১৫ই আগস্টের ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের আকাশে যখন নেমে এলো নিস্তব্ধতা আর গুলির শব্দ, তখন হয়তো অনেকে মনে মনে ফিরে গিয়েছিলেন চার বছর আগের আরেক বিকেলে— ৭ই মার্চ ১৯৭১। সেদিন সেই একই মানুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লাখো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন, তা পুরো জাতিকে ঠেলে দিয়েছিল মুক্তির যুদ্ধে। ইতিহাসে এমন বৈপরীত্য বিরল— একদিকে জাগরণের বজ্রনিনাদ, অন্যদিকে প্রভাতের অন্ধকারে নেমে আসা শোকের চাদর।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বিকেলে, ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ছিল না কেবল রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা—বরং ছিল এক কবিতার মতো ছন্দময় আহ্বান, এক ইতিহাসের স্ফুলিঙ্গ।
ঢাকার আকাশে সেদিন ছিল মৃদু রোদ, কিন্তু বাতাসের ভেতর চাপা এক অস্থিরতা। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান—আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান— লাখো মানুষের ভিড়ে ঠাসা। কেউ গাছে উঠে বসেছে, কেউ খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, কারও হাতে বাঁশের খুঁটি, কারও হাতে সাদা-লাল পতাকা। কারো চোখে অশ্রু, কারো হাতে মুঠো করা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সবাই অপেক্ষায়—বঙ্গবন্ধু কী বলবেন?
ঠিক বিকেল ৩টা বেজে কিছু পর, মঞ্চে উঠলেন তিনি— শেখ মুজিবুর রহমান। ধীর পায়ে হাঁটছিলেন, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে যেন বয়ে আনছিলেন এক জাতির ইতিহাস। কোনো প্রস্তুত লেখা কাগজে ছিল না, ছিল কেবল সাত কোটি মানুষের আশা-ভরসা আর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের স্মৃতি।
তিনি মঞ্চে লেখা কোনো কাগজ থেকে পড়েননি, বরং মুহূর্তের আবেগ, দীর্ঘদিনের সংগ্রামের স্মৃতি ও সামনে দাঁড়ানো লাখো মানুষের চোখের ভাষা থেকে নিজের বক্তব্য বুনেছিলেন।
“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”— এই অমর উচ্চারণ শুধু শ্লোগান ছিল না, ছিল মুক্তিকামী বাংলার আত্মার ডাক। সেই দিনই তিনি জনগণকে সশস্ত্র লড়াইয়ের সরাসরি ঘোষণা না দিলেও, একে একে যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন—যেমন হরতাল, করফিউ ভাঙা, অফিস-আদালত বর্জন, প্রশাসনের অচলাবস্থা তৈরি করা—তা আসলে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির রূপরেখা। তার প্রথম শব্দে নেমে এলো নিস্তব্ধতা, আর কিছু সময়ের মধ্যে তা রূপ নিল উত্তাল জনসমুদ্রে। এই একটি লাইন যেন বাতাস ছিঁড়ে প্রবেশ করল মানুষের বুকের গভীরে। সরাসরি যুদ্ধের ডাক তিনি সেদিন দেননি, কিন্তু দিলেন এমন নির্দেশ, যা অচল করে দিল পাকিস্তানি শাসনযন্ত্র—হরতাল, করফিউ ভাঙা, বর্জন। মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চ সেই দিনই প্রস্তুত হয়ে গেল।
৭ই মার্চের সেই ভাষণটি কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তখনই সরাসরি সম্প্রচার করেনি, কিন্তু এপি (Associated Press) এবং রয়টার্সের সাংবাদিকরা তাৎক্ষণিকভাবে ভাষণের সারমর্ম টেলিগ্রামে প্রেরণ করেন, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলার স্বাধীনতার দাবিকে পৌঁছে দেয়। তাছাড়া, এই ভাষণের কিছু অংশ তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে রেডিও ও টেলিভিশনের প্রচার থেকে বাদ দেয়, যাতে “স্বাধীনতার সংগ্রাম” শব্দবন্ধটি জনমানসে ছড়িয়ে না পড়ে। এই ভাষণ ছিল আমাদের জাগরণের অগ্নিশিখা, আর ১৫ই আগস্ট সেই শিখায় হঠাৎ নেমে আসা অন্ধকার। তবু ইতিহাস সাক্ষী—বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত সেই কবিতাময় আহ্বান আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে ধ্বনিত হয়, যেন চিরকাল বলে যায়—
“যতদিন বাঙালি বেঁচে থাকবে, ততদিন মুক্তির সংগ্রামের শপথ ভোলা যাবে না।”
চার দশক পর, ২০১৭ সালে, ইউনেস্কো এই ভাষণকে “বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়— এটি এখন কেবল রাজনৈতিক দলিল নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক অনন্য শিল্পকর্ম, যেখানে বক্তৃতা রূপ নিয়েছে কবিতায়, কবিতা রূপ নিয়েছে বিপ্লবের ঘোষণায়, যা বাস্তবে যুদ্ধের মঞ্চ তৈরি করে দেয়।
কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার বছর পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোরে সেই জনকের প্রাণ হরণ করা হয়। একে অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা করেন—বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক বৈপরীত্য হিসেবে। যে মানুষ একদিন মুক্তির কবিতা শোনালেন, তাকেই তাঁরই প্রিয় বাংলাদেশে হত্যা করা হলো।
কিন্তু ইতিহাসের নির্মম মোচড়— স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার বছর পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোরে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। ভোরের নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে গেল রেসকোর্সের সেই বিকেলের বজ্রনিনাদ।
আজও, ১৫ই আগস্টের শোক আর ৭ই মার্চের জাগরণ— দুটি তারিখ একে অপরের বিপরীত মেরুর মতো থেকেও একই সুতায় বাঁধা। একটিতে জাতির আত্মপ্রকাশ, অন্যটিতে জাতির হৃদয়ে চিরস্থায়ী ক্ষত। তবু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের সেই আহ্বান এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়, যেন প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়— “যতদিন বাঙালি বেঁচে থাকবে, ততদিন মুক্তির সংগ্রামের শপথ ভোলা যাবে না।”

 
                         
                         
                         
                         
                         
                         
															


