নিজেকে প্রকাশ করা, জাহির করা কিংবা নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া আমাদের দেশের মানুষের সহজাত প্রবণতা। এখন এই প্রকাশ কিংবা অস্তিত্ব জানান দেওয়ার পন্থাতে ভিন্নতা রয়েছে। কেউ নিজেকে প্রকাশ করতে চাই সৃজনশীলতা তথা সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে, নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, দ্রোহের মাধ্যমে। কিন্তু এই মানুষদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। সিংহভাগ মানুষ সংক্ষিপ্ত রাস্তায় হেঁটে নিজের যশ এবং প্রতিপত্তি চায়। বিলাস, ব্যসন এবং দান-খয়রাতের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব এবং মর্যাদা তথাকথিত সম্মানের কথা জানান দিতে চায়। এই যে নিজেকে প্রকাশ করা, জাহির করা, নিজের অস্তিত্বকে জানান দেবার পথকে সুগম করেছে কথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সেখানে সৃজনশীলতার চেয়ে চমক বেশি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের চেয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য বেশি। এই মাধ্যমের একটা সুবিধা কিংবা অসুবিধা যেটাই বলি না কেন, সেটা হল এখানে আপনি সকল মানুষকে আপনার প্রতিপক্ষ বানাতে পারেন। হয়ত আপনার ব্যক্তিগত কোনো মতামত কিংবা ইস্যুতে একজন আপনার বিপরীতে কথা বলেছেন কিংবা বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এই একজনের বক্তব্যকে আপনি সাধারণীকরণ করে সকলের বক্তব্য হিসাবে উপস্থাপন করছেন। ভূমিকা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। এবার আসল কথায় আসি। মহাসড়কে মই ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে পথচারী পার করা যুবককে নিয়ে গত ২/৩ দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব রসিকতা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই রসিকতা দারুণ সংক্রামক। একবার শুরু হলে সবাই স্রোতে গা ভাসান, স্রোতের বিপরীতে কথা বলার মানুষের সংখ্যাও নিতান্তই হাতে গোনা। এখানে ভিন্ন বিবেচনা, ভিন্ন চোখে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো কিছুকে দেখার, বোঝার, ব্যাখ্যা করার মানুষের বড়ই অভাব। যে বিষয়ে আলাপ শুরু করেছিলাম। মই দিয়ে সড়ক বিভাজক পার করা। এই ঘটনাকে কি আমরা একটু ভিন্নভাবে ভাবতে পারি কিনা? কমপক্ষে কিছু প্রশ্ন তো তুলতে পারি? প্রথম প্রশ্ন হল, টাকার বিনিময়ে যে সেবা লোকটা দিচ্ছেন, সেই সেবা মানুষ নিচ্ছেন কিনা? এখন আপনারা বলতে পারেন এইটা সেবা কিনা। আমি সেই বিতর্কে না গিয়ে বলব, যদি নিয়ে থাকেন, তাহলে জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তারা সেই সেবা কেন নিচ্ছেন? কই আপনারা তো সেই প্রশ্ন করছেন না? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, যে লোকটা অর্থ উপার্জনের জন্য এমন অভিনব কিংবা অদ্ভূদ পেশা কিংবা পন্থা বেছে নিলেন, তার সামনে আর কোনো সহজলভ্য বিকল্প ছিল কিনা? কারণ এই সেবা দিতে গিয়ে তার নিজের জীবনেরও ঝুঁকি রয়েছে। তৃতীয় প্রশ্ন হল, আমরা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া লোকটাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রসিকতা করছি, তারা কেউ সংবাদ মাধ্যমে, ছাপা কাগজে পুরো বিষয়টাকে পড়েছি কিনা? এরকম অনেক প্রশ্নের আলোকে যদি আমরা ঘটনাটাকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমাদের এই রসিকতাবোধ উবে যাবে। নিজেদেরই নিজেদের প্রতি অনুশোচনা জন্মাতে পারে, জন্মাতে পারে করুণা। কারণ, আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ এবং প্রতিষ্ঠান আমাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখায়নি। ঘটনা বিশ্লেষণ করতে শেখায়নি, সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারেনি। তাই তো আমাদের কাছে আইডিয়ার চেয়ে ঘটনা বড়, ঘটনার চেয়ে ব্যক্তি মুখ্য হয়ে উঠে।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি যদি বলি আমাদের কথিত উন্নয়নের যে উপর কাঠামো, সেই কাঠামোতে স্থানীয় মানুষের সুবিধা-অসুবিধা তো বটেই, তাঁদের মনোজাগতিক কোনো বিষয়কেই বিবেচনায় নেওয়া হয় নাই। আমরা যদি ছাপার অক্ষরে কিংবা পত্রিকাগুলির অনলাইন ভার্সনে নিউজটি পড়ি তাহলে, কেন মানুষ ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সড়ক বিভাজক পার হচ্ছেন, তার উত্তর মিলবে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন এক বা একাধিক মানুষ। এই দেশে জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা তোয়াক্কা না করেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তাব্যক্তিরা তাদের খামখেয়ালিপনা কিংবা স্বার্থসিদ্ধির জন্য উন্নয়নের নামে নানা সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দেন। আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই। যে পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে সংবাদ শিরোনামের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজনকে গ্রেফতার করেছে, সেই পত্রিকাতেই কিন্তু উল্লেখ রয়েছে, পূর্বে দুর-পাল্লার বাস থেকে স্থানীয় লেনে যাতায়াতের জন্য সওজ ভবনের সামনে একটা গেইট খোলা থাকত। ওইখানেই শিমরাইল মোড়ে দূর-পাল্লার বাস যাত্রীদের নামিয়ে দিত। কিন্তু কর্তৃপক্ষ গত দুই মাস গেইটটি বন্ধ করে রেখেছে। কেন রেখেছে, তার কোনো উল্লেখ কিন্তু পত্রিকাতে নাই। ঢাকা শহরের ধামমন্ডির সাত মসজিদ রোডে সড়ক বিভাজকের উপর ৫০০ এর উপর গাছ কেটে ফেলল দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। আরো উন্নত সড়ক বিভাজক করার নামে গুরুত্বপুর্ণ ক্রসিংগুলি বন্ধ করে আবাহনী মাঠের কাছে একটা আর জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতালের কাছে একটা এর কাছে আরেকটা ক্রসিং রাখা হয়েছে। ফলে জ্যাম এবং উলটোপথে রিক্সা এবং যানবাহন চলাচল বেড়েছে। সিটি কর্পোরেশন যখন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, তখন এইটা নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছিল, গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে যে, বিষয়টা নিয়ে তাদের সাথে কোনো আলোচনাই হয় নাই। এখন সেই উল্টোপথে যানবাহন চলাচলকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক পুলিশ। কি বিচিত্র এই দেশ! এখানে সরকার চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারে, আমরা পারি না, আমাদের যত রসিকতা- পেটের দায়ে, কিংবা শুধুমাত্র যথাযথ জ্ঞানের অভাবে এমন কাজ করা মানুষদেরকে নিয়ে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলি, পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, রাস্তার ধারে ডিজিটাল ডিসপ্লে, বিশাল বিশাল হোর্ডিং-এ দেখবেন সরকার প্রধানের তো বটেই মন্ত্রী-এমপিদের রাস্তাঘাট, সেতু, উড়ালসেতু উদ্বোধনের ভিডিও ক্লিপিংস, ছবি। এর মধ্যে একটু খুঁজে দেখবেন তো একটা ছবিও পান কিনা যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কোনো শিল্প কারখানা উদ্বোধন করছেন সরকার প্রধান কিংবা কিংবা মন্ত্রী-এমপিরা। তাহলে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ যুবকেরা, কর্মহীন মানুষেরা কাজের জন্য কোথায় যাবেন? এত কথার পর সার কথা যেটা বলতে চাই, সেটা হল, আমাদের কথিত গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একের পর এক এ রকম এক একটি ইস্যু সামনে নিয়ে আসে, আমরা রঙ্গ-রসিকতায় মেতে উঠি। একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, কেন এগুলি ঘটছে? এগুলির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণ কি? আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, আমাদের এই রঙ্গ-রসিকতার আড়ালে জরুরী প্রশ্ন আড়াল হয়ে যাচ্ছে কিনা? আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কোনো কৃতকর্মের দায় তার পরিবারের উপর বর্তায় কিনা? স্রোতে গা ভাসালে সাথে সঙ্গী মিলবে অনেক। কথিত দশজনের একজন হতে পারবেন, এই জীবনে আর এগারো হওয়া হবে না। সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সব সময়ই চায় আমরা এভাবে গোলে হরিবোলের দলে গা ভাসিয়ে চলি, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্র নিরাপদ বোধ করে। কিন্ত নাগরিক হিসাবে আমাদের কাজ হল সমাজের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, এসব অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা। সেটা যদি আমরা না পারি, তাহলে আমরা একের পর এক ইস্যুতে, ঘটনায় রসিকতায় মেতে থাকব, আর রাষ্ট্রযন্ত্র এবং এর সুবিধাভোগী স্বল্প সংখ্যক মানুষ তাদের ফায়দা লুটবে। আসুন নিজেকে প্রকাশ করি, নিজের অস্তিত্ব জানান দিই কিন্তু ভিন্নভাবে। ঋত্বিক ঘটকের কথা ধার করে বলি, আসেন ভাবি, ভাবা প্রাকটিস করি।#