যে সমাজে পণ্ডিত ব্যঙ্গার্থে এবং প্রগতিশীল গালি অর্থে ব্যবহৃত হয়!

আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, পরিবারে, সমাজে প্রশ্ন করা, মতামত প্রদান করা ছেলে কিংবা মেয়েটিকে বলা হয় বেশি বোঝে, পণ্ডিত! এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই জায়গাতে আমাদের অনেক শিক্ষকই ছাত্রদেরকে পণ্ডিত  বলে ব্যঙ্গ করেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু, যার একাডেমিক ফলাফল উল্লেখ করার মত নয়; কিন্তু বিশ্ব সাহিত্য, সিনেমা, সিনেমাটগ্রাফি ইত্যাদি বিষয়ে তার দারুণ আগ্রহ এবং বিষয়গুলি সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা আছে। একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থতে কাজ করত। সংস্থা’র কর্ণধারেরা পারিবারিকভাবে শিল্প, সাহিত্য, মঞ্চের সাথে যুক্ত। আমার বন্ধুকে সেই কর্ণধারেরা পণ্ডিত বলে ডাকতেন। আমরা কথিত গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখতে পাই আমাদের সরকার প্রধান কোনো বিদেশ সফর শেষে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানে বেশিরভাগ সাংবাদিকেরাই প্রশ্নের পরিবর্তে তোষামোদি কথাবার্তা বলে সময়টা পার করেন। এঁদের মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন প্রশ্ন প্রয়োজনীয় এবং যৌক্তিক প্রশ্ন করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্নকর্তার নাজেহাল অবস্থা আমরা দেখতে পাই। তার মানে আমাদের পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র কোথাও প্রশ্ন করাকে, মতামত ব্যক্ত করাকে, দ্বিমত পোষণ করাকে স্বাগত জানানো তো হয়-ই নাই বরং অপমানিত করা হয়। এর ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে, একটা প্রশ্নহীন জাতি হিসাবে আমরা গড়ে উঠেছি।

বাংলাদেশের ফুস্ফুস, উপকুলীয় জেলাগুলির সেইফগার্ড সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে যায়, আমরা প্রশ্ন করি না, কেন সুন্দরবনকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয়ভাবেই করতে হল? আমরা প্রশ্ন করি না কেন উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে কেন দেশটাকে উত্তপ্ত করে তুলছি? আমরা প্রশ্ন করি না, আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল, বাওর, বন যেগুলি সর্বজনের সম্পদ, সেগুলি কিভাবে ব্যক্তি মালিকানায় চলে যায়, কিভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে দখল হয়ে যায়? আমরা ব্যক্তি কিংবা দখলকারীকেও প্রশ্ন করতে পারি না আবার যাদের দায়িত্ব এগুলির দেখভাল করার, সেই আইনের রক্ষকদের, রাষ্ট্রের কথিত কর্ণধারদেরকেও প্রশ্ন করতে পারি না। আচ্ছা ধরে নিলাম, এগুলি জাতীয় ইস্যু, সামাজিক ইস্যু এগুলির প্রভাব সবার জীবনে যা হবে, আপনার আমার জীবনেও তাই হবে। কিংবা এগুলি নিয়ে আমার কথা না বললেও চলবে, প্রশ্ন না তুললেও চলবে, এইসব ইস্যুতে কথা বলার, প্রশ্ন তোলার অনেক মানুষ রয়েছে। কিন্তু তাই বলে যে ইস্যু দৈনন্দিন জীবনে আমার আর্থিক, স্বাস্থ্যগত এবং মানসিক ক্ষতির কারণ সেই ইস্যুতেও আমি কথা বলব না? প্রশ্ন তুলব না? তুলি না তো। যদি তুলতে পারতাম, সবাই মিলে যদি কথা বলতে পারতাম তাহলে কি বছরের পর বছর ওয়াসা আমাদের ময়লা এবং দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহের পরও ওয়াসার এমডি’র বেতন এবং সুযোগ সুবিধা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেত নাকি তিনি স্ব-পদে বহাল থাকতে পারেতেন? শুধু ওয়াসা কেন এ রকম শত ইস্যু রয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, যেগুলি নিয়ে কথা বলার, প্রশ্ন তোলার প্রত্যক্ষ দায় আমার, আপনার, আমাদের। বছর কয়েক আগে, একদিন ন্যাশনাল গ্রিডে বিপর্যের কারণে দেশব্যাপী ব্ল্যাক আউট হল। বাসা থেকে আমাকে ফোন করে জানালো যেন অবশ্যই মোমবাতি নিয়ে বাসায় ফিরি। তখন আমার অফিস লালমাটিয়াতে। লালমাটিয়া থেকে টাউন হল হয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রত্যেকটা দোকানে ৫ টাকার মোববাতির দাম বাড়িয়ে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে? আমি জিজ্ঞাসা করি কেন ভাই? এই কেন শুনলেই তাদের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়, মুখে হয়ত কিছু বলতে পারেন না কিন্তু ভাবখানা এমন পোষালে নেন, না হলে কেটে পড়েন। দ্যাখতাছেন না, আপ্নের সামনেই মাইনস্যে ক্যামনে টু-শব্দডি নাই কইরাই নিয়া যাইতাছে? এক দোকানে গিয়ে দেখি দোকানদার দাড়িওয়ালা মুরুব্বি, বললাম, চাচা কেন নিবেন ৫ টাকার মোমবাতি ২০ টাকা? চাহিদা আছে দিগুণ দাম নিলেও না হয় কথা বলতাম না, তাই বলে ৪ গুণ দাম বাড়িয়ে দিলেন? এত কথা বলার পরও মুরুব্বির মুখে কোনো কথা নাই। তখন বললাম, ৫ টাকার মোমবাতি ২০ টাকায় বিক্রি কইরাই তো এই টাকা নিয়ে হজ্জ্বে যাইবেন। আর লতিফ সিদ্দিকী কইলেই হ্যার মন্ত্রীত্ব চইল্যা যায়। দোকানদার তো নাখোশ শুরু থেকে, চারপাশে ৫ টাকার মোমবাতি ২০ টাকা দিয়ে কেনার জন্য ব্যস্ত খরিদ্দারেরাও আমার দিকে রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি এতক্ষণ যে বিষয়গুলির অবতারণা করলাম, সেই বিষয়গুলিতে প্রশ্ন তোলার জন্য কি খুব বেশি পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন আছে? এগুলি সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ, দেশের ভবিষ্যৎ, আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ জড়িত। সেগুলি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলেও আমাদেরকে শুনতে হয়, এগুলি নিয়ে কথা বলে লাভ আছে? পণ্ডিত তো, বেশি বোঝে, এইটা বোঝে না, এখন সময় ভাল না। তাহলে এ দেশে সত্যিকার অর্থে পান্ডিত্যপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে সেটা সহজেয় অনুমেয়। এখন কথা হল, এই যে প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করা, মতামত প্রদানকে বাধাগ্রস্থ করা এগুলি কি পরিকল্পিত না কি আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এগুলির প্রচলিত ধারা থেকে আমরা অবচেতনে রপ্ত করে ফেলেছি। প্রশ্নহীন সমাজের গতি কি, প্রশ্নহীন শাসনব্যবস্থার, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি এগুলি নিয়ে কথা বলতে গেলে আপনাকে অভিধা আর শুধু বেশি বোঝে, পণ্ডিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আপনাকে নিশ্চিতভাবে অভিহিত করা হবে মহাপণ্ডিত হিসাবে। এখন এই যে প্রশ্নহীন সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রশ্নহীন জাতি হিসাবে আমরা আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছি যে আমাদেরই পূর্বসূরীদের মধ্যে যারা প্রশ্ন করে গেছেন, কথায়, গানে কবিতায়, তাঁদের কথা কোট করলেও আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না। তাই লালনের গান নিজের ফেসবুক স্টোরিতে শেয়ার করে সঞ্জয় রক্ষিতকে গ্রেফতার হতে হয়, বিচারিক আদালতে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেতে হয়।

আরও পড়ুন: আমরা কি একটু ভিন্নভাবে ভাবতে পারি না?  

আর এই ঘটনায় আমাদের সমাজের, দেশের মানুষদের মধ্য থেকে কিংবা বলা যায় গড় জনতার বাইরে যে গুটকয়েক মানুষ এর প্রতিবাদ জানায় এবং সঞ্জয় রক্ষিতের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে, তাদেরকে ‘পগতিশিল’ (প্রগতিশীলের ব্যঙ্গ রুপ) বলে গালিগালাজ করা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা হয়। এটা এবারই নতুন তা নয়। এই ধরনের ঘটনা, মানে কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং সেই নিয়ে সরকারের ভূমিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে যতবারই হৈচৈ হয়, পক্ষে বিপক্ষে মতামত আসতে থাকে ততবারই দেখেছি ভিক্টিমের পক্ষে কথা বলা মানুষদেরই শুনতে হয় এই গালি অথবা নাস্তিক, কিংবা ভিক্টিমের ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে সেই ব্যক্তি বা মানষদেরকে মিলিয়ে ফেলা হয়। আবার কথিত প্রগতিশীলদের মধ্যেও নানা দল-উপদল। তারাও একাংশ বর্তমান সমাজের স্রোত যেদিকে সেদিকে তাল মিলাতে গিয়ে, অন্য দলকে গালিগালাজ করছেন।

অথচ এই দেশেরই সন্তান শিখাগোষ্ঠীর অন্যতম পুরোধা মোতাহের হোসেন চৌধুরী আজ থেকে বহু বছর আগে বলে গেছেন ‘সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতায় কোন পার্থক্য নেই। যা সভ্যতা তা-ই প্রগতি, অথবা যা প্রগতি তা-ই সভ্যতা। কিন্তু কালচার্ড লোকেরা তা স্বীকার করে না। উভয়ের সুক্ষ পার্থক্য সম্বন্ধে তারা সচেতন। প্রগতি তাদের কাছে মোটের উপর জ্ঞানের ব্যাপার। কেননা জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়। তাই জ্ঞান, বিশেষ করে বিজ্ঞানপ্রসূত কল্যাণকেই তারা প্রগতি মনে করে। প্রকৃতিবিজয়লব্ধ সমৃদ্ধির স্বার্থক বিতরণই তাদের কাছে প্রগতি। কিন্তু সভ্যতা শুধুমাত্র প্রগতি নয়, আরো কিছু। প্রগতির সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না। আর সৌন্দর্য ও প্রেমের ব্যাপারটা-কেননা শিল্প, সৌন্দর্য ও প্রেমেরই অভিব্যক্তি-চিরন্তন ব্যাপার, প্রগতির ব্যাপার নয়।’

আমাদের পূরসুরীরা যেখানে প্রগতিশীলতাকে পেরিয়ে যেতে চেয়েছেন। যেখানে প্রগতিশীলদের চেয়ে কালচার্ড মানুষকে এগিয়ে রেখেছেন, সেখানে আজ আমরা প্রগতিশীলতা এবং প্রগতিশীলদেরকে গালিগালাজে মত্ত। এখন কথা হচ্ছে, যারা নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবী করছেন, তারা আদৌ প্রগতিশীল কিনা। কিন্ত আমাদের সামনে কিছু রোল মডেল তো আছেন, আমরা তাদেরকেও মুড়ি-মিছরির একদর করে ফেলি। ফলে ক্ষতিটাও হচ্ছে আমাদেরই, সমাজেরই, রাষ্ট্রেরই। লাভবান হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষ।

আরও পড়ুন: স্তনকর

আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষা নিয়ে নতুন চিন্তার প্রবর্তক দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরি এর মতে ‘মানুষের মর্যাদা হল দর্শনের ভিত্তি। মানুষের মাঝে অনিঃশেষ সম্ভাবনা রয়েছে, তার প্রতি বিশ্বাস থাকতে হবে, যে বিশ্বাস একজন মানুষের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দেবে, ফলে একে অন্যকে শ্রদ্ধা করবে। কেউ ফাঁকা কলস নন, তা তিনি যেই হোন না কেন। দরিদ্র নিরক্ষর জনমানুষের অফুরন্ত সম্ভাবনাগুলোকে আহরণ করে তা তাদেরই কল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব। নিরক্ষর হতদরিদ্র মানুষের ক্ষমতাহীনতার যে সনাতনী ধারণা রয়েছে, তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করে নতুন চেতনায় উজ্জীবিত করা সম্ভব।’ ফ্রেইরি উপলব্ধি প্রচলিত শিক্ষা মানুষের জীবনাচরণকে স্থিতাবস্থায় রেখে দেয়। পাওলো ফ্রেইরির উপলব্ধি আজকে আমাদের জীবনে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে দারুণভাবে সত্য। তাই তো শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ চাকুরে হয়, সরকারের হুকুম তামিল করে, নিজের বিবেক-বিবেচনাকে কাজে লাগাতে পারে না। বলা যায়, সেই বোধই তো গড়ে ওঠে না। ফলে আমরা তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়ে যাই। বরং যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসই প্রবল হয়; ফলে আমার নিজের বিশ্বাসের বিপরীতে কোনো কথা গেলে সেই কথাকে আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই তো পন্ডিত, পাণ্ডিত্য আমাদের সমাজে ব্যঙ্গার্থে এবং প্রগতিশীল এবং প্রগতিশীলতা গালি অর্থে ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এই মানুষেরাই একদিন গড়ে তুলবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, যেখানে পণ্ডিতেরাই হবে সমাদৃত, সাথে সাথে সকল মানুষ পাবেন তার যোগ্য মর্যাদা। এই মানুষেরাই, আমাদেরই উত্তরসূরিরা শুধু প্রগতির মধ্যে অবদ্ধ না থেকে পোঁছে যাবে সভ্যতার স্তরে, যেখানে মানুষ প্রগতিশীল থেকে প্রকৃত কালচার্ড মানুষ হবেন।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!