এ এক অন্য আঁধার (পর্ব ১৪)

আসছি স্যার, বলেই বদন ঘরের মধ্যে এল একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর জানাতে। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই সে আকাশের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে জড়িয়ে। আকাশও তাকে খুব বিশ্বাস করে। বদনের কিছু বলার আগে আকাশ বলল, আনন্দ ছেলেটা কেমন বলো তো?
স্যার, দুটো পৃথক সত্তা নিয়ে তাকে চলতে হয়। ব্যক্তিগত জীবনে সে মতির সঙ্গে জড়িয়ে। দুজনের চলাফেরা একসাথে। হাটে বাজারে কিংবা চায়ের দোকানে দুজনকে একসঙ্গে দেখতে পাবেন। গ্রাম বাংলার উন্নয়ন নিয়ে দুজনের চিন্তা এক বিন্দুতে মিশে আছে। মূল পার্থক্য মতি কোনো রাজনীতি করে না কিন্তু আনন্দ বিভাস সামন্তের সাথে থাকতে থাকতে পার্টির মস্ত বড়ো ক্যাডার হয়ে উঠেছে। সেটাই আনন্দের দ্বিতীয় সত্তা, যা রাজনীতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। বিভাস সামন্তের সব ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায় আনন্দের উজ্জ্বল ইমেজের আড়ালে। ছেলেটার মধ্যে কেউ কোনো দিন কোনো বিচ্যুতি দেখতে পায় নি। আম জনতা কূটনীতির মানদন্ডে বিভাসবাবুকে বড়ো নেতা মনে করলেও সামাজিক ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে জানে, আনন্দই সব কর্মকান্ডের মূল কাণ্ডারী। এতেও বিভাসবাবুর গোপন সম্মতি রয়ে গেছে। কখনো নিজের সিদ্ধান্ত আনন্দের উপর চাপিয়ে না দিয়ে সব সময় বলে থাকেন, যা সুযোগ এসেছে, পাবলিকদের মধ্যে কীভাবে দিলে হয়, দাও।
তাহলে সব কাজ সম্পন্ন করে আনন্দ, আর কূটনীতির জোরে বিভাসবাবু এলাকার নেতা?
তা বলতে পারেন স্যার। বিভাসবাবু বাস্তবিক বাবু বোসের মতো ঘোড়েলবাজিতে সেরা। মস্তিষ্কের কারসাজিতে আনন্দের মতো অনেক কর্মঠ যুবককে ছাপিয়ে যেতে পারেন। সেই যাদুতে এতদিন নিজের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পেরেছেন।
আকাশের মুখে এক ঝলক হাসি, বদনের মুখে নতুন বিস্ময়। কেন এমন হাসি, তা বদনের মাথায় ঢুকছে না। তাহলে কী বড়বাবু বিভাস সামন্তকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবছেন? নিজের মূল্যায়ণে সামন্তবাবু সম্পর্কে নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছেন? একবার ভাবল, প্রসঙ্গটা পরিস্কার করে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ওসিসাব খারাপ কিছু ভাবতে পারেন ভেবেই চুপ করে গেল। যদিও মনের গভীরে নতুন কৌতূহল শাখাপ্রশাখা বিস্তারে ব্যস্ত। বদন আর নিজের আতিশয্য চেপে রাখতে পারল না। চাপা স্বরে বলল, স্যার, বিভাসবাবুর প্রসঙ্গ শুনে এভাবে হাসলেন যে? নতুন কোন অবস্থান পেয়ে গেলেন নাকি?
তুমি কী জানো, বাবু বোসের কী পরিণতি হয়েছে?
বদন অপলক চোখে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। তার পক্ষে সত্যি সত্যি বাবু বোসের শেষ পরিণতি জানা সম্ভব হয় নি। তো তো করে বলল, জানব কী করে স্যার, আপনি তো এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন।
দুটো শ্রমিককে জোর করে মার্ডার করার দায়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ঘানি টানছে। অনেক চেষ্টা করেও জামিন পাচ্ছে না। ওর পক্ষে গত পরশু কে একজন আমাকে ফোন করেছিলেন। সে কী অনুরোধ। তোমাকে জানিয়ে রাখি বদন, লোকটা কিছুতেই জামিন পাবে না। আরও কিছুদিন লক-আপে থেকে বুঝুক, আমার সাথে লাগলে কী সাংঘাতিক পরিণতি হতে পারে। তারপর অন্য ভাবনা ভাবলেও ভাবতে পারি।
স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। পুলিশ লাইনে চাকরি করতে হলেও কিছুতেই বাবু বোসকে সহ্য করতে পারি নি। লোকটা যে মারাত্মক বিচ্ছু, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। পারেন না, এমন কাজ নেই, অথচ মুখে এমন ভাব দেখান যে কোনো অন্যায় তিনি এতটুকু সহ্য করতে পারেন না। আরেকটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি, বিভাস সামন্ত বাবু বোসের চেয়েও মারাত্মক। শুধু আর্থিক লোভ নয়, শুধু মিথ্যা ক্ষমতার দম্ভ নয়, সেই সাথে তাঁর জীবনে অসম্ভব নারী ভোগের লোভ রয়েছে। দূষিত রাজনীতিকে হাতিয়ার করে যা খুশি তাই করছেন। বাইরে রাতদিন প্রচার করছেন, ক্রিমিনালদের সাথে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। বাস্তবে দেখবেন একেবারে অন্য চিত্র। এভাবেই সামন্তবাবু চারদিকে খারাপের প্রতিযোগিতায় ইন্ধন দিয়ে চলেন। কী বলব স্যার, বিভাসবাবুর মতো বেশ কিছু লোকের জন্যে আমরা এখন পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিবর্তে অকারণে ল্যাং মারার এক বিবর্ণ ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। সামন্তবাবু সেই বিবর্ণ ইতিহাসের নষ্ট নায়ক। যে কেনো মূল্যে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা কিংবা নিজের নেতৃত্ব ধরে রাখা কিংবা রাজনীতির ক্ষমতাকে সামনে এনে অবৈধ নারী ভোগের সুযোগ নেওয়া— সব কিছুই পারেন। এ যুগের অন্যতম সেরা স্বৈরাচারী সামন্তপ্রভু। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সামন্তবাদের বিস্তার চলছে বিভাসবাবুদের হাত ধরে। তাই বলছি কী স্যার….।
কিস্‌সু ভেব না বদন, আমি বাঘ সিংহের সঙ্গে একসঙ্গে খেলতে ভালোবাসি। তুমিও জানো, আমি কী করতে পারি, আর কী করতে পারি না। শুধু খেলার মাঠ পেলেই হল। আমার লম্বা দৌড় দেখে মজা পাবে বদন।
আপনার লম্বা দৌড়ের জন্যে আমিই আপনাকে উপযুক্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে দেব স্যার।
কথায় চোকরা বোকরা ঢং দেখিয়ে কোনো অনুমতি না নিয়ে বিভাস সামন্ত আকাশের চেম্বারে ঢুকে পড়লেন।
আকাশ ইশারা করে বদনকে বাইরে যেতে বলল। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে সামন্তবাবু বললেন, একটা অভিযোগ জানাতে আপনার কাছে এসেছি স্যার। ব্যাপারটা নিজেই ট্যাকেল করলে হয়তো আপনি রাগ করতেন। সেজন্যেই আপনাকে আগে জানানো প্রয়োজন বলে মনে করেছি। নিশ্চয় জেনে ফেলেছেন যে সাম্প্রতিক রাজনীতিতে আমার যে দহরম-মহরম চলছে, তা দিয়ে খুব সহজে ঘটনাটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিতে পারতুম কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেয়েছি, আইন মেনে আপনার মাধ্যমে জিতে যেতে। তাহলেই আমার পক্ষে সরকারি লেবেলে আপনার নামে একটা ভালো রিপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। ভালো কাজ করলে প্রমোশন কখনো আটকে থাকত পারে না স্যার। আমি সবার উন্নতির পক্ষে। এতদিন রাজনীতিতে টিকে থাকার মূল রসদ এমনি মনোভাবের মধ্যেই রয়েছে। সময় গড়ালে এ নিয়ে আপনি আরও বেশি করে জানতে পারবেন।
আকাশের মুখে হাসি। —বলুন সামন্তবাবু, কী সমস্যায় পড়ে আপনাকে আমার কাছে আসতে হল? ফোন করলেই তো কাজ হয়ে যেত।
তা বলেছেন ঠিক, তবুও ভাবলাম, অনেক দিন আপনার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। কাজ নেব, আর দেখা দেব না, নিজেকে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হয়। Kindly মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন। একটা ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে। আমরা সরকারে রয়েছি, আর একটা ক্লাব এভাবে রাজত্ব ফেঁদে বসবে, এ হতে পারে না। আমি নেতাজী সংঘের ছেলেদের কথা বলছি স্যার। ওরা আজকাল কারণে অকারণে আমার উপর হুমকি দিতে শুরু করেছে।
কী বলছেন বিভাসবাবু?
Kindly প্রশ্ন করে বিষয়টাকে হাল্কা করে দেবেন না। যা বলছি, সবই সত্যি। আমার কত ইনফরমার আছে জানেন? চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি। তারাই আমাকে খবর দিল। রায়চক চরে ওরা লাঠি বল্লম ছোরা নিয়ে আমাকে আক্রমণ করতে চাচ্ছে। প্রথম টার্গেট আমি, তারপর আমার কাছের সঙ্গীরা।
এত শক্তি পাচ্ছে কোত্থেকে বলতে পারবেন? পঞ্চায়েত রয়েছে, থানা রয়েছে, এস ডি ও অফিস রয়েছে— এতগুলো প্রশাসন এড়িয়ে এসব ভাবনা ওদের মাথায় আসছে কী করে? এতে অনেক বড়ো বিপদও তো আসতে পারে।
সেজন্যেই আপনার কাছে এসেছি স্যার। আপনি শুনলেই বুঝতে পারবেন। যদি মনে করেন, তাহলে আমার পার্টির সব শক্তি আপনার সাথে যুক্ত করে দেব। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, এটা রাখুন। শুধু কাজ নেব, কোনো মূল্য দেব না, এ পদ্ধতিতে আমি বিশ্বাস করি না।
বিভাসবাবু, আগে বলুন, আপনি নিজেই কী স্পটে থাকবেন? থাকলে একরকম ব্যবস্থা, না থাকলে অন্য কিছু ভাবতে হবে।
উপযুক্ত ফোর্স দেওয়ার পরে যদি বলেন, আমাকে থাকতেই হবে, আমি থাকব। একটা কথা মনে রাখুন, মতি বাড়তে বাড়তে আকাশে উঠে গেছে। পুলিশ প্রশাসনকেও বুড়ো আঙুল দেখাতে শুরু করেছে। সত্যি বলছি স্যার, কেবল ওর কাজকম্মে এলাকার মানুষ আর স্বস্তিতে থাকতে পারছে না। ছেলেটা সুযোগ বুঝে অঘটন ঘটাবে, দোষ হয়ে যাবে পুলিশ প্রশাসনের, আমার পার্টির।
পুঁটিরাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ভিতরে আসতে পারি স্যার? শুধু একটা আবেদন জানাতে এসেছি।
দুজনের আলোচনা মাঝপথে থমকে গেল। ওসি কী বলতে চাইল, তার সবটা শোনা হল না বিভাসবাবুর। নিজেও আরও কিছু যুক্তি দেখানোর কথা ভেবেছিলেন, তাও সম্ভব হল না। আকাশ পুঁটিকে আপ্যায়ণ করে বলল, ভিতরে এস পুঁটি। তারপর কী মনে করে?
পুঁটিরাম বলতে শুরু করল, স্যার, কী যে দিনকাল পড়ল, কিছুতেই নিশ্চিন্তে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সেটুকু জানাতে আপনার কাছে এসেছি।
সামন্তবাবু উস্কে দিলেন, তোমার আবার নিরাপত্তার অভাব হচ্ছে নাকি? স্যার তো রয়েছেন। শুনলে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। ভালো করে বুঝিয়ে বললেই কাজ হবে।
আকাশ একটু হাসল। পুঁটিরাম কে, তার কাজ কী, এসব জানা হয়ে গেছে তার। লোকটা মনের কথা দুড়দাড় করে বলে দিতে পারে। তাই সাগ্রহ নিয়ে বলল, হ্যাঁ বলো শুনি, সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধান করে দেওয়াই তো আমার কাজ।
পুঁটিরাম হাত জোড় করে বলল, স্যার, অনেক করে বোঝানোর পরেও বাউরি পাড়ার ছেলেমেয়েগুলোকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা গেল না। মিড ডে মিল খাওয়ার লোভে দুপুর হলেই স্কুলের দিকে ছুটছে। আপনিই বলুন স্যার, বাউরি পাড়ার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার জন্যে এভাবে সময় নষ্ট করবে কেন? ট্রাডিশন ব্রেক হয়ে যাচ্ছে না স্যার? ওরা পড়াড়োনা করলে কতটা সর্বনাশ হবে, একবার ভেবে দেখতে পারেন।
আকাশের মাথায় দু’তিনটে প্রশ্ন পরপর ঘুরছে। বলল, অভিভাবকরা চাচ্ছে, তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাক। এতে তো কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। মিড ডে মিলের ব্যবস্থা সরকার থেকে করা হয়েছে। এতে তোমার ব্যক্তিগত সর্বনাশের কী আছে?
কী যে বলেন স্যার। ওরা লেখাপড়া শিখলেই তো যত বিপদ। পড়তে শিখবে, কাগজপত্রে কী লেখা আছে, তা মিল করে দেখবে। এভাবে চলতে থাকলে তো আমার তেজারতি ব্যবসার বারোটা বেজে যাবে। স্যার, এ নিয়ে আপনি একটু ভাবুন। এ জন্যে যা যা করলে হয়, করুন। যদি আপনাকে বাড়তি সন্তুষ্ট করতে হয়, করব।
নটুও বিভাস সামন্তের সঙ্গে থানায় এসেছিল। সে বলল, স্যার, নীহারিকা মেয়েটাই যত নষ্টের মূল। ওই তো সকলকে ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। কোনো কাজ নেই, কেবল মতির কথা মেনে চলাকেই নিজের কাজ হিসেবে ভাবে। ভিতরে কী নটঘট আছে, জানি না স্যার। আপনি যদি হুকুম করেন তো মেয়েটাকে তুলে এনে আপনার সামনে হাজির করতে পারি। মানে আপনি নিরিবিলি….।
বিভাস সামন্ত দীর্ঘদিনের রাজনীতিক, প্রশাসনের মর্জি বুঝে চলার ক্ষেত্রে একেবারে পোড়খাওয়া মানুষ। নটুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এসব কি বলছিস রে? মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় আমি নেই। স্যার কী বলবেন, জানি না। পুঁটিরামের দিকে চেয়ে আবার বললেন, অন্যভাবে তো চেষ্টা করা যেতে পারে। তোর হাতে যে তাস রয়েছে তা টেক্কা হিসেবে কাজ করতে পারে। বিভাস ভালো ভাবেই জানেন, নোটনের বিধবা বোনটা দেনার দায়ে পঞ্চায়েতি ঢঙে একরকম পুঁটির হাতে বাঁধা পড়ে আছে। একটু বোঝালে, নীহারিকা না বলতে পারবে না। এতে সুবিধে হল, সাপ মরল অথচ লাঠি ভাঙল না।
সে চেষ্টা কী করি নি স্যার? মতি ঢ্যামনার জন্যে মেয়েটা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বললে মনোযোগ দিয়ে শুনছে কিন্তু সেই মতো কাজ করছে না। মতির সব কাজ তো ভালো কিছুতে বাধা দেওয়া। ঢ্যামনা সাপটা চিবিয়ে চিবিয়ে এমন করে কথা বলে, শুনলে শরীর জ্বলে যায়। শিং তুলে তেড়ে আসা বজ্জাত গরুর মতো। ঢ্যামনা সাপ তো, খুব লাফিয়ে চলে। সহজে কামড়ায় না কিন্তু যেভাবে ফনা তুলে ছুটে আসে, তাতেই শরীর কেঁপে ওঠে।
বিভাসের রসিকতা, একজন মতি ক’টা মেয়েকে চালাবে শুনি? শুনছি, ঘরে একটা পুষে রেখেছে। বাইরেও নীহারিকার মতো কয়েকটা রয়েছে। দেখছি, ছেলেটা মেয়েদের শরীর সামলানোর হাপর হয়ে উঠেছে।
পুঁটিরাম ভাবতে বাধ্য হল যে বিভাসবাবু নিশ্চয় তার প্রস্তাব নিয়ে আগেভাগে অনেক আলোচনা করেছেন। নাহলে সব শুনে ওসি সাব চুপ করে থাকলেন কেন? সামন্তবাবুর কথা ঠিক মাথায় ধরে নিয়েছেন। পুঁটিরাম বিভাসবাবুর উদ্দেশ্যে খোশামুদে মনোভাব নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, আরেকটা কথা শুনুন স্যার, মতি আমার বিরুদ্ধে চারদিকে যা তা বলে বেড়াচ্ছে। রায়চক নিয়ে আপনার সাথে কী সব নটঘট চলছে জানি না। তাতেই মতি রেগে কাঁই হয়ে আছে। ওর মাথায় কোনো হিসেব কাজ করছে না স্যার। আপনাকেই কিসের বাচ্চা বলে গাল দিতে শুনেছি। শরীর এত তেতে গিয়েছিল যে তা সহ্য করতে আমাকে খুব বেগ পেতে হয়েছে কিন্তু চুপ করে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ওই ঢ্যামনার সাথে যে সব উঠতি ছেলে রয়েছে, তারা মোটে ভালো নয়। না শুনবে প্রশাসনের কথা, না শুনবে আপনার কথা, কেবল মতির কথা শুনে নাচতে শিখেছে। যত সব বেআক্কেলে বেইমানের দল।
বিভাস সামন্ত রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁতে দাঁত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, কুত্তার বাচ্চা এতটাই বেড়ে গেছে? কোনো ভয়ডর নেই, এভাবে আমার বিরুদ্ধে বলার সাহস পাচ্ছে? ওসির উদ্দেশ্যে তাঁর আস্ফালন, কিছুতেই এসব মেনে নেব না স্যার। সরকারের পক্ষে প্রশাসন রয়েছে, রাজনীতিতে আমি রয়েছি, মতি সেখানে কে? আর দেরি করবেন না স্যার। নতুবা আমার উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিন। ওই কুত্তাকে কীভাবে শেষ করি দেখুন। নটুকে বললেন, আজকের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফ্যাল। রায়চক চরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মতির লাশটা দেখতে চাই।
টাকার বান্ডিল হজম করা যে কত কষ্টের, আকাশ সেদিন চেয়ারে বসে প্রথম বুঝতে পারল। বিভাসের হুঙ্কার শুনে তার মনে হতে থাকল, সামন্তবাবু খানায় বসে এলাকার রাজনীতি পরিচালনা করছেন। ভিতরে ভিতরে ভীষণ অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল। বাধ্য হয়ে সামন্তবাবুকে শুনিয়ে বললেন, আপনি কী নিজেকে এলাকার ঈশ্বর ভাবছেন? যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার থাকে, তা প্রশাসনের দায়িত্ব। নটু কী থানার পুলিশ নাকি? মতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব যদি একা নটু পালন করে, তাহলে থানায় আমাদের কাজ কী? জেনে রেখে দিন, রায়চক নিয়ে মতির গায়ে নোখের আঁচড় পড়লে আপনিও মহাবিপদে পড়ে যাবেন। বাবু বোসের পরিণতির কথা ভেবে নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছি। এর বাইরে গেলে আমি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব না।
বিভাস সামন্তও কম ঘোড়েল নন। অনেক বছর রাজনীতি করছেন। অনেক বড়ো অভিজ্ঞতা। কূটনীতিতে দাবার চাল দিতে এলাকার মধ্যে সেরা মানুষ হয়ে উঠেছেন। কখন জ্বলে উঠতে হয়, তাঁর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। একটু থেমে, এক পলক ভেবে কণ্টস্বরে কাঠিন্য এনে বললেন, দেশ চালাতে গিয়ে নিজেকে নিংড়ে দেব, প্রাণ খুলে মানুষকে সেবা দেব, আর আপনি প্রশাসনের চেয়ারে বসে যা খুশি তাই করবেন? আমাদের দলীয় ভাবমূর্তির চেয়ে নিজের খামখেয়ালিপনাকে বড়ো করে দেখছেন? এসব মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাকে খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিই, আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে এস পি-কে ধরে বুঝিয়ে দেব, আমিও পারি প্রশাসনের উপর চাপ রেখে দেশের মানুষের স্বার্থে প্রকৃত কাজ আদায় করে নিতে। তারপর আপনার বিরুদ্ধে অন্য লড়াই শুরু হবে। রাজনীতির জোরে যে প্রশাসন আমরা গড়ে তুলেছি, তার উপর নির্ভর করে পদস্থ অফিসারদের চাকরি করতে হয়।
আকাশ মাথা গরম না করে বোঝানোর ভঙ্গীতে বলল, একটা খবর এখনও আপনাকে দিতে পারি নি। নেতাজী সংঘের যে সব সদস্য এতদিন আপনার সাথে ছিল, তারা এখন আর কেউ আপনার সঙ্গে নেই। আনন্দও চলে গেছে। সকলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি মতি নিজেই। তারা মতির কথায় উঠছে বসছে। আপনাকেই ঠিক করতে হবে, এত বড়ো সমর্থন হারিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারবেন, না নতুন করে ঘর গোছানোর চেষ্টা করবেন। শুধু আপনার এ উগ্রমূর্তির খবর ক্লাবে পৌঁছে গেলে দেখবেন, নতুন খেলা শুরু হয়ে যাবে। এতদিন ‘আমার এলাকা’ বলে যে দাপট দেখাতেন, তা মতির পক্ষে চলে যেতে পারে। হয়তো এলাকার মধ্যে কূটনীতিতে আপনিই সেরা, কিন্তু এখন দেখছি, মতির মতো বাচ্চা ছেলের হাতে আপনাকেই ঘায়েল হতে হচ্ছে। নতুন সময়ে এ প্রহসন সত্যি দুঃখজনক সামন্তবাবু।
পুঁটিরামের মধ্যে অভিনব ব্যস্ততা। বিভাস সামন্তের পাশে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, স্যার, ওসিসাব ঠিক বলেছেন, আর এগোবেন না। সামনে বড়ো বিপদ। কী করবেন বলুন, মতির মতো কুকুরের বাচ্চা স্লো পয়জন দিয়ে ঠিক সময়ে ক্লাবের সকলকে ভাঙিয়ে নিয়ে গেছে। শুনছি, ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি রাজনীতিতে নামবে।
এতদিনের অভ্যেস, কিছুতেই পিছু হটতে পারছেন না বিভাস সামন্ত। গলার স্বর চড়িয়ে নটুকে বললেন, চক্কোত্তিকে খবর দে, হেস্তনেস্ত না করে ছাড়ছি নে। আজ সন্ধে এস ডি ও, এস ডি পি ও-র সাথে কথা সেরে নিচ্ছি। তারপর কে সামনে এসে দাঁড়ায়, সেটাই দেখব।
নটু আর দেরি করতে পারল না। লিডারের কড়া হুকুম। সাইকেলে সামনে এগিয়ে চলল ট্যারা চক্রবর্তীর বাড়ির দিকে। এতদিনের টানাপোড়েনে নটু ভালোভাবেই জেনে গেছে, অনেক চেষ্টায় কিছুটা হাত পাকাতে পারলেও সে তখনও ট্যারার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে নি। লোকটা সত্যি সাংঘাতিক। ডাকাতি, রাহাজানি, খুনখারাপি— সবেতেই এলাকার মধ্যে সেরা। নটুকেও একটা সময় ট্যারার হাত ধরে সামনে আসতে হয়েছে, কিন্তু কখনো তার নেতৃত্ব কেড়ে নিতে পারে নি। পৈশাচিক কাজে ট্যারার শরীরে যে বংশগত অধিকার রয়েছে, তা তার রক্তে নেই। ওর বাবাও ছিল মস্ত বড়ো ডাকাত। এমন সব জায়গায় কাজ সেরে বের হতে পারত, যা নটুর পক্ষে ভাবাও কঠিন। ট্যারার বাবা ভীষণ চক্রবর্তী শুধু ডাকাতিতে হাত পাকায় নি, রাতের অন্ধকারে ডাকাতি শেষ হলে জোর করে নারীদেহ ভোগের সেরা ওস্তাদ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ট্যারার মধ্যে কমবেশি সেই দোষ থাকলেও তাকে এখন রাজনীতির কলে পড়ে থাকতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও সব সুযোগ নিজের মতো করে কাজে লাগাতে পারে না। এজন্যে ভিতরের খেদ তাকে মাঝে মধ্যে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। বার বার চেষ্টা করেও বাপকা বেটা হয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। সাম্প্রতিক সময়ে বিভাসদার হাত ধরে নারীদেহ নিয়ে কিছুটা ছিনিমিনি খেলতে পারছে নটু। কেবল সেই কারণে সে বিভাস সামন্তের উপর অনেকখানি দুর্বল। দ্বিতীয়বার নারীভোগকে সে উচ্ছ্বিষ্ট হিসেবে ভাবতেও রাজি নয়। বরং জীবনের এ উপরি পাওনাকে সে নিজের সৌভাগ্য হিসেবে ভাবতে শিখেছে।
সময়ের টানকে সামন্তবাবু গলার স্বরের যাদুতে এমন উচ্চগ্রামে তুলে নিয়ে যেতে পারেন যে অনেকেই তা দেখে থমকে যেতে বাধ্য হয়। কখনো গলার স্বর নামিয়ে, কখনো আরেকটু উঁচুতে তুলে কথার তুবড়ি দিয়ে বিশুদ্ধ মানুষকে কাত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সামন্তবাবু সত্যিই সেরা। একটু সময় নিয়ে গুম হয়ে বসে থেকে ওসির উদ্দেশ্যে গলার সুর চড়িয়ে বললেন, প্রথমেই আপনাকে অনুরোধ করব প্রশাসন দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে, না পারলে আমাকে অগত্যা ট্যারা চক্রবর্তীর সাহায্য নিতে হবে। আপনি প্রশাসনে আছেন। আমি রাজনীতিতে। যাবার আগে শেষ অনুরোধ, শুধু শুধু আমাকে বঞ্চিত করে নিজের পদমর্যাদা রক্ষা করতে চাইবেন না।
আকাশ একবার বিভাস সামন্তের দিকে দুচোখ রেখে মুখ ঘুরিয়ে নতুন আরেকটা চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। বিভাস সামন্ত যেমন বাইকে এসেছিলেন, তেমনি বাইকে ফিরে গেলেন। মনের যন্ত্রণায় আকাশ নিজের চেম্বারে পায়চারি করছে আর কত কী ভাবছে। মনের সব রাগ উপছে পড়েছে বিভাস সামন্তের উপরে। কেবল রাজনীতির জোরে লোকটা এতটা দম্ভ দেখাতে পারলেন। প্রশাসনকেও বুড়ো আঙুল দেখাতে তাঁর বিবেকে এতটুকু বাধছে না। সামন্তবাবু এতদিন নিজের ইচ্ছেয় শুধু ঘুঘু দেখেছেন, এখন তাঁকে আকাশের উদ্যোগে ফাঁদ দেখতে হবে। তখন বুঝবেন, কত ধানে কত চাল। যে স্পর্ধা নিয়ে সামন্তবাবু হেনার দিকে তাকাতে চাচ্ছেন, সেই চোখদুটো উপড়ে নেওয়া তার পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। চেয়ারে বসে সরোষে চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে বেইমান, তোর মৃত্যু হবে আমার হাতেই।
আকাশ আর কথা না বলে গুম হয়ে বসে থাকল চেয়ারে। হেনার দেহ সৌন্দর্যের ছবি তার দুচোখের পাতায় ভাসছে। কতদিন মেয়েটার সঙ্গ পায় নি সে। সামন্তবাবু জানেন না, তিনি যে মেয়েটাকে বেওয়ারিশ ভাবছেন, তার উপরে আকাশের কত বড়ো দাবি রয়েছে। কল্পনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে হেনার শরীরের গন্ধ নিতে নিতে আকাশ মনে মনে উন্মত্ত হয়ে উঠল। একটা বজ্রকঠিন প্রতিজ্ঞা তার মধ্যে ক্রমে সুদৃঢ় হয়ে উঠছে, যে কোনো মূল্যে হেনাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
চলবে…
Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!