জীবনের অষ্টব্যাঞ্জন সময়ের ব্যবধানে এক এক রকম। কেউ হয়ত টক ঝাল মিষ্টি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। কেউ বা হয়ত শুধুই নোনতা বা মিষ্টি আবার কারও কারও ক্ষেত্রে হয়ত শুধুই টক। যার জীবন যেমনই হোক না কেন। আমাদের প্রত্যেকেরই চেষ্টা থাকে যার যেমন ভাল লাগে সেরকম কিছুটা পরিবর্তন করে নেয়ার। আমাদের কোনও কিছুই অবধারিত নয়। পরিবর্তন হতেই থাকে। সেটি হয় মানসিক হয় তা শারীরিক অথবা অর্থনৈতিক। তবে জীবনের এই প্রান্তে এসে অনুভূতি হচ্ছে এমন যে এইতো মাত্রই আরও একটি বছর চলে গেল জীবনে আরও একটি নতুন অধ্যায় শুরু হল। মৃত্যুর আরও নিকটবর্তী হওয়াকেই জীবন প্রবাহ বলে কি? জীবন থেকে ঘটনাবহুল আরও একটি বছরের দৃশ্যমান সমাপ্তি হল।
চেষ্টা করে গেছি মানবিক গুণাবলী অর্জন করবার। একজন মানুষের মাঝে দয়া, মায়া, কৃপা, উদারতা, অহিংসা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, স্নেহ, প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস, জ্ঞান, আনন্দ এগুলোই হল শিষ্টাচার। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এসব শিষ্টাচারগুলো কে আত্মস্থ করার। জানি না কতটুকু পেরেছি। একজন ব্যক্তির চিন্তাশক্তি যখন এসকল শিষ্টাচার তথা মানবিক গুণাবলী নিয়ে কাজ করে তখন মানুষের মাঝে মানবতা বিকশিত হয়। মানুষের শারীরিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক বিকাশকে প্রভাবিত করার উপায় প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরি।
জীবনকে কখনই সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে ঢুকিয়ে দেই নি। যত রকম বিপত্তি এসেছে, তার মাঝ দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। কখনও কখনও উতরেও গেছি। সেটা যে সব সময় নিজের পছন্দমাফিক হয়েছে তাও নয়। সমাধানের সাথে নিজেকে যুক্ত করে এগিয়ে গিয়েছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ হল সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। কিন্তু কিন্তু করে এগিয়ে যাওয়া যায় না। কথায় বলে তো “সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।” জীবনে পর্যালোচনা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
সকল সম্পূর্ণতার পথে বৃথা না দৌড়ে নিজের সক্ষমতায় যতটুকু হয়, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই হল জীবনের শান্তি। কেন শুধু অব্যক্ত মনোভাবকে অসম্পূর্ণতার দৃষ্টিকোণ থেকে আড়াল করে রাখার বৃথা চেষ্ঠা করা। এতে শুধু শ্রান্তিই বেড়ে যায় না, বাড়িয়ে দেয় পথের সীমানাও।
জীবন চক্র একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া। আমরা চাই বা না চাই। জীবন তার প্রবাহে পথ চলবেই। সে আমরা চাই না চাই। আমরা শুধু তাকে অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারি। তবেই তো মানসিক বিকাশ ঘটে। নিত্য নতুনের মাঝেই তো বাঁচার আনন্দ লুকিয়া থাকে। রাগ অনুরাগ নিয়েই তো আমাদের পথ চলা।
জীবনের দোলাচলে খুব রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ছে। যিনি ছিলেন একজন আত্মজ্ঞ পুরুষ। প্রতিটি কাজে, ভাবনায়, লেখায় নিজের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য এবং জীবনের অর্থ সম্পর্কে গভীর ধারণা পোষণ করেছেন।
জন্মদিন আসে বারে বারে মনে করাবারে—
এ জীবন নিত্যই নূতন
প্রতি প্রাতে আলোকিত পুলকিত
দিনের মতন।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(স্ফুলিঙ্গ কবিতা থেকে উদ্ধৃত)
অতীন্দ্রিয়লোকে রবীন্দ্রনাথ: কবি-জীবনের শেষ পর্যায়
রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভূমি ও ভূমার অনুভূতি সংমিশ্রণে এক অতীন্দ্রিয় লোকের সন্ধান পেয়েছেন। আমরা জানি রবীন্দ্র-প্রতিভারশ্মি বিচিত্র ধারায় হৃদয় ও মনের এবং জগৎ ও জীবনের আনাচে-কানাচে অলিতে-গলিতে প্রবিষ্ট হয়েছে; অদেখা-অজানা ও অভাবিত বিষয়ও তাঁর প্রতিভার আলোয় উজ্জ্বল ও প্রত্যক্ষীকৃত হয়েছে। যিনি ছিলেন কল্পনা, আশা ও অনুভূতি-প্রদীপ্ত মহাসাধক, তিনিই শেষজীবনে হলেন জগৎ ও জীবনের রহস্যজ্ঞ ত্রিকালদ্রষ্টা মহর্ষি।
(তথ্য সূত্র: বিচিত চিন্তা আহমদ শরীফ (বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও চিন্তাবিদ আহমদ শরীফ [১৯২১-১৯৯৯] তাঁর জীবনের চল্লিশটি বছর ব্যয় করেছেন বাঙালি নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তা-অনুসন্ধানে।)
আবহমান কালের প্রবাহিত স্রোতধারায় ভিন্ন ভিন্ন রঙ অনেকসময় জীবনে আসে তা কিন্তু আবশ্যিক নয়, হয়ত প্রকৃতির নিয়ম রক্ষা করার জন্যই আসে। তা হয় ক্ষণস্থায়ী। দাঁড়িকমাহীন একটুকরো জীবন বয়ে বেড়ানোই কি তাহলে বেঁচে থাকা? বেঁচে থাকার স্পৃহা মানে হলো বাঁচার প্রবল ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা। এটি জীবনের প্রতি ব্যক্তির অঙ্গীকার এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকার দৃঢ় সংকল্প। জীবনে অস্থিরতা কোনও ভালকিছু বয়ে আনে না। নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানসিকতাকে বিকশিত করতে পারা একজন মানুষের জন্য চরম পাওয়া। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে একটা সংবেদনশীলতার সূতো থাকে, দোলাচলের সূতো থাকে। অনেক প্রিয় সিদ্ধান্ত আমরা একলা হয়ে যাওয়ায় ভয়ে নিতে পারি না। আবার অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমরা অপছন্দকে গিলে ফেলি অনায়াসেই। সব আবেগ আমাদের স্পর্শ করে না। আবার সবার আবেগ আমাকে ছুঁয়েও যায় না। ধৈর্য আমাদের পরম বন্ধু। জীবনে অস্থিরতার কোনও স্থান নেই। বরং ধৈর্য আমাদের কে আমাদের কঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তবে আত্মমগ্নতা সুফলের চেয়ে কুফলই বয়ে আনে বেশি। জীবনে আত্মমগ্নতা হবার প্রয়োজন খুব একটা নেই। সমালোচিত হতে শিখুন। তবেই উৎকর্ষিত হতে পারা যায়।
সব শেষে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “আত্ম-বিলাপ” থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করছি।
জীবন-প্রবাহ বহি কাল-সিন্ধু পানে যায়,
ফিরাব কেমনে
দিন দিন আয়ুহীন, হীনবল দিন দিন,—
তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!
বিদীর্ণ সকল রঙের পথচলা নিয়ে শুরু হোক আরও একটি নতুন বছরের প্রতিটি সকাল।