এই মুহূর্তে প্রিয়াংশু চৌধুরী অনেক বড় ডাক্তার। পাকাপাকি ভাবে বিদেশে চলে যাবার সবরকম প্রস্তুতি সারা। স্ত্রী রাইমা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে ব্যস্ত। এখন হাতে সময় কম। কবে আবার দেশে ফিরবে তার সম্ভাব্য মাস, বছর কারোরই জানা নেই। আসলে ইচ্ছেও নেই এদেশে থাকার বিন্দুমাত্র। এমন সুযোগ বারবার আসে না কারো, কপাল একেই বলে। সত্যি কথা বলতে কি বিদেশে যাবার আশাটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল কিন্তু স্বপ্ন যে এভাবে সত্যিই সামনে এসে দাঁড়াবে ভাবতেই মনটা কেমন হয়ে যাচ্ছে বারবার। স্বপ্নের দেশটা প্রতিনিয়ত কড়া নাড়ছে সামনে এসে।
মা’কে এখন ঠিকঠাক জায়গা মতো পৌঁছে দিতে পারলে হয়। নিজের দেশ, নিজের মাটি সব ছেড়ে বিদেশে যেতে মোটেই রাজি নয় মা। প্রিয়াংশু আক্ষেপ করছিল তাই বন্ধুদের কাছে। কাছের দু-একজন বন্ধু বলেছিল “সেকি! মাসীমাকে গিয়ে আমরা বোঝাই?” প্রিয়াংশু বলেছিল “লাভ নেই রে, মা রাজি নয়।”
রাইমা বাচ্চাকে নিয়ে, তাছাড়া নিজস্ব কিছু কেনাকাটি, বিউটি পার্লার, মা-বাবা-বোনের জন্য টুকটাক এটা সেটা কেনা, এ সব নিয়েই চূড়ান্ত ব্যস্ত। সেদিন সন্ধ্যার সময় আয়েশ করে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল আর চলছিল তুমুল আড্ডা। গল্প ও আড্ডার মাঝেই রাইমা বলে উঠল “তাড়াতাড়ি আমেরিকা ঘুরতে আসার প্রস্তুতি নাও বাবা। আমি কোনো কথা শুনব না কিন্তু। “এরপর বোনের দিকে তাকিয়ে বলল ” সাত আট মাসের মধ্যে যদি তোরা সবাই আমার ওখানে না গিয়েছিস তো দেখবি আমি আর এদেশে আসবই না।” দিদির কথায় রক্তিমা বলে ”আরে সাত আট মাস কেন? তার আগেও তো যেতে পারি? ”রাইমা হেসে বলে ”দেখব, দেখব।”
আজ বাজার থেকে সোজা মায়ের কাছে এসেছে রাইমা। বোনকে আর ওর বরকেও ডেকে নিয়েছে ফোন করে। জমজমাট গল্প আড্ডার মধ্যেই মা বললেন ”হ্যারে রাইমা তোরা কি সত্যিই পাকাপাকি ওখানে থেকে যাবি?”
– আগে তো যাই। প্রিয়াংশু আগে সব দিক গুছিয়ে নিক, তারপর ভাবা যাবে, তাছাড়া এই দেশে আছেই বা কি?
– তা ঠিক বলেছিস দিদি, এই আমার বরকে দেখ। ওর মা, বাবা ওকে ছাড়তেই চায় না। কেমন আঁকড়ে ধরে ছেলের ভবিষ্যতটা নষ্ট করছে।
রক্তিমার কথা শুনে ওর বর দীপায়ন এবার চোয়াল শক্ত করে, রক্তিমা চুপ করে যায় আর কথা বাড়ায় না।
মা বলেন “তোরা সবাই রাত্রে খেয়ে যাবি কিন্তু।”
রাইমা ফোনে প্রিয়াংশুকে বলে দেয় “রাতে ফেরার পথে এ বাড়ি হয়ে যেও। মা রান্না করেছে আমাদের জন্যে।” প্রিয়াংশুর ইতিবাচক উত্তরে রাইমা হেসে বলে “আজ রাতে এখানে থেকে গেলে হয় না? “ওপ্রান্তে প্রিয়াংশু বলে “জো হুকুম বিবিরাণী।” আসলে প্রিয়াংশুর মনটা এখন খুব ফুরফুরে, এমনিতেও বউকে শ্রদ্ধা করে যথেষ্ট।
রক্তিমাকে দীপায়ন জানিয়ে দেয় “আর দশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ব কিন্তু।” রাইমা অবাক হয়ে বলে ”সে কি দীপায়ন! তোমরা খেয়ে যাবে তো?”
– না দিদি আজ হবে না, বাড়িতে বলা নেই সেভাবে।
– ফোন করে দাও।
– রান্না হয়ে গেছে এতোক্ষণে। এখন ফোন করে লাভ নেই। তাছাড়া মা, বাবার বয়স হয়েছে, ওদের আমি এভাবে বলতে পারি না।
রাইমা চুপ হয়ে যায়। রক্তিমাও আলাদা করে আর কিছু বলে না। কিছুক্ষণ পরে চলে যায় ওরা। মুখ ফসকে দীপায়নের মা, বাবা সম্পর্কে ঐসব কথা বলা ঠিক হয়নি। নিজের ওপর নিজের-ই কেমন রাগ হয় রক্তিমার।
দিদির সাথে প্রতিযোগীতা দিতে গিয়ে দীপায়নকে ছোট করা হয়েছে। নিজের কাছে নিজেকেও কেমন ছোট লাগছে রক্তিমার। তাছাড়া বিয়ের পর থেকে ভালোই তো আছে সে। মা’কে, বাবাকে যথেষ্ট সম্মান করে দীপায়ন। বিয়ের পর একটাই আবদার ছিল দীপায়নের “তোমার সব কিছু মেনে নেব কিন্তু আমার মা, বাবাকে নিজের মা, বাবা ভাবতে হবে, আর কখনোই যেন বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি না হয়। ”
রক্তিমা কথা রেখেছিল। দিদির মতো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অতো স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও যথেষ্ট উচ্চ মনের এবং জ্বলজ্বলে একটি পরিবারকে পেয়েছিল একথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, মনেও ছিল শান্তির বাতাবরণ।
রক্তিমা আর দীপায়ন চলে যাবার পর রাইমা মনের সব রাগ প্রকাশ করতে লাগল তার মা, বাবার ওপরে। দীপায়নের জীবনে কোনো স্বপ্ন নেই, ইচ্ছে নেই, মা বাবার কোলে বসে থাকুক সারাজীবন। জীবনে উঁচু জায়গায় পৌঁছতে গেলে একটু স্বার্থপর হতে হয়, প্রিয়াংশুর ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে একের পর এক আলোচনায় মুখর হলো।
।। দুই।।
বাবাই তখন ছোট, মা-বাবার একমাত্র সন্তান। অসিত চৌধুরী একটা ছোট কারখানায় কাজ করেন, সামান্য বেতন। স্ত্রী মালা দিন রাত সেলাই করে সংসারের অভাবকে ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। ছেলেকে ভাল স্কুলে ভর্তি করানো, প্রতিদিন নিয়ম করে ছেলের জন্যে ফল, দুধ, মাখন -ঘি, শাকসবজি, মাছ, মাংস যেভাবেই হোক প্রতিদিনের তালিকায় রাখা। যত্ন, স্নেহ, মায়া, মমতাও ছিল এই পরিবারের আরো এক সম্পদ। সন্তানকে বড় করতে যা যা প্রয়োজন তার কোনো কিছুর-ই ত্রুটি ছিল না। নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল বাবাই। তার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছে মালা। ছেলেকে সবরকম ভাবেই তৈরি করেছে , এমনকি নিজেকেও। দিদি বলেছিলেন “বাংলা স্কুলে কি ছেলে মানুষ হয় না! আমদের ছেলে মেয়েরাও তো বাংলা স্কুলে পড়ছে। সাধ্যের মধ্যে কর সবকিছু।”
মুখে মুখে কখনো তর্ক করেননি মালা। মনে মনে ভেবেছেন রাজ্যে চাকরি কোথায়। নিজের জীবনে যা করতে পারেন নি, ছেলেকে দিয়ে তা ভরিয়ে তুলবেন। একটাই তো সন্তান। ওর জন্যে এটুকু না করলে নিজের কাছে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবেন না যে। আজ রাজ্যের অবস্থা কতো খারাপ। জন্মের পর থেকে একই অবস্থা। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাটা ভীষণ জরুরি যে। নিজের জীবনে নিজেই ভুক্তভোগী। আজ এই রাজ্যে গ্র্যাজুয়েশনের কী -ই বা মূল্য, যতোই ভাল রেজাল্ট থাক। এসব আলোচনা মালা কারো সাথেই করত না, স্বামীকে বোঝাতেন। কথার মধ্যে যুক্তি তো আছেই। স্ত্রীর কথাকে অমান্য করেননি কখনো বরং সব সময়ই সহমত পোষণ করেছেন। তাই আত্মীয়স্বজনদের থেকে একটু দূরত্ব-ই বজায় রেখেছেন বরাবর। একটু বড় হতেই প্রতিটি সাবজেক্টের জন্য আলদা আলাদা প্রাইভেট টিউটোরের প্রয়োজন পড়ল। ছেলের স্বপ্ন পূরণের লক্ষে তার যা যা প্রয়ো জন সব কিছুরই আয়োজন চলল। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল প্রিয়াংশু।
কখন যে বোর্ড এক্সামের রেজাল্ট বেরনোর সময় চলে এলো এবং যথারীতি দুর্দান্ত রেজাল্ট। খুশির বন্যা বয়ে গেল স্কুল, পাড়া, পরিবার এবং বন্ধু মহলে। ছোট্ট বাড়িতে তখন খুশির উৎসব।
শুরু হল এরপর প্রবল লড়াই। ডাক্তার হবার তীব্র ইচ্ছাকে সার্থক করতে এরপর চলল তারই প্রস্তুতি। রাত জেগে সেলাই-এর কাজ করা ছাড়াও, টুকরো আরো কিছু কাজে দিনগুলো কিভাবে যে কেটে যেতে লাগল। আসলে স্কুলের খরচ, ইংলিশ মিডিয়ামের প্রাইভেট টিউটোরের আকাশ ছোঁয়া খরচ, এতোটা পরিশ্রমের ধকলে চোখের তলায় কালি পড়তে বেশি দিন সময় লাগল না। মা-বাবার আদরের বাবাইও একমনে পড়তে লাগল কোনোদিকে না তাকিয়ে। সামনে শুধুই একের পর এক পরীক্ষার প্রস্তুতি।
ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষায় যথারীতি ভাল ফলাফল আর সময়ের হিসেব মেনেই একদিন ডাক্তারি পড়তেও চলে গেল কলকাতা। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা, আর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় গ্রাস করল যেন। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল। এতো শূন্যতা এর আগে কখনো অনুভব করেননি। অসিত চৌধুরীও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন। মনের মধ্যে দুজনের একই প্রশ্ন, পারবে বাবাই মা-বাবাকে ছেড়ে এইভাবে এতোদিন থাকতে? কোনদিন থাকে নি যে।
এই প্রথম সন্তানকে ছেড়ে থাকা। ছোট্ট বাবাই কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। অসিত চৌধুরীর বুকের ভেতরটা ব্যথা করে প্রায়ই। এই তো সেদিনও কাজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকলেই এক ছুটে বাবাই দরজার সামনে এসে দাঁড়াত। কোনোদিন আবার লুকিয়ে পড়ত দরজার পেছনে বা খাটের তলায়। মাকে বলা নিষেধ, বাবাকেই খুঁজে বের করতে হবে। অসিত বলতেন “কোথায় গেল আমার বাবাটা? কোথায় গেল?” তবুও সাড়া নেই। শেষে কাঁদো কাঁদো গলায় যখন বলতেন “আমার বাবাটা আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, যাই, অফিসে চলে যাই। আর বাড়িতে আসব না।” এই শুনে খাটেরতলা থেকে এক ছুটে বেরিয়ে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আধো আধো গলায় বলত “এইতো আমি এসে গেছি , এসে গেছি।” মালাও এসে তাদের খেলায় যোগ দিতেন তখন।
রান্না ঘরে গিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন মালা। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? সন্তান বড় হলে তো বাইরে পড়তে যাবেই। অসিত চৌধুরী বোঝায় মালাকে। “যাও না দিদির বাড়ি থেকে দুদিনের জন্যে ঘুরে এসো, মনটা ভালো লাগবে।”
মালা হেসে বলেন “তা কি করে সম্ভব? এতোদিন ছেলের পড়াশোনার জন্য কারো সাথেই তো যোগাযোগ করা হয়নি। এখন হঠাৎ করে গেলে কি ভাববে?”
– গিয়ে দেখোই না একদিন, আগে থেকে কেন এতো ভাবছ বলোতো? যাও ঘুরে এসো, দেখো ভাল লাগবে মনটা।
।। তিন।।
একদিন সত্যিই গেল দিদির বাড়ি। মালাকে দেখে সবাই একটু অবাকই হলো। আসলে ছেলে ছেলে করতে করতে কারো সাথে সে’ভাবে যোগাযোগ করাই হয়ে ওঠেনি এযাবৎ। আজ দিদির বাড়ি যাওয়ার সময় কিছু ফল, মিষ্টি আর দিদির ছোট্ট নাতনির জন্যে চকলেট নিল সঙ্গে।
মালাকে দেখে হৈ হৈ পড়ে গেল সারা বাড়িতে। মালার দিদি দোলা জড়িয়ে ধরলেন বোনকে, চোখে জল দু’বোনের। কতো গল্প -কতো কথা! বাবাইকে নিয়ে ওদের গর্বের শেষ নেই। এরপর বাবাই কি পড়বে, ওর স্বপ্ন কি! এতো ভালো পার্সেন্টিজ, পরিবারের কতো গর্বের সন্তান ইত্যাদি। দিদির বড় ছেলে বাপ্পা খুব আন্তরিক। ছোট মাসী কি খেতে ভালোবাসে মিঠুকে বারবার মনে করিয়ে দিল।
…সত্যি রে দিদি, বাপ্পার বউ মিঠুটা কি ভাল হয়েছে।
মালার কথায় হেসে দোলা বললেন “সত্যিই মিঠুটা খুব ভালো হয়েছে, গানটাও ভাল গায়। ”
দিদিই এ বাড়ির প্রধান। দিদির কথাই শেষ কথা। দিদির ছোট ছেলে বিট্টু বলল “মাসীমনি এরপর মেসোকে না নিয়ে আসলে দেখবে তোমাকে কি করি।” ছোট ছেলের কথা শুনে দোলা বললেন “এরপর একা আসুক দেখি, ঘরে ঢুকতে দেব আর।”
সারাদিন অনেক খাওয়া দাওয়া হল। কতো গল্প, আড্ডা। ফেরার সময়ে অসিতের জন্যে মিষ্টি এবং নানারকম মোয়া, নারকেলের নাড়ু এবং গাছের পেয়ারা, কলা, আম ব্যাগ ভর্তি করে দিল দুই ভাই মিলে। তারপর এক বন্ধুর গাড়ি ঠিক করে দিয়ে বলল মাসীমনিকে যেন একেবারে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। মালা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ড্রাইভার ছেলেটি বলে উঠলো “আপনি নিশ্চিন্তে বসুন। আমি বাপ্পার বন্ধু, আমি ওদিক দিয়েই যাব, আপনি কেন এতো ইতস্তত করছেন? আপনি বাপ্পা বিট্টুর মাসীমনি তার মানে তো আমারও মাসীমনি তাই না?”
মালা অবাক চোখে ছেলেটির দিকে তাকাতেই ছেলেটি আবার বলে উঠল “এতোটা রাস্তা আমি একা যাব, আপনি থাকলে বেশ হবে, দুজনে গল্প করতে করতে দিব্যি যাওয়া যাবে।”
গাড়ির সামনে পরিবারের সবাই মিলে এসে দাঁড়ালো, মালার দুচোখ জলে ভরে উঠল, অসিত জোর করে ভাগ্যিস পাঠিয়েছিল।
সারাটা রাস্তা সেদিন বাপ্পার বন্ধু রাজুর সাথে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরল। কতো গল্প, কতো কথা! বড় আপন মনে হলো ছেলেটিকে। রাতে ঘুমানোর সময় চোখের সামনে ভেসে উঠল কতো ছবি। বাপ্পা গান করছে, ছাত্র -ছাত্রীদের ভিড়। বাড়িতেই গানের স্কুল আছে আর গান-ই হল বাপ্পার নেশা আর পেশা। খুব ছোট থেকেই ভীষণ ভালো গান গায় বাপ্পা। মুম্বইতে এতো ভালো ভালো গানের সুযোগ পেয়েও পরিবারের সবাইকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছে। এইভাবে একা একা থাকতে একেবারেই মন চায়নি। হাসতে হাসতে সেদিন বলছিল বাপ্পা “জানো তো মাসিমনি আমি চারদিন থেকেই এমন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম , মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে জেলখানায় আটকে রেখেছে। আমি বিখ্যাত হতে চাইনা গো। সবাইকে নিয়ে এই যে শান্তির জীবন তাকে আমি হারাই কি করে বলো তো? সবাই বলে ক্যারিয়ারটা একেবারে শেষ করে দিলি। কি হবে বলো তো ওমন ক্যারিয়ারের যেখানে নিজের কাউকেই কাছে পাব না। “বাপ্পার ছোট্ট মেয়ের আধো আধো কথাতে সারা বাড়ি একেবারে তোলপাড়। বারিময় এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। দিদি আর জামাইবাবু নাতনি নিয়েই অস্থির। সারা বাড়িটা আনন্দে ঝলমল করছে।
বাপ্পার বন্ধু রাজুও গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিল “গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি না পেয়ে লোন নিয়ে এই গাড়িটা কিনলাম। মোটামোটি যা আসে চলে যায় সংসার। একটাই শান্তি যে সবাই মিলে একসাথে থাকতে পারছি। অন্য রাজ্যে যেতে হয়নি, চাকরির যা বাজার এখানে, কি আর করব বলুন।”
সত্যিই বাংলা স্কুলে পড়াশোনা করার পর তেমন রেজাল্ট না হলে চাকরি বাকরি পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ইংরেজি স্কুলে পড়লে তবুও তো কিছু একটা সম্ভব। রাজু আরো বলল “মাসীমা মন খারাপ করবেন না। ছেলে ডাক্তার হয়ে এসে চেম্বার খুললে আপনার সব কষ্টের সমাধান আর আমরাও বিনে পয়সায় একজন নামকরা ডাক্তার পেয়ে যাব। বাপ্পাদের বাড়িতে তো সব সময়ই আলোচনা হয় আপনার বাবাইকে নিয়ে। অসাধারণ রেজাল্ট, ও তো আমাদের সবারই গর্বের।”
রাজুর কথা শুনে মালার বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। ছেলের জন্যে এটুকু কষ্ট করতে পারবে না?
।। চার।।
সেদিন রবিবার, অসিত চৌধুরী সকালে জলখাবার খেয়ে সবে টিভিটা অন করেছেন। মালা ঠিক করলেন ছোট মাছের ঝাল ঝাল চচ্চড়ি করবেন আজ, অনেকদিন ধরে অসিত বলছিলেন। অন্যদিন সারা সপ্তাহের কাজের যা ব্যস্ততা। আজ একটু পরে বাজারে যাবেন অসিত। এই রবিবার টার জন্যে অধীর আগ্রহে বসে থাকেন মালা। অন্যদিন একা একা খেতে হয়, ছেলেটা চলে যাবার পর এমনিতেই ভাল কিছু রান্না করতে ইচ্ছে করে না। শুধু সপ্তাহের এই দিনটি একটু অন্যরকম , দুজনে অনেক গল্প, আড্ডা, একসাথে বাজার গোছানো, এই রবিবারেই সারা সপ্তাহের বাজার একসাথে নিয়ে আসেন অসিত। জলখাবার খেয়ে একটু টিভি দেখেন, সেই সময়ে মালা দু কাপ চা নিয়ে একটু আরাম করে বসেন। তারপর ধীরে সুস্থে বাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি।
আজ টমেটো পেস্ট করে পেঁয়াজ, রসুন, শুকনো লঙ্কা, হলুদ, ধনেগুঁড়ো দিয়ে অসিতের দারুণ প্রিয় একটা ঝাল ঝাল মাছ চচ্চড়ি করবেন; সঙ্গে সরু সরু করে আলু আর বেগুন।
রান্না ঘরে গিয়ে দু’কাপ চা বানিয়ে বসার ঘরে আসতেই মালা খেয়াল করলেন অসিত বুকে হাত চেপে বসে আছেন। চায়ের কাপদুটো পাশের টেবিলে রেখেই স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বললেন “কি হয়েছে তোমার? অমন করছ কেন? শরীর খারাপ করছে?”
অসিত চৌধুরী দু হাত দিয়ে বুকে চেপে বললেন “বুকে ব্যথা করছে অসহ্য।”
কোনোরকমে পাশের বাড়িতে মালা ফোন করে যে কোনো একটা গাড়ি ডাকতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন হাসপাতালে। ডাক্তার দেখে বললেন “আর কিছুই করার নেই। স্যরি।”
কোনোরকম সময় আর চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে একদিন হঠাৎই সবকিছু শেষ হয়ে গেল, হার্ট ফেল। বাবাই এসেছিল বাবার মুখে আগুন দিতে। সমস্ত নিয়ম কানুন ঠিকঠাক পালন করল, তারপর চলেও গেল তার নিজস্ব ঠিকানায়।
ছেলের যাবতীয় খরচ আর সংসার চালানোর মতো কিছু একটা কাজ যে এবারে চাই। অসিতের দুই বন্ধুর সহযোগিতায় একটা কাজ পাওয়া গেল ঠিকই কিন্তু জীবনে বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেল এক লহমায়।
সারাদিনের প্রচন্ড পরিশ্রম আর মানসিক যন্ত্রণায় কিছু দিনের মধ্যেই মালা যেন এক অন্য নারীতে রূপায়িত হলেন। জীবন যে এতো কঠোর হতে পারে তা ছিল তাঁর কল্পনার অতীত। কেমন যেন অবসন্ন আর দুর্বলতা গ্রাস করল মালা চৌধুরীকে। শরীর যেন আর চলেই না। ছেলেকে কিচ্ছু জানালেন না, ওর ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয়, এমনিতেই কতো ভারি ভারি পড়া। ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি বারবার মনের মধ্যে গেঁথে নিজের সমস্ত দুর্বলতাকে কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন মনেপ্রাণে।
দিদির বাড়ির সবাই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই অসময়ে, রাজুও সব সময় বাপ্পার পাশে পাশে থেকেছে। ছেলেটার এতো মায়া, মাত্র একদিনের পরিচয়।
দেখতে দেখতে সময় কিভাবে কেটে গেল। বছরগুলো যায় আর আসে। কিন্তু মালার জীবনে দিন আর রাত যেন কাটতেই চায় না।
।। পাঁচ ।।
প্রিয়াংশু অবশেষে ডাক্তার হল কিন্তু ভীষণ রকম ইচ্ছে ছিল পিএইচডি করে বিদেশে যাবে কিন্তু তা হয়ে উঠল না। চাকরিটা নিতেই হল। ছেলেকে পেয়ে ভীষণ খুশি মালা। এতো দিনের সব কষ্টের অবসান। কিন্তু আগেকার দিনের এই বাড়িতে তো ডাক্তার বন্ধু বান্ধব আনা সম্ভব নয়। পুরনো স্মৃতিকে নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। মায়ের অনুভূতিকে কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়েই বাবা মায়ের এই বাড়িটাকে বিক্রি করে কলকাতার এক অভিজাত পরিবেশে অসাধারণ একটা ফ্ল্যাট কিনল।
নতুন এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এসে এবং এতোদিনের চেনা পরিবেশ, চেনা গন্ডি অতিক্রম করে কলকাতা শহরের এই ঘ্রাণ মালাকে খুব তাড়াতাড়ি অবসন্ন করে তুলল, ক্রমেই মানসিক অবসাদের শিকার হলেন তিনি। এতো বড় ফ্ল্যাটে একা একা সারাটা দিন, ভীষণ একা লাগে। প্রতিদিন ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনের কথা, চেনা মানুষের মুখ , উঠোনের পেয়ারা গাছ, আম গাছ, চড়ুই পাখির কিচিরমিচির, বাবুই পাখির সেই সুন্দর বাসা, স্বামীর সাথে সেই উঠোনে কতো স্মৃতি, ছোট্ট বাবাইয়ের কতো আবদার।
ছোট্ট বাবাই এখন রাশভারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ডক্টর প্রিয়াংশু চৌধুরী। কেমন যেন সমীহ করে চলতে হয় ছেলেকে। মালা ভেবেছিল ছেলে ডাক্তার হয়ে ফিরলেই এই একাকীত্ব কেটে যাবে কিন্তু সব হিসেব, সব ভাবনার জায়গাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। ছেলের কথার ওপর কথা বলতে কেমন যেন বাধো বাধো লাগে। ভীষণ বেমানান মনে হয় এই ফ্ল্যাটে।
প্রতিদিন রাতে মালা অপেক্ষা করেন একসাথে দুজনে খাবেন বলে। কতোদিন ছেলের সাথে খাওয়া হয়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর ঐ তো সামান্য খাওয়া, ইচ্ছে করে না যে। একদিন প্রিয়াংশু জানিয়ে দেয় ঐভাবে বসে থাকার কোনো দরকার নেই। কাজের কোনো টাইম টেবিল নেই এই পেশায়। ওর ঘরের টেবিলে রেখে দিলেই হবে। মালা আর কথা বাড়ালেন না।
একদিন নিজেই নিজেকে বোঝালেন এই পেশার দায়িত্ব অনেক, আহারে ছেলেটার বড় খাটনি যাচ্ছে। নিজে যত বছর চাকরি করেছেন কম খাটনি তো হয়নি। বাইরের জগতের কাজ আর ঘরের কাজের কতো ফারাক। ছেলের ওপর যেটুকু অভিমান ছিল সব সরিয়ে ফেললেন নিমেষেই।
।। ছয়।।
বিয়ের সিদ্ধান্তটা প্রিয়াংশু নিল কিছুদিনের মধ্যেই। রাইমার কথা নিজেই জানালো মাকে। ‘বড় ঘরের কনভেন্ট এডুকেটড রাইমা’ বেশ স্পষ্ট উচ্চারণ প্রিয়াংশুর মা অপলক। নীরবতার চেয়ে বড় কথা আর কিই বা হতে পারে! ছেলের প্রতি এমনই ভাষা আজ মায়ের। আসলে প্রিয়াংশুর জন্মের পর মেয়ে সন্তানের জন্যে মনে প্রাণে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলই। কিছু ইচ্ছে নিজের কাছেই রাখতে হয়। সব স্বপ্ন তো প্রকাশ করতে নেই। তাই অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে স্বামীর কাছে সেই ইচ্ছের কথা আর প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি।
আজ প্রিয়াংশুর বিয়ে হলে তবুও তো একটা মেয়ে আসবে তার ঘরে। একটা মেয়ে না হলে সংসারটা পূর্ণ হয় নাকি? কথা বলারও তো একটা মানুষ চাই। রাইমাকে একেবারে সন্তানের মতো কাছে টেনে নেবে। মনটা আনন্দে ভরে উঠল মালার।
বিয়ে হল বেশ ধুমধামেই। বধূবরণ থেকে সমস্ত নিয়ম রীতিমতো পালন করলেন মালা। নিজের শাশুড়ির আশীর্বাদের সোনার হারটা দিয়ে নিজেও আশীর্বাদ করলেন ছেলে বৌকে। এছাড়াও নিজের যেটুকু সম্বল ছিল তার সবটুকু তুলে দিলেন রাইমার হাতে। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে বুকে টেনে নিলেন রাইমাকে। এরপর নিজের ঘরে স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে কত কথাই বলে গেলেন। তারপর নিজের মনেই ঘরে বসে রইলেন।
মা সামনে না আসাতে খুশিই হয়েছে প্রিয়াংশু। মায়ের ঐ শুষ্ক কাঠের চেহারা আভিজাত্যের রং-এর মধ্যে যেন কালিমা ঢেলে দিচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। মা আড়ালেই থাক। কনভেন্ট এডুকেটেড রাইমার বন্ধুরা রাইমাকে ঘিরে তখন গল্প আড্ডায় মশগুল। ওদের সামনে আবার হাসির পাত্র না হতে হয়। এমন একটা করুণ মুখ করে থাকে সবসময়। ভীষণ বিরক্ত লাগে প্রিয়াংশুর। এত বড় ফ্ল্যাট। এত ঝকঝকে আসবাবপত্র, তবুও মা খুশি নয়।
ধীরে ধীরে সবকিছু কেমন ফিকে হতে লাগল মালার জীবন থেকে। এই সংসারে, এই নতুন আসবাবের মধ্যে মালার কেমন যেন নিজেকে অতিথি অতিথি মনে হয়। চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকা ছাড়া তেমন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বড়লোক বন্ধু বান্ধব। পার্টি, আড্ডায় বাড়িটা মুখরিত থাকত সব সময়। ঘরে একটা প্রাণীর অবস্থান কারোরই নজরে পড়ত না।
প্রিয়াংশু কথায় কথায় আজকাল প্রায়ই বলে ‘এমন ঘরে জন্মেছি জীবনের সব স্বপ্ন, সব আশা একেবারে শেষ হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজনরাও তেমন কারো পরিচয় দেওয়া যায় না। বিদেশে যাব এতো স্বপ্ন ছিল। সব মাটি হয়ে গেল সব সব। চাকরি চাকরি করতে করতেই সব শেষ হয়ে গেল রাবিশ। “রাইমা নিশ্চুপ, এতো টুকু প্রতিবাদ নেই। মায়ের করুন মুখটা একবারো কারো নজরে পড়ল না। এমন একটা নিষ্ঠুর দিন এভাবে এতো তাড়াতাড়ি সামনে এসে দাঁড়াবে কে জানত। ছেলে যে আজ বড় ডাক্তার।
।। সাত।।
সময়ের সাথে সাথে জীবনও বোধ হয় পালটে যায়। একটা ছোট্ট বাচ্চা মালা চৌধুরীর সমস্ত দুঃখ, জ্বালা, যন্ত্রণা সবকিছুকে কিভাবে পালটে দিল। ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে ভীষণই খুশি মালা চৌধুরী। জীবনের রংটা যে এভাবে পালটে যেতে পারে তা ভাবতেও পারেনি নাতনি অন্তপ্রাণ মালা চৌধুরী। সারাদিনের সবটুকুই তো এই ছোট্ট সোনার সঙ্গেই কাটে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা নাতনিকে নিয়ে যখন ভীষণই ব্যস্ত। হঠাৎ প্রিয়াংশু এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরে ঢোকে। অনেকদিন পর ছেলের মুখে এমন হাসি দেখে মালার মনটা ভরে যায়, যেন সেই ছোট্টবেলার প্রিয়াংশু, ভাল রেজাল্ট করে হাসি হাসি এমন একটা মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকত প্রতিবার। তারপরেই তিনজনে সন্ধ্যাবেলা পুজো দিতে যেত মন্দিরে। পরের দিন আবারও স্নান করে মা, আর ছেলে দু’জনে মিলে পুজো দিতে যেত আরো দূরে এক মন্দিরে। তারপর মন্দিরের বাইরে বসে থাকা গরীব-দুঃখীদের সেই প্রসাদ বিতরণ করত।
সময়, নাকি পরিস্থিতি কোনটা দায়ী এই জীবন বোধকে পাল্টে দেবার জন্যে? নইলে সবটুকু হাসি নিয়ে রাইমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে প্রিয়াংশু বলে উঠল “রাইমা গুড নিউজ, গুড নিউজ, তুমি কোথায়?” রাইমা দৌড়ে এসে বলল “আরে আজ এতো তাড়াতাড়ি! ফোন করোনি কেন?”
– তোমাকে চমকটা তাহলে দেব কি করে?
– কিসের চমক?
– বারে শোনো নি? তোমাকে যে গুড নিউজের কথা বললাম?
– এতো ভণিতা না করে বলোই না।
– আগামী মাসে আমরা আমেরিকা চলে যাচ্ছি।
”কি বলছে বাবাই?” ছেলের মুখে আমেরিকা চলে যাবার কথা শুনে চমকে ওঠেন মালা। চমক আরো বাড়ল রাইমার এক মুখ হাসি আর জ্বলজ্বলে কণ্ঠস্বরে “সত্যিই বলছ প্রিয়াংশু? আমি ভুল শুনছি নাতো? সত্যিই আমরা আমেরিকা যাচ্ছি?”
– ‘শুধু যাচ্ছি না, সামনের মাসেই যাচ্ছি। গোছানো শুরু করে দাও।” আর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল “শুনলেই তো সব, তুমি এই দেশ ছেড়ে যাবে না আমি জানি, তাই তোমাকে এই নিয়ে বলে লাভ নেই।”
স্তম্ভিত মালা কি যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই প্রিয়াংশু বলে উঠল “এই এতো বড় ফ্ল্যাটটা তো এইভাবে পড়ে থাকতে পারে না, কোনো আপদ বিপদও হতে পারে একা থাকলে।”
– কেন তোরা আসবি না মাঝে মাঝে?
খুব ধীর গলায় সবটুকু কান্নাকে চেপে রেখে মালা কথাগুলো বললেন।
– না না কবে কখন আসি তার কিচ্ছু জানা নেই, হয়তো আর আসাই হবে না।
– আসা হবে না আর?
– মনে হয় না।
মালার খুব বলতে ইচ্ছে করছে “কেন বাবাই! কেন তুই অতো দূরে চলে যাবি? তোকে ডাক্তারি পড়ালাম কতো কষ্ট করে। আজ তুই বাবার সেই কথাগুলো একদম ভুলে গেলি। মনে নেই তোর কিছু? তোর বাবা তোকে বলতেন, এই দেশের কতো মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। এই দেশের গরীব অসহায় মানুষের সেবা করবি তুই বড় হয়ে। গ্রামেগুলোতে একজন ভালো ডাক্তার নেই। তুই তাদের জন্যে বড় হয়ে অনেক কিছু করবি বাবা।”
কিন্তু না মালা কিছুই বলতে পারলেন না। অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলেন শুধু। বাবাই বলে ডাকতেও কেমন দ্বিধা হয় আজকাল। এখন যে তার পরিচয় ডক্টর প্রিয়াংশু চৌধুরী, গুরু গম্ভীর ব্যক্তিত্ব। ডাক্তার হতে গেলে এমনটা হতে হয় বুঝি? মা ডাকটাও আজ কোথায় হারিয়ে গেছে।
মালা নির্লিপ্ত ভাবে বললেন “আমি এই ফ্ল্যাটে একা থাকতে পারব, কোনো অসুবিধে হবে না। তুই তো প্রতিদিন ফোন করবি-ই।”
– ফোন! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? কতো টাকা বিল ওঠে বলো তো? তুমি তো আবার স্মার্ট ফোনও ব্যবহার করতে পারো না। তাহলে মেসেঞ্জারে কল করা যেত। প্রতিদিন ফোনে কথা বললে কতো টাকা বিল উঠবে আইডিয়া আছে কোনো? কারখানার পরিবেশে জীবন, বিদেশের মুখ দেখেছে কখনো? যাই হোক যা বলছিলাম এই ফ্ল্যাটটি এতো তাড়াতাড়ি বিক্রি সম্ভব নয়। দু-একজন ব্রোকারকে বলা আছে। তবে আপাতত আমার চেনা বর্ধমানের একটি ছোট পরিবার ভাড়া থাকবে।”
সব তো ঠিকই করে ফেলেছে, বাবাই এখন বড় হয়ে গেছে। মাকে আর দরকার পড়ে না যে। ভেতরের সবটুকু কষ্টকে নিজের মধ্যে রেখে মালা শান্ত গলায় বললেন “আমাকে তাহলে কি করতে হবে?”
মায়ের দিকে না তাকিয়েই একটু মাঝারি ঝাঁজে প্রিয়াংশু বলে “তুমি তো আবার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকবে না। অবশ্য যে সব আত্মীয়স্বজন। আমি তাই একটা আশ্রমের কথা ভেবেছি। আমি দেখে এসেছি , মোটামুটি কথাও হয়েছে। এই এতো বড় ফ্ল্যাট এমনি এমনি পরে থাকার চেয়ে একটা শিক্ষিত পরিবার ভাড়া থাকা ভাল। আর যে জায়গার কথা বলছি, সেখানে কথা বলার মতো অনেক মহিলা পাবে। খারাপ লাগবে না তোমার। টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করবে না। আমি সব ব্যবস্থা করেই যাব। তবে একটা কথা…..
মালা চৌধুরী তাকালেন এবারে প্রিয়াংশুর দিকে। আর স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল বহু বছর আগের ফেলে আসা দিনগুলোতে। ছোট্ট বাবাইকে অনেক বড় করতে গিয়ে নিজের আত্মীয়স্বজনদের থেকে কিভাবে দূরে সরে গেছেন। তাছাড়া সারাদিন স্বামী স্ত্রীর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর শরীরও সায় দিত না লোক-লৌকিকতায়। ছেলে ছেলে করেই তো তখন জীবন। সবটুকু স্বপ্ন আর ভালোবাসা একমাত্র বাবাইকে ঘিরে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ জলে ভরে উঠেছে , চমকে উঠলেন প্রিয়াংশুর কথায় “দয়া করে কান্নাকাটি করে নাতনীর মনটাকে নষ্ট করে দিও না, জানোই তো তোমাকে ছাড়া ও একেবারে অচল।”
।। আট।।
বৃদ্ধাশ্রমের একটা ঘরে মালা চৌধুরী। এমন কিছুই বয়স নয় কিন্তু মানসিক অবসাদে আজ যেন বড় বেশি বিষন্ন। অনেকেরই জীবন তাঁরই মতোন।
তবে একজন মহিলা সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর নাম সানন্দা চ্যাটার্জি , নিঃসন্তান। স্বামীর মৃত্যুর পর একাকী জীবন থেকে মুক্তি পেতে নিজেই বেছে নিয়েছেন এই আশ্রমকে। আত্মীয়স্বজনদের কাছে বোঝা হয়ে থাকতে মন চায়না কিছুতেই। একটা সময় কতো অভিমানই করতেন স্বামীর কাছে। দুজনের সেই সংসারে সন্তান নেই বলে কত রাগ, অনুরাগ , অভিমান, মন খারাপ, যন্ত্রণা।
আজ সানন্দা চ্যাটার্জি নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে করেন। নিজে নিঃসন্তান থাকাকালীন অন্যান্য সন্তানের মায়েরা যখন জ্বলজ্বল চোখে ছেলেকে নিয়ে, মেয়েকে নিয়ে হেঁটে বেড়াতেন, তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন এক শূন্যতায় ভরে যেত। আজ এতোজন মায়ের শূন্যতা কেমন যেন এক ঝটকায় তাঁর এতোদিনের সমস্ত শূন্যতাকে উড়িয়ে দিল। মনে হল নেই তো নেই , কিন্তু যাদের সবকিছু থেকেও নেই , তাদের শূন্যতার গভীরতার কথা ভেবে এই প্রথম কেঁদে ফেললেন সানন্দা চ্যাটার্জি , যিনি কোনোদিনও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন নি।
মালা চৌধুরী তখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন। ছোট্ট প্রিয়াংশু কিভাবে কখন যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আবার এক ঝটকায় মায়ের হাত ছেড়ে দৌড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা মাঠে একা একাই ছুটছে বৃষ্টির মধ্যে। মা চিৎকার করে বলছেন “চলে এসো, চলে এসো বাবাই । এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে সোনা।” মায়ের কথা শুনে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট প্রিয়াংশু বলছে “চলো না মা, তুমিও ভিজবে।”
মা হেসে বলছেন “এভাবে ভিজতে আছে বাবা? তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে যে। এসো এসো ভেজা জামাকাপড় খুলে একটু গরম দুধ খেয়ে নাও, এসো সোনা এসো।”
সানন্দা চ্যাটার্জির দীর্ঘশ্বাস তখন সারা ঘর জুড়ে।#




