লোকগণিত পরিচয় (প্রথম পর্ব)

লোকগণিত বা Folk-mathematics নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অল্প দিন হল আলোচনা শুরু হয়েছে। এই পরিভাষাটি এখনও সর্বজন পরিচিতি লাভ করেনি। Folk-mathematics শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা হল লোকগণিত। Folk-mathematics শব্দটি প্রথম আয়ারল্যাণ্ডে প্রকাশ পায়। Gene Mairer নামে একজন আইরিশ লোকসংস্কৃতিবিদ প্রথম ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে Folk-mathematics নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দেয়। এই প্রতিশব্দটি এবং প্রবন্ধটি সেই সময় একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধটি The Math Learning Center Report (later the continum) থেকে সহায়তা পায়। এবং পরে National Science Foundation Dissemination Grant থেকে সাহায্য লাভ করে। এই প্রবন্ধটি তার পরের বছর ১৯৭৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে Instructor Magazine-এ প্রকাশ পায়; এবং ১৯৮০ সালে Mathematics Teaching Journal-এ প্রকাশিত হয়, যেটির নাম পরবর্তীকালে Great Britain’s Association of Teacher of Mathematics হয়। এই বছরই এই Folk-mathematics প্রতিশব্দটি স্বীকৃতি পায়। লোকগণিত সমাজবিজ্ঞান চর্চাতে একেবারেই নব্য সংযোজিত বিষয়। আয়ারল্যান্ডের Gene Mairer প্রথম এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন ২০০১ সালে। ২০০৪ সালে ভারতবর্ষের অমলকান্তি ভৌমিকও লোকগণিত বিষয় নিয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু এই দুটি গবেষণার কোনোটিতেই লোকগণিতের সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। এছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে লোকগণিতের ধারণা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনাচক্রে বক্তৃতা হলেও কোথাও সুনির্দ্দিষ্ট, কংক্রিট সংজ্ঞা দেয়নি বা দেওয়ার চেষ্টা করেননি আলোচকরা। বর্তমান গবেষণাতেই সর্বপ্রথম লোকগণিতের সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দীর্ঘদিনের গবেষণাতে লোকগণিতের সংজ্ঞা ক্রমশ পরিমার্জিত রূপ পরিগ্রহ করে অবশেষে একটি কংক্রিট সংজ্ঞা নিরূপণে সমর্থ হয়েছি। বর্তমান প্রবন্ধে প্রদেয় লোকগণিতের সংজ্ঞার গভীরতা ও বিস্তৃতি অনেক বেশি। লোকগণিত বলতে বুঝিয়েছি, সমাজে বসবাসকারী মানুষ প্রাত্যহিক জীবন অতিবাহিত করতে কিছু নিয়ম-রীতি বা কৌশলের অবলম্বন নেয়, যার মধ্যে গণিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে; এই গণিতই হচ্ছে লোকগণিত। বা Folk-mathematics। একটি গবেষণাপত্রে এই সম্পর্কে বলেছি— Folk-mathematics means the mathematics of life. We have followed easily some techniques and rules in everyday life and it is practices for generation after generation. From the beginning, men have born the concept of measurement, assessment and counting without any instruction, in broad sense which called Folkmathematics. We see various application of Folk-mathematics in every stage of the daily life. Our every human action like walking, acting, thinking, swimming, eating, drinking, dancing etc. are measurable and countable and is included in the Folk-mathematics.

লোকগণিতের সংজ্ঞা প্রথমে যখন দিয়েছিলাম তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ সংকীর্ণ। একদম গোড়াতে বলা হয়েছে, লোকসমাজ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে যে সকল গাণিতিক চেতনার প্রয়োগ ঘটায় বংশ পরম্পরায় তাকেই লোকগণিত বলে। কিন্তু এই সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক। লোকগণিত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার সংজ্ঞার দিকে নজর রেখে বলতে হয় লোকগণিত কেবলমাত্র লোকসমাজের গণিত নয়। লোকগণিত যদি শুধুমাত্র লোকসমাজের হবে তবে তা কীভাবে বিবর্তিত হয়ে আধুনিক মার্জিত গণিত হয়ে উঠবে। যদি লোকগণিত শুধু লোকসমাজের হয়, তবে সেক্ষেত্রে তা সার্বিকভাবে জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে না।

উন্নত গণিতের উৎস হল লোকগণিত। পরিশীলিত উন্নত গণিত চৰ্চিত হয় উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেখানে লোকসমাজের প্রতিনিধি থাকে কম। মার্জিত পরিশীলিত সমাজের মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর জটিল গণিতের চর্চা করেন। অথচ এই সব গণিতের উৎসস্থল হল লোকজীবন। লোকজীবনের কর্মকাণ্ডে লোকগণিত প্রয়োগ হয়। এই প্রয়োগ স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিক। লোকগণিত Folk society থেকে Elite society-তে সঞ্চারিত হয়ে তা বিকশিত হয়, নব্য রূপ লাভ করে, আবার কখনও কখনও বা অপরিবর্তিত রূপ নিয়ে উচ্চতর গণিতের আঙিনায় প্রবেশ করে। লোকগণিত শব্দটি অর্বাচীন হলেও লোকগণিতের ধারণা সেই আদিম সমাজেও বর্তমান ছিল। তারা তাদের ব্যবহারিক জীবনে লোকগণিতের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য করে তুলতে পেরেছিল গাণিতিক চেতনাকে কাজে লাগিয়ে। এইভাবে, সভ্যতা এগিয়ে চলতে শুরু করে। লোকগণিতও সময়ের সাথে সাথে বদলে উচ্চতর গণিতের রূপ লাভ করে।

লোকগণিত মানুষের জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রকাশ। সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে মানুষ লোকগণিতের প্রকাশ ঘটায়। এই গণিত চেতনা নিরক্ষর, অর্ধশিক্ষিত লোকসমাজে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হয়। লোকশিল্পী, শ্রমিক, কৃষক, মজুর, জেলে, কুমোর, তাঁতি প্রভৃতি শ্রেণির সদস্যরা নিজেদের অজান্তেই তারা তাদের কর্মে লোকগণিতের চেতনাকে প্রকাশ করে। লোকগণিত চর্চা হয় প্রাত্যহিক জীবনে। এই গণিত তাই লোকসমাজ তথা মার্জিত সমাজের মানুষের জীবনের অঙ্গ। মানুষ মুখে মুখে যে গণিত চর্চা করে থাকে তা লোকগণিতের অন্তর্গত। এই গণিত চর্চাকে মৌখিক গণিত বা Oral mathematics বলে। সারা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এই গণিত চর্চার কথা জানা যায়। বিভিন্ন দেশীয় সাহিত্যে মৌখিক গণিতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এছাড়া লোকসংস্কৃতির আরও একটি বিশিষ্ট ধারা হল লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যেও অজস্র গাণিতিক চেতনার কথা পাওয়া যায়; এই গণিত চেতনাকেও লোকগণিত বলা হয়।

জীবন সম্পৃক্ত সংস্কৃতির সংজ্ঞাতে লোকগণিত অবিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবে লোকগণিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে পরিবর্তন সাধিত হয় গাণিতিক সূত্র মেনে। এই পরিবর্তনের ধারা কখনই গাণিতিক সূত্রকে অতিক্রম করে না। বিবর্তিত সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতির পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত রূপ। এই পরিমার্জন, পরিবর্ধনের অন্তরে গাণিতিক চেতনা নিহিত থাকে।

লোকগণিত লোকসমাজে প্রথাবহির্ভূতভাবে চর্চিত হয়। লোকসমাজ এবং পরিশীলিত সমাজে কোনো প্রথা না মেনেই এই গণিত চর্চা হয়ে থাকে। লোকসমাজ, সমাজ ছাড়াও উপজাতিদের মধ্যেও এই গণিতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এখন আমরা নিজেদের সভ্য জাতি বা মার্জিত জাতি বলে দাবি করি। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাতে, কাজে, কর্মে নিজেদের অজান্তেই গণিতের ব্যবহার করি। পরিমাণ, পরিমিতিবোধ, পরিমাপক একক আমরা নিজেরা নিজেদের অজান্তেই ব্যবহার করি। আমরা প্রতিদিনের কাজকর্মে কিছু নিয়ম-কৌশল মেনে চলি, তা সবই এই লোকগণিত নির্ভর।

লোকগণিতের বিভিন্ন একক আজকের সভ্যতায় বিবর্তিত হয়ে নিত্যনতুন রূপ ও নাম লাভ করেছে। যেমন— কুনকে, কড়ি, শলা, বর্গ, পণ, কাহন, কাঠা, বিঘা, পাই, কুড়ি, গণ্ডা, হালি, শ, পাই, শলি ইত্যাদি। বিবর্তনের হাত ধরে মিটার, ফিট, গজ, কিলোমিটার, মাইল, গ্রাম, ছটাক, কিলো, কুইন্টাল, মণ, টন ইত্যাদির পাশাপাশি গণনাতে ওজনে কম্পিউটার ব্যবহার সভ্যতার অগ্রগতির চরম নিদর্শন। এই সবই সংঘটিত হয়েছে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, গাণিতিক নিয়ম মেনে।

লোকগণিত সাধারণভাবে Indigenous people দ্বারা চর্চিত বলে আগে মনে করা হত। তাই অনেকে এই Indigenous Mathematics বলতে লোকগণিতের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। গ্রামীণ গণিত লোকগণিতের একটা শাখা। গ্রামীণ মানুষের চিন্তা-চেতনা গাণিতিক নিয়ম মেনে আবর্তিত বিবর্তিত হয়। তাদের জীবনও গণিত নির্ভর এবং এই গণিতকেও আলোচনায় লোকগণিত বলা হবে।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!