গত ২৫ নভেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ১৯৬০ সালে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার দায়ে প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা এবং মিনার্ভা মিরাবেল নামের তিন বোনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার দুই দশক পর ১৯৮১ সালে ল্যাটিন আমেরিকার নারীদের এক সম্মেলনে এই তিন বোনকে স্মরণ করে ২৫ নভেম্বরকে নারীর প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার আরো দুই দশক পর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে এবং ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত সময়কালকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন পতিরোধ পক্ষ বা ১৬ দিনের প্রচারাভিযান হিসাবে ঘোষণা করে, যা মূলতঃ সিক্সটিন ডেই’জ এক্টিভিজম হিসাবে বিশেষভাবে পরিচিত। এ বছর বৈশ্বিকভাবে এই পক্ষ পালনের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “ইউনাইট টু ভায়োলেন্স এগেইনেস্ট অল উইমেন এন্ড গার্লস”। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে দেশের সার্বিক নারী নির্যাতনের চিত্র মাথায় রেখে স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে “সাইবার সহিংসতাসহ নারী এবং কন্যা শিশুদের প্রতি সকল প্রকার সহিংসতাকে “না” বলুন, নারী এবং কন্যার অগ্রসরমানতা নিশ্চিত করুন।”
দিবস, পক্ষ, প্রেক্ষাপট , উদ্দেশ্যে এবং উদযাপন কিংবা পালনের আলোকে আমরা একটু দেখে নিতে চাই, এগুলিক আমাদের নারীদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে কি’না। আমি কোনো পরিসংখ্যানের আলোকে এই আলোচনা এগিয়ে নিতে চাই না। কারণ পরিসংখ্যান নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন এবং সহিংতার প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রকে সাফাই গাওয়ার সুযোগ করে দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখপাত্ররা বলেন গত বছর এতটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল, এবছর সেই তুলনায় একটি কম ঘটেছে কিংবা বলেন, অমুক আমলে এতটা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল, আমাদের আমলে সেই তুলনায় দুইটি কম ঘটেছে। তাছাড়া এই দিবসের প্রেক্ষাপট যদি আমরা বিবেচনায় নেয় তাহলে দেখব দিবসটির সূচনা কিন্তু কোনো রাষ্ট্রের দ্বারা হয় নাই বরং নাগরিকদের দ্বারা হয়েছে। পরবর্তীতে জাতিসংঘ সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ব্যক্তি নাগরিক কিংবা নাগরিক সমাজের দায় এখানে অনেক বেশি। সেই দায় নাগরিকেরা কতটুকু নিচ্ছেন এবং সেই অনুসারে দায়িত্ব কতূকু পালন করছেন, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া জরুরী।
বেশ কয়েক বছর আগে কুষ্টিয়ার একজন নারী কৃষক সরবরাহকারীর নিকট সরকারি ভর্তূকির মাধ্যমে বিক্রি হওয়া সার সংগ্রহ করতে গেলে, তাকে বলা হয় তিনি সার পাবেন না, কারণ তিনি কৃষক হিসাবে স্বীকৃত নন। এর চেয়ে বড় মশকরা আর কি হতে পারে? কারণ সাধারণভাবে দেখা যায় কৃষিখাতের ২১ টি কাজের ১৭ টিতে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলিই তারা করে থাকেন। ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বীজ থেকে চারা অঙ্কুরোদগম ঘটানো নারীর চর্চা, যত্ন এবং মননের সমন্বয়ে সম্পন্ন হয়। এই ঘটনাকে আমাদের নাগরিক সমাজ নারীর প্রতি বঞ্চনা হিসাবে দেখেন। হা-হুতাশ করেন কিংবা করেন না। যারা করেন, তারা বলেন, এই রাষ্ট্র, এই সমাজ আজও নারীকে তার ন্যায্য অধিকার দিতে শিখল না। কিন্তু তারা নারীর ভেতরের দহনকে উপলব্ধি করতে পারেন কি’না সেটা নিয়ে আমার সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
বছর সাতেক আগে একই জেলার একটি উপজেলার একটি গ্রামে ঘোষণা করা হয় গরু এবং নারীদের মাঠে প্রবেশ নিষেধ। এখানেও কথিত সুধী সমাজ এটুকুই বলে ক্ষ্যান্ত দেন যে এই বক্তব্য নারীর জন্য অবমাননাকর। কিন্তু তারা নারীর মানসিক পীড়নকে বুঝতে পারেন না। কিংবা হতে পারে এই বক্তব্যে ওই গ্রামের কোনো নারী অপমানিত বোধ করেন নাই কিংবা মানসিক পীড়নও অনুভব করেন নাই। কারণ কোনটা তার জন্য অপমান কোনটা পীড়ন, কোনটা নির্যাতন সেই বোধই তাদের তৈরি হতে দেওয়া হয় না। এই দেশে জন্মগতভাবে যদি কেউ সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে না আসে, আমাদের পরিবার সমাজ, প্রতিষ্ঠান মানুষকে সংবেদনশীল হিসাবে গড়ে উঠতে সেই অর্থে কোনো ভূমিকা পালন করেনা। তাই অন্যের অপমান, মনোবেদনা, পীড়ন আমরা খুব কম ক্ষেত্রেই বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি। কিন্তু নির্যাতন তো দৃশ্যমান এবং নৈতিক ও আইনগতভাবে অপরাধ। সেই নির্যাতন প্রতিরোধেই বা নাগরিক হিসাবে আমরা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছি? পারছি যে না, সেইটার সাক্ষ্য কিন্তু এবারে বাংলাদেশে নারীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের স্লোগানই বহন করছে। স্লোগানের মধ্যে কিন্তু প্রতিরোধের দীপ্ততার চেয়ে আহবানের সুরই বেশি কানে বাজে। এখন কথা হল, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্র কি এই আহবান আমলে নিবে?
আমাদের পরিবার, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠান এখনও মনে করেন স্বামী তার স্ত্রীকে তো একটু শাসন করতেই পারে এবং সেই শাসনের মাত্রা চড়-থাপ্পড় পর্যন্ত অনুমোদন করে। স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকজন দ্বারা গুরুরতর আহত হওয়ার পরও বলতে শোনা যায়, ও কি আর এমনি এমনি ঠ্যাঙ্গানি খাইছে, খাইছে তো চোপার দোষে। আবার এই ধরনের ঘটনায় যখন গ্রাম পর্যায়ে সালিশ-দরবার হয়, নির্যাতনের শিকার নারীর বক্তব্য খুব কম ক্ষেত্রেই শোনা হয়, নির্যাতনের শিকার নারীর হয়ে যখন তার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কথা বলেন, তখন সালিশকারেরা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু-আধটু এরকম হয়ই। তার মানে কি দাঁড়ায়? সালিশে কিংবা পারিবারিক পর্যায়ে সুরাহার ভিত্তিতে এই দম্পতি যদি একসাথে সংসার করেন, তাহলে সামনের দিনেও বউকে চড়-থাপ্পড় কিংবা গুরুতর আঘাত করার অনুমোদন পরোক্ষভাবে আমরা, আমাদের পরিবার এবং সমাজ পুরুষকে দিয়ে দেয়। এখন সেই পুরুষকে, সেই সমাজকে শুধু আহবান জানিয়ে কতটুকু সাড়া আমরা পাব, সেইটা কি হিসাব-নিকাশ করে বলার প্রয়োজন আছে? শারীরীক নির্যাতনের বাইরেও কত রকমের নির্যাতন কি মাত্রায় যে নারীর প্রতি সংঘটিত হয়, সেইটা একান্ত সংবেদনশীল মানুষ ছাড়া বোঝা কস্টাসাধ্য।
নারীকে হেয় করে কথা বলা, বউয়ের বাবার বাড়ির লোকজনকে নিয়ে কথা বলা, তাদের আর্থিক সংগতি, সামাজিক অবস্থান নিয়ে কথা শোনাতে আমাদের কথিত শিক্ষিত সমাজও পিছিয়ে থাকেন না। কারণ আমাদের সমাজ এবং যে সকল প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করেছি, সেগুলি এবং সেইসব প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতি, নিয়ম-কানুনও ভীষণভাবে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত। ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই সন্তান না হওয়ার দায় আমাদের পরিবার এবং সমাজ এখনও নারীর উপরই চাপায়। কথিত পুরুষত্ব দেখাতে গিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা বলে নারীকেই অপমান এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আমি আমার এলাকাতে ছোটবেলাতে একটা কথা শুনতাম। জুতো এবং বউ যার যার, তার তার। যিনি বলতেন তিনি রসিয়ে বলতেন, যারা শুনত তাদের মুখেও হাসির অভিব্যক্তি পরিস্কার বুঝা যেত। এখন বুঝি এইটা নারীর জন্য কতটা অসম্মানজনক। অথচ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছেই আপনি নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা প্রত্যাশা করছেন?
যৌতুক এই সমাজে এখনও টিকে আছে এবং আমরা নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবী করি। এর চেয়ে দ্বিচারিতা আর কি হতে পারি। নারীর গৃহকর্ম, শ্রমের মূল্য এই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কেউই দেয় নাই। যৌতুকের বলি হওয়া নারীর পরিসংখ্যান দিয়ে এর ভয়াবতা বোঝানো যাবে না। কারণ যৌতুক এই সমাজে এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে তার এত শাখা-প্রশাখা যে আপনি কোনটা যৌতুকের মধ্যে পড়ে, আর কোনটা পড়ে না, সেই কূল-কিনারাও করতে পারবেন না। মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার থাকলে বাস্তব চিত্র আমাদের সকলের জানা। আর হিন্দু নারীর তো পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারই নাই। এইগুলি আইন এবং নীতিগত বিষয় কিন্তু উপার্জনক্ষম নারীও কি সব ক্ষেত্রে তার উপার্জত অর্থ নিজের মত ব্যয় করতে পারেন, ভোগ করতে পারেন বরং অনেক ক্ষেত্রেই এই উপার্জনের কারণেই তাকে শারীরীক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
যৌন নির্যাতন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নতুন করে বলার কিছু নাই। কিন্তু বলার আছে সমাজের, প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া, সময়টা কখন ছিল, নারীর সাথে কেউ ছিল কি’না, নারীর পোশাক কেমন ছিল। মানে আমরা প্রত্যেকেই যৌন নির্যাতন এবং নিপীড়কের বিচারের চেয়ে, নির্যাতনের শিকার নারীর দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নিজ বাড়িতে, প্রতিষ্ঠানে এবং নিজের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারাও নারীরা, কন্যা শিশুরা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছেন। এগুলি আগেও হত না, এমন নয়। কিন্তু কথিত সম্ভ্রমহানি, পারিবারিক, সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে নারীরা প্রকাশ করতেন না কিংবা আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিতেন। কিন্তু এখন অনেক ঘটনায় পত্র-পত্রিকার আসে, নির্যাতনের শিকার নারী, কন্যারা প্রকাশ্যে মুখ খোলেন, প্রতিবাদ জানান। কিন্তু তাতে কি অবস্থার খুব উন্নতি হয়েছে?
তাহলে নারী এবং কন্যাদের প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় কি? সেইটা বিশদ আলোচনা। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে, কারিকুলামে এই বিষয়ে কন্টেন্ট থাকতে হবে। সেই কন্টেন্ট পড়ানোর মত, আলোচনার মত, শিক্ষার্থীদের হৃদয়গাহী করে তুলবার মত শিক্ষক তৈরি করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক সকল আইন নারী, কন্যা এবং শিশুদের প্রতি সংবেদনশীল হিসাবে প্রণয়ণ এবং সংস্কার করতে হবে। এই সকল বিষয়ে সমাজে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যাতে পরিবারে, সমাজে প্রতিষ্ঠানে কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে তিনি নিজে কিংবা তার সহ-নাগরিক তার দায়িত্ব পালন করেন, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং রাষ্ট্র সেই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আর এই সকল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে আজই, এখনই। জাতিসংঘের সম্পতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালে সারা বিশ্বে পঞ্চাশ হাজার নারী তাদের ঘনিষ্ঠ জন, জীবনসঙ্গী কিংবা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন, যা ২০২৩ সালে ছিল তিরাশি হাজার তিনশ জন, অর্থাৎ প্রতিদিন সারা বিশ্বে গড়ে ১৩৭ জন নারী তাদের জীবনসঙ্গী কিংবা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন। আমি শুরুতেই বলেছিলাম, কোনো পরিসংখ্যানের আলোকে আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র বোঝাতে গিয়ে এটুকু করতেই হল। কিন্তু আমি বলতে চাই, একজন নারীর জীবনেও যদি এই পরিণতি হয়, সেটাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশের বাস্তবচিত্র আমরা জানি। এই চিত্র পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণে বিলম্বের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। দুনিয়ার সকল নারী এবং কন্যা শিশুদেরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।#




