১০.
চর কালপানি দিয়ে মন্থর লয়ে ছুটতে শুরু করে মজনু শাহের ঘোড়াটি।বাদামি কেশর। নিভৃত আর মায়াময় চক্ষুদ্বয়। মজনু তার এই ঘোড়াটি কিনেছিল ছত্রশালের হাটে। বিবি ফুলজান ঘোড়াটির নাম রেখেছে সুমি। এই ঘোড়া নিয়ে, ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ধান পাট তামাক নিয়ে এক হাট থেকে আরো আরো দূরে কাছের হাটগুলোতে ঘুরে বেড়ায় মজনু। মজনু শাহ।ভালো বাঁশি বাজাতে পারে বলে লোকমুখে তার নাম মজনু মাস্টার। ধুবুরি শহরের এক কবি মজনু আর তার ঘোড়াটিকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিল। সেই থেকে গঞ্জ হাটে মজনুর বেশ কদর। খাতিরদারি।
মাঝে মাঝে মজনু মনের সুখে ফাঁকা রাস্তায় সুমিকে ছোটাতে ছোটাতে গলা ছেড়ে গান ধরে-
“আরে চলে রে মোর ঘোড়ার গাড়ি রে
কাদো পন্থ দিয়া
আরে নওদারি নাইওরি গুলা
দেখি থাকে চায়া রে”
আমরা দেখি মস্ত এক আবছায়ার ভিতর লীন হয়ে যাচ্ছে মজনু শাহের ঘোড়াটি।
১১.
জীবন জীবনের মতন। মরণঘেরা জন্মঘেরা হাসি আর কান্নার। জীবনের পর জীবন কেটে যায়। চাঁদের রাত পেরিয়ে মজনুর ঘোড়াটি সারারাত হেঁটে হেঁটে চলে আসে গঙ্গাধরের উজানে। সেখানে তখন ভোরের আলো আর বাতাসের ভেতর মুনসি করিমের কয়েকশো “বাথানের মহিষ” ব্যপ্ত এক সিলুয়েট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মজনুর ঘোড়াটি,বলা ভালো মজনু মাস্টারের ঘোড়াটি তখন কিছুটা দ্বিধা নিয়েই মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে থাকে আরো আরো চাঁদের রাতের দিকে। সে এক মস্ত পর্যটনের মতন হয়তো বা!
মজনু শাহ কি এবার রওনা হবে নদী গঙ্গাধরের উজানে। তামারহাট হয়ে গৌরীপুর হয়ে পানবারির জঙ্গলে। সেখানে “হাতি ধরা ক্যাম্প” বসিয়েছেন গৌরীপুরের জমিদার লালজী রাজা। সেই ক্যাম্পে দশ দশটি জংলী হাতিকে “ফাঁস পদ্ধতিতে” গহিন জঙ্গলের ভেতর থেকে নিজস্ব কুনকি হাতির সাহায্যে ধরে এনেছেন লালজি রাজা।
এখন এই “হাতি ক্যাম্পে” প্রশিক্ষণ চলছে সেই জংলী হাতিদের শান্ত করবার, পোষ মানানোর কাজ।
সন্ধ্যেবেলায় চারপাশ নির্জন হয়ে গেলে মাহুত, ফন্দি, দফাদার, পাতাওয়ালাদের সক্রিয় সহযোগিতায় শুরু হয় সেই প্রশিক্ষণের কাজ।
এ বড় কঠিন শ্রমের কাজ। মধ্য রাত পর্যন্ত এই পর্ব চলে।
আর এই প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয় নানান ধরনের লোকগান। সেই গানের ছত্রে ছত্রে হাতি, মাহুতের কথা উচ্চারিত হয়। যেমন-
একজন গাইছেন প্রথম লাইন-
“আল্লাহ আল্লাহ বল রে ভাই
হায় আল্লা রসুল”
মাহুত ফান্দি র দল একযোগে দোহার দিয়ে গাইছে-
“ভুটান মহলের হাতি রে ভাই
হায় আল্লা রসুল”
১২.
তখন চারপাশের পৃথিবীতে অদ্ভুত এক রহস্যময়তা জেগে ওঠে। শুরু হয় নুতন এক বিনির্মাণ পর্ব।
আর হাতি ক্যাম্পের চারপাশে ছড়ানো গহিন বনভূমি থেকে ভেসে আসতে থাকে বুনো হাতির ডাক।
লালজি রাজা দূরাগত এক আত্মমগ্ন উদাসীনতায় বাজাতে থাকেন নিম কাঠের দোতরা।
জঙ্গল থেকে ধরে আনা সেই হাতিদের ঘিরে তখন মাহুত ফান্দিরা নাচতে থাকে, গাইতে থাকে গান-
“ও মোর গণেশ হাতির মাহুত রে
ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন হস্তির শিকারে”
এই রচিত ঘোরের মধ্যে একসময় দেখা যায় লোকগানের সুরের দোলায় কেমন শান্ত হতে থাকে।
সেই জংলী হাতিরাও।
এই ছবিগুলি জুড়ে যেতে থাকে অন্তহীন সব ছবির সঙ্গে।
আর নদী মাঠের শিথানে ক্রমে আবছায়া হয়ে যেতে থাকেন রূপকান্ত বয়াতি কিংবা রূপকান্ত গিদাল।#