প্রথমেই বলে রাখা ভাল যারা গভীর ভাবে নির্জনতাকে এবং নিস্তব্ধকে অনুভব করতে চান, একমাত্র তাদের জন্যেই হয়ত এই জায়গাটির আবিষ্কার। এখানে এসে নিজের কণ্ঠস্বরও ভীষণ কর্কশ মনে হয়। এতটাই মোলায়েম এবং নরম এই পরিবেশ। তাই এখানে আসামাত্র প্রতিদিনের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। সবুজ গালিচায় মোড়া পাহাড়ী ঢাল আর মাঝেমাঝে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ নিয়ে যায় কোঠিগাঁওয়ের পথে। দার্জিলিং জেলার মিরিকের কাছে, পোখরিয়াবং টি এস্টেটের মাঝে সবুজ প্রকৃতির কোলে কোঠিগাঁও। Kothi Gaon একটি ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম। এই অঞ্চলটি মূলত দার্জিলিং এর চা বাগানগুলির মধ্যে বিস্তৃত। চা বাগানকে নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করেন এই অঞ্চলের মানুষ। তবে বর্তমানে গ্রামীণ ট্যুরিজমের চাহিদা বেশ ভালো। ছুটি কাটানোর জন্য মনোরম পরিবেশে।
ক্লান্তিকর জীবন থেকে একটু বিশ্রামের প্রয়োজনে এমন নিরিবিলি শান্ত প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার প্রবণতা এখন অনেকের মধ্যেই। তাই বেশ কিছু হোমস্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখানে। স্থানীয় মানুষের উষ্ণ আতিথিয়তা ও প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ মিলেমিশে পাহাড়ী অবসরকে করে তুলেছে মোহময়ী। রোজকার খাবার ছেড়ে যারা একটু স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে চান আর তার সঙ্গে মনোরম প্রকৃতির কোলে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে, পাখিদের মিষ্টি মধুর আলাপচারিতাকে সঙ্গী করে প্রকৃতির নীরবতায় হারিয়ে ফেলতে চান নিজেকে, তাদের জন্য এই পাহাড়ী গ্রাম এক দারুণ ডেস্টিনেশন একথা বলাই যায়। সঙ্গে এই হোমস্টের আধুনিক এবং অভিনব আর্কিটেকচার যা রাতের আলোয় জঙ্গলের নীরবতা ও নিকষ কালো প্রকৃতির মাঝে রহস্যময় হয়ে উঠে এক ভালোলাগার পরিবেশ তৈরী করে।
কোঠিগাঁও থেকে কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে মিরিক লেক, গোপালধারা চা বাগান, পোখরিয়াবং, জোরপোখরি, সীমানা ভিউ পয়েন্ট, লেপচা জগৎ প্রভৃতি জায়গাগুলি।
মিরিক লেক:
মিরিকের প্রধান আকর্ষণ হল মিরিক লেক। পাহাড়ে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদে যেদিকেই তাকানো যায় চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে রয়েছে সুমেন্দু হ্রদ। পাহাড়, ঘন জঙ্গল আর ঝিল এই তিনের সঙ্গমে মিরিক হয়ে উঠেছে ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রথম থেকেই এই সুমেন্দু হ্রদে বোটিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। তারপর যোগ হয়েছে নতুন সংযোজন। এই জনপ্রিয় হ্রদে শুরু হয়েছে শিকারা পরিষেবা। এখানে বোটিং-এর পাশাপাশি শিকারায় চেপে উপভোগ করা যায় মিরিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
পাইন ঘেরা অরণ্য। উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢাল আর সেই পাহাড়ের গা বেয়ে ছবির মতো চা বাগান। ভিউ পয়েন্ট থেকে তুষারাবৃত রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় বসে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত।
দার্জিলিং জেলার দু’টো প্রিয় জায়গা লেপচাজগৎ ও গোপালধারা। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংগামী চারটি রাস্তার মধ্যে যে-রাস্তাটি মিরিক হয়ে যায়, সেটির মাধুর্যের কথা হয়তো অনেকেরই জানা। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের দু’পাশে ঘন পাইনের বন ও সুসজ্জিত চা বাগানের শোভা অনেক ভ্রমণপিপাসুকেই দার্জিলিংয়ের যাত্রাপথে এই রাস্তাটির প্রতি আকৃষ্ট করে। এই চা বাগানগুলোর মধ্যেই আছে গোপালধারা নামে একটি ছোট্ট গ্রাম। এখানে পৌঁছেই মন জুড়িয়ে যাবে যেকোনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষের। যাঁরা কিছু দিন মানুষের কোলাহল থেকে দূরে কোথাও পাইনের জঙ্গলে হারিয়ে যেতে চান, এই জায়গাটা তাঁদের জন্য যথোপযুক্ত। যত দূর চোখ যায়, পাইন গাছের আলো-আঁধারি ও চা-বাগানের গালিচায় মোড়া গোলাকৃতি ঢিপিগুলো ছাড়া অন্য কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। শুধু যদি ওই পাইনবনের মাথায় এক ফালি কাঞ্চনজঙ্ঘার অবকাশ পাওয়া যেত, তা হলে প্রকৃতি হয়ে উঠত অনন্য। এই চা বাগানের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। তবে গোপালধারা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাওয়া যায়না।
আরও পড়ুন: সামসিং – রকি আইল্যান্ড
পোখরিয়াবং: পাহাড়ের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে পৌঁছে গেছি এবং ভালোবেসে ফেলেছি নির্জন এই স্থানটিকে। অদ্ভুত রকম একটা মায়া রয়েছে এখানকার আবহাওয়ায়। পাহাড় আমার বরাবরই বড়ও প্রিয়, বহু জায়গাতে ইতিমধ্যে ঘোরার সুযোগও হয়েছে কিন্তু পোখরিয়াবং সবার চেয়ে যে যেন একটু অন্যরকম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কিছু টুকরো মূহুর্ত হৃদয়ের অভ্যন্তরে সযত্নে তুলে রাখলাম যা আজও প্রতিমুহূর্তে লালন করে চলেছি।
যারা এখনও এই পোখরিয়াবং-এ যাননি বা যাবার কথা ভাবেনওনি, তারা অবশ্যই সেখানে যেতে পারেন। দুচোখ আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারবেন এখানকার সবটুকু রূপ, রস, গন্ধকে। ফেরতি পথে অনুভব করবেন বেঁচে থাকার বাড়তি ভালোলাগাটুকু।
জোরপোখরি: সুখিয়াপোখরি থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে জোরপোখরিতে। দার্জিলিং থেকে জোড়পোখরির দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার আর শিলিগুড়ি থেকে জোরপোখরির দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় এখানে। জোর মানে হল জোড়া, আর পোখরি মানে হল পুকুর। এই জায়গাটির উচ্চতা হল ৭৪০০ ফুট; জোরপোখরি থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য দেখার সাধ পরিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া যায়; জোর পোখরিতে রয়েছে জোড়া পুকুর, তার চারপাশ খুব সুন্দর করে বাঁধানো রয়েছে, তৈরী হয়েছে সুন্দর উদ্যান। পুকুরের জলে সাঁতার কেটে বেড়ায় রাজ হাঁসের দল; আর একটি জিনিস এখানে আছে, যা বিশ্বের খুব কম জায়গাতেই আছে; এখানে দেখতে পাওয়া যাবে হিমালয়ান সালামানডার। এটি হল উভচর গোত্রীয় একটি প্রাণী, যে প্রাণী প্রাগঐতিহাসিক যুগ বা ডায়নোসরের আমল থেকেই জীবিত রয়েছে এখনো পর্যন্ত। গোটা বিশ্বে অতি বিরল এই প্রাণী। নানারকম রঙের হয়, অনেকটা গিরগিটির মত দেখতে।
কোঠিগাঁও থেকে দার্জিলিং এর দূরত্ব ৩২ কিমি, তাই চাইলে দিনে-দিনে দার্জিলিং থেকেও ঘুরে আসা যায়।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কোঠিগাঁও এর দূরত্ব ৭০ কিমি। গাড়ীতে যেতে সময় লাগে ৩-৩.৩০ ঘন্টা। গাড়ী ভাড়া আনুমানিক ৪,০০০ থেকে ৫,৫০০ টাকা।
কোঠিগাঁও ইকোস্টেতে আনুমানিক খরচ:
ব্যালকনি সহ প্রতি রাতের ভাড়া ৩০০০ টাকা।
ব্যালকনি ছাড়া প্রতি রাতের ভাড়া ২,৫০০ টাকা।
দুপুরে খাওয়ার খরচ একজনের ৪০০ টাকা।
ব্রেকফাস্ট, টি, এবং ননভেজ ডিনার একজনের ২৭০ টাকা।
ছবিঋণ: মণিজিঞ্জির সান্যাল