রূপকান্ত তার দুই চোখ দিয়ে কেমন দূরাগত এক বিভ্রম কিংবা ভ্রম নিয়ে এই উত্তরদেশের উত্তর শিথানে প্রবাহিত নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। সে কি নদীজলপ্রবাহ দেখে আদতে কিঞ্চিৎ আনমনা হয়ে পড়ছিল! না কি তার দু চোখের ভেতরের অন্তর্গত কোন এক বিষন্নতা তাকে মরন আর জন্মের এক চিরায়ত ধানজমির পরিসরের বিস্তৃত এক বিস্তারের ভেতর ক্রমে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল!
তখন সন্ধ্যা পূর্ববর্তি সময়কাল। আকাশ বাতাস পরিধি জুড়ে একটা মন কেমনের স্তব্ধতা।
এভাবেই তো দিনের পিঠে দিন যায়। দূরের কোন বনভূমির খুব গহীন থেকে সেই কবে শুনে ফেলা জখম বাঘের কান্না আরো আরো স্মৃতিময় করে তোলে রূপকান্তকে!
নিকটবর্তী নদীতে সারি বাঁধা নৌকো থেকে কোন এক মাঝির কণ্ঠ থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরোনকালের কোন এক গানের কলি-
‘এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পারের কিনার
ভবের হাট ভাঙ্গিয়া গেইলে রে
কেউ তো কারো নয়।’
এই গান এই বুকের ভেতর হাহাকার তৈরি করা সুর এই নদী এই নৌকো এই প্রায় সন্ধ্যাকাল নিয়ে এই উত্তরদেশের বুকের মধ্যে জেগে উঠতে থাকে এই অতিপ্রাকৃত মহাজগৎ যেখানে প্রাচীন প্রবাদের মত ক্রমে জায়মান হয়ে উঠতে থাকেন রূপকান্ত তার সব আর সমস্তটুকু নিয়েই।
২.
ঘোড়াডাঙার মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে, গরু জল খাওয়া ঘাট অতিক্রম করতে করতে, ডাকাতিয়ার বিল ছুঁয়ে ছুঁয়ে রূপকান্ত তার স্বপ্নের শাখা প্রশাখাকে কখন কিভাবে যে ডানা মেলা পাখির বিস্তৃতি দিতে শুরু করে সেটা কিন্তু কেউ বুঝতেই পারে না।
দীর্ঘ একটা শরীর নিয়ে শরীরের মস্ত ছায়া নিয়েই সে প্রবেশ করে এরাজ ধনীর দেশে। জোড়া পুকুরের দেশে। কুড়া দহ বিল খামারের দেশে। যেখানে বৃক্ষলতার ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে বেড়ায় আবহমানের
সেই জোড়া মহিষ। তাদের গলায় জোতদারের পরিয়ে দেওয়া তামার ঘন্টা।সেই ঘণ্টার শব্দ অবিকল বাদ্য বাজনার মতোই বাজে,বাজতেই থাকে খাল বিল নদী পাথারের পরিধিতে।
রূপকান্ত হাঁটতে থাকে। তাকে তো এভাবেই হেঁটে যেতেই হয়। তার শরীরের ছন্দে মাঝে মাঝে মন্থরতা এসে গেলে সে নিজেকে তামাক বাড়িতে গান গাইতে থাকা, নাচ করতে থাকা পুরনো কালখন্ডের
নাচুনিদের কথা মনে করে। তার শরীর অধিগ্রহণ করে নেয় গান আর গান, যার সুরের দাউদাউ আগুনে জীবনভর তাকে পুড়তে পুড়তে খাক হয়ে যেতে হল।
গান ঘুরে ঘুরে উড়ে যেতে থাকে তখন আস্ত একটা
নদী ও জলের আখ্যানের ভেতর-
‘কলসির পানি মাঝি যায় ঢালিয়া
কলসি হইল মোর খালি রে
হায়রে কলসিতে নাই মোর পানি রে।’
এভাবেই তো এরাজ ধনীর দেশে মানুষের পায়ে পায়ে উড়ে যায় ধুলোর ঘূর্ণি।
রূপকথার পালঙ্কের পাশে তখন সাপের ফণার হিসহিস।
৩.
উজানের দিকে তাকিয়ে কি দেখে রূপকান্ত!সে কি তার চোখের মুখের পেশির তরঙ্গ দিয়ে এক ঝাঁক পাখিদের উড়ে যাবার দৃশ্যের কাছে খুব মন্থরলয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে!উজান আকাশে কি মেঘ জমেছে!না কি ধুলোর ঘূর্ণি ছুটে আসতে চাইছে সেই উজান দেশ থেকেই!
এরাজ ধনীর বংশের সেই কবেকার জোত জমি আর প্রতিপত্তির গল্প এখন তো গাঁথা কিংবা শোলোকের মত জনপদ জনপদে প্রায় প্রতিদিনই নুতন কোন পরিবর্ধিত গল্পের মতন হয়ে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পরতে থাকে।
এভাবেই তো নুতন একটা পর্ব বিন্যাস শুরু হয়ে যায়।
রূপকান্ত তার ভ্রম ও ভ্রান্তি নিয়েই আবারও যাত্রা শুরু করে উত্তর দেশের নুতন কোন জেগে ওঠা চরের কিংবদন্তির দিকে।
তখন সন্ধ্যা ঘনতর।তখন রতপাখিদের ডানায় পির ফকিরের দোয়া।
তখন গ্রাম্য পথে মহিষের গাড়ি চলে। সেই গাড়ির নিচে ভুসো মাখা মায়াবী লন্ঠন দোলে।
আর সব ছাপিয়েই জেগে ওঠে গান-
‘আজি মৈশাল বন্ধু মোর
হারেয়া গেইছে রে।’
চলবে…