অসাধারণ নির্জন তাকদা এবং তিনচুলে

সখী ভালোবাসা কারে কয়! ছোট ছোট মুহূর্তগুলো নিয়েই আমাদের জীবন, আমাদের ভালো থাকা, আমাদের ভালোলাগা। একটা করে দিন চলে যায় আর আমরা এই পৃথিবীর কাছে ঋণী হয়ে পড়ছি প্রতিনিয়ত। ঋণী হয়ে পড়ছি কিছু মানুষের কাছে। মাঝে মাঝে সময় পেলেই ছুটে চলে যাই ঐ দূর পাহাড়ে বা গভীর জঙ্গলে। যাই এ কারণেই জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখব বলে। জীবনকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করব বলে। সময় সুযোগ পেলে বা ভ্রমণের নেশায় অনেকেই হয়তো চলে যায় প্রকৃতির মনোরম শোভা উপলব্ধি করতে। কিন্তু হৃদয় দিয়ে কতজন আমরা সেখানকার মানুষের জীবনকে বুঝতে পারি। আদৌ বোঝার চেষ্টা করি কি?

পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে কতো স্থানীয় মানুষের সাথে পরিচয় হয়। পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কিভাবে জীবন অতিবাহিত করছে। কাছে পিঠে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নেই যানবাহনের ঠিকঠিক ব্যবস্থা। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করে থাকে কখন গাড়ি আসবে কিম্বা সেই গাড়ির দেখা মিললেও দাঁড়াবে কি? তাই পা দুটোই একমাত্র শেষ ভরসা। তাই তারা সেই পা দুটোর ওপর ভরসা করেই আর মনের সমস্ত জোরকে অবলম্বন করে চলতে থাকে আপনমনে, আপন খেয়ালে বয়ে যাওয়া নদীর মতো। পাহাড়ের মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ মুখের হাসি। সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণাকে অনায়াসেই একপাশে সরিয়ে রেখে, জীবনকে অন্য রঙে-অন্য ছন্দে কাটাতে চেয়েছে আজীবন। জীবন মানেই যে টাকা পয়সার লেনদেনের খেলা তা নয় বরং জীবন মানে তাদের কাছে একটা মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস; সবাই মিলে মিশে একসাথে থাকার অঙ্গীকার। জীবনকে কতো রূপে তাই দেখতে চেয়েছে।

মাঝে মন অনেক কিছু বলতে চায় কিন্তু সেটা কি? সে তো নিজেই জানে না। জানা আর না জানার মাঝামাঝি কতো নদী, কত পাহাড়, কত পাহাড়ী ঝরণা, বুনো ফুল, হাতির দংগল, আর ওই সেই শান্ত ঘিস নদী। এই নদীটি আমার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই ছুটে যাই আমার প্রিয় এই নদীটির কাছে। আচ্ছা মাটি কি মানুষের প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে? করে তো বটেই, ঐ যে বলে নরম মাটি। আসলে এই মাটিতে থাকা মানুষগুলো মনের দিক থেকেও বেশ নরম, মোলায়েম, যার সাথে দু-দন্ড কথা বলা যায়। পাহাড়ের মানুষের অনাবিল মুখের হাসি মানুষগুলোকে অনেক কাছে এনে দেয়, মনে হয় যেন একেবারে এক অন্য গ্রহের বাসিন্দা। এতো অভাবের মধ্যেও কি সুন্দর তার মুখের হাসি যেন বলতে চায় ঈশ্বর যা দিয়েছেন তাতেই আমি খুব সুখী। আসলে প্রকৃতিই মানুষকে গড়েছে তার মতো করে। রুক্ষ মাটিতে থাকতে থাকতে অনেক সময় মানুষ যেন বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল মারে, সে নিজেও বোঝে না তার আদিম ভয়ানক প্রচ্ছন্ন রুপটাকে, কি বিশ্রী আর কি ভয়ানক সেই রুপ! একদিন আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই চমকে ওঠে! নিজের মন কে নিজেই চিনতে পারে না।তারপর কোনো একদিন মনের মধ্যে জন্মায় এক হতাশার বীজ, জীবন তাকে এই ভাবেই শিক্ষা দেয়। পাহাড়ী মন উড়ে যায় অনেক দূরে, যেখানে নেই কোনো বিষাক্ত প্রতিযোগিতার খেলা, নেই কোনো দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ, নেই কোনো হিংসা, আছে শুধু নরম মাটির খেলা, যে মাটিতে ভর দিয়ে অনেকটা পথ চলা যায়।

গিয়েছিলাম দার্জিলিং জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম তাকদা। এই গ্রামটিতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম জীবন কি! জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি-ই বা কি! শুধু মাত্র নির্জনে নিজের সুখের জন্য বা একটু বিশ্রামের জন্যে যে সেখানে ছোটা তা কিন্তু নয়, বরং পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলাম। বাঁচার জন্যে খুব বেশি কিছুর দরকার নেই। দরকার শুধু একটা বিরাট হৃদয়। আসলে মানুষের চাওয়া পাওয়ার উপরেই তো নির্ভর করে আমাদের জীবনের সুখ। আসলে এই সুখ নামক অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের মন নামক চালকের মাধ্যমে। ভাল আছি, ভাল থাকব এই বোধটা তো আমাদের হৃদয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

পাহাড়ে, জঙ্গলে বেড়াতে তো সবাই যায়, যায় ছুটি কাটাতে। কিন্তু দুর্গম সেই জায়গার মানুষ যে কিভাবে জীবন কাটায় খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না কিছুতেই। জীবন মানে যে শুধুই গাড়ি বাড়ি আর রেস্তরাঁ নয়; জীবন মানেই যে শুধু আভিজাত্যের মোড়ক নিজেকে আবদ্ধ রাখা নয় বরং জীবন মানে সবাই মিলে মিশে একসাথে অনেকটা পথ কাটানো। একসাথে সুখে দুঃখে একে অপরের সঙ্গী হওয়া, পর্বতের চড়াই উৎরাই পথ বেয়ে অনেকটা পথ হাঁটা।

এমনই কিছু জায়গায় যেতে যেতে আবিষ্কার করেছিলাম পাহাড়ের একটি নির্জন গ্রামকে। একটাই ছবি তুললাম অবশেষে; প্রকৃতির পাশে নিজের ছবি তুলতে বড় লজ্জা করে, খুব তুচ্ছ মনে হয় নিজেকে। চারপাশে প্রকৃতির এতো সৌন্দর্যের পাশে প্রাণভরে শুধু অক্সিজেনটুকুই নেওয়া যায়। ঘরে ফেরার পথে মনটা কেমন করে। আসলে বেড়াতে গেলে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয় জীবনকেও। যেখানেই যাই মনটাকে মিশিয়ে দিই সেখানকার মাটি আর মানুষগুলোর সাথে।

অসাধারণ নির্জন তাকদা, তিনচুলে এবং চমকে দেওয়া উপহার; সঙ্গীহিসেবে মনোরম কুয়াশা ঘেরা সেই সন্ধ্যা। চারপাশে প্রকৃতির এতো সৌন্দর্য তখন মন ভাল করা পাখিরা যেন ভালোবাসার গান গেয়ে যায়, কানে কানে বলে যায় কতোকিছু, আর সেই মুহূর্তে সেখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে ইচ্ছে করে। তখন জীবনে কি পেলাম আর কি পেলাম না তার টুকরো টুকরো হিসেব নিকেশকে বড্ড হালকা মনে হয়। আর সেই জায়গা যদি হয় কোনো এক পাহাড়ের গ্রাম। আসলে প্রকৃতির পাশে নিজেকে নিয়ে ভাবাটা বাতুলতা মাত্র, বড়ই তুচ্ছ। চারপাশে প্রকৃতির এতো সৌন্দর্য তখন মন ভাল করা পাখিরা যেন ভালোবাসার গান গেয়ে যায়, কানে কানে বলে যায় কতোকিছু, আর সেই মুহূর্তে সেখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়িতে ফেরার সময় মনটা কেমন করে ওঠে। আসলে ঘরের বাইরে পা রাখলেই তো হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় জীবনকে। মনটাও মিশে যায় সেখানকার মাটি আর মানুষগুলোর সাথে।

অদ্ভুত ভালোবাসা পাই প্রতিবার-ই। এবারেও একটা ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যাবেলা ঘন কুয়াশায় অসাধারণ মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া ছেড়েছে তখন। আমরা হাঁটছিলাম ধীরপায়ে, এক দোকানে চকলেট, চিপস, বিস্কুট, কেক এসব কিনতে গিয়ে গল্প শুরু হল। নেপালি সেই বিক্রেতা দাদার অমায়িক ব্যবহার কখনো ভোলার নয়। তাঁর নাম নির্মল প্রধান। তাঁর দোকানের নাম নির্মল স্টোর্স। অনেকটা সময় কাটালাম সেখানে, সঙ্গী হল সেখানকার প্রাচীন ইতিহাস। এছাড়া দার্জিলিং চায়ের সঙ্গে অন্যান্য চা-এর গুণাগুণ বা পার্থক্য নিয়েও হল তুমুল আলোচনা। একমুখ হাসি নিয়ে বিদায় জানাবার সময় বললেন ‘আবার আসবেন কিন্তু।’ আমার মনে হচ্ছিল বহু বছরের চেনা কোনোজন। বহু যুগ ধরে তার গল্পই যেন শুনে এসেছি। নিজেরই লেখা একটি কবিতা মনে পড়ে গেল-

এক একটা সময়কে
খুব চেনা মনে হয়
মনে হয় বহু যুগ ধরে ওরা মিশে আছে
আমার সমস্ত অনুভূতির ভেতর

এক একটা অনুভূতিকে
আমার খুব চেনা মনে হয়
মনে হয় ওরা বহু যুগ ধরে মিশে আছে
আমার সমস্ত অস্তিত্বের কাছাকাছি

কিছু শব্দ ভিড় করে আজকাল
চেনা অচেনার মাঝামাঝি বিলাসী দুপুর
ফুটে ওঠে কতো ছবি
ভেসে ওঠে পদাবলী সুর।

অদ্ভুত হৃদয় দিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলছিলেন। কতো গল্প, কতো কথা। পরে হোটেলে ফিরে সেই দোকানে কেনা খাবারের প্যাকেটটা খুলতেই আবিষ্কার হল আরো একটি বাদামি রং-এর প্যাকেট। একটু অবাকই হলাম, বাদামি রংএর প্যাকেটটা খুলতেই দেখি সেই অসাধারণ দার্জিলিং চা। আমাদের কথার ফাঁকে কখন যে এই বিরাট বড়সড় প্যাকেটটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে খেয়ালই করিনি।
সখী ভালোবাসা কারে কয়।
এ ঋণ শোধ করি কিভাবে!

তাকদা দার্জিলিং এর মূল শহর থেকে কমবেশি ৩০ কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না কিন্তু দেখা যায় দিগন্তবিস্তৃত ঘন সবুজের সমারোহ আর বিখ্যাত সমস্ত কোম্পানির চা বাগান। উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ পর্যটনের সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা তাকদার অন্যতম আকর্ষণ। এখানে পর্যটকদের থাকার জায়গাগুলো পাহাড়ের উপর দিকে আর যারা চা বাগানের কাজ করে তাদের থাকার জায়গাগুলো নীচের চা বাগানের কাছেই। রাত্রিবেলায় যখন ঘরে ঘরে আলো জলে, মনে হয় আকাশে তারারা নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। অপূর্ব সুন্দর সে অনুভূতি। এছাড়া তাকদা অর্কিড সেন্টারে রংবেরঙের অর্কিডও মনকে মাতিয়ে রাখতে পারে সহজেই, আর আছে অসাধারণ বৌদ্ধমন্দির, মনকে আবিষ্ট করে যা অতি সহজেই। সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে কোনো কোলাহল নেই, অশান্তি নেই, হিংসা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। আছে শুধু শান্তির বাতাবরণ। মনকে বিশুদ্ধ রাখতে এই প্রাঙ্গণ-ই যথেষ্ট। যেদিকে দৃষ্টি যায় সেদিকে শুধু আকাশছোঁয়া পাইন গাছ আর সবুজ চা বাগান মনকে ভাল করে দেয়।

এছাড়াও তাকদা থেকে খুব সহজেই ঘুরে নেওয়া যেতে পারে রিশপ, লাভা, পেডং, সিলারিগাঁও, কালিংপং- এসব জায়গাগুলো। ব্যস্ত এবং শহরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষেরা ক্লান্ত একঘেয়ে জীবন থেকে দুটো দিন একটু নিরিবিলিতে যারা কাটাতে চান, তাদের জন্য অন্যতম সেরা ঠিকানা হতেই পারে তাকদা। এখান থেকে দার্জিলিং গাড়িতে মাত্র এক ঘন্টার পথ, তাই তাকদা থেকে খুব সহজেই নষ্টালজিক টয়ট্রেন আর কাঞ্চনজঙ্ঘার শোভা উপভোগ করা জীবনের অন্যতম সেরা ভ্রমণ তালিকায় স্থান পেতে পারে।

তাকদা হেরিটেজ বাংলো ইংরেজ আমলে তৈরি করা বাংলো। এখন এই বাংলো আরো নতুন রূপে, বাংলোর সামনে সবুজ ঘাসের লনে বসে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার প্রচুর সুযোগ।

লেপচা ভাষায় কুয়াশা মানে তাকদা। আকাশছোঁয়া উঁচু উঁচু পাইন গাছের জঙ্গল ঢেকে যায় সেই কুয়াশায়। ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথ। উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢাল ধরে নজরকাড়া সবুজ চা বাগিচার ঢাল। রাস্তার দুই ধারে সাদা, গোলাপি এবং হলুদ রঙের ধুতরো ফুলের সারি। বিকেল গড়াতেই সাদা তুলোর মত উড়ে এসে চারদিক আবছা হয়ে উঠেছে কুয়াশায়। কোনও কোনও সময় ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে পাথুরে রাস্তা ভিজে সার হচ্ছে। এরই মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়ের কোলে নজর পড়েছে শতাব্দী প্রাচীন বৃটিশ স্থাপত্যের নমুনা, পাথরের তৈরি ছোট-বড় বাংলো। তার কোনোটায় আবার নিচে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের সময়কার লুকনো বাঙ্কারও। এখনও এক কোণে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইউরোপিয়ান ক্লাব। একটু দূরেই রয়েছে এক সময়কার এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্কিড সেন্টারও। আর এর কিছুটা দূরত্বে এবড়ো থেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে প্রায় ২০০ মিটার উঠলেই পাইনের জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মাথায় নজর কাড়বে ‘সোনপুর হাউস’, বিহারের প্রসিদ্ধ সোনপুর মহারাজার এক সময়কার ছুটি কাটানোর বাংলো। তথাকথিত রাজা, মহারাজাদের প্যালেসের আদল নয়, পুরোটাই ‘কলোনিয়াল’ স্থাপত্য।

১৯০০ সালের পর ব্রিটিশ উচ্চ পদস্থ অফিসারদের অতি পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে সোনপুর হাউস। তারপর থেকে এলাকায় তৈরি হয়, একই রকম ছোট-বড় মোট বারোটি বাংলো। ১৯১৫ সাল নাগাদ দার্জিলিং মহকুমার তাকদা সারা বিশ্বে পরিচিত লাভ করে ‘ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া’হিসাবেই।

৩১- এ জাতীয় সড়ক দিয়ে গেলে রম্ভি হয়ে তিস্তা ভ্যালি এবং রংলি। রংলিওট চা বাগান পার হলেই তাকদা। আবার কার্শিয়াং হয়ে জোড়বাংলো থেকেও তাকদা পৌঁছানো যায়। একসময় ঘোড়া সওয়ারি করেও সাহেবরা এলাকায় গড়ে তোলেন ব্রিটিশ কলোনি। এমনকি, লোবস ডায়েরি ফার্ম, চকলেট কারখানা, কেভেনটার্সের ডেয়ারিও তৈরি হয়। এশিয়ার অন্যতম সম্ভ্রান্ত গ্রাম হিসেবে তাকদার একসময় পরিচিতও ছিল। সব এখন ইতিহাস। এখন তাকদাকে কেন্দ্র করে পর্যটকেরা মংপু, তিনচুলে, লামাহাটার মতো এলাকাগুলো অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন। তেমনই আছে অসাধারণ সুন্দর কয়েকটি চা বাগান। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তো আছেই শৈলশহর দার্জিলিং। বেসরকারি তো বটেই সরকারি স্তরেও তাকদার আরো পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রচার করা দরকার- তাহলে তাকদা পর্যটন মানচিত্রে জোরালো ভাবে ঠাঁই পাবে।

তাকদা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে তিনচুলে। দুচোখ ভরে কাঞ্চনজংগাকে দেখা আর উপভোগ করার অন্যতম সেরা জায়গা। তাকদা থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে একটা বেলা তিনচুলেতে কাটানো জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন হয়ে যেতে পারে। তবে তিনচুলে গেলে একটা রাত্রি অন্তত থাকা উচিত, কারণ? কারণটা খুব সহজ, সকাল বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন। এতো অসাধারণ এবং মনোময় যা কল্পনা করা যায় না। ভোরের সূর্যালোক কাঞ্চনজঙ্ঘাকে করেছে অপরূপা। এতো সৌন্দর্য আর এতো রূপ কাঞ্চনজঙ্ঘার যা এখানে না এলে জানা সম্ভব নয়। এছাড়াও আছে পাইন গাছের জঙ্গল। পাহাড়ের গায়ে কোথাও কোথাও অ্যাসেলিয়ার ঝাড়ও আছে। লিলি, অর্কিড নিজেদের মতো করে সৌন্দর্য ছড়িয়েছে অনেকটাই। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে তাকালেই গাছের ফাঁকে ফাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা যায়, মনে হয় আমাদেরকেই যেন অনুসরণ করছে। আহা কী মনোরম সে দৃশ্য!

এখানে সুন্দর সুন্দর হোম স্টে, ঝলমলে আলোতে হোম স্টেগুলো আরো যেন ঝলমলে। অসাধারণ সব পাখি, একটা পাখির নাম জানা গেল আলতাপরী। সুন্দর সুন্দর রং বাহারি পাখির মতোই এই পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য, যে সৌন্দর্য বারবার যেন পালটে যাচ্ছিল। কখনও মেঘমুক্ত আকাশের নীচে বিস্তৃত চা বাগানের সবুজ গালিচা বিছানো প্রাঙ্গণ, কখনও আবার কালো মেঘের আসা যাওয়া। আলো আর ছায়ার যেন যৌথ প্রতিযোগিতা কে কিভাবে নিজেদের রূপকে তুলে ধরতে পারে। কখনও আবার এক পশলা বৃষ্টি যেন আকাশ বাতাস মাটিকে ভরিয়ে তুলছে এক অনাবিল ভালোবাসায়।

সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় তিনচুলে যেন নানান রঙে সেজে উঠেছে। কখনো সাদা মেঘের আস্তরণ পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে, মনে হচ্ছে সুন্দর ঘোমটা দিয়ে আছে, যেন সে এক লাস্যময়ী কন্যা, আহা প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য এখানে না এলে তো জানতেই পারতাম না। এখানে আসলে আর যে ফিরে যেতে মন চায় না। পৃথিবীর সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সহজেই মুছে যায়। অবাক হয়ে দেখতে ইচ্ছে করে এখানকার স্থানীয় মানুষের মুখ, কতো নিঃস্ব অথচ কতো সারল্য। জীবনে হয়তো কিছুই নেই, অথচ ওদের হাসি মাখা মুখ বলে দেয় ওরা কতো ভাল আছে, ওরা কতো সুখী। আসলে ভাল থাকাটা নির্ভর করে মানুষের মনের ওপর, আর মনের চালক স্বয়ং আমরাই। তাই বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে আমাদের এখানে আসতেই হবে।

কিভাবে যাবেন—
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে তাকদার দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। কালিম্পং থেকে ৩৩ কিলোমিটার আর দার্জিলিং থেকে ৩০ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে সহজেই আসা যায় এখানে।

নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সোজা তিনচুলে যাওয়া যায়, সেখানে একদিন দুদিন থেকে তারপর সেখান থেকে সোজা তাকদা। সেক্ষেত্রে ভাড়া ২৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা। এছাড়া শেয়ারেও যাওয়া যায়, ভাড়া একজনের ২০০টাকা।

ছবিঋণ: মণিজিঞ্জির সান্যাল

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!