স্মৃতিতে অগ্রহায়ন ও জয় কাকা

অগ্রহায়ণের সকালে একটা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। পরিচিত মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। ওটা আসে জয় কাকার বাড়ি থেকে। মনে হয়, পুরো শৈশব চিত্রময় আবহ নিয়ে পা’য়ে পা’য়ে হেঁটে আসে শহরের একটা ছোট্ট কুটিরে। আমার অনুভবে। সত্যি বলছি শীতকাল আসলেই জয় কাকার কথা মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে! আমার স্মৃতি থেকে প্রতিবেশী জয় কাকার স্মৃতি মুছে দিলে আমার শৈশবের আনন্দঘন একটা অনুষঙ্গ অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। জয় কাকা একটা অতীত ঐতিহ্যের নাম। মনে পড়ে অপূর্ব সুন্দর সব দৃশ্য! আমাদের গ্রাম। শীতের হিম সকাল। দুপুরের মিঠেকড়া রোদ। আর কুয়াশায় ঘোর লাগা ভেজা ভেজা সন্ধ্যা। আরও কত শত আনন্দময় স্মৃতি!

তখন আশ্বিনের শেষের দিকে সকাল আর সন্ধ্যা সময় আধো আধো কুয়াশার ঘোর লেগে থাকতো। অর্থাৎ শীতের কুয়াশা তখনো ঠিক জমে ওঠেনি। শীতের হালকা আমেজ জানান দিচ্ছে মাত্র। আর এই দিকে, শীতের আগমনী বার্তা পেয়ে খেজুর গাছে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জয় কাকা। পাটের গ্যাঁট থেকে ভালো মানের পাট বেছে নিচ্ছেন। তার দুই মেয়ের সাহায্যে রশি পাকাচ্ছেন। সেই রশি দিয়ে আবার তৈরি করছেন খুব মজবুত করে মোটা ক্যাছি। কোমড়ের পিছনে কলসি বেঁধে খেজুর গাছে উঠতে হলে সেই গাছে ক্যাছি দ্বারা এক হাত বাঁশের টুকরো দিয়ে আট দশ ধাপের সিঁড়ির মতো বানাতে হবে তো, আর তবেই না খেজুর গাছের লক্ষ্যস্থানে উঠা সম্ভব।

শীত আসলো আর খেজুর গাছের আগা কেটে মাটির ঠিলা (কলসি) লাগালেই তো আর রস পাওয়া যাবে না! লক্ষ্য অর্জনের জন্য গাছিই ভালো করে জানেন কয় দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। ঠিক সেই মোতাবেক একটি গাছ কয়েকদিন পর্যন্ত সকাল বিকেল গাছের উর্ধাংশে চাঁচাছুলা চলে এক দু’ফোটা রসের আগমন না দেখা পাওয়া পর্যন্ত। মাথায় গামছা আর কোমড়ে ক্যাছি বেঁধে তাতে দু’তিনটি ধারাল ছুরি ঝুলিয়ে নিয়ে গাছে উঠে এবং বেশ যত্নের সহিত এভাবে কয়েক দিন ধরে গাছের সাদা অংশ কেটে বের করে দেয়। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর সেই মোক্ষম দিন অর্থাৎ কাটার পর বিশেষ কায়দায় ছোট বা বড় কলসি গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, যাতে রস কলসিতে জমা হয় পয়লা কাটা রস- অর্থাৎ একটি গাছের প্রথম দিনের সংগ্রহ করা রস। প্রথম দিন কয়েক রসের স্বাদ খানিকটা নোনতা-মিষ্টি স্বাদের হয়। খাওয়ার জন্য এই পয়লা কাটা রসের প্রতি সবার আগ্রহ থাকে। অনেকে আগেভাগে থেকেই বলে রাখে। পয়লা কাটা রস যেন মায়ের শাল দুধের মতো।

বিকেল ৩ টার মধ্যে গাছি জয় কাকা গাছে কলসি লাগিয়ে রেখে আসতেন। এরপর সারারাত ধরে ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরে পড়া মিষ্টি রসে কলসী ভরপুর হয়ে উঠত। আবার খুবভোরে সূর্য উদয়ের আগে জয় কাকা তার দুই মেয়ে সাঈদা আর এলিফা’কে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে যেতেন গাছ থেকে রস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। দশ পনের কলসি রস ভারে করে নিয়ে সূর্য উঠার ঠিক পরেই চলে আসতেন বাড়িতে। এরপর সব রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির পালা। টিনের তৈরি চারকোনা বড় তাফালে করে পনের বিশ কেজি রস ছেঁকে নিয়ে ঢেলে মাটির বড় চুলার ওপর তুলে দিয়ে খড়িকাঠের আগুনে জ্বাল দেওয়া হতো সেই রস। আগুন জ্বলতো দাউ দাউ করে। রস বলকাতে থাকে। আগুনের তাপে রস ক্রমেই লাল হয়ে আসে। সেই সঙ্গে ছড়াতে থাকে মিষ্টি একটা গন্ধ। জয় কাকার বাড়ি থেকে সারাপাড়ায় ছড়িয়ে পড়তো টাটকা রসের সেই মৌ মৌ ঘ্রাণ।

রস গাঢ় ঘন হয়ে আসে। তখন এটাকে ক্যাই বলে। ক্যাই যখন দু’আঙুলে চিটচিটে আঠার মতো লেগে থাকবে তখনই বুঝা যাবে যে গুড় হয়ে এসেছে। আর গন্ধটাও হবে গাঢ় মিষ্টি। চুলা থেকে নামানোর পরই শেষ হয়ে যেতো সব গুড়। সবাই অপেক্ষা করে থাকতো গুড়ের জন্য। কারণ শীতের মুড়ি-মুরকি থেকে শুরু করে নানা রকমের সব পিঠা-পায়েস তৈরি করতে খেজুর গুড়ের ব্যবহার- এটাই এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। সে সময় খেজুর গুড়ের পিঠা-পায়েস ছাড়া নতুন মেয়ে-জামাই আপ্যায়ন জমতোই না।

আমাদের গ্রাম বিলাসবাড়ী ইউনিয়নে জয় কাকা ছাড়া আর কেউ রস আর গুড়ের কারবার করতো না। এটাই ছিল তার পেশা। সারাজীবন জয় কাকা খেজুরের গুড় তৈরি আর বিক্রি করেই জীবনধারণ করেছেন। সে সময় খেজুরের গুড় বলতেই জয় কাকার বাড়িই বুঝতো সবাই।

অনেক বছর হলো জয় কাকা নেই। গ্রামেও এখন আর আশ্বিন-কার্তিক মাসে সেই শীতের সকাল নেই। -খেজুরের গাছও নেই। কলসী কোমড়ে বেঁধে ভোরের কুয়াশা কেটে জয় কাকার মতো আর কেউ খেজুরের রস সংগ্রহ করতে যায় না। চুলায় বলকানো রসের মিষ্টি গন্ধ আর বিলায় না কেউ।

আর দশটা গ্রামের মতো আমাদের গ্রামও এখন ডিজিটাল গ্রাম। ইন্টারনেটে সোশ্যাল মিডিয়ায় খেজুর গাছের ছবি দেখি আমরা। গাছের মাথায় ঝুলে আছে কলসি। এমন দৃশ্যের ছবি পোস্ট করে আমরা পুলকিত হই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জয় কাকারা নেই। খেজুর গাছ নেই। পটে ছবি আছে। কিন্তু গাছ নেই। সব হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে!

যদিও আমরা চাইনি! তবুও মানুষের জীবন থেকে ক্রমেই ইতিহাস-ঐতিহ্য আর প্রকৃতির চিরচেনা রূপ চলে যাচ্ছে, আর্কাইভে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!