প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে চলে যেতে হবে দার্জিলিং থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে লামাহাট্টায়। ৫৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামে তামাং, ভূটিয়া, শেরপা ইত্যাদি পার্বত্য উপজাতির বাস। তিব্বতী লামাদের ভারত সরকার এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করায়, সেই থেকে জায়গার নাম লামাহাট্টা। প্রকৃতির অসাধারণ রূপ বৈচিত্র্য পরতে পরতে উপলব্ধি করা যায়। পাইনের জঙ্গল, পাহাড়, আকাশ, নীরবতা, গ্রামবাসীদের সহজ সারল্য এখানে মিলেমিশে একাকার।
লামা কথার অর্থ হল বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং হাট্টা কথার অর্থ হল বাসস্থান অর্থাৎ এই লামাহাটা শব্দটির অর্থ হলো যেখানে বৌদ্ধরা বাস করেন, ভারতীয় সরকার তিব্বতীয় লামাদের বসবাস করার জন্য এই জাইগাটি নির্বাচন করেছিলেন সেই জন্যই এখানকার নাম লামাহাট্টা।
শহুরে কোলাহল থেকে দূরে লামাহাটা প্রকৃতিকে মন ভরে উপভোগ করা একটি আদর্শ স্থান হিসেবে আপনারা বেছে নিতে পারেন শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি সামনের দিকে যত এগিয়ে চলে মনটাও ধীরে ধীরে পালটে যায়। শিলিগুড়ি থেকে লামহাট্টা এই পুরো জার্নিটাতে সময় লাগে মোটামুটি তিন ঘণ্টার মতো। আর চলতি পথে মাঝে মাঝেই চায়ের জন্য তো বিরতি নিতেই হয়। সাথে একটু আধটু চায়ের সাথে টা চললে তো আর কথাই নেই। তাই চায়ের দোকান দেখলেই থেমে যেতে ইচ্ছে করে প্রকৃতিকে দুচোখ দিয়ে দেখার অভিলাষে। সমতল ছেড়ে অনেকটা ওপরে এসে অন্যরকম একটা ভাললাগা কাজ করে বৈকি। হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি, চা শেষ করেই রওনা দিতেই হয়। পথের সৌন্দর্য লেখায় ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আসলে চোখে দেখা, সাথে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা, তাকে অক্ষরের মালায় ফুটিয়ে তোলা তো কম নয়। যাহোক তিস্তাবাজার পর্যন্ত আসতে সময় লাগল পৌনে দুঘন্টার মতো। জায়গাটি সুন্দর এবং জমজমাট। তিস্তা বাজারের অনতিদূরেই লাভার্স ভিউ মিট পয়েন্ট। পেশক রোড-এর ওপর চমৎকার একটি জায়গা। গাছে গাছে ঘেরা রাস্তার সামনেই এক একটা ধাপের সিঁড়ি, পাশেই দু-একটা দোকানপাট।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনে অবাক করা দৃশ্য। উচ্চতাটা আঁচ করা যায় এখানেই, সামনের গভীর খাদ, দূরে তিন চার টুকরো পাহাড় আর ঘোরাফেরা করছে মেঘেরা। একদম নিচে বয়ে যাচ্ছে দুটি নদী। তিস্তা আর রঙ্গিত। বাঁ দিক দিয়ে বয়ে আসা রঙ্গিতের চেয়ে নজর কেড়ে নেয় সোজা সামনের দিকে বহমান সবুজ রঙা তিস্তা। এদের মিলনস্থলে জন্মেছে ছোট একটা দ্বীপের মত বালিময় ডাঙা। গাছ গাছালি আর ছায়ার ঘোমটা টানা জায়গাটিতে সময় কেটে যায় এক নিমেষেই।
সুন্দর এই মুহূর্তটিকে ছেড়ে যেতে মন না চাইলেও এগোতে তো হবেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছনো গেল লামাহাট্টায়। গাড়ি থেকে নেমে লামাহাট্টা লজের মুখেই অনুভূত হল তাপমাত্রা বেশ কম। সাজানো রাস্তার দু’পাশে ফুলের গাছগুলো সূর্যের আলোয় যেন ঝলমল করছে। বাঁদিকে অবস্থিত এই জায়গার মূল আকর্ষণ একটা বিশাল পার্ক। সময় নষ্ট না করে তাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম লামাহাট্টা ইকোপার্ক।
আরও পড়ুন: কোঠিগাঁওয়ের পথে
ডানদিকে ছোটো ছোটো দোকান, হোম স্টে আর গভীর খাদ। পাইন এবং আরো সুন্দর সুন্দর গাছে সাজানো গোছানো লামাহাট্টা পার্কটি দেখেই মনটা ছুটে চলে যেতে চাইল। ২০১২ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগের সাথে উপজাতিরা হাত মিলিয়ে যত্ন করে গড়ে তুলেছে এই পার্ক। পার্কের ভেতরে আছে সুন্দর বসার জায়গা যা ফটো প্রেমিকদের আকর্ষণ করবেই। এছাড়াও আছে ওয়াচটাওয়ার। যতদূর চোখ যায় শুধুই চিরহরিৎ এর ঘন বন। সুবিশাল পাইন গাছগুলো আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তাদের পাশেই দুলছে নানান রঙের কাপড়ের পতাকা। স্থানীয়দের বিশ্বাস এই পতাকার মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত বাতাসে চারপাশের পরিবেশ ও মানুষের মন পবিত্র হয়। জঙ্গল কেটে কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে বাগানের একেবারে ওপরে যাওয়ার জন্যে। একদম চূড়ায় পৌঁছলে দেখা যাবে সুন্দর একটা লেক। গ্রামবাসীদের কাছে এই লেক খুব প্রিয়।
এখানকার মানুষের জীবন সহজ সরল, অনাড়ম্বর, নির্জন এবং নিস্তব্ধ যা দেখলেই মন প্রাণ ভরে যায়। কত অল্পতেই তারা সন্তুষ্ট। একতাই এদের জীবনের ধর্ম। এখানে আসলে মনে হয় প্রকৃতিই একমাত্র সঙ্গী। মনে হয় নিবিড় আলিঙ্গনে তার সঙ্গেই শুধু বাস। এখানকার একটি বিরলতম আকর্ষণ অর্কিড। পরিবেশই এই দুষ্প্রাপ্য অর্কিড সৃষ্টির রহস্য, সঙ্গে অফুরন্ত জল। পাইনের মতো বড় বড় গাছের সাথে ফুল এবং অর্কিডের বাগান আর রংবেরঙের পতাকা দিয়ে যেন সাজানো আর একটা পাহাড়। সবুজ প্রাকৃতিক রঙের সাথে নীল, সাদা, লাল, হলুদ পতাকা আর এক মায়াবী নিস্তব্ধতা রোমাঞ্চিত করে। লোকজন বিশেষ নেই। যারা আছে সবাই সামনেই ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমরা আগেই জেনেছিলাম, আসল জায়গাটিতে যেতে গেলে বেশ কিছুটা ওপরে উঠতে হবে। ওপরে আছে দুটি লেক। মনে হয় ওই লেক দুটিই হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওপরের দিকে লোকজন বিশেষ নেই। পাহাড়ি রাস্তা কেটে পথ করা হয়েছে। তা বেশ খানিকটা উঁচু। খুব সাবধানে পা ফেলে উঠতে হবে। মাঝে মাঝে বসার জন্য বেঞ্চ আছে। সেখানেও সময় কাটানো যায়। পাহাড়ি জায়গায় ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে। তাই যতটা পারা যায় পা চালিয়ে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেকটা চড়াই বলেই সময়সাপেক্ষ। লামাহাট্টা পার্কে যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় তত ভালো, সন্ধ্যের আগেই নিচে নেমে আসা উচিত।
কৃত্রিমভাবে তৈরি রাস্তার পাশাপাশি পথচলতি মানুষ আরেকটা শর্টকাট বানিয়ে নিয়েছেন নিজেদের সুবিধার্থে। তবে সেটার ঝুঁকি একটু বেশি। ওপরে এসে মনে হয় এ এক অন্য জগৎ! থমথমে রহস্যে ঘেরা অরণ্যের মাঝে এক টুকরো ফাঁকা জায়গা। সামনের বনানীর বিস্তার কতদূর তা জানতে ইচ্ছে হলেও রহস্যভেদের উপায় নেই। ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ, পেঁচার মত একটা ডাক, আর নির্জনতা যেমন গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে, তেমনই অজানার আকর্ষণ হাতছানি দেয় ক্রমাগত।
কিভাবে যেতে হবে—
লামাহাট্টা যেতে গেলে আপনাকে শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গের ট্রেন ধরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছতে হবে। কিম্বা ফ্লাইটে বাগডোগরা বিমানবন্দরে। তারপর ভাড়া করতে হবে লামাহাট্টা যাওয়ার গাড়ি। যে হোম স্টে বা লজে থাকবেন, আগে বলে রাখলে তারাও গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। লামাহাট্টা পৌঁছতে সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেক।
কোথায় থাকবেন:
লামাহাট্টায় রয়েছে বেশ কিছু হোম স্টে। সেগুলির কোনো একটিতে পরিবার-বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে স্বচ্ছন্দে কয়েক দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। এছাড়াও থাকতে পারেন লামাহাট্টা লজে।#