আমার দেখায় আমার বাংলাদেশ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানমন্দির

ফরিদপুরে পল্লীকবি জসিমউদ্দিন’র বাড়ী থেকে বরিশালে নিজ বাড়িতে ফিরবো এবার, যাবো, কিন্ত মনের মধ্যে চেপে আছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের ভাঙ্গারদিয়া গ্রামে থানার বিশ্বের ভৌগলিক গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান- যেখানে কর্কটক্রান্তি রেখা দ্রাঘিমা রেখার সহিত ছেদ করেছে। আরও স্পষ্টভাবে বলা যায়- কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদ বিন্দুটি পড়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। ছোটবেলায় আমরা সকলেই কমবেশি পাঠ্যবই ভুগোলে পড়েছি বিষুবরেখা, কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি বিষয়ে এবং জেনেছি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি গিয়েছে। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের ঠিক কোথায় তা জানতাম না। জানার পর থেকে নিজের কৌতূহলী মন তাড়া করেছে। সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন ধরে।

ভাবছি কিভাবে যাবো? ওখানে পরিচিত কেউ থাকলে ভাল হতো। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল এক ভাইয়ের কথা- নাম মোঃ মাহাবুবুর রহমান, পেশায় ব্যাংকার। বর্তমানে ওনার পোস্টিং ফরিদপুরে। সাথে সাথে ফোন দিলাম ওনাকে। উনি ষ্টেশনে নেই, ফিরবেন অনেক রাতে। মনটা খারাপ হলো। যাওয়া হলো না আমাদের। অগত্যা বাড়িতে ফিরে এলাম। কিন্তু না দেখার অপূর্ণতা হৃদয়ে রয়েই গেল।

বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ভাবছি, আগামীকাল সকালে যাবো। কেননা পরেরদিনও অফিস ছুটি। তাড়াতাড়ি রাত্রির ভোজ পর্ব শেষ করে শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হলাম। বন্ধুর মটরবাইক নিয়ে রওনা হলাম ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে। মাহবুব ভাইয়ের বাসায় এসে দেখি সকালের জলখাবারের ব্যাপক আয়োজন। ভাবী নানা পদের খাবার দিয়ে টেবিল সাজিয়েছেন। জলখাবার খেলাম কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকায় মনভরে খাবার খেতে পারলাম না। অত ভোরে কষ্ট করে জলখাবারের আয়োজন করায় ভাবী আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে ভাইকে বাইকের পিছনে বসিয়ে তারই দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ভাঙ্গারদিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটছি। একে তো মাটির রাস্তা তার উপর উচু নিচু, বেশ ঝক্কি পেতে হচ্ছে।আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে টের পেলাম রাস্তা খারাপ কাকে বলে! দুই হাতেই বেশ ব্যথা পেলাম। খুব ধীরে এবং থেমে থেকে বাইক চালাতে হচ্ছে। দূর থেকে সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। তার মানে ভাঙ্গারদিয়া গ্রামে প্রবেশ করেছি। স্থানটি যতটা না দেখার তারও চেয়ে বেশী অনুভবের। মাথার উপরে নীল আকাশ আর চারিদিকে ধানের ক্ষেত, সবুজের হাতছানি। তাকালেই মনের ভেতরে আনন্দ অনুভূত হয়। আমি অপ্লক তাকিয়ে আছি, বাতাস আমার শরীর ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে আমি গভীরভাবে শ্বাস নিচ্ছি। আহ! কী শান্তির পরশ আমাকে ভেতরে অনুভুত হচ্ছে। আসতে আসতে পথে যতটা কষ্ট পেয়েছি, সেসবের রেশ কেটে গেছে। এক উৎফুল্ল মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি আমি, তারই স্বাদ অনুভব করছি প্রাণভরে।

ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীতেকর্কটক্রান্তি, মকরক্রান্তি ও বিষুবরেখা নামে ৩টি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত রেখা আছে। একইভাবে আরও ৪টি উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত রেখা আছে, সেগুলো হলো ০ ডিগ্রি, ৯০ ডিগ্রি, ১৮০ ডিগ্রি এবং ২৭০ ডিগ্রি দ্রাঘিমা। অর্থাৎ এই ৪টি উত্তর-দক্ষিণ রেখা এবং ৩টি পূর্ব-পশ্চিম রেখাÑ সব মিলিয়ে ১২ জায়গায় ছেদ করেছে। আর এই ১২টি বিন্দু হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু। মোট এই বারোটি বিন্দুর ১০টি বিন্দুই পড়েছে সাগর ও মহাসাগরে এবং সেখানে কেউ যেতে পারে না। এর মধ্যে মাত্র দুটি ছেদ বিন্দু পড়েছে স্থলভাগে। এর একটি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গাদিয়া গ্রামে অপরটি পড়েছে সাহারা মরুভূমিতে, যেখানে যে কারো পক্ষেই যাওয়া অসম্ভব। কেউ যেতে পারে না। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদ বিন্দুটি পড়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় ভাঙ্গারদিয়া গ্রামে।

ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানে প্রতি বছর জুন মাসের ২১ তারিখ দুপুর ১২টার সময় কেউ যদি বাইরে দাঁড়ায় এবং আকাশ পরিস্কার থাকলে যে কোন ব্যক্তি আবিষ্কার করবে সূর্য ঠিক মাথার উপর এবং সেজন্যে সেখানে সেই ব্যক্তি কোনো ছায়া পড়ছে না। কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার সেই ছেদ বিন্দুতে সেটি একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য।যে কেউ চাইলেই এসে ঘুরে যেতে পারে, গর্বিত হতে পারে কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় দৃশ্যমান এই ছেদ বিন্দু পা রেখে।

লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘একটি স্বপ্ন’ প্রবন্ধে বলেছেন, জমি চাষ করার সময় অনেক মানুষ এই বিন্দুটির উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে কিন্তু এই জায়গাটির অচিন্তনীয় ভৌগোলিক গুরুত্ব অনুভব করে সম্ভবত আর কেউ এখানে পা দেয়নি।’

ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মানমন্দির (বিজ্ঞান গবেষণাগার) ও পর্যটন কেন্দ্র। এবং এই স্থানটি নাম দেয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানমন্দির।’

চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটা হাঁটলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আনন্দভরা উচ্ছ্বসিত মন নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!