উৎসবের কর্দম

বাংলার বুকে যে কোনও উৎসবে বরাবর ধরা দিয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আমেজ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের কালীপুজোও সেই একই সুরে গাঁথা। গ্রামের নাম হাড়িপুকুর। হিলি থানা এলাকায় মুসলিম অধ্যুষিত এই গ্রামে দেশভাগের পর থেকেই সাড়ম্বরে পূজিতা মা কালী। গ্রামে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা কম বলে কখনওই ভাটা পড়েনি দেবীর আরাধনায়। প্রথাগত ভাবে সারা বছর হিন্দু পুরোহিত পুজো করলেও এই সংক্রান্ত বাকি সব দায়িত্ব সোৎসাহে পালন করেন স্থানীয় মুসলিম পরিবারের সদস্যরাই।

এমনকি, বছরভর মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের ভারও সামলান তাঁরাই। কাঁটাতারের বেড়া কিংবা ধর্মের ভেদাভেদ ছায়া ফেলতে পারেনি তাঁদের এই একসূত্রে গেঁথে থাকায়। দেশভাগের পরেও এতটুকু খামতি হয়নি পুজোর কোনও সাজসজ্জায়। ম্লান হয়নি উৎসবের আনন্দ বা ঐতিহ্য। দীপাবলির আলোয় তাই এখনও সেজে ওঠে পুরো গ্রাম। দুই বাংলার সীমান্ত রক্ষীরা থাকেন পুজোর আয়োজনে এই মন্দিরে মূর্তিপুজো হয় না। হয় শুধু ঘট পুজো। তবে আড়ম্বরে কোনও দিনই ত্রুটি নেই এতটুকুও। ভারত সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ) ও বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী (বিজিবি)- দুই বাহিনীই এই উৎসবে সমান ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। তাঁদের প্রত্যেকের উৎসাহে ঝলমল করে হাঁড়িপুকুরের কালীপুজো। পুজোর দিনে খিচুড়ি ভোগ হয় বিপুল আয়োজন করে।

ধর্মের ভাগাভাগি মাথায় না রেখে সবাই মিলে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই, আশপাশের গ্রাম থেকেও বহু মানুষ ভিড় জমান এই পুজোয়। উৎসবের মূল সুর হয়ে থেকে যায় সম্প্রীতি।

এই সম্প্রীতির চিহ্ন থাকে গ্রামে। এবারের পুজো তে দেখা গেল, প্রচুর বোরকা পরিহিত মহিলা ঠাকুর দেখতে গেছেন। দুর্গা হয়ে উঠেছে সকলের উৎসব। সব ধর্মের মানুষের। গ্রহণ করেছে দুর্গা উৎসবকে সব জাত ও ‘বদজাত’। কিন্তু ধর্ম তো কেবল বাহ্যিক ব্যাপার। এই রকম ছিল বাংলার সংস্কৃতি। কিন্তু অধুনা শহরের এক দুটি পুজোতে দেখা গেল, ঠাকুর দালানে ওঠা, পুজোতে চিরকাল অংশ নেওয়া কিছু জন্মসূত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে ধর্ম তুলে দালানে উঠতে বারণ করা। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা খুব মনে হয়, মুসলমানদের উৎসব এ বাংলাতে এখনও উপক্ষিত। ঈদের উৎসবে এখনও স্কুল কলেজের পরীক্ষা ফেলা হয়। ঈদ উৎসব উপলক্ষ্যে একদিন মাত্র ছুটি থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। বিষয়টি দুঃখজনক।

আর একটি কথা – ঈদে কী খাবার হয় হিন্দুরা অনেকে জানেন না। তার কারণ মুসলমান সম্পর্কে একটা সঙ্কোচ থেকে গেছে কোথাও যেন। সিমাই, আর বিরিয়ানি বাদেও হালিম, ক্ষীর, ফিরনি এখনও অপরিচিত অনেকের কাছেই। এমনকি বিদেশি বার্গার, কন্টিনেন্টাল, পিৎজা এখন ঘরে ঘরে জনপ্রিয়তা পেলেও কাছের মানুষদের খাবার আমরা চিনি না। চিনি নি। তাছাড়া অনেকের ধারণা মুসলমান মানেই মাংস খায়।

আর একটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। উর্দুর মত অভিজাত ভাষা শেখার ঝোঁক কমেছে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে। আরবি, ফারসী এখন উপেক্ষিত। সেটা কী কোনও প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নয়?

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের সময় ব্যর্থ আন্দোলন সম্পর্কে “লোকহিত” প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মাটির পরে ঘটি ঠুকিলেই হইবে না।’ —মুসলমানদের শ্রেণিকে একসময় এক করে দেখেনি আন্দোলনকারীরা। আর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তাঁরা অংশ নেবেন এ ভাবনা বাতুলতা মাত্র। —ঠিক এক ঘটনা ‘ঠাকুরদালান আমাদের’ বলে- যখন সংখ্যাধিক মানুষ মনে করে, তখন বিপদের সীমানা বন্যার জলের মত ঢুকে পড়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন আর জাত ধর্ম এসব বিবেচনা করার সময় থাকে না! এই তো কিছুদিন আগেই ভয়াবহ করোনা কী সেকথা জানায়নি?

একবিংশ শতকে যুদ্ধ, অতিমারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিম্নবিত্ত পরিণত হওয়ার দিকে যাত্রা— ভয়াবহ সঙ্কট হয়ে এখন মাথা তুলে হিমশৈলের মত দেখা দিচ্ছে। চোখে ঠুলি পড়ে থাকলে কী আর করা যাবে? সমবেত হতে হবে ঐ হাঁড়িপুকুরের মত, ঠাকুর দালানের গল্প এখন অচল পাঁচ পয়সার মত দূরে সরাতে হবে।
সরাতেই হবে।♦

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!