মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত সেলিনা হোসেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস লক্ষীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রাম। মরহুম এ. কে মোশাররফ হোসেন ও মরিয়ম-উন-নিসার নয় সন্তানের মধ্যে তিনি চর্তুথ সন্তান ছিলেন। শৈশবের আঙিনা করতোয়া নদীর পাশে, তারপর পদ্মা নদীর অববাহিকায় কেটেছে। রাজশাহীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ে লেখালেখি মাধ্যমে সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। একই সাথে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ছোটগল্পবিষয়ে প্রবন্ধ রচনার জন্য ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক লাভ করেন। জীবনের নানামাত্রিকতায় সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ অনুধাবন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকেই সেই অনুধাবনের বিরল ঐশ্বর্য সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের প্রত্যক্ষ দৃশ্য তুলে ধরেছেন তাঁর ‘একাত্তরের ঢাকা’ গ্রন্থে। “ ২৭ তারিখে কার্ফ্যু ভাঙতেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই দেখলাম সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়াল সংলগ্ন এ.আর. ভূঁইয়ার বাড়িটি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জনপ্রাণীহীন শূন্য বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। … এলিফ্যান্ট রোডে পড়তেই দেখলাম মানুষ ছুটছে। পোটলা-পুঁটলি বৌ-বাচ্চা নিয়ে যে যেখানে পারছে পালাচ্ছে। … রাস্তায় অল্পকিছু গাড়ি-রিকসা চলছে। নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজারের কাছে আসতেই দেখলাম বাজারের বিধ্বস্ত অবস্থা। তরকারীর ঝুড়ির উপর উপুড় হয়ে আছে লোক, পিঠে গুলি। গুলি খেয়েও গড়িয়ে পড়েনি, যেভাবে বসেছিলো সেভাবেই রয়ে গেছে। আশেপাশে আরো তিন-চারটে লাশ হয়ে উপুড় হয়ে, চিৎ হয়ে পড়ে আছে।” মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের প্রত্যক্ষ স্মৃতি তাঁর জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত পারে। তাইতো তিনি বলতে পারেন, “একাত্তর বাঙালি চেতনায় অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা। … একাত্তর তারাভরা আকাশের নিচে আলপনা আঁকা উঠোনে গণমানুষের উৎসব। … একাত্তর পলিমাটিভরা ক্ষেত ফসলের ঐশ্বর্য। … বাংলার নবান্ন স্মরণ করে ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন গণআন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের। শহীদের আত্মা আমাদের স্বাধীনতার অমরজ্যোতিতে আলোর বিচ্ছুরণ।” (একাত্তরের অমরকথা- সেলিনা হোসেন)
বিশ্বে নয়া উপনিবেশিকতার প্রবল প্রতিপত্তে, নয়া সাম্রাজ্যবাদের চরম উত্থানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, শিল্প-সাহিত্যে যেসব গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে, সেসব তাঁর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে উঠে এসেছে। বাংলার জনজীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সাহিত্যের, বিশেষ করে উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধে তাঁর অনন্য সৃষ্টি সম্ভার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা একাডেমিতে জীবনের সিংহভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন, আর সেই সময় গভীর সংযোগ ঘটে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গ্রন্থের । উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ প্রকাশিত হবার পর তাঁর ব্যাপ্তি, খ্যাতি যেন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের বিভিন্ন বাঁকে লিখে চলেছেন অবিরাম, আর লিখতে গিয়ে বাস্তবকে বোঝার জানার ব্যাকুলতা, ভৌগোলিক স্থানে পরিভ্রমণের মাধ্যমে বিষয়ের প্রতি গভীর সংযোগ তাঁর সৃষ্টিকর্মকে বৈচিত্র্য দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের বহু অজানা তথ্যে তাঁর গল্প, উপন্যাস স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পাঠক গবেষককে বিস্মিত করে। সাহিত্য সংস্কৃতির নানা আয়োজনে-সেমিনারে-সম্মিলনে-উৎসবে-বইমেলায় বিভিন্ন দেশ বিদেশে পরিভ্রমণ করেছেন। যার ফলে তাঁর সাহিত্য সম্ভার বিশ্ব সাহিত্যে অন্যতম শক্তিশালী সংযোজন হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, দেশপ্রেম, নারী জাগৃতি, নৃ-গোষ্ঠীর প্রতি মমত্ববোধ, শিশু-কিশোরদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক চিরায়ত মানবিক মূল্যবোধ তাঁর লেখায় অপূর্ব বন্ধন সৃষ্টি করে। বাঙালি-জীবনের মহোত্তম ভাবনায় প্রণীত তাঁর বহুবিধ প্রবন্ধ অসামান্য মননশীলতার পরিচয় দেয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিবাদী মনোভাব, তাঁকে আন্তর্জাতিক মানবে পরিণত করে।
কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের বহু সৃষ্টিকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে পঠিত হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। দেশে-বিদেশে বহু সম্মানে ভূষিত এই প্রতিভাধর সাহিত্য-শিল্পীর সাধনা সমকালকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ‘ভাষা মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি’ গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘আমরা সাহিত্যকে স্মৃতির দলিল হিসেবে তুলে ধরব, প্রতিদিনের জীবনের বর্ণনা বিস্মৃত হব না, মানবিক নিপীড়নের মুখে টিকে থাকার সংগ্রামকে স্থায়ী রূপ দেব এবং আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নের গল্প বলব। সৃজনশীল প্রকাশকে রূদ্ধ করার চেষ্টা হলে তাকে প্রতিরোধ করব। জেন্ডার, শ্রেণী, জাতি, জাতিসত্তা, জাতীয়তা কিংবা ধর্ম ইত্যাদিকে অস্বীকার করে মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করলে তাও প্রতিরোধ করব।’ ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে এশিয়-আফ্রিকা সাহিত্য সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার জনজু শহরে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সেলিনা হোসেন তাঁর ‘মাতৃভাষা, সাহিত্য সম্মেলন ও বইমেলা’ নামক প্রবন্ধে। মানুষের জন্ম যেস্থানে হোক না কেন, বিশ্ব পরিম-ল অবারিত। লেখক সেই অবারিত স্থানের ভেতর জীবনের আত্মিক প্রকাশ ঘটান। সর্বমানবচিত্তের যোগ স্থাপনই প্রত্যেক লেখকের প্রধান প্রচেষ্টা থাকে। আর এ কারণে লেখক দার্শনিকরা ভৌগোলিক ও কালের সীমা অতিক্রম করে মহাকালের অগ্রযাত্রার পথিক হয়ে যান। এই সাধনা কঠোর তপস্যার, সকলেই অতিক্রম করতে পারে না। সৃষ্টি সাধনায় মহীয়সীরূপে সেলিনা হোসেন মহাকালকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
সেলিনা হোসেনের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তারমধ্যে’ স্বদেশে পরবাসী’ গ্রন্থটিতে উনিশটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মূলত কথাসাহিত্য আমার ক্ষেত্র। প্রবন্ধে যা লিখেছি তা একান্তই মুহূর্তেক ভাবনার ছিটেফোঁটা বহিঃপ্রকাশ। সেখানে কোনো বড়ো ক্যানভাস নেই, আছে ছোট পরিসরে টুকরো টুকরো আঁচড়- যাকে বড়ো ক্যানভাসে একত্র স্থাপন করলে একজন সৃজনশীল লেখকের মানস-ভুবন রঙেরেখায় চিত্রিত হয়।’ ‘সৃজনশীল লেখক প্রবন্ধ না লিখলে নিজের মানসকে পাঠকের সামনে খুলে দিতে পারেন না।’ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম ‘স্বদেশ পরবাসী’। জীবনের ভাবনাকে উপস্থাপন করেছেন। ‘একজন লেখক তাঁর সাহিত্য ভাবনাকে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে রাখেন। সে শেকড় চলে যায় গভীর থেকে গভীরে, তিনি অনবরত সেখান থেকে রস শোষেণ। এই শোষার মধ্যে লেখক থেকে লেখকে পার্থক্য আছে। যিনি যতো গভীর করে আত্মস্থ করেন তিনি তত বড় শিল্পী।’ এই প্রত্যয় ব্যক্ত করতে গিয়ে কবিগুরুর প্রসঙ্গের সাথে আপন অনুভব মিলিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গত এসেছে পটুয়াখালি, টেকনাফ, শাহপরী দ্বীপ, সমুদ্র, জাফলং, পাহাড়, ঝর্না, কাপ্তাই হৃদ, কান্তজ মন্দির, রাঙামাটি, পাহাড়ের সৌন্দর্যসহ নানারকম অন্তর অনুভূতি। ‘’পরিশ্রমবিমুখতার ফলে ক্ষমতার অপচয়ই এখন আমাদের সাহিত্যিক পরিম-লে জলবায়ু। ভবঘুরে জীবনযাপনে যেমন ধৈর্য্য, পরিশ্রম, সহিষ্ণুতার প্রয়োজন- গদ্যের ভূখ-ও তেমনি পরিশ্রমী, কর্মঠ এবং শিল্পিত হাত চায়। ছন্দ থাক আর না থাক দু’চার লাইন গদ্য-কবিতা ছাপিয়ে রাতারাতি নাম কেনার অপচেষ্টা বেদনাদায়ক।’ এই নির্মম সত্য উচ্চারণ একজন প্রকৃত লেখকই করতে পারেন। প্রত্যেকটি প্রবন্ধে আছে তুলনা প্রতিতুলনা, যুক্তির পারঙ্গমতা। নিসর্গের বিন্যাসে উপন্যাসের প্রসঙ্গে ইউরোপের সভ্যতার প্রসঙ্গ, বাংলার উৎপাদন প্রক্রিয়া, গ্রাম জীবন স্থান পেয়েছে। ১৯৪৭-এর পরবর্তী বাংলাদেশের উপন্যাস প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আলাউদ্দীন আল আাজাদ, সরদার জয়েনউদ্দিন, আবু ইসহাকসহ সেসময়ের লেখকদের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। উপন্যাসের কাঠামো বর্ণনা করে অনাগত লেখকের প্রতি আহবান, ‘তাই আমরা একজন টগবগে তরুণের অপেক্ষায় আছি, আলেকজান্ডারের মতো যে অবলীলায় উপন্যাস নামক ঘোড়াটির মতিগতি বুঝবে।’ ‘সে ছোটা স্বকীয় ক্ষমতা এবং আসুরিক পরিশ্রমের বিচক্ষণ যাত্রা।’ এই বিচক্ষণ প্রত্যাশা সকলের জন্য। কবিগুরুর ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে যে অনুভব, সেই অনুভব নানামাত্রিকতায় লেখকের লেখায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ‘ জগতের উপর মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপরে বিশ্বমনের কারখানা- সেই উপরের তলা হইতে সাহিত্যর উৎপত্তি।’ সাহিত্যর গতি বিচিত্র, তা যেন জড়ত্বের দ্বারা বিশ্ববোধের লোপ না ঘটে। সৌন্দর্যের প্রকাশে লেখকের প্রজ্ঞা অতি আবশ্যক। যেকথা কবি কীটস বহুবছর আগে বলেছেন, Truth is Beauty, Beauty is Truth তা যে সর্বকালে সমানভাবে প্রযোজ্য। সফোক্লিপসের ইদিপাসের আর্তনাদ, আমার জন্য নয়নমুগ্ধকর বিশ্ব কোথায়? রোমিও জুলিয়েটের জুলিয়েট যখন বলেন,
O, I have brought the mansion of a love,
But not possess’d it, and thought I am sold
not yet enjoyed
প্রেমের এই মর্মবাণী লেখকের অন্তরে কম্পন বয়ে আনতে পারে। রাষ্ট্র সমাজের ভেতর লেখকের বসবাস, কাল পরিক্রমায় যা পাই, তা লেখকের ভাণ্ডার থেকে পাই। সেলিনা হোসেন নানাভাবে উপলব্ধির জগতকে প্রকাশ করে ‘স্বদেশ পরবাসী’তে আরো লিখেছেন, সেতুবন্ধন, অলিখিত জীবনের ভাষ্যকর, দাজাই ওসামুর শিল্পভুবন, ভূমিকা: অগ্রজের, ঘরগেরস্থিতে নোনাজল, প্রসঙ্গ: সেইসময়, শুধু কিছু কথা, আব্বাসউদ্দীন: বহমান নদী, একমেরুতে বসতি, সোনালি ভুবন, ল্যাতিন আমেরিকার উপন্যাস, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ: শিল্পসাহিত্যের ভূমিকা, উপন্যাসের দিগ্বলয়: স্বপ্ন ও বাস্তব, ছোটগল্পের সংকট, শিল্পের খনন: লেখকের দায়, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষ।’ মুক্তচিন্তা ও বোধের প্রখরতায় প্রত্যেকটি প্রবন্ধ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন লিখছেন অনবদ্য, একইভাবে লেখক শিল্পীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে তাদের সাহিত্য চর্চাকে প্রসারিত করছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমে তাঁর মহৎ ভাবনা লেখক-শিল্পীকে দায়বদ্ধ করে তোলে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনার সাথে তাঁর চিন্তার সাযুজ্য খুঁজে পাই। “সূর্যের ভেতরের দিকে বস্তুপিণ্ড আপনাকে তরল-কঠিন নানাভাবে গড়িতেছে, সে আমরা দেখিতে পাই না, কিন্তু তাহাকে ঘিরিয়া আলোকের মণ্ডল সেই সূর্যকেই কেবল বিশ্বের কাছে ব্যক্ত করিয়া দিতেছে। এইখানে সে আপনাকে কেবলই দান করিতেছে, সকলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করিতেছে। মানুষকে যদি আমরা সমগ্রভাবে এমনি করিয়া দৃষ্টির বিষয় করিতে পারিতাম, তবে তাহাকে এইরূপ সূর্যের মতোই দেখিতাম। দেখিতাম, তাহার বস্তুপিণ্ড ভিতরে ভিতরে ধীরে ধীরে নানা স্তরে বিন্যস্ত হইয়া উঠিতেছে, আর তাহাকে ঘিরিয়া একটি প্রকাশের জ্যোর্তিমণ্ডলী নিয়তই আপনাকে চারি দিকে বিকীর্ণ করিয়াই আনন্দ পাইতেছে। সাহিত্যকে মানুষের চারি দিকে সেই ভাষার রচিত প্রকাশম-লীরূপে একবার দেখো। এখানে জ্যোতির ঝড় বহিতেছে, জ্যোতির উৎস উঠিতেছে, জ্যোতির্বাষ্পের সংঘাত ঘটিতেছে। ‘সাহিত্যের এই পথরেখা চিনতে পারলেই বিশ্ব সাহিত্যের দ্বার বোঝা যায়। … এই বিশ্বসাহিত্যে আমি আপনাদের পথপ্রদর্শক হইব এমন কথা মনেও করিবেন না। নিজের নিজের সাধ্য অনুসারে এ পথ আমাদের সকলকে কাটিয়া চলিতে হইবে।… গ্রাম্য সংকীর্ণতা হইতে নিজেকে মুক্তি দিয়া বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে বিশ্বমানবকে দেখিবার লক্ষ্য আমরা স্থির করিব, প্রত্যেক লেখকের রচনার মধ্যে একটি সমগ্রতাকে গ্রহণ করিব এবং সেই সমগ্রতার মধ্যে সমস্ত মানুষের প্রকাশচেষ্টার সম্বন্ধ দেখিব, এই সংকল্প স্থির করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে।” (বিশ্বসাহিত্য)। সেলিনা হোসেনের বিচিত্র কর্মযজ্ঞের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের সামগ্রিক জীবনবোধের পরিচয় নানামাত্রিকতায় ফুটে উঠেছে। তাঁর ভাষার নির্মাণ স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে সেলিনা হোসেনের সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞ বিশাল এবং বিস্তৃত অধ্যায় হয়ে আছে। বিশ্বকবিকে নিয়ে ছোটগল্প ‘আতুড়ঘর’, উপন্যাস ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’ অভূতপূর্ব সংযোজন সাহিত্যের ইতিহাসে। সেলিনা হোসেন তাঁর গল্প ও উপন্যাস প্রসঙ্গে বলেন, ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘর দেখে মনে হয়েছিল এত ছোট্ট একটি ঘর। এই ঘরে জন্ম নিলেন কত বড় একজন মানুষ। লিখলাম গল্প ’আঁতুড়ঘর’ নামে। … রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যে কয় বছর একটানা বাস করেছিলেন সেই পটভূমিতে লিখলাম উপন্যাস ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তারমধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশে আমরা, ১৯৬১: ঢাকায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, রবীন্দ্রনাথ, বাঁশি ও বাংলার সুর, ছিন্নপত্রে’ নদী ও মানুষ, উপন্যাসের নানাকথা, পোশাক-সচেতন রবীন্দ্রনাখ, রবীন্দ্রনাথ ও মাতৃভাষা’ উল্লেযোগ্য। বিশ্বকবিকে নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের সময়’ নামক একটি গ্রন্থ কলকাতার দে’জ পাবলিশিং খেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থ প্রসঙ্গে তিনি ভূমিকায় লেখেন, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ শুনলেই আমার ভেতর একটা ভাবনা কাজ করতো। রবীন্দ্রনাথের জীবন ধরে সাল ভিত্তিক একটি কাজ করার চিন্তা আমি তখন থেকেই করেছি। তাঁর জীবনের প্রতিটি বছর বছরে তিনি কি করেছিলেন এবং সে সময়ে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যদেশে কি ঘটনা ঘটেছিল। অনেকদিন বিষয়টি মাথায় রাখি এবং তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। তার সূত্র ধরে লেখা হয় আমার ’রবীন্দ্রনথের সময়’ গ্রন্থটি।’ সেলিনা হোসেনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ক সকল লেখার সংকলন “রবীন্দ্রনাথ” নামক গ্রন্থে পাওয়া যাবে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সুবিশাল সৃষ্টিশীলতা অমর হোক। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকিতে তাঁর ভাবনা ও লেখালেখি সর্ম্পকে বলেন, “আমি আপনাদেরই সেলিনা হোসেন। আমার অন্তরে বসবাস করে ‘জয়ধ্বনির ‘ জয় বাংলা’। জীবনের সকল ইচ্ছের মধ্যে সজীব শ্যামল মাটির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা সসময়। সবুজের পাললভূমিতে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জয় বার্তার মাধ্যমে সৃষ্ট এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জন্মেছিলাম দেশভাগের নিদারুণ আর্তনাদের সময়। অনুভব করেছি সেইসব যন্ত্রণা। লক্ষ্য করেছি বিপণœ মানুষের জীবনের নানারকম আর্তি। মাঠে ময়দানে শুনেছি ভাটিয়ালি পল্লীগীতি কীর্তন বাউল সংগীত। প্রকৃতির বিচিত্র রূপে মুগ্ধ চিত্তে অপরূপ সৌন্দর্যের দেশকে অকৃপণ ভালোবেসেছি। জাতীয় শক্তির তেজকে জাগ্রত করার রাজনৈতিক পদক্ষেপের সাথে তপস্যার মতো মানুষের জীবনকে অনুভব করেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক শাসকের ভয়াবহ নৃশংসতা, হত্যাযজ্ঞ, বীভৎস অত্যাচার দেখে হতবাক হয়েছি। নারীর উপর সীমাহীন হিংস্রতার বিরুদ্ধে জাগ্রত একটা সমাজের অনুভব করেছি। সমস্ত কঠিন সময়কালে আমার অন্তর বার বার বলে, ‘যখন বুকের রক্তে লিখেছি / একটি নাম/ বাংলাদেশ।’ আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের বাঙালির শরীর পরিপুষ্ট থাকবে প্রাচুর্যে, দেশের একটি মানুষও নিরক্ষর থাকবে না, এদেশে ধর্মান্ধতার উত্থান হবে না। নারীর মর্যাদা রক্ষিত হবে। এসবই আমাদের একাত্তরের অবিনাশী চেতনা। সকল চেতনার মধ্যে আমি অনুভব করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। বাংলার তীর্থভূমিতে বহু আলোকিত মানুষের আগমন ঘটেছে। সেইসব অমর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আমরা। স্বজাতির গৌরবের জয়ধ্বনিতে সমস্ত দেশের মানুষ অহিংস হোক।
আমার লেখার ভুবন, এই মৃত্তিকার জনমানুষের বিপণ্ণ ক্লিষ্ট জনজীবন। বড্ড ভালোবেসে প্রান্তিক জনপদে ছুটে গিয়েছি। ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে নিয়ে জনজীবনের চালচিত্রের শৈল্পিক রূপায়ন উপন্যাস, ছোটগল্পসহ সমস্ত সৃষ্টিকর্মে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। সেই সাধনা দেশকে উপজীব্য করেছে। যা বিশ্ব আঙিনায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছে। এর মূল কারণ, আপনাদের ভালোবাসা। আমিও ভালোবাসি, আর প্রতিনিয়ত দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করি।
জগতের মধ্যে কত বিপুল আয়োজন, আমি সেই আয়োজনের মধ্যে মানবিকতার ধর্মকে সারথি করেছি। সময়ের দীর্ঘ বিবর্তনে উন্নয়ন ভাবনা, শিল্প বিপ্লবের বিচিত্র উদ্যোগ লক্ষ্য করছি। বিশ্বে শরনার্থী, যুদ্ধ বিধ্বস্ত জনজীবন দেখে আমার অন্তরজগত ক্রন্দন আবেগে প্লাাবিত হয়। সমতার বিষয়টি সুদূরপরাহত হলেও আমি নৈরাশ্যবাদী নই। দেশের অভ্যন্তরে নারী পুরুষের সমতার জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূলধারায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছি। আমি সকল কিছুর উর্দ্ধে লেখাই আমার আনন্দবোধের শক্তি এনে দেয়। যতদিন বাঁচি, ততদিনই আমার একটাই জগৎ, তা হলো লেখার জগত। আমি সুন্দর জগতের প্রাচুর্যে সুখদুঃখ, আনন্দ বেদনাকে সারথি করে সচেতনভাবে লিখে চলেছি। এই চলা অবিরাম। সেই অবিরাম পথে অন্তরে ধ্বনিত হয়, সব্বে সত্তা সুকিতা হোন্তু। সকল জীব সুখী হোক।
সাহিত্যের নানা আয়োজনে বৃহৎ মিলনের উৎসব লক্ষ্য করি। বঙ্গীয় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আমিও বঙ্গবাণীর রূপরস আস্বাদন করে মনুষ্যত্বের জয়গান করি। আমার জন্মদিবস কখনই ঘটা করে পালন করিনি, করতেও দেইনি। সত্তর অতিক্রম করার সময় বঙ্গীয়’র মাধ্যমে জন্মদিনে সকলের সাথে মিলনযজ্ঞে মিলিত হয়েছিলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হবার পর আবার মিলিত হয়েছি। গত দুবছর আমরা আমাদের বহু আপনজনকে হারিয়েছি। সেইসব বেদনার ভেতর আমি নির্মল সুন্দর বিশ্বে বেঁচে আছি। এ যে আমার বড় প্রাপ্তি। এই দেশের সকল ধর্মের মানুষ, সকল জাতির জনগোষ্ঠী শান্তিতে বেঁচে থাকুক। সমতার বাংলাদেশ হোক। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। মুক্তচিন্তার সমাজ সৃষ্টি হোক।
আসুন, আমরা পরস্পরকে ভালোবেসে ভালোবাসার সোনার বাংলা সৃষ্টি করি।” (সেলিনা হোসেন)
সেলিনা হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থ ও জীবনের নানা দিক (সারসংক্ষেপ):
প্রকাশিত গ্রন্থ: উপন্যাস – ৪৫টি, গল্পগ্রন্থ – ১৬টি, প্রবন্ধ – ১৫টি, শিশু সাহিত্য – ৪১টি, সম্পাদিত গ্রন্থ – ১১টি, ইংরেজি অনুবাদ – ১২টি।
উপন্যাস:
জলোচ্ছ্বাস (১৯৭২); জ্যোস্নায় সূর্যজ্বালা (১৯৭৩); হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬); মগ্ন চৈতন্যে শিস (১৯৭৯); যাপিত জীবন (১৯৮১); নীল ময়ূরের যৌবন (১৯৮২); পদশব্দ (১৯৮২); চাঁদ বেনে (১৯৮৪); পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬); নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি (১৯৮৭); ক্ষরণ (১৯৮৮); কাঁটাতারে প্রজাপতি (১৯৮৯); খুন ও ভালোবাসা (১৯৯০); কালকেতু ও ফুল্লরা (১৯৯২); ভালোবাসা প্রীতিলতা (১৯৯২); টানাপোড়েন (১৯৯৪); গায়ত্রী সন্ধ্যা – এক (১৯৯৪); গায়ত্রী সন্ধ্যা – দুই (১৯৯৫); গায়ত্রী সন্ধ্যা – তিন (১৯৯৬); দীপাম্বিতা (১৯৯৭); যুদ্ধ (১৯৯৮); লারা (২০০০); মোহিনীর বিয়ে (২০০১); কাঠ কয়লার ছবি (২০০১); আনবিক আঁধার (২০০৩); ঘুম কাতুরে ঈশ্বর (২০০৪); মর্গের নীল পাখি (২০০৫); অপেক্ষা (২০০৭); দিনের রশিতে গিটঠু (২০০৭); মাটি ও শস্যের বুনন (২০০৭); পূর্ণ ছবির মগ্নতা (২০০৮); ভূমি ও কুসুম (২০১০); যমুনা নদীর মুশায়রা (২০১১); আগস্টের একরাত (২০১৩); গেরিলা ও বীরাঙ্গনা (২০১৪); দিনকালের কাঠখড় (২০১৫); স্বপ্নের বাজপাখি (২০১৫); নিঃসঙ্গতার মুখর সময় (২০১৬); হেঁটে যাই জনমভর (২০১৬); সাতই মার্চের বিকেল (২০১৮); বিষণ্ণ শহরের দহন (২০১৯); সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া (২০১৯); বধ্যভূমিতে বসন্ত বাতাস (২০২১); ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (২০২১); শরণার্থী সুবর্ণরেখা (২০২২)
গল্পগ্রন্থ:
উৎস থেকে নিরন্তর (১৯৬৯); জলবতী মেঘের বাতাস (১৯৭৫); খোল করতাল (১৯৮২); পরজন্ম (১৯৮৬); মানুষটি (১৯৯৩); মতিজানের মেয়েরা (১৯৯৫); অনূঢ়া পূর্ণিমা (২০০৮); সখিনার চন্দ্রকলা (২০০৮); একালের পান্তাবুড়ি (২০০২); অবেলার দিনক্ষণ (২০০৯); নারীর রূপকথা (২০০৯); নুনপান্তার গড়াগড়ি (২০১৪); মৃত্যুর নীলপদ্ম (২০১৪); নুনপান্তার গড়াগড়ি (২০১৫); প্রিয় দৃশ্য সূর্যাস্ত (২০১৮); রক্তফুলের বরণডালা (২০১৯)
শিশু-কিশোর সাহিত্য:
সাগর (১৯৯১); বাংলা একাডেমী গল্পে বর্ণমালা (১৯৯৪); কাকতাড়ুয়া (১৯৯৬); বর্ণমালার গল্প (১৯৯৭); আকাশ পরী (২০০১); অন্যরকম যাওয়া (২০০১); যখন বৃষ্টি নামে (২০০২); জ্যোস্নার রঙে আঁকা ছবি (২০০২); মেয়রের গাড়ি (২০০৩); মিহিরুনের বন্ধুরা (২০০৪); রংধনু (সম্পাদনা) (২০০৪); এক রুপোলি নদী (২০০৫); গল্পটা শেষ হয় না (২০০৬); বায়ান্নো থেকে একাত্তর (২০০৬); চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ (২০০৮); মুক্তিযোদ্ধারা (২০০৯); সোনারতরীর ছোটমণিরা (২০০৯); পুটুসপুটুসের জন্মদিন (২০১০); নীলটুনির বন্ধু (২০১০); কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ (২০১১); ফুলকলি প্রধানমন্ত্রী হবে (২০১১); হরতালের ভূতবাবা (২০১৪); রাজু ও লাল পিঁপড়া (২০১৫); রাসেলের জন্য অপেক্ষা (২০১৬); হোজ্জার ছোট্ট পুতুল (২০১৭); বটফলের গল্প (২০১৭); লারার মেঘের ভেলা (২০১৮); একুশের রক্তপলাশ (২০১৮); নদীর সঙ্গে গান (২০১৮); যে নদী মরুপথে (২০১৮); নদীর ধারের মেয়েটি (২০১৮); অপেক্ষা (২০১৮); শিমুলের স্বপ্ন (২০২১); একুশের মিছিল (২০২২)
প্রবন্ধ গ্রন্থ:
স্বদেশে পরবাসী (১৯৮৫); ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন (১৯৮৫); একাত্তরের ঢাকা (১৯৮৯); নির্ভয় করো হে (১৯৯৮); মুক্ত করো ভয় (২০০০); ঘরগেরস্থির রাজনীতি (২০০৮); নিজেরে করো জয় (২০০৮), প্রিয় মুখের রেখা (২০১০), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০১০); পথ চলাতেই আনন্দ (২০১৪); বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০১৭); আপন আলোয় দেখা (২০১৮); পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ মুজিবুর রহমান (২০২০)
সম্পাদিত গ্রন্থ ও পত্রিকা:
নারীর ক্ষমতায়ন : রাজনীতি ও আন্দোলন (যৌথ) (২০০৩); ইবসেনের নারী (২০০৬); ইবসেনের নাটক ও কবিতা (২০০৬); জেন্ডার বিশ্বকোষ (যৌথ) (২০০৬); বাংলাদেশ নারী ও সমাজ (যৌথ) (২০০৭); জেন্ডার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন (যৌথ) (২০০৭); সাহিত্যে নারীর জীবন ও পরিসর (যৌথ) (২০০৭); জেন্ডার আলোকে সংস্কৃতি (যৌথ) (২০০৭); পুরুষতন্ত্র নারী ও শিক্ষা (যৌথ) (২০০৭); দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী গল্প (যৌথ) (২০০৮); জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ (২০০৯); কালো বাতাসের কান্না (যৌথ) (২০১৬); হিজড়া শব্দকোষ (২০১৯); রূপান্তরিত মানুষের গল্প (২০১৯)
২২ বছর ধরে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘ধান শালিকের দেশ’ সম্পাদনা।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘ছোটদের অভিধান’-এর অন্যতম সম্পাদক।
ইংরেজিতে অনুবাদ গ্রন্থ:
The Shark The River & The Grenades (1987); Warp and Woof (1999); Selected Short Stories of Selina Hossain (2007); Plumed Peacock (2009), Fugitive colours (2010); Life is Beautiful (2012); The Painter’s Pallette (2012); Between Two Worlds and others stories (2014); River of My Blood (2016); Waiting for Russel (2017); Charcoal Portrait (2019); The Land and The Flower (2019).
পুরস্কার ও সম্মাননা:
জাতীয় পুরস্কার একুশে পদক (২০০৯); বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০); স্বাধীনতা পদক (২০১৮), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৭)
অন্যান্য পুরস্কার:
রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত সাহিত্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নশিপ স্বর্ণপদক (১৯৬৪); ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক (১৯৬৯); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১); অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২); ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসের জন্য কমর মুশতরী পুরস্কার (১৯৮৭); ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮); লেখিকাসংঘ স্বর্ণপদক (১৯৮৯); অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪); অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪); শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬ ও ১৯৯৭); জেবুন্নেসা ও মাহবুল্লাহ ট্রাস্ট প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮); এম নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০২); ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৩); ঢাকা লেডিস ক্লাব কর্তৃক লায়লা সামাদ স্বর্ণ পদক (২০১১); মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০১৪), Life Time Achievement Award Rotary Club of Dhaka (২০১৩-১৪), আনন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৫); আলোক পুরস্কার (২০১৬); Who’s Who (২০১৭), দাগ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭); নারায়নগঞ্জ সুধী পাঠাগার থেকে অধ্যাপক নূরুল হক সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭) স্বাধীনতা পদক (২০১৮), সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮); মমতাজ সবুর সাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি (২০১৮); ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮); আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৯); সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (২০১৯); এক্সিম ব্যাংক অন্যদিন হুমায়ূন আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (২০২১)
ভারত থেকে সম্মাননা:
দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যে ‘রামকৃষ্ণ জয়দয়াল হারমোনি অ্যাওয়ার্ডস’ দিল্লি (২০০৬); দিল্লির ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানিং এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১০); ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসের জন্য আইআইপিএম সুরমা চৌধুরী আন্তর্জাতিক পুরস্কার (২০১১); গীতাঞ্জলি সম্মাননা পদক, কলকাতা (২০১৫); ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স এ্যান্ড লিটারেচার, দিল্লি প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫); মতি নন্দী সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা (২০১৯); ‘তবু একলব্য’ স্মারক সম্মাননা, কলকাতা (২০২১); সেন স্বর্ণপদক, কলকাতা (২০২২)
ডি-লিট উপাধি:
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত থেকে ডি-লিট ডিগ্রি (২০১০) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি (২০১৮) অর্জন করেন।
ফেলোশিপ:
বিট্রিশ কাউন্সিল ফেলোশিপ (শিক্ষা) লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৪); ফোর্ড ফাউন্ডেশন ইনডিভিজুয়াল গ্র্যান্ট সাহিত্য (১৯৯৪-৯৫); সিনেট মেম্বার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রেমচাঁদ ফেলোশিপ, সাহিত্য আকাদেমি, দিল্লি ২০০৯
সম্মানসূচক দায়িত্ব:
ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটারস্ এ্যান্ড লিটারেচার এর গর্ভিনং কাউন্সিলে সার্ক দেশসমূহের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত সদস্য (২০১৫)। বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য (অবৈতনিক) (২০১০ -২০১২); ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিচালনা বোর্ডের বাংলাদেশের প্রতিনিধি (২০১০-২০১৩); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি (২০১৪-২০১৯); বঙ্গবন্ধু চেয়ার, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সাভার, ঢাকা (২০২০ -২০২১)। সভাপতি, বাংলা একাডেমি (২০২২ – ২০২৪)
পাঠ্যসূচিতে গ্রন্থ:
‘নীল ময়ূরের যৌবন’ ও যাপিত জীবন’ উপন্যাস রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়; নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাস দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নদীয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ ও ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ অংশে পাঠ্য। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ গল্প পাঠ্য। ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’, ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ ও ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ৩টি উপন্যাস নিয়ে এমফিল থিসিস সম্পন্ন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে ২০০৬ সালের দুই সেমিস্টারের পাঠ্য ছিল ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিস ডিপার্টমেন্টে ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাস পাঠ্য এবং ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর উপন্যাস, গল্প বহু শিক্ষার্থী উচ্চতর গবেষণা করছেন।
সেমিনার ও ভ্রমণ:
বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ। ভারত, নেপাল, ভূটান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, আমেরিকা, জার্মানি, কানাডা, ক্যাম্বোডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, স্কটল্যান্ড, কেনিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেন, রুয়ান্ডা, নাইরোবি, চীন, জাপান।
(সাহিত্যমনীষী সেলিনা হোসেনের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী সংখ্যা থেকে সংগৃহিত।)
সাহিত্যমনীষী সেলিনা হোসেন তাঁর বিচিত্র কর্মময় ও সৃষ্টিশীল সাধনার ছয় দশক অতিক্রম করেছেন। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ “নীল ময়ূরের যৌবন” উপন্যাস অবলম্বনের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ কয়েকটি মঞ্চে। “যাপিত জীবন” চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাঁর সাধনা সাহিত্যের স্বতন্ত্র ভুবন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বসাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিশীলতা জ্যোর্তিময় হয়ে আছে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭৮তম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।




