পারিবারিক সূত্রে গত ১০ বছরে প্রতিবছর গড়ে একবার করে লালমনিরহাট আসি। থাকাও হয় কয়েকদিন। লালমনিরহাট শহরটাকে রেলওয়ে শহর বলা যায়। শহরের ৫০ শতাংশের বেশি জায়গাতে ব্রিটিশ আমলের রেলে’র স্থাপনা নানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবারই এসে শহরের মধ্যে ঘুরপাক খাই। একাধিকবার পরিকল্পনা করেছি সকালে ট্রেনে চেপে বুড়িমারি যাব। বুড়িমারি হল বাংলাদেশের অন্যতম স্থল বন্দর। এই বন্দরের আরেকটি বিশেষ দিক হল এই বন্দর ভারত, ভূটান এবং নেপালের সাথে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে আবার ট্রেনে করেই ফিরে আসব। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। গত ৬ এপ্রিল সেই পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পেল। সেই সাথে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা তিনবিঘা করিডোর হল বাড়তি ভ্রমণ কিন্তু অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। এই লেখা একটা নিছক ভ্রমণ কাহিনী হতে পারত। কিন্তু লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপার পর থেকে বুড়িমারি পৌঁছান পর্যন্ত লোকাল ট্রেনের কামরার অভিজ্ঞতা এবং ট্রেনের জানালা দিয়ে দু’পাশে যা দেখলাম তাতে ভ্রমণ বৃত্তান্তের চেয়ে অন্য আলাপই বেশি জরুরী মনে হল।
লালমনিরহাট থেকে ট্রেনের সময় সকাল আটটা পনের মিনিটে। আমরা সময়ের বেশ আগে থেকে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কাউন্টারের লোকের দেখা নাই। কিন্তু কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমান যাত্রীদের সেটা নিয়ে কোনো উচ্চ-বাচ্চও নাই। এইটা আমি ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের সময় আগেও খেয়াল করেছি, এই অঞ্চলের লোকের সময় নিয়ে তেমন তাড়াহুড়া নাই। সেই আলাপে এখানে যেতে চাই না। যাই হোক আমার পেছনে অপেক্ষমান একজন যাত্রী শুধু একবার বললেন, ট্রেনের সময় পার হয়ে যাচ্ছে কাউন্টারের লোকের দেখা নাই, ব্যাপার কি? অন্য একজন যাত্রী তার উত্তর দিলেন, ওরা জানে আজ ট্রেন লেইট। আমি একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম, সেই তথ্যটাও তো আমাদেরকে জানাতে হবে। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে লাইনে অপেক্ষমান যাত্রীরাই নিজের সিট নিশ্চিত করতে ট্রেনের জানালা দিয়ে ব্যাগ, বস্তা ছুঁড়ে দিয়ে, পরিবার কিংবা বন্ধুদের মধ্যে একজন আগে উঠে একসিটে বসে আরো দুইটা-তিনটা’র দখল নিয়ে বসে আছেন। আমি উঠবার পর মনে হল, কামরাতে সিট সংখ্যার চেয়ে মানুষ কম। কিন্ত বেশ কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খালি সিটে বসতে গেলেই সিটে বসা লোকের বক্তব্য এখানে লোক আছে। সম্ভবত মাদ্রাসা পড়ুয়া দুইজন কিশোরের সাথে তাদেরই আহবানে দুইজনের সিটে তিনজন বসলাম। ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই শুরু হল আশেপাশে নানা আলাপ।
‘আমি একাই রেখেছি চার জনের সিট। মনে হল বিষয়টা অত্যন্ত গর্বের।’
‘হাফেজ মানে জানেন? যিনি কোরান শরীফকে হেফজ করেছেন।’
ট্রেন কিছুদূর এগোতেই আমাদের কামরায় একজন মাঝবয়সী নারী এসেই এক যাত্রীকে ধমকের সুরে বললেন, সিট থেকে ব্যাগ সরাও। তার মানে ট্রেন ছাড়ার পরও মানুষ সিট দখলে রেখেছে। ধমক খাওয়া যাত্রীর সহযাত্রীরা ধমক দেওয়া নারীকে জ্ঞান দিতে শুরু করলেন, আপনি এভাবে বলতে পারেন না। আপনি বসবেন, ভালভাবে বললেই হত। জ্ঞানের আলাপ ভাল মত জমে উঠবার আগেই সেই নারী দিলেন আরো জোরসে ঝাড়ি, রোজা-রমজানের দিন গরু খাওয়া মুসলমানের কোনো হুশ আছে? বলেই ট্রেনের কামরায় পিচকিরির মত করে ফেললেন পানের পিক। কোনো এক অজানা কারণেই তার আশেপাশের সব যাত্রী নীরব। আমি ভাবলাম, এই কথাটাই যদি শাখা-সিঁদুর পরিহিত কোনো হিন্দু নারী পান খেতে খেতে বলতেন দৃশ্যটা হয়ত এ রকম থাকত কি না? বছর পেরোয়নি, এই জেলাতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একজন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ট্রেন চলা শুরু হবার পর থেকে কামরার ভেতরের যাত্রীদের যেমন দেখছি, তাদের আলাপ শুনছি, ঠিক তেমনি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য, প্রকৃতি, বাড়িঘরও দেখছি। বাইরের দৃশ্যও মন ভাল করতে পারল না সেভাবে। না করতে পারার কারণ একাধিক। প্রায় একশত কিলোমিটারের এই যাত্রায় দিগন্ত বিস্তৃত একটি মাঠও চোখে পড়ল না; একবারও, চোখে পড়ল না শতবর্ষী কিংবা বিশালাকৃতির কোনো গাছ। গাছ বলতে চোখে পড়ল আকাশমনি। শুধুমাত্র বাড়িঘরের আশে-পাশে কিছু আম এবং সুপারি গাছ। তবে প্রায় পুরোটা রাস্তা জুড়েই দু’ধারে দেখলাম ছোটবড় অসংখ্য বাঁশের ঝাড়। পুকুর কিংবা জলাশয় চোখেই পড়ল না সেইভাবে। ফসল হিসাবে চোখে পড়ল ধান, ভূট্রা আর তামাক। দীর্ঘযাত্রার একটা বড় অংশ জুড়েই তামাকের ক্ষেত। রেল লাইনের ধারের তামাকের পাতা শুকানোর দৃশ্য কোথাও কোথাও শৈল্পিক রূপ ধারণ করেছে। ঝুলন্ত পাতার নানা বর্ণ যেমন তাকিয়ে দেখার মত, তেমনি বসতবাড়ির সাথে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ স্বাস্থ্যের ঝুকিপূর্ণও বটে। আরেকটি জিনিস চোখে পড়ল, সেটা হল, এই রমজান মাসেও নারীরা কৃষিক্ষেতে কাজ করছে স্বাভাবিক পোশাকেই। লালমনিরহাট থেকে থেকে বুড়িমারি পর্যন্ত সবচেয়ে যে জিনিসটি দারুণভাবে আমার চোখে পড়ল সেটা হল, রেললাইনের দু’ধারে তো বটেই দূরেও যতদূর চোখ যায় বসতবাড়িগুলির ৯০ শতাংশের উপর বাড়ি হল টিনের। শুধু চাল নয়; টিনের বেড়া, টিনের চাল। বড় কোন গাছহীন এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষেরা প্রচণ্ড গরমের দিনে কিভাবে বসবাস করে! যখন ভাবছি, ঠিক তখনই রেললাইনের অনতিদূরে চোখে পড়ল কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি মসজিদ। মনে মনে ভাবলাম, বান্দাকে এই আজাবের মধ্যে রেখে খোদা কিভাবে ওই ভাল ঘরে থাকবেন? আসলে খোদার কি কোনো ঘর আছে? তবুও খোদার নামেই ঘর নির্মিত হয় বান্দাকে বঞ্চিত করে। বান্দার হক নষ্ট করে জমানো টাকায় গড়ে উঠে খোদার ঘর। এ রকম নানাবিধ ভাবনার মাঝেই পৌঁছে গেলাম বুড়িমারি রেলস্টেশনে। স্টেশন থেকে বুড়িমারি স্থল বন্দর ২ কিলোমিটারের মত হবে। ঝাঁ চকচকে না হলেও বন্দরের মোটামুটি পরিচ্ছন্ন একটা চিত্র কল্পনায় নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু রেলস্টেশন থেকে বন্দর পর্যন্ত পুরোটাই আমাকে হতাশ করেছে। এত ধুলাবালি এবং অগোছালো একটা জায়গা। তাই ওখানে খুব বেশি সময় ব্যয় না করেই যাত্রা শুরু করলাম, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা তিনবিঘা করিডোরের উদ্দেশ্যে। যদিও এইটা আমার পরিকল্পনায় ছিল না, কিন্তু স্টেশন থেকে আমাদের বহনকারী ইজিবাইকের চালকের প্ররোচনায় এবং আমারই মত স্বপরিবারে স্থল বন্দর দেখতে আসা একটা পরিবারের সাথে রওনা হলাম খুব বেশি-ভাবনা চিন্তা না করেই। বুড়িমারি থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা, তিনবিঘা করিডোরের রাস্তার দূরত্ব দশ/বার কিলোমিটার। এতদিন শুধু তিনবিঘা করিডোরের কথা শুনেছি, পত্রিকাতে পড়েছি। এই প্রথম নিজ চোখে দেখলাম। অদ্ভুত এবং করুণ এক দৃশ্য। নিজ বাসভূমে পরবাসী যাকে বলে আর কি। আমি দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা পর্যন্ত যাইনি। করিডোর পর্যন্ত গিয়েছি। করিডোরে প্রবেশের আগে এপাশ থেকে বিজিবি সতর্ক করে দিচ্ছে সোজা রাস্তা ধরে যাবেন, বাঁয়ে ও ডানেও না। বুঝলাম বায়ে এবং ডানে ভারত। করিডোর ধরে সোজা সামনে গেলে আবার বাংলাদেশ। করিডোর পেরিয়ে বাংলাদেশের অংশে ঢুকে দেখলাম। ওপাশ থেকে, অর্থাৎ দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা থেকে পাটগ্রামের দিকে আগত লোকজনকেও বিজিবি চেক করছে। স্থানীয় এক যুবককে জিজ্ঞেস করলাম, এরা তো বাংলাদেশের মানুষ। বিজিবি কেন এদেরকে চেক করছে, জিজ্ঞাসাবাদ করছে? যুবক জানালেন, এরা ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা গ্রাম থেকে বাংলাদেশের একটা উপজেলা সদরে যাচ্ছে। তাই সাথে ভারতীয় পণ্য আছে কি’না বিশেষ করে মদ, ফেনসিডিল সেগুলি চেক করছে। করিডোরের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা অংশে যাত্রী ছাউনি’র আদলে দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা আছে, ওয়াশ রুম আছে, টিউবওয়েল আছে। জায়গাটাতে ছায়াও আছে।
ফেরার পথে পাটগ্রাম রেল স্টেশনে একদল মানুষকে দেখলাম, সাথে ব্যাগ-প্যাটরা। নানা বয়সের। একজন অন্যদের কাছ থেকে টাকা তুলছে। একজনকে দেখলাম, গলায় কয়েক প্যাঁচ তুলসীর মালা। একবার মনে হল এরা কি কীর্তনের দল? দূরে কোথাও কীর্তন করতে যাচ্ছে নাকি? কাছে গিয়ে দেখলাম না, দলের মধ্যে সবচেয়ে মুরুব্বী লোকটার পোশাক এবং অবয়ব বলে দেয় ইনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কথা বলে জানলাম, এরা মূলত নির্মাণ শ্রমিক। একটা কোম্পানির ভবন নির্মাণের কাজে চাঁপাই-নবাবগঞ্জ থেকে এসেছে কাজ করতে। ইদ উপলক্ষ্যে পরিবারের কাছে ফিরছে। গলায় তুলসীর মালাধারী লোকটিও শ্রমজীবী। তিনি এই এলাকার মানুষ। এই দলের সাথে তার এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই অল্প ক’দিনেই। তাই তিনি এসেছেন এই আত্মার আত্মীয়দেরকে বিদায় জানাতে। মনটা এক অন্য রকম ভাল লাগায় ভরে উঠল। এই বাংলাদেশের নানান চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্রই মূল চরিত্র ছিল আবহমানকাল ধরে। উদ্বিগ্ন হই চরিত্রটা বদলে যাচ্ছে বলে। আশা নিয়ে ফিরি আবারও প্রায় মরুভূমি হতে যাওয়া এই অঞ্চল আবারো ভরে উঠবে সবুজ শ্যামলিমায়। রাম-রহিম-রবার্টদের একটা সাধারণ কিন্তু মূখ্য পরিচয় হবে তারা একই দেশের সমমর্যাদা সম্পন্ন, আত্মার সম্পর্কে সম্পর্কিত নাগরিক।
ছবিঋণ: সুদেব রয়