গত জুন মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় যা মূলতঃ জুলাই মাসে এসে খুব জোরালোভাবে দানা বাধে। এই আন্দোলনের আন্দোলনের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবান্ধব এবং শিক্ষানুরাগী শিক্ষকদের প্ল্যাটফর্ম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছিল এবং এক পর্যায়ে তারা শারীরিকভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে সামিল হন। প্ল্যাটফর্মটিকে প্রগতিশীল শিক্ষকদের নেটওয়ার্ক হিসাবে দাবী করা হলেও এবারের আন্দোলনে নেটয়ার্কের ব্যানারে এমন কিছু মুখ আমরা দেখেছি, যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত। শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম এবং নেতৃস্থানীয়দের প্রায় সকলকে আমরা চিনি। কাজেই তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কম। সাম্প্রতিক আন্দোলনে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তো বটেই রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনী পুলিশের নানা রকম বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, তর্কে জড়িয়েছেন এবং সত্যিকার অর্থে তাঁরা তাঁদের আন্তরিকতা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছেন। দেশে যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা একটা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্ত এবারই প্রথমবারের মত প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক তাদের ভূমিকার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। সেই আলাপে না গিয়ে আমরা বরং ৫ আগস্ট পরবর্তী শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা নিয়ে একটু আলাপ করি।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে হত্যা, তাদের উপর দমন, পীড়ন যখন তুঙ্গে ঠিক সেই রকম একটা সময়ে ৩ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবী উত্থাপন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। ঠিক তার পরের দিন ৪ আগস্ট অন্তবর্তীকালীন সরকারের একটা রূপরেখা সাংবাদিকদেমাধ্যমে দেশবাসীর সামনে তুলে তুলে ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে। কিন্ত অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তাদের মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটেছে কি’না সেটা দেশবাসীর কাছে পরিস্কার। বরং অন্তর্বতীকালীন সরকারের কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে গিয়ে শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যদের একজনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে দেখেছি। এটাও বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সমাজে খুব সাধারণ বিষয় লোকটা মোটের উপর ভাল কি মন্দ, সেদিকে আমাদের নজর নাই। লোকটার গায়ে কোন দলের মার্কা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। কাজেই শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা যতই প্রশংসিত হোক না কেন, এখন এমন কোনো যৌক্তিক কথাও যদি তারা বলেন, যেটা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা ধবল ধোলাইয়ের শিকার হবেন। এখন সেই বিবেচনা মাথায় রেখেই কি’না জানিনা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যদের কারো কারো বক্তব্য মনে হচ্ছে জনতুস্টির ধারা অনুসরণ করছে। যেমন একজন শিক্ষকের বক্তব্য এ রকম, “ভাস্কর্য আর ক্যালিওগ্রাফিকে একই শিল্পের মর্যাদা দিবেন না, প্রথমটা পিওর আর্ট”। যদিও কথার মধ্যে হেঁয়ালি আছে। কিন্তু এটাও আমরা ধরে নিতে পারি যে তিনি বলতে চাইছেন, ভাস্কর্যের জন্য যারা রোদন করছেন তারাই ক্যালিওগ্রাফির বিরোধিতা করছেন। অর্থাৎ ক্যালিওগ্রাফি অংকনকে যারা বিরোধিতা করছেন, তাদেরকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। নেটওয়ার্ক সদসদের কেউ কেউ জামায়াত আগামী নির্বাচনে কত ভোট পেতে পারে সেই হিসাব মেলাতে চাইছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। হতে পারে উনার উদ্দেশ্য সাধু। হয়ত এই দেশে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা আসলেই কতখানি, সেইটা প্রমাণের আশায় এই হিসাব –নিকাশ কিংবা আলোচনা। কিন্তু জামায়াত কিভাবে পট পরিবর্তনের সাথে সাথে দারুণ সমীহের সাথে এবং দরবেশী ভাবমূর্তিতে সামনে চলে এলো সেই প্রশ্ন তো সবার আগে তো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের করার কথা। কিন্তু তারা সেইটা না করে জামায়াতকে আলোচনায়ই শুধু নিয়ে আসছেন না, জামায়াতের মনোনীত ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টার বাণী প্রচারের দায়িত্ব পালন করছেন। তাও আবার শিক্ষক নেটওয়ার্কের নারী সদস্যরা। নারীদের কথা আলাদাভাবে বললাম, কারণ দলটির নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটা সকলেরই জানা। বিষয়গুলি আমার কাছে গোলমেলে মনে হচ্ছে। একবার ভাবুন তো “আমি শুধু মুসলমানদের উপদেষ্টা নই, আমি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার উপদেস্টা।” আপাত দৃষ্টিতে এই বক্তব্যকে খুব মহান মনে হলেও শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যদের কাছেও কি এই বক্তব্যের কোনো ভিন্ন মানে নাই? বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক বড় ভাই বলতেন, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজির এগুলি যে বিজ্ঞান সেজন্য ইংরেজিতে এগুলির পাশে সায়েন্স কথাটা আলাদা করে লিখতে হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান যে বিজ্ঞান সেইটা প্রমাণের জন্য পলিটিক্যাল সায়েন্স লিখতে হয়। এই দেশে যে হিন্দু-বৌদ্ধ–খ্রিস্টানরা দেশের অন্য নাগরিকদের সমান সেইটা জোরপূর্বক প্রমাণের অপচেষ্টা হল, ধর্ম উপদেষ্টার এই বক্তব্য, আর শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যরা সেই বাণী প্রচারের দায়িত্ব নিলে, যে নাগরিকেরা একটু ভিন্নভাবে ভাবেন, তারাও নড়েচড়ে বসেন। তাহলে সবাই কি গোলে হরিবোলের দলে? লেখাটা প্রস্তুত করার সময় মনে হল, আমি যা লিখছি, সেটা গণমাধ্যম এবং বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। শিক্ষক নেটওয়ার্কের কারো সাথে কথা বললে নিশ্চয় তাঁদের নিজস্ব কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষক নেটয়ার্কের সদস্যদের দু-একজনের এ ধরনের বক্তব্যের বিপরীতে মন্তব্য করে আমি কোনো সাড়া পাইনি। তাই একজনের সাথে ফোনে কথা বললাম। তাঁর ব্যাখ্যা হল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করে না। এখানে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসাবে চেনামুখগুলিকেই মিডিয়া সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু কোন সাংগঠনিক কাঠামো না থাকায় সেই অর্থে আমাদের সাংগঠনিকভাবে কোনো নেতা নাই, কোনো গঠনতন্ত্রও নাই। কাজেই নেটওয়ার্কের সদস্যরা ব্যক্তিগত কোনো বক্তব্যের জন্য জবাবদিহিতা করতেও বাধ্য নন। আর একটা বিষয় হল, শিক্ষক নেটওয়ার্ক নানান ইস্যুতে তাদের অবস্থান পরিস্কার করেছে। মাঠে থেকেছে, কিন্তু এতবড় রাজনৈতিক ইস্যুতে তারা কখনও সম্পৃক্ত থেকে বিজয় অর্জনের অংশীজন ইতোপূর্বে হন নাই। তাই এইটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমার কাছে উনার যুক্তি পরিস্কার। তাহলে কি আমরা আপনাদের কাছে একটু বেশিই প্রত্যাশা করে ফেলেছিলাম? আমাদের প্রত্যাশা ছিল লম্বা সময় ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দলোনে আপনারা যেমন পাশে ছিলেন, তেমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও আপনারা এই দেশের একটি মানুষও যাতে বৈষম্যের শিকার না হন সেই ব্যাপারেও আপনারা গুটিকয়েক মানুষ হলে উচ্চ কন্ঠে কথা বলে যাবেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আপনারা সবার আগে কথা বলবেন। কিন্তু এবারে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়ান উপস্থাপন করা হল, যে সমস্ত হিন্দুরা সরাসরি আওয়ামলীগের রাজনীতির করতেন, শুধুমাত্র তাদের উপরেই হামলা হয়েছে। বলা হল, এইটা আওয়ামলীগের লোকেরাই করেছেন কিংবা হিন্দুরা বা অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিজেরাই নিজেদের উপাসনালয়ে ভাংচূর করেছে। এই বয়ানের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে যারা শুধুমাত্র ভোট দিতে যান, তাও তো গত দুইবার ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি কিংবা যান নি কিন্তু সরাসরি কোনো রাজনীতির সাথে যুক্ত নন এমন মানুষও যে হামলার শিকার হলেন, তাদের বাড়িঘরে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হল সেগুলি আড়ালে চলে গেল। এ বিষয়ে আপনাদের জোরালো কোনো বক্তব্য ছিল কি, আছে কি? শিক্ষক নেটোয়ার্কের সদস্যদের অনেকেই মাঠ গবেষণায় অভিজ্ঞ। আপনারা কমপক্ষে একটা জেলাতে গিয়ে খোঁজ নিতে পারতেন। আমি একটি জেলার চিত্র উপস্থাপন করতে পারি, সেখান থেকে আপনারা বাকি জেলাগুলির বিষয়ে ধারণা নিতে পারেন। যে জেলায় ৫ আগস্টের পর সর্বমোট হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মত ঘটনা ঘটেছে ৫০০টি, এর মধ্যে শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের বাড়িঘর, উপসনালয়ে ঘটেছে ১০০ এর বেশি। যার মধ্যে প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে ৮০% ঘটনার ক্ষেত্রে হামলার শিকার ব্যক্তি বা পরিবারের আওয়ামী রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ কোনো সংযোগ নাই।
একইভাবে দেশের একটা বড় অংশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং অন্যান্য শিক্ষকেরা যেভাবে হেনস্থার শিকার হলেন, সেখানে আপনারা একটা বিবৃতি দিয়েই আপনাদের দায় সম্পন্ন করেছেন। এই ক্ষেত্রেও একই বয়ান, গত ১৫/১৬ বছরে এইসব শিক্ষকেরা তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব, অনিয়ম এবং দূর্নীতির কারণে ছাত্রদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের মুখে পতিত হয়েছেন। সবক্ষেত্রে কি তাই? একই পেশার মানুষ হিসাবে নিজেরা যদি ১০ টি স্কুলে তথ্যানুসন্ধান করেন, বুঝতে বাকি থাকবে না, কত শতাংশ ক্ষেত্রে গণবয়ান সত্য প্রমাণিত হয়। আপনারা এখন আপ্লূত অনেক শিক্ষকই নাকি এখন নেট ওয়ার্কের সদস্য হতে চাইছেন। খুবই ভাল কথা। আপনাদের প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালী হোক, পরিসর বড় হোক কিন্তু যে বিষয়গুলির অবতারণা করলা সেগুলিও নিশচয় ভেবে দেখবেন। শেষ করতে চাই, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের যে আলাপ কিংবা অপলাপ শুরু হয়েছে, সেই ক্ষেত্রেও নেটওয়ার্কের কোনো কোন সদস্যের যুক্তি কিংবা পাল্টা যুক্তি চোখে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মত-দ্বিমত থাকবেই। কিন্তু সবার আগে ভাবা দরকার বোধহয়, কার উদ্দেশ্য কি? আমি মনে করি এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং ফলাফল কি হতে পারে সেটা অন্য দশজন মানুষের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভাল বুঝতে পারার কথা এবং আমি বিশ্বাস করি, সেটা আপনারা বুঝেছিলেনও বটে। আপনাদের প্রস্তুতিরও দরকার ছিল সেইভাবে। প্রাথমিক ধাক্কা আপনারা সামলাতে কতটুকু পেরেছেন, সেটা নিজেরাই মূল্যায়ন করবেন। তবে এখনও তো সময় ফুরিয়ে যায়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনাদের কার্যকর ভূমিকাই আমাদের প্রত্যাশিত। ব্যত্যয় ঘটলে ইতিহাসই কথা বলবে।#