এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ১২)

রবিবারের সকালে মতির কাজের শেষ ছিল না। সমাজসেবা যে সময় মেনে চলে না, মতি তা ভালো করেই জানত। আসলে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে ব্যস্ততার তারতম্য ভিন্ন ভিন্ন। বিভাস সামন্তের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে মতিকে নিয়ে, মতির ব্যস্ততা চলছে সাধারণ মানুষের উপকার করা নিয়ে। বাড়ির সামনে এক চিলতে উঠোনের মাঝে বেঞ্চে বসে মতি একমনে কী সব লিখে চলেছে। বেলা বাড়ছে পলে পলে। সূর্যের তেজও বাড়ছে। দুপুরের মধ্যে শেষ করতেই হবে। হেনা ওরফে রেহেনা মতির মনোযোগ দেখে অবাক না হয়ে পারল না। মানুষের উপকারের জন্য মতির ভাবনা নিয়ে তার মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই কিন্তু পেটে কিছু না দিয়ে এত বেলা পর্যন্ত পড়ে থাকলে শরীর টিকবে কী করে? মতি তা বুঝতে চায় না। সামনে গিয়ে বলল, তোমার খিদে তেষ্টা বলে কিছু নেই নাকি? এত হিজিবিজি কী সব লিখছ?
আজকের বিকেলের মধ্যে দরখাস্তগুলো শেষ না করলেই নয়। কী এলাকায় আমরা বাস করছি দ্যাখো, যারা সুবিধে পাবে, তাদের এসব কাজ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সব দায় আমার। ভেবে নিয়েছে তারা, এ কাজ আমাকেই করে দিতে হবে। না করে দিতে পারলে বাবুদের প্রশ্ন আর অভিমানের মুখে পড়ে নাস্তানাবুদও হতে হবে। হয়তো তুমি বলবে, ঘরের খেয়ে বিলের মোষ তাড়ানোর মতো কাজে যুক্ত থেকে লাভ কী? তা বলতেই পারো। এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আর বেশি বাকিও নেই। এই তো মাত্র কটা, শেষ করেই উঠব।
হেনা সরে গিয়ে বেঞ্চ থেকে দরখান্তগুলো নিজের হাতে নিয়ে বলল, কী এত ছাইপাঁশ লিখছ দেখি।
এতদিন ক্লাব করে বুঝেছি, কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারলে কোনো মূল্য পাওয়া সম্ভব নয়।
হেনা দুচোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল মতির লেখা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগুলোর উপর। বাউরি পাড়াতে স্কুল চালু হবে ৫ অক্টোবর থেকে। শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন শ্যামল দে, প্রবাল হালদার, রহিম সেখ এবং তামান্না মন্ডল।
হেনার মনে কৌতূহলের বন্যা। একটা নতুন ভাবনা মাথার ভিতরে ঘুরছে। চাপা স্বরে বলল, স্কুলে পড়ানোর জন্যে আমাকে নিলে না কেন? বাড়িতে বসে শুধু শুধু তোমার অন্ন ধ্বংস করছি।
মতির একগাল হাসি। গলার স্বরে নতুন রোমাঞ্চ। —ভালো করেই জানি, তোমাকে নিলে সপ্তাহের অর্ধেক দিন আমার কপালে ভাত জুটবে না।
এসব কী বলছ মতি?
এ ক’দিনে বুঝেছি, তোমার মতো যত্ন করে আমাকে কেউ খেতে দেয় না।
কাজের পিছনে সারাদিন টোটোকোম্পানি হয়ে ঘুরলে রাস্তা থেকে কে ধরে এনে তোমাকে সময়মতো খেতে দেবে?
মতি মুখ নীচু করে বলতে শুরু করল, আমার স্মৃতি কিন্তু অন্য কথা বলছে, যতদিন মা ছিল, আমি না ফিরলে না খেয়ে বারান্দায় বসে থাকত, অনেকদিন বিকেল তিনটের সময় মায়ের সঙ্গে বসে ভাত খেয়েছি। কিন্তু সেই খাওয়ার চেয়ে মা যে এতক্ষণ আমার জন্যে অপেক্ষা করত, সেটাই যেন শ্রেষ্ঠ পাওনা হিসেবে দেখা দিত আমার কাছে। ছেলের জন্যে মায়ের ভাবনা যে কত আলাদা হতে পারে তা এখন মর্মে মর্মে বুঝতে পারি। অনেক দিন রাতের খাওয়া শেষ করেছি এগারোটার পরে। মাও তখন খেয়েছে আমার সঙ্গে বসে।
আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত করার জন্যে একথা বলি নি মতি। আর পাঁচটা ঘটনার মতো একথা বলেছি। দুঃখ পেয়ে থাকলে ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি যে মাসিমার প্রসঙ্গ টেনে এনে জীবনের এত বড়ো গভীর সত্য উপস্থিত করবে, তা স্বপ্নেও ভাবি নি। আমারও খুব খারাপ লাগছে।
আরেকটা প্রসঙ্গ তোমাকে শোনাই।
নানা কাজের মধ্যে একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করলেও মা ছিল সান্ত্বনার টনিক। বাড়িতে ফিরলেই মায়ের হাসি মুখ আমাকে ভীষণ তরতাজা করে তুলত। মা চলে যাবার পরে সেই সব পর্ব জীবন থেকে কেমন করে উবে গেছে, তা ভাবলে খুব কষ্ট পাই মনে মনে। এখন তো জীবন চলছে ভীষণ টেনে টেনে। সর্বক্ষণ ভিতরে রয়েছে একটা নেতিয়ে পড়া ভাব। মায়ের অভাব জীবনে এত প্রকট হয়ে বেঁচে থাকে? ঠিক বুঝতে পারি নে। কেন জানি নে তুমি আসার পর থেকে নতুন করে মায়ের স্মৃতিগুলো বার বার মনে পড়ছে। আমি কী তোমার মধ্যে হারানো মায়ের স্মৃতি খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি? জানি নে, ভুল ভাবছি কিনা।
হেনা থেমে থেমে বলল, মায়ের শূন্য আসন কেউ পূরণ করতে পারে না মতি। মা আর মায়ের মতো কখনো এক হয় না। শুধু এটুকু বলতে পারি, মাতৃত্ব হারানোর জন্যে তোমার মধ্যে যে যন্ত্রণা কাজ করছে, তা বেশ অনুভব করতে পারছি। আমিও জানি, সাদা মন নিয়ে তোমার মাতৃত্বের অভাব পূরণ করার সামর্থ আমার নেই।
এক অর্থে ঠিক কথাই বলেছ। মাতৃত্ব সাদাই হয়। জীবনের অন্য সব যন্ত্রণা সহজে মুছে যায় ওই সাদা ধপধপে মাতৃত্বে। সত্যি বলছি, তোমার মধ্যে সেই শক্তি রয়েছে। সন্ধে সকালে তা বেশ অনুভব করতে পারি। কেউ না জানুক, আমি খুব করেই জানি, ভিতরে কী যন্ত্রণা নিয়ে তুমি আমার সংসারে খুশির আমেজ ধরে রাখতে পারছ। মাতৃত্বের সাদা গুণ না থাকলে তো এভাবে সম্ভব হত না। কী অসীম সহনশীলতা রয়েছে তোমার মধ্যে। জানি নে, এমনি সহনশীলতার অন্য নাম মাতৃত্ব হয় কিনা।
তোমার এত বড়ো Philosophy আমার মাথায় ঢুকছে না মতি। এটুকু বুঝতে পারি, হাপরে পুড়ে লোহা যেমন লাল হয়, তোমার জীবনের দগদগে অভিজ্ঞতাগুলো তেমনি। সেজন্যে বোধ হয়, কারুর আচরণের মানবিক বা অমানবিক দিকগুলো খুব সহজে চিনে নিতে পারো। আরও বুঝি, হারানো মাতৃত্ব থেকে যা পেয়েছ, তা সত্যি অসীম, অতুলনীয়।
নিজেকে আড়াল করার যাদুমন্ত্র রয়েছে তোমার মধ্যে।
এভাবে ভাবা ঠিক নয় মতি। তোমার Philosophy আমি বুঝি নে।
পাশের ঘর থেকে ডুরানি পায়ে পায়ে মতির সামনে এসে দাঁড়ালেন। —তোমাকে একটা কথা বলি বাবা, এত দেরি করে খেলে শরীর টিকবে না। বড়ো অসুখ-বিসুখও চলে আসতে পারে। আমরা এতগুলো মানুষ তোমার উপর নির্ভর করে বেঁচে রয়েছি। তুমি সুস্থ না থাকলে চলবে কী করে? আমার বৌমা তো ঠিক কথা বলেছে। যাও বাবা, খেয়ে নাও, আর দেরি করো না। শুধু আজকের জন্যে নয়, সব দিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার অভ্যেসটুকু আয়ত্ত করে ফেলতে হবে। শরীর সুস্থ না থাকলে ক্লাবের এত ভারী ঝক্কি বইতে পারবে না বাবা।
আপনিও আজ আমার জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা দিতে পারলেন। মাত্র ক’টা দিন পার হয়েছে, তাতেই আমাকে শাসন করার অধিকার পেয়ে গেছেন। খুব করে বুঝতে পারছি, আমার মঙ্গলের জন্যে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিতে পেরেছেন বলেই এই অধিকারটুকু লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
ঘুরিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না বাবা। বেলান্ত করে কোনোদিন খেও না। অন্তত আমাদের কথা ভেবে তোমাকে সুস্থ থাকতেই হবে।
বেশ বললেন আপনি।
এ তো জীবনের কথা। পেট চালানো আর শরীর রক্ষার মধ্যে একটা দারুণ মিল রয়েছে। বৌমাকে একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারো না? তাতে তো তোমার উপর থেকে কিছুটা চাপ কমে যেতে পারে। শুধু শুধু ঘাড়ে বসে খেতে কেমন যেন লজ্জায় পড়ে যেতে হয়। ভাগ্যের তাৎক্ষণিক বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেয়েছি তোমার কারণে। তুমি যা করেছ, তা ক’জন পারে? হেনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নীরজকে আজই একটা চিঠি লেখ বৌমা, তাতে মতির কথা অবশ্যই উল্লেখ করবে। নিশ্চয় বাড়িতে বসে আমাকে নিয়ে নানা ভাবনা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
এ নিয়ে আমিও ভেবেছি। তাই দুদিন আগে আপনাকে না জানিয়ে ডাকযোগে পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। হয়তো কাল পরশু হাতে পেয়ে যাবেন।
হেনার সামাজিক সমুন্নতি দেখে ডুরানি খুশি না হয়ে পারলেন না। মতিও বুঝতে পারল যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নব্য অতিথিরা কত বেশি আপন হয়ে উঠেছে। তিন দিন পরে নীরজের পত্র হাতে পেয়ে হেনা বুঝতে পারল যে তার চিঠি নীরজ মেসোর হাতে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। ডুরানিকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই তো আপনার বন্ধুর চিঠি, কী লিখেছে দেখুন।
এক পলকে পড়া শেষ করে ডুরানি বললেন বৌমা, তাহলে কবে আসছে নীরজ?
সামনের শনিবার মেসোমশাই আসছেন।
প্রহর গোনা শুরু হল দু’জনের। হেনা জানে, মেসোমশাই এলে তার শ্বশুর কত বেশি খুশি হবেন মনে মনে। বিকেলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, সকালে হাঁটতে বের হওয়া, সন্ধেয় চা খেতে খেতে দু’জনের বন্ধুত্ব জমে খির হয়ে ওঠে। খাঁটি বন্ধুত্ব কী, তা দু’জনকে দেখে হেনা বেশ উপলব্ধি করতে পারে। শ্বশুর ডুরানি তাকে অনেকবার শুনিয়েছেন নীরজের সঙ্গে তাঁর মানসিক নিবিড়তার কথা। শ্বশুরের পুরনো বন্ধুত্বের স্মৃতি তর্পণে ডুবে থেকে হেনার সময় পার হলেও পরের দিন থেকে ডুরানির সময় কিছুতেই পার হচ্ছিল না। সকাল হলে ভাবছেন, দুপুর হতে এত দেরি হচ্ছে কেন। বিকেলের ভাবনা, দিনটা দ্রুত মুছে গিয়ে সন্ধে নেমে আসুক। মনের সচলতা সময়কে কীভাবে হার মানাতে পারে, ডুরানি তা বেশ উপলব্ধি করতে পারছিলেন। মাঝে মাঝে আবেগের টানে ডুরানির মধ্যে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলেও অপেক্ষায থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেসও ত্যাগ করেছেন কটা দিনের জন্যে। বিকেল হলে হেনার প্রশ্ন, বেড়াতে যাচ্ছেন না কেন?
নীরজ এলে না হয় হাঁটার পরিবর্তে একটু বেশি করে ছুটে নেব, তাতেই পুষে যাবে। তারপর প্রাণ খুলে খুক খুক করে হাসি। হেনাও তা বেশ উপলব্ধি করতে পারল।
ডুরানি আবার বলতে শুরু করলেন, জানো বৌমা, নীরজের চিঠি পাওয়ার পর থেকে আমি আর আমিতে নেই। বিকেলে পথে বেরিয়ে হাঁটতে গেলে নীরজের কথা ভেবে একা একা কষ্ট পেতে হবে বলে এ কটাদিন তোমাদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটিয়ে দিয়েছি। আজ নীরজের আসার দিন, কিছু সময় পরে এসে পড়বে।
সন্ধে সাতটার পরে ডুরানির কথা সত্যি হয়ে উঠল। মতির বাড়ির সামনে নীরজ এসে উপস্থিত হলেন। আসুন মেসোমশাই, হেনার সাদর আপ্যায়ণ, সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরের পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, দুজনে ততক্ষণ গল্প করুন, আমি চা করে আনছি।
ডুরানির প্রতি নীরজের প্রথম প্রশ্ন, তারপর বলো কেমন আছ, কদিন তো কোনো খোঁজখবর নিতে পারি নি। হুট করে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পরে কোথায় আছ, কী করছ, শরীর কেমন আছে, কিছুই জানতে পারি নি। জানো ডুরানি, মানুষের জীবনে আকস্মিকতা এমনিই। কখন হঠাৎ করে এসে উপস্থিত হয়, তা আভেভাগে অনুমান করা যায় না। টানা ক’দিন একা একা বিকেলে বেড়াতে গিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছি। তুমি কাছে না থাকলে মনের একটা অংশ বড়ো শূন্য থেকে যায়। সেই ছোটোবেলা থেকে দু’জনের একসঙ্গে পথচলা শুরু হয়েছিল। আজও তা চলছে। চাচ্ছি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এমনি করে চলুক। পৃথিবীর মানুষ জানুক, বাঙালি বন্ধুত্বের পরম্পরা রক্ষা করতে জানে।
ডুরানির বুকের গভীর থেকে একটা বড়ো দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে এল। —জানো নীরজ, আগে কখনো ভাবি নি, জীবনে এমন দিন আসতে পারে, এসেছে বলেই বুড়ো বয়সে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারছি। এখন তো বার বার মনে হচ্ছে, মানুষ চেনার কাজে আমরা দুজনে অনেকখানি পিছিয়ে ছিলাম। সেগুলো এখন পর্যায়ক্রমে পূরণ হচ্ছে। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে নীরজ। সারা রাত জেগে দু’জনে বসে বসে গল্প করব। কদিন দেখতে না পেয়ে মনে মনে ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছিলুম। আজ তা পুষিয়ে নিতে হবে না?
হেনা চা-এর ট্রে হাতে ঘরের ভিতর ঢুকে বলল, চা এনেছি, খেয়ে নিন মেসোমশাই।
ডুরানির মুখে বিচিত্র হাসি। নীরজের প্রশ্ন, এভাবে হাসলে যে?
হেনা এখন বেশ শক্ত হয়ে উঠতে পেরেছে। নিজেই সংসারটাকে পরিচালনা করছে। কেবল আমার কথা ভেবে বৌমা তোমাকে পত্র পাঠিয়েছিল।
নীরজ বললেন, তারপর বলো, এখানে কেমন আছ? কী কী পার্থক্য চোখে পড়ছে?
দারুণ প্রশ্ন করতে পারলে নীরজ। আগে ভাবতুম, সুখ কেবল আর্থিক বৈভবে, এখন ভাবছি, জীবনের সব সুখ সত্যের অনুসন্ধানে। ছেলের কাছে যা পাই নি, মতির কাছে তা শেখার সুযোগ পাচ্ছি। ছেলেটা খুব কর্মঠ। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকে। নিজের কতটা লাভ হল, তা নিয়ে আদৌ ভাবে না। কখন খেতে হবে, কতক্ষণ বিশ্রাম নিলে শরীর ভালো থাকবে, এসব ওর মাথায় নেই। এলাকার মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করাকেই মূল কাজ হিসেবে ভেবে নিয়েছে। বোধ হয় শুধুমাত্র ছেলেকে নিয়ে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলুম বলে এত সব বড়ো বড়ো সত্যের প্রকাশ ঠিকমতো চোখে পড়ে নি। এখন তা মতির সৌজন্যে বেশ দেখতে পাচ্ছি, উপলব্ধির ঘর ক্রমে বড়ো হচ্ছে। এতে অনেক কিছু শেখার আছে নীরজ। এমন জায়গা আগে খুঁজে পেলে নিজেকে আরও বেশি মেলে ধরা সম্ভব হত। এখন সেই ক্ষেত্র খুঁজে পেয়ে মনে মনে খুব খুশি হতে পারছি। নিজের ছেলে যা দিতে পারল না, মতি তা দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারল যে শুধু সম্পর্ক নয়, মানবিকতা জীবনের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। তারপর তুমি কেমন আছ, বলো?
তুমি বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকে আমার মধ্যে একটা নতুন নিরাসক্তি শুরু হয়েছে। সংসারের সব দায়িত্ব ছেলের কাঁধে তুলে দিয়েছি। বিষয় আমার কাছে বিষময় হয়ে উঠছিল। অনেক করে ভেবেছি, এসব মায়া ত্যাগ করাই ভালো। একটাই সৌভাগ্য, আমার ছেলে আকাশের পথে নামতে পারে নি। জানো ডুরানি, তোমার মুখে মতির গল্প শুনে মনে হচ্ছে, সংসার জীবনে বাপ ছেলের সম্পর্কটুকু এক অর্থে ভুল। যে ছেলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে না, তার জন্যে বাপের গর্ব করার কিছু আছে কী? অথচ সবার জন্যে হয়ে উঠতে পারলে সেই বাপের বুক গর্বে ভরে উঠতে পারে। যে কারণে তুমি মতির জন্যে গর্বিত হতে পারছ, আকাশের ক্ষেত্রে সেই মূল্যবোধ আদৌ ধরা পড়ে নি। মূল পার্থক্য সেটাই। দুঃখ কী জানো ডুরানি, নিজেরাই নিজেদের ছেলেকে মতির মতো করে গড়ে তুলতে পারলুম না। পারলে অন্য ভুবন পেতুম, অন্য অনুভূতি পেতুম, পৃথিবীকে দেখার জন্যে চোখদুটোকে অন্যভাবে কাজে লাগাতে পারতুম। তা আর হল কই?
বাইরের কোথাও ব্যস্ত হয়ে থাকা পাপান ছুটে এসে ঘরের ভিতরে ঢুকে কিছু সময় চুপ করে থাকল। একটু কী ভেবে নিল। তারপর বলল, মাস্টারদাদু, এতদিন পরে আমাকে মনে পড়ল? প্রতিদিন সন্ধেয় দাদু তোমার কথা বলেছে। মা তোমাকে নিয়ে কত গল্প করেছে। সেসব আমি খুব মন দিয়ে শুনেছি। তত রাগ বেড়েছে তোমার উপর। কেবল মনে হয়েছে চা খেতে বসলেই যে দাদু আমার হাতে বিস্কুট গুঁজে দিত, সেই মাস্টারদাদু আসছে না কেন?
নীরজ পাপানকে কোলে তুলে নিয়ে কেবল ভাবছেন, ছোটো হলেও পাপানের সঙ্গে আকাশের একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ছেলেটা ছোটো বয়স থেকে জীবনকে বুঝতে শিখেছে। সে বাপকে অনুসরণ না করে কেবল দাদুকে অনুসরণ করে।
রাত বাড়ছে পলে পলে। দেওয়াল ঘড়ির ঢং শব্দ জানিয়ে দিল, ন’টা বেজে গেছে। ততক্ষণে হেনা রান্না শেষ করে ফেলেছে। হাসিমুখে ঘরের ভিতরে ঢুকে বলল, অনেক পথ পার হয়ে এসেছেন, এখন কী খেতে দেব?
মিনিট পনেরো পরে দাও। মুখ ঘুরিয়ে ডুরানির কাছে নীরজের প্রশ্ন, আকাশ নতুন করে স্বরূপনগর থানায় পোষ্টিং হয়েছে, এই সংবাদটুকু আমার কাছে চেপে গেলে কেন?
মতির জীবনদর্শন থেকে বুঝেছি, যে ছেলে শুধু তার বাপের, সে কখনো দেশের ছেলে হয়ে উঠতে পারে না। আকাশের ক্ষেত্রে সেই ব্যর্থতা আরও বেশি মাত্রার। সে বাপের কাছে ছেলে হয়ে উঠতে পারে নি, দেশের ছেলে হয়েও নয়। সে কেবল অপরাধ জগতের। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে স্মৃতির পাতা থেকে ঘসে ওকে তুলে দিতে পেরেছি নীরজ।
হেনা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল শ্বশুরের দিকে। বাম হাত মাথার উপর রেখে কী যেন বুঝে নিতে চাইল। শ্বশুর আকাশকে ত্যাগ করলে শ্বশুরের কাছে তার কোনো মূল্য থাকে কী? সেই ভাবনায় দুলতে থাকল হেনা। আকাশের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, সেটাই তার শ্বশুর অস্বীকার করতে চাচ্ছেন? কিন্তু তা কী কোনো মূল্যে মুছে ফেলা যায়?
ডুরানি দুলছেন নিজস্ব হিসেবের দিকে দুচোখ রেখে। তাঁর মূল্যায়নের পাতার একদিকে রয়েছে মতি, অন্যদিকে আকাশ। রক্তের সম্পর্কে মতি তাঁর কেউ নয়। মাত্র ক’দিনের পরিচয়। অনেকখানি বাধ্য হয়ে তার বাড়িতে থাকতে হচ্ছে কিন্তু সেই ছেলেটি তাঁর কাছে একান্ত আপন হয়ে উঠতে পেরেছে। অথচ আকাশ সম্পর্কে নিজের ছেলে হয়েও এখন তাঁর কাছে চরম শত্রু ছাড়া কিছুই নয়। মতি ক্লাবের কাজ সেরে বাড়িতে এসে ডুরানির ঘরে ঢুকে বলল, আপনার চ্যবনপ্রাস কী ফুরিয়ে গেছে?
একথা বলছ কেন বাবা?
না মানে কাল সকালে বাজারে যেতে হবে, ফুরিয়ে গেলে কিনে আনা সম্ভব হত।
তোমার সান্নিধ্য পেয়ে মনের জায়গা এত বড়ো হয়ে উঠেছে যে আর চ্যবনপ্রাস খাওয়ার প্রয়োজন আছে কী?
প্লিজ, এসব বলে আমাকে ছোটো করবেন না। আমি আপনাকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করি, শুধু সেটুকু মনে রাখতে চাই। ভিতরের শ্রদ্ধা এমনি এমনি তৈরি হয় না স্যার। তার জন্যে একটা বড়ো মন লাগে যা আপনার মধ্যে রয়েছে। যা যখন দরকার পড়বে, অকপটে আমাকে বলতে পারেন। এ দরকার মেটাতে পারলে তো মননে বড়ো হয়ে ওঠার সুযোগ পাব। আসলে ক্লাবের কাজ সেরে হাতে সেরকম সময় থাকে না, তাতেই অনেক হিসেব তালগোল পাকিয়ে যায়। শুধু ভয় হয়, আমার ভুলে আপনার জীবনে ব্যথা পাওয়ার কারণ না হয়ে ওঠে।
জানো মতি, ঈশ্বর তাকেই অপরিসীম শক্তি দান করেন যে মানুষের জন্যে কাজ করে। সেই শক্তি আছে বলেই দেশের জন্যে এত কাজ করতে পারছ কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে খেয়ে শরীর রক্ষার কথা ভুলে যেও না। শরীর মনের টানে খুব বেশিদিন চলে না মতি। আবার শরীর না টানলে কাজের গতি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। জীবনের এ গতি ঠিক জোয়ার ভাটার মতো। জোয়ারে দুকুল ছাপিয়ে যায়, ভাটার স্রোতে কমতে কমতে হাঁটু জলে পরিণত হয়।
হেনা আবার ঘরে ঢুকে দেখল, তখনও তার শ্বশুর বক্‌বক্ করে চলেছেন। মতি তা গিলছে বাধ্য ভাবশিষ্যের মতো। হাসি পেল হেনার। শ্বশুর ডুরানি ক’দিনে মতিকে যতটা জানতে পেরেছেন, বাল্যবয়স থেকে তখনও মতি নিজেই নিজেকে জানতে পারে নি। একটু হেসে উঠে বলল, কাকে এসব শোনাচ্ছেন? মতি এত কাজপাগল যে নিজের জন্যে কিছু শোনার সময় পর্যন্ত পায় না। শুনলেও তা অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। দেখলেন না, এত করে বলার পরেও আমাকে কীভাবে বঞ্চিত করল।
ডুরানি বেজায় খুশি হলেন জীবনের আদর্শ নিয়ে নতুন বিতর্ক শুনে। হেনাকে সমর্থন করে বললেন, বৌমা, এ বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। পরে জানতে চাইব, বিতর্কে তুমি জিতলে, না মতি জিতল। অবশ্য এ মানবিক প্রতিযোগিতায় হার জিত বলে কিছু নেই। যে হেরে যায়, সেও জয়লাভ করে নতুন আলো পেয়ে। কারণ কী জানো হেনা, এ তো জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অভিনব দ্বন্দ্ব। ব্যাকরণে সমাস পড়ার সময় জেনেছি, দ্বন্দ্ব মানে মিল, আবার দ্বন্দ্ব মানে ঝগড়া। এখানে কিন্তু ঝগড়ার কিছু নেই, স্রেফ অংশগ্রহণ করে লাভটুকু নিজের করে নেওয়া।
মতিকে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে গেল হেনা, ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, আপনিও তো দেখলেন, এত করে অনুরোধ করার পরেও মতি আমাকে সর্বশিক্ষা অভিযানের স্কুলে দিদিমনি করে নিতে পারল না। আমি খাটব, বিনিময়ে কিছু পাব যা এ সংসারে কাজে লাগবে। এতে মতির কেন যে এত আপত্তি, তা আমার মাথায় ঢোকে না।
ঘরের ভিতর থেকে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে মতির জবাব ভেসে এল। —কোনোভাবেই এ হতে পারে না। যে কারণে লোক আমাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবতে পারে, তাতে সম্মতি দিতে পারি কী?
তোমার এ যুক্তিহীন কথা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এতগুলো লোক তোমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছি, আর তুমি নীতিকথা বলে সকলের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নুয়ে পড়তে চাচ্ছ? আমাদের পেটপূরণের জন্যে আমাদের কোনো দায় থাকবে না? কিছু করতে চাইলে সেই অধিকারে তুমি বাধা দিতে পারো?
এর ভিতরে আরও বড়ো জটিল সমস্যা রয়েছে।
কষ্ট করে তা জানাতে পারছ না কেন?
তুমি যে এখানে আছ, তা আমাকে গোপন করে চলতে হয়।
এর কোনো প্রয়োজন আছে কী?
মেসোমশাই পুঁটিরামের ছেলে গুণধরের গালে চড় মেরেছিলেন, তা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
ভুলতে যাব কেন?
মনে রেখো, পুঁটি ছোটো হায়না, ওর চেয়ে অনেক বড়ো হায়না পুঁটির সঙ্গে রয়েছে। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভয়ের।
বিভাস সামন্তর কথা বলছ?
নামটা জানলে কী করে?
জানতে হয় মতি। এ ক’দিনে তোমার জীবনচর্চায় নিজেকে অনেকখানি পাল্টে নিতে পেরেছি। মানুষ সারাক্ষণ মনে মনে যা নিয়ে ভাবে, অজান্তে সে সব অস্ফুটে বের হয়ে আসে মুখ দিয়ে। অবশ্য এতে দোষের কিছু নেই। বরং আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার মানসিক কসরত রয়েছে। দিন দুই আগে বদ্ধ ঘরের মধ্যে তোমাকে সেই কসরত করতে দেখেছি। একা একা বিভাস সামন্তের বিরুদ্ধে যে হুঙ্কার দিচ্ছিলে, তাতেই অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
আরেকটা বড়ো হায়নার খবর তোমাকে জানিয়ে রাখি। স্বরূপনগর থানার মূল চেয়ারে বসে আছেন যে মানুষটা তার চেয়ে বড়ো হায়না এ এলাকাতে নেই। দিনে রাতে তাঁর হিংস্রতা সীমাহীন হয়ে উঠছে। তা নিয়েও তোমাকে অনেক বেশি করে ভাবতে হবে।
এভাবে ভাবতে যাচ্ছ কেন?
প্রতিবাদ করার ভাবনা কী এতটাই ভুল? বহু মানুষের সমবেত প্রতিবাদেই তৈরি হয় নতুন ক্ষেত্র। আমি অন্তত সেভাবে ভাবতে শিখেছি। যে লোক পুলিশের পোষাক পরে নিরীহ মানুষকে বিনা দোষে খুন করতে পারে, তার কথাই তো সমাজে বেশি করে প্রচার করতে হবে। এটুকু না পারলে বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে যেতে হয়।
প্লিজ, এ প্রসঙ্গ থাক না।
হেনা কিন্তু মরিয়া। থেমে থেমে বলল, কেন যে তুমি বাধা দিচ্ছ, তা মাথায় ঢুকছে না। একজন পদস্থ পুলিশ অফিসার অন্ধকার জগতের লোকজনদের সঙ্গে অবাধে ওঠাবসা করবে, তা জেনেও চুপ করে থাকতে হবে? যে লোকটা টাকার লোভে পিশাচ হয়ে নিজের পিতাকে চড় মারতে পারে, তাকে হিংস্র জন্তু ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারা যায় কী?
আরও কী সব বলতে চাইলেও আবেগে অবরুদ্ধ হয়ে গেল হেনা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মতি সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। নিজেও ভীষণ হতভম্ব। কথা বলার অবস্থানে নেই। অভিনব পরিস্থিতি। মতি খুব সহজে বুঝে গেল, অনেক বড়ো আঘাত সহ্য করতে না পেরে এত সব কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। অন্য একটা উপলব্ধি মতিকে তাড়া দিতে থাকল। আর পাঁচটা বউএর মতো মেয়েটি নিজের স্বামীর অন্যায়কে শেষতম অবস্থান হিসেবে ভাবতে পারে নি। বরং স্বামীর মন্দ ভাবনাকে পরিত্যাগ করে প্রমাণ করে দিতে পেরেছে যে বাঙালি সমাজের মুখরক্ষার জন্যে ঘরে ঘরে তার মতো মেয়ের কত বেশি প্রয়োজন। বাঙালি সমাজে বিভাস সামন্তের মতো কিছু অমানুষ থাকলেও আজও সেলিম ডুরানির মতো অনেকেই সত্যের পূজারী হয়ে রয়েছেন। জীবনের এ পথ দুর্গম হলেও অনির্বান সত্য হয়ে শেষ পর্যন্ত অনেক বড়ো সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারবে।
চলবে…
Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!