শরৎ গোধূলি

কয়েকবার ফোন করেও ছেলেকে পেল না ঋতু। মনের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। পুজোর ছুটি আছে সামনে। মহালয়ার দিনে আলাদা করে কেউ পুজো দেয় কি না জানে না ঋতু। কিন্তু বছরে এই দিনটা ঋতুর কাছে অত্যন্ত আনন্দ আর ভাললাগার একটি দিন। উঠানময় শিউলি সাজানো ভোর আর মিষ্টি মায়া জড়ানো নরম রোদ আকাশজুড়ে। সেই সকাল থেকে গঙ্গাবক্ষের ঢেউ পবিত্র মুগ্ধতা নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মা দুর্গার আগমনী বার্তা প্রথম ধ্বনিত হয় এই দিনে। পুজো দেবার জন্য মন ব্যকুল হয়ে ওঠে আর ছেলে রিতমের কথা মনে পড়ে। তাকে কাছে পাবার জন্য মাতৃমনের গহীনে ধুকুপুক করতে থাকে।
ছেলেকে ফোনে তাকে পাওয়া ভার। অভীককে কোনো পুজোর কথা বলে লাভ নেই। সে প্রসাদটুকু অবধি আছে। আজকাল সব জোগার ঋতুকেই করতে হয়। সব কিছু একা হাতেই সামলে নেয় ঋতু। কিন্তু ছেলের জন্য উচাটন মন কীভাবে প্রশমিত হবে! সে ভাবত, ছেলেকে বড় করে তুলতে পারলেই সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। কিন্তু নি:সঙ্গতার মেঘলা বাতাস ঋতুর মনকে ব্যথিত করে তোলে। রিতমকে নিয়ে তার যে কত স্বপ্ন ছিল়। ছেলে পড়ার জন্য বাইরে যাবে এ কথা তো কখনো ভাবনায়-ই আসেনি তার।
এখনকার মায়েরা কত সচেতন। তারা ছেলেমেয়ে রাজ্যের বাইরে, দেশের বাইরে পড়তে যাবে এ ব্যাপারে কতশত পরিকল্পনা তাদের। নিজেদের মনকে যেন তারা সদাই প্রস্তুত রাখে সন্তানদের জন্য। পড়াশুনার জন্য ছেলের বাইরে চলে যাওয়া এখনও মেনে নিতে পারে না ঋতু।
রান্নাঘর ময়ময় করছে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধে। আবারও মন কেমন করছে রিতমের জন্য।
ফোন বাজছে ওঘরে।
রিতম নিশ্চয়।
-আন্টি কেমন আছো? আমি টিয়ারা।
অনেকদিন পর। টিয়ারাকে ভোলে নি। ভুলবেও না কোন দিন। পড়াশোনা করত না। যেবার ক্লাস টীচার হলো ঋতু। তখন থেকে টিয়ারার দিকে নজর দিয়েছিল ঋতু।
-আন্টি আমি বি.এ. কমপ্লিট করলাম। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। সবার আগে আপনাকে ফোন করছি। সত্যি কী এক আনন্দে মন ভরে গেল। কিন্তু রান্না
ঘরে অনেক কাজ এখন।
-পুজো দেবো তো, তা নিয়েই আমি একটু ব্যস্ত রে আজ।
-আন্টি তোমার পুজো কবে?
সারাদিন নানা কাজে কেটে গেল। রাতের খাওয়া সেরে আর একবার ছেলেকে ফোন না করে থাকতে পারল না ঋতু। রিং টোন বেজেই গেল। কেউ সাড়া দিল না। এবার অভিমান হল। কী এত কাজ যে মায়ের ফোন ধরতে পারছে না! রিতমের বাবা অভীক তো এমনধারার মানুষ। ঋতুর বুকের ভেতরে অনুভূত চাপচাপ কষ্ট যেন সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। একটু একটু করে শিথিল দাম্পত্যে, অভীকের কাছে থেকে নিজেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। খুব প্রয়োজন না হলে অভীককে ফোন করে না সে। রিতম বাইরে পড়তে যাওয়ার পর অভীকের স্বার্থপরতা যেন আরো বেড়ে গেছে। দশবার ফোন করলে একবার সে ফোন। চিরকাল অভীক একরকম রয়ে গেল।
রিতম হোয়াটস্ অ্যাপে একটু সাড়া দিলেও তো পারে, তার ঋতুর মনটা শান্ত হয়। ছেলেও কী তবে বাবার মত? অথচ ছোট্ট রিতম মা ছাড়া কিছু বুঝত না। ঋতু এখন বুঝতে পারে, সংসার থেকে গা বাঁচিয়ে চলার জন্যই অভীক নিজেকে সরিয়ে রাখত। দুর প্রবাস জীবনে তবে ছেলেও কি ভাবে- মায়ের কী বা প্রয়োজন? একদিন ছেলের ফোন এল।
–সারাদিন এত ফোন করে ডিসটার্ব কোরো না তো। আমার কাজ থাকে। ভালো আছি আমি।
গলার স্বরে এত রূঢ়তা! থমকে গেল ঋতু। তার মন ও মগজে অনুরণিত হতে থাকল ইথারে ভেসে আসা রিতমের কণ্ঠস্বর। দাম্পত্যে অভীকের সঙ্গে মনের দূরত্ব বাড়লেও মেনে নিয়েছে সে। ছেলেকে ঘিরেই স্বপ্নের জাল বুনতো সে, রিতমই ছিল ঋতুর একমাত্র ভরসা।
এ বছরের পুজোতে মনের ভিতর আনন্দবোধ করছে না ঋতু। শুধু অভ্যাসের তাগিদে পুজো করে সে।
পুজোটা দেবেই। কিন্তু কার জন্য আয়োজন? এ কথা বারবার ভাবতে থাকে সে। কাউকে গিয়ে প্রসাদ দেবে এবার সে ইচ্ছেও একেবারে অবশ। এতটা বছর ফুল দিয়ে ঠাকুরের আসন সাজাবার কাজ ভালোবেসে করে। এবছর কোনোরকমে!
কে যাবে পদ্মফুল আনতে? মোড়ের মাথার বড় দোকানটায় পদ্মফুল বিক্রি করে। আজ সে খুব বিষণ্ণ ও অবসন্ন। ধূপকাঠি ধরিয়ে আসন পেতে বসেছে, দু-চোখ বেয়ে জলধারা নেমে আসছে। বিয়ের পর কয়েকবার নিজের বাড়িতে পুজোতে মা’কে এনেছে ঋতু। এখন মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক, মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও আবেগ বশে আনতে পারে ঋতু। রিতমের কণ্ঠ একটি বার শোনার জন্য অস্থির হয়ে থাকে হৃদয়। নিজের অজান্তেই হাতের আঙুল রিতমের ফোন নাম্বার টিপে যায়। নাহ, কোনো সাড়া নেই।
শরীর ক্লান্ত লাগছে বেশ। একটু গড়িয়ে নেবে ভেবে বিছানার দিকে এগোতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। এ সময় আবার কে এল? এমন নয় তো মাকে সারপ্রাইজ দেবে ভেবে কিছু না বলে চলে এল? কী এক কাল্পনিক সুখ প্রবাহে নিজেকে প্লাবিত করে ফেলল ঋতু। দরজা খুলতেই দেখে হাতে পদ্মফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিয়ারা।
-আন্টি, তোমার জন্য। গোলাপ তো কমন ফুল। কেন জানি মনে হল তোমার জন্য পদ্মফুল নিই। মোড়ের দোকানটায় পদ্মফুল চোখে পড়লl প্রথমে স্বপ্নঘোর কাটার ধাক্কা। পরক্ষণেই ঋতুর মনপ্রাণ জুড়ে এক ভালোলাগার উষ্ণশীতল জলধারা বয়ে গেল। তার যে আজ পদ্মফুলের কথাই মনে হচ্ছিল। মা বলতেন, পৃথিবীতে মানিয়ে চলতে পারলে কষ্ট দুর হয়ে যায়। চেষ্টা করছে ঋতু। রিতম আসে নি, কিন্ত টিয়ারা তো এসেছে। সেও তো সন্তানসম।
-তুমি জানলে কী করে, পদ্ম আমার প্রিয় ফুল?
-আন্টি আপনি একদিন ক্লাসে গল্প করেছিলেন পদ্ম আপনার প্রিয় ফুল।
এ কোন প্রাপ্তি! ঋতুর দু চোখ ভরে আনন্দাশ্রু। এক অপূর্ব শরৎ গোধূলি।♠
Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!