গারো পাহাড়ের চিঠি: কোচবাড়িতে নিমন্ত্রণ

কোচ বাড়িতে আজ ছিল নিমন্ত্রণ। ঘরোয়া রান্নার নিমন্ত্রণ। নিজেদের জন্য নিজেরা যা প্রাত্যহিক আয়োজন করে সেই আয়োজনের অতিথি আমি।মাটির দাওয়ায় পাশাপাশি বসে খাবো ঘরের জনদের নিয়ে। অতিথি বলেই যে বিশেষ ভাবে কোন কিছুর আয়োজন করবে অতিথি সৎকারের প্রয়োজনে এমন ধ্যান ধারণায় আমার ঘোর আপত্তির কথা অনিল কোচকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।

অনিল সে-কথা অক্ষরে অক্ষরে রেখেছে। ছিপছিপে মাঝারি বয়সের অনিল কোচের কুঁকড়ানো মাথা ভর্তি চুলে কালোর চেয়ে সাদার দখল বেশি বলেই একটু বয়স্ক লাগে।

গাঁয়ের রঙ ফর্সা হলেও না মাজা কাঁসার থালার রঙের মতো গায়ের রঙ।কোন কথার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার কোন ছাপ অনিলের মুখ পাঠ করে বোঝবার উপায় নেই। স্টোন ফেইস।

অল্প গল্পের স্বল্প কথার মানুষ অনিল। তুমি শুনলে হাসবে- আমি এক গামলা ফড়ফড় করে কথার খই ছিটালে অনিল জবাব দেয় চা-চামচের মতো চামচে করে ছোট বাক্যে।

শব্দ গুণে গুণে। কখনো কিছুক্ষণ পর পর শব্দ ব্যবহার করে। বাক্যের মানে বের করতে হলে অনিলের উচ্চরিত শব্দগুলোকে আবার সাজালেই তবে বোঝায় যায় অনিলের কথার মানে। ওর কথাতে একটু বেশিই মনোযোগ দিতে হয়। আনমনে কথা শুনলে আমি নিশ্চিত অনিলের শব্দ কোথায় যে পড়ে যায় যাবে- তা না আমি খুঁজে পাবো না, অনিল উদ্ধার করতে পারবে।

অনিলের সারল্য আমাকে প্ররোচিত করে। গারো পাহাড়ের বেড়াতে গেলে আমি অনিলের সাহচর্য প্রত্যাশা করি। অনিলকে খুঁজি। বাড়ি থেকে বের হবার সময় থেকেই মনে মনে ভাবতে থাকি আমি যেন অনিলের দেখা পাই। গারো টিলা অনিলের হাতের করতলে আঁকাবাঁকা রেখার মতো চেনাজানা। অনিলকে নিয়ে যখন আমি বনে হাঁটি, তখন মনে হয় সমগ্র বন অনিলের ভেতর দিয়ে আমার সাথে হাঁটছে। আমার সাথে বলছে পুরাণ কথা। পুরাতন কথা। আজকের কথা। জাল কথা। কথার ফান্দে পড়ে কোচদের কান্দনের কথা।

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ে চিঠি: ভেজা পাতার আমন্ত্রণে 

এই সময়ের অনিল অন্য সময়ের থেকে আলাদা। বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে যখন অনিল কথা বলে উঠে, সে তখন সজীব সতেজ। শির উঁচা শাল বৃক্ষ। এককেটা কথা যেন বল্লমের আগার মতো সুঁচারু- তীক্ষ্ণ আর লক্ষ্যভেদী। মহাঋষির জলে বাণ ডাকলে যেমন গমগম করে শব্দ ছুটে তেমনই অনিলের কথার তোড়। আমি তখন মুক। নির্বাক। পলকহীন।শুকনো কম্পিত ঠোঁটে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ছিপছিপে মাঝ বয়সী অনিল কী ভীষণ তেজদীপ্ত ঘোড়সওয়ার। ঢাল আর লক্ষভদী বল্লম নিয়ে ছুটে চলা কোন এক পুরান কালের ক্ষত্রীয়। গায়ে তার অসুরের মতো শক্তি। দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের মতো শক্ত আর অভেদ্য হয়ে। লড়াইয়ের মাঠে- পরশুরামের তাণ্ডব বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে লড়াকু সৈনিক।

বন্য ক্ষত্রীয় অনিল কোচ আর মাঠে উবু হয়ে ধানের চারা বোনা অনিল কামলার মাঝে বিভক্তি রেখাটা কোথায়- জিজ্ঞেস করলেই যে সশব্দ উচ্চকিত হাসির ফোয়ারা তুলে তখন আমি আর আমার চেনাজানা অনিল কোচকে আর চিতে পারি না। শুধু তাকিয়ে দেখি হাসতে হাসতে অনিলের ছোট্ট চোখ দুটি আরো ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে আর চোখের দুই পাশে তামাটে মুখের বলিরেখা– স্টার চিহ্নের মতো চামড়ার ভাঁজ ক্রমেই বল্লমের আগার মতো সরু ধারালো চকচকে হয়ে যাচ্ছে। এমন সচিত্র অনিল কোচ কী জানি কী মানে প্রকাশ করে- তার মর্মোদ্ধার আমি করিনি- মানে করতে চাইনি।

কোচের খাদ্য তালিকা ও রন্ধন প্রণালী পাল্টে গেছে। যেতে বাধ্য। কৌমের যৌথতা ভেঙে গেলে আর নিজস্বতা ধরে রাখা যায় না। পরাজিতের ভিন্নতাও শাসক গোষ্ঠী নানা উপাচরে ভেঙে দেন। তার সংগঠন ভেঙে দেন। তার আরাধনার স্থান গুড়িয়ে দেন। এমনকি খাদ্যের স্বাদও। শাসকের খাদ্যশৃঙ্খলাও জাতিত্ব পাবার কারণে অপরাপর খাদ্যাভ্যস গৌণ হয়ে পড়ে নানা প্রতিবেশিক চাপে তাপে ও ভাপে। স্বাদে থাকে পুরাণ কথা। কাজে কাজেই কোচের রান্নাঘর এখন বাঙালি শাসিত। বাঙালির রন্ধন প্রনালী দ্বারা শাসিত।

ভিন্নতা যে নেই তা নয়। অনিল কোচ কৌম কোচের খাদ্যশৃঙ্খলা ধরে রেখেছে কিছুটা দারিদ্র্যের চাপে, কিছুটা ক্ষত্রীয় জেদে ক্ষাত্র তেজের ঝলকে। তাই বলে বাঙালি রন্ধন প্রণালি অনিলের পাকঘরে ঢুকেনি- তা কিন্তু নয়। ঢুকেছে ছেলেমেয়েদের চাপে। আর বাড়ির আঙ্গিনায় রান্নার উপকরনের অপ্রাপ্যতায়।

কোচ রান্না তেল বিহীন রান্না। আধা সিদ্ধ সবুজ শাকে হালকা লবন ছিটিয়ে এক থালা গরম ভাত গোগ্রাসে গিলে ফেলবার সানন্দ উল্লাসে ভরা আয়েশি ঢেকুর। অনিলের ঘরের দাওয়ায় বসে বসে কতদিন দেখেছি মুখভরা শাকভাত চিবাতে চিবাতে অনিল বাম হাত দুই আঙুলে মরিচ দাঁতে কেটে কী আয়েশে না চাবাচ্ছে! হাতভরে থালা থেকে ভাত তুলে মুখে শাকভাত পুড়ে দিতে পাঁচ আঙুলই মুখের ঢুকে শাক ভাত রেখে ঠিক ঠিক আঙুলগুলো বের করে আনছে বেশ কায়দা করে।

এই অনিলের ছনে ছাওয়া দাওয়ায় বসে আছি আমরা। ছোেট্ট উঠানের একপাশে লাকড়ির পাহাড়। অন্যপাশে খুব ছোট্ট করে ছাওয়া খেলাঘরের মতো ঘর- শ্রাবণে পদ্ম পুজা হয়। অনিলের বাপ ঠাকুরদার আমলেও জাঁকজমক ভাবেই পদ্ম পুজা হতো- এখন তেমন দাপট আর নেই নাম রক্ষার মতো কিছু একটা ফি বছর করে মাত্র গাঁওবুড়ার আদেশ নিয়ে। তার পাশেই শূকরের খোঁয়াড় আর খড়ের পাল্লা- গরু বাছুরের সাংবাৎসরিক খড়ের যোগান।

দুপুরে খাবার তালিকায় ছিল আঠালো বিন্নি ধানের ভাত অনিলের ভাষায় মি বুত্তুম। কড়া ঝালে মাখা শুটকি ভর্তা মানে নাখাম বিচ্চি। গমেন্দা জাবা- যাকে আমরা মিষ্টি কুমড়া বলি–অল্প আগুনের আঁচে নুন আর পাহাড়ি লাল মরিচের কাঁচা সিদ্ধ ।আমাদের যেমন তেল নুনে ভাঁজতে ভাঁজতে কালচে করে ফেলে অনিলের গিন্নীর হাতে মিষ্টি কুমড়ার পাতা আর ডাটাগুলো প্রায় সবুজই থাকে। গরমের ভাপে একটু মিয়িয়ে পড়ে শুধু। কচকচ করে যখন গমেন্দা জাবা খাচ্ছিলাম শুরুতে একটু নুনতা নুনতা লাগলেও মুখ গহ্বর ভরে গেছিল সতেজ পাতার রসে।

অনিল গিন্নী মুখভরা পান চাপার একপাশে নিয়ে গোল মতো ফোলা গালে কথা বলতে বলতে বাঁশের কাবারি দিয়ে তৈরি হাতা দিয়ে খাবার বেড়ে দিতে দিতে নানা পদের কথা বললেও এখন আর সবগুলো স্মরণ করতে পারছি না।

অনিল আমার পাশেই জোড়াসানে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার খাবার দেখছে। তদারকি করছে। সে খাবে পরে। এক সাথে খেতে বসি বললেও সে শুনল না। নিজেই পিঁড়ি পেতে দিল। কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি। কালচে হয়ে গেছে। পিঁড়ির জমিনে পাছার স্পষ্ট দাগ। অনিল বলল ওর ঠাকুরদার আমলের পিঁড়ি। অতিথি সেবার পর খাবে। অতিথি তার কাছে নারায়ণ। নারায়ণকে নৈবেদ্য দিয়েই তবে গেরস্তের মুখে সাদা ভাত ওঠে।

সকালে একমাথা বৃষ্টি নিয়েই অনিলের উঠানে পা রেখেছিলাম। কাঁধের ব্যাগ রাখতেই বলল, চল শামুক নিয়ে আসি। চুচ্চুরু জাবা হবে। দারুণ খাবার। তোমার পছন্দ হবে। তবে হাংকি জাবা মানে কাঁকড়া তরকারি স্বাদে আলাদা। বনের ভেতর ঝোরা শুকিয়ে গেছে। শীলাপুত্রী নদী তার উৎস হারিয়ে কেবলই সীমিত খাল। এখান সেখানে প্যাডেল চালিত বোট চলে সৌখিন মানুষের বিনোদনের তাড়নায়। শীলাপুত্রী এই তল্লাটের বড় জলাশয়। পাহাড়ি সোঁতা থেকে বনের ভেতর দিয়ে গেছে এই ছোট্ট নদী।

পাহাড়ি মানুষের জলের উৎস ছিল শীলাপুত্রী। শুধু গারো, কোচের? পশুপাখির ছিল জলাধার। অনিলের বাবার হাত ধরে এখানে আসত খেয়া জাল নিয়ে কাঁকড়া ধরার জন্য। যা মাছ পেতো শুকিয়ে শুটকি করে বোয়ামে ভরে রাখত অনিলের মা।

অনিলের বাড়ির পাশেই একটি ডোবা। ডোবা মানে জমির বাতর উঁচু হবার কারণে নয়া বৃষ্টির জল আটকে গেছে। অনিলের মতো আমিও ঘোলা জলে নেমে পড়লাম। একহাঁটু জল হবে। কোথাও আরেকটু কমও হতে পারে।অনিল উবু হয়ে দুহাতের দশ আঙুলে কী যেন কী যেন খুঁজতে খুঁজতে কিছুক্ষণ পর পর তুলে আনছে শামুক। পিচ্ছিল পেঁচানো শঙ্খের মতো শামুক। আমিও উবু হয়ে দশ আঙুলে কাঁদামাটি খামছে খামছে পেয়েছি পেয়েছি বলে যেই জলের ভেতর থেকে হাত তুলি দেখি শুধুই মাটি– জলে ভেজা মাটি আর পচে যাওয়া কালচে তৃণ।

অনিল আমার ব্যর্থতা দেখে হাসে। ঠোঁট চেপে চোখ নাচিয়ে হাসে আর একটু পর পর আরো গোটা দুই শামুক তুলে পাড়ে রাখা কচু পাতায় রেখে আবারও উবু হয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজে অগভীর ডোবার জলে ডুবানো শরীর।

আবাদী জমিতে মাটি ছানার মতো করে পুরুষ যেমন নারীর সমস্ত তল্লাটে উচাটন হয়ে খুঁজে নারীর উত্তাপ ঠিক তেমনি করে অনিল কোচ গভীর মমতা আর অনুরাগে ডোবার জলে ডুবানো শরীরে খুব আস্তে মোলায়েম আয়েশে খুঁজছে শামুক-শঙ্খের মতো পেঁচানো ভরাট শরীরের শামুক অতিথি নারায়নের উদ্দেশ্য নৈবেদ্য দেবার অভিষ্পায়।#

ছবিঋণ: জ্যোতি পোদ্দার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!