিনয়ের জন্য। বংশীবদন চট্টের প্রাথমিক প্রয়াসটুকু ছেড়ে দিলে বৃন্দাবন দাসই ছিলেন বংলা চৈতন্যজীবনী সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রূপকার। তাঁর রচনা গৌর ভক্তমণ্ডলীর চৈতন্য-ভাবনাকে তুলে ধরেছিল। বৃন্দাবন নরহরি সরকারের সাধন-পদ্ধতিকে তীব্রভাবে সমালোচনা করলেও, নরহরির শিষ্য লোচনদাস প্রথম বাঙালি চরিতকার হিসেবে বৃন্দাবনের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছেন। বৃন্দাবন দাস ভাগবত পুরাণ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সংস্কৃত চৈতন্যজীবনীকারদের পন্থানুসারী। সেজন্য তাঁর রচনায় শ্রীচৈতন্য দেখা দিয়েছিলেন দ্বাপরীয় কৃষ্ণের কলিযুগাত্তোর হিসেবে। সে তত্ত্বে রাধার কোনো স্থান নেই। কিন্তু কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভাবিত ছিলেন স্বরূপ দামোদরের কড়চার দ্বারা, যিনি ‘রসরাজ মহাভাব দুই একরূপ’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের মধ্যে রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ই সমীকৃত—এই গূঢ় বক্তব্য পরিবেশন করেছিলেন ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-কার । এমন ভিন্ন মতাদর্শের লেখক হয়েও কৃষ্ণদাস কেবল বৃন্দাবন দাসের চরণই বন্ধনা করেননি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন বৃন্দাবন দাসের গ্রন্থটির— ‘মনুষ্যে রচিত নারে ঐছে গ্রন্থ ধন্য।/ বৃন্দাবন দাস মুখে বক্তা শ্রীচৈতন্য’।। শুধু এখানেই শেষ নয়, এই কবি বৃন্দাবন দাসকে ‘চৈতন্যলীলার ব্যাস’ বলে প্রভূত সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এসব প্রশংসা যে ভক্তির রসে জারিত, তা বোধহয় না বললেও চলে। এতে প্রকৃত সাহিত্যরসের বিচার অবরুদ্ধ। কেননা সাহিত্যবিচারে গুরুত্ব দেওয়া হয় রসসম্ভোগের বিষয়টিকে। সাহিত্যের আনন্দমূল্য নির্ধারণই সমালোচনার কাজ। আর সমালোচনা হল এক ধরনের নির্মোহ বিশ্লেষণ, যার দ্বারা কোনো কিছুর অন্তর্নিহিত শ্রেষ্ঠতাকে আবিষ্কার করা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্যে এই অনপেক্ষ শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে পূর্বজদের প্রতি সুবিপুল শ্রদ্ধা। তবে সবক্ষেত্রে যে এমন ঘটেছে তা হয়তো নয়। যেমন, কৃষ্ণদাস কবিরাজ অনন্য প্রতিভধর কবি ছিলেন। তাঁর শিষ্য বলে পরিচিত সিদ্ধ মুকুন্দদেব ‘সিদ্ধান্ত চন্দ্রোদয়’-এ কবিরাজ গোস্বামীকে ‘ত্রিভুবনে অতুলনীয়’ বলে বর্ণনা করেছেন। এ শুধু তাঁর গুরুর প্রতি শিষ্যের মোহমুগ্ধ দৃষ্টিতে অন্ধবিচার নয়, স্মরণে রেখেছেন গোস্বামীজির বিপুল পঠন-পাঠন ও নিগূঢ়তত্ত্ব বিশ্লেষণের সক্ষমতার কথাও। তবে অতিভক্তির বাহুল্য যে একেবারেই নেই তা জোর দিয়ে বলা যাবে না, কারণ তিনিই ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলেছেন— ‘শিলা দ্রবীভূত হয় তাঁর গুণ শুনি’। আবার বৃন্দাবন দাস সম্পর্কে উদ্দবদাসের পদাবলিতে যে-প্রশংসা শুনতে পাওয়া যায় সে তাঁর পাণ্ডিত্য ও কবিত্বকে ঘিরে। উদ্ধব লিখছেন— ‘ধন্য ধন্য বৃন্দাবন দাস।/ চৈতন্যমঙ্গলে যার কবিত্ব প্রকাশ।/ যার রসময় পদাবলী। / শুনিলে পাষাণ যায় গলি’।। পাষণ্ডী ও নাস্তিকরা যে তাঁর গ্রন্থ পাঠ করে শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করে ও ভক্তিমার্গে ব্রতী হয় সে কথাও ঘোষণা করেছেন এই কবি। মাধবাচার্য লিখেছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল কাব্য’, যা ভাগবতের অংশবিশেষের অনুবাদ। সে গ্রন্থ পড়ে পদকর্তা দেবকীনন্দনের অনুভূতি— ‘মাধব আচার্য বন্দো কবিত্ব শীতল। / যাঁহার চরিতগীত শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’।।

এবার আসা যাক বৈষ্ণব পদাবলির ক্ষেত্রে। বৈষ্ণব পদকর্তা ‘মহাজন’ নামে সংবর্ধিত। এঁদের মধ্যে যাঁরা বিশিষ্ট ও শক্তিসম্পন্ন তাঁদের ক্ষেত্রে অনুকূল তথা স্তুতিগানের অতিরেকের হদিস মিলেছে যথেষ্ট। এর সূচনা কবি জয়দেব থেকে। তিনি যদিও বাংলা ভাষায় পদ লেখেননি, কিন্তু বঙ্গের বৈষ্ণবপদাবলির উৎসমুখ বলে বিবেচিত। তাঁর কাব্য গীতগোবিন্দ একই সঙ্গে ভক্তিরস ও প্রেমরসের সমাহার। গোটা ভারতে তাঁর গীতগোবিন্দের খ্যাতি ও প্রসার। নাভাজী দাস তাঁর ‘ভক্তমাল’-এ এই ভারত-বন্দিত কবি সম্পর্কে জয়দেবকে কবিদের মধ্যে রাজচক্রবর্তী স্বরূপ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর উক্তি, ‘জয়দেব কবি নৃপচক্কৈব খন্ডমণ্ডলেশ্বর আনি কবি। / প্রচুর ভয়ো তিহু লোক গীতগোবিন্দ উদাগর’।। আর এই কাব্যটি সম্পর্কে ষড়গোস্বামীর অন্যতম রঘুনাথ দাস গোস্বামী লিখেছেন, ‘শ্রীগীতগোবিন্দ গ্রন্থ সুধাময় বিরচিত মনোহর ছন্দ’। মধ্যযুগের আর এক কবি জয়দেব ও তাঁর কাব্য সম্পর্কে খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন— তিনি গোবিন্দদাস কবিরাজ। তাঁর মতে, জয়দেব কবীশ্বর, কবিকুলগুরু, সুরতরু, অপিত জনের দগ্ধ চিত্তকে করেন ভক্তিধারা মিশ্রণে শীতল। এই কবিপত্নী পদ্মাবতীর প্রসঙ্গও সংযুক্ত করেছেন তাঁর প্রশংসা-বাণীতে। ব্রজবুলির নিক্কল-ঝঙ্কৃত ছন্দে প্রকাশ পেয়েছে এই রসিক কাব্যসাধকের প্রগাঢ় স্বতঃস্ফূর্ত অনুভব—
শ্রীজয়দেব কবীশ্বর সুরতরু
যছু পদপল্লব ছাহে।
তাপতাপিত মঝু হৃদয় বিয়াকুল
জুড়াইতে করু অবগাহে।।
জয় জয় পদ্মাবতী রতিসেব।
রাধারমণ চরিত রসবর্ণমে
কবিকুলগুরু দ্বিজ দেব।।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!